আজ মন চেয়েছে...
লিখেছেন লিখেছেন বৃত্তের বাইরে ১৬ জুন, ২০১৩, ০৬:৫৪:২২ সন্ধ্যা
ঘরে বাইরে কাজের চাপ,পড়াশুনা সব সামলে ক্লান্ত প্রিয়া। প্রিয়জনদের সাথে আড্ডা দেয়ার ফুরসত খুব একটা হয়না। মাঝে মাঝে বাবা মায়ের কথা ভেবে মনটা যখন খুব খারাপ হয় তখন প্রিয়া চলে যায় পার্কে বাচ্চাদের খেলা দেখতে বা কখনও চলে যায় বাড়ীর পাশের ওল্ড হোমে বুড়ো-বুড়িদের সাথে গল্প করতে। ওল্ড হোমের বুড়ো-বুড়িরা একদম পার্কে আনন্দে মেতে থাকা শিশুদের মত। তারাও সব একসাথে বসে দাবা খেলে,বই পড়ে,গল্প করে, কখনও বা তাদের ফেলে আসা দিনগুলোর কথা ভেবে যখন মন খারাপ হয়ে যায় তখন একজন আরেকজন কে সান্ত্বনা দেয়। আপন না হয়েও এই যে আপন করে নেয়া এর মাঝেই যেন খুঁজে পায় এক অনাবিল প্রশান্তি। ওদের সাথে গল্প করলে প্রিয়াও হারিয়ে যায় অতীতে। বাবা-মাকে তখন আর দূরে মনে হয় না মনে হয় তারা তার খুব কাছে। ওল্ড হোমের এই মানুষগুলো তাকে এমন ভাবে আপন করে নিয়েছে যে আজ বাবা দিবসে কিছু একটা করে তাদের চমকে দিবে প্রিয়া।
প্রিয়া যখন ছোট ছিল তখন আর আজকের দিনের মত এত ঘটা করে বাবা দিবস পালন করা হতোনা। বাবা কে তো সে সারাবছরই ভালবাসে,সারাজীবন ভালবাসবে এর জন্য আবার দিবসের দরকার হয় নাকি! তবুও এখন সবাই একটা বিশেষ দিনে বাবাকে সারপ্রাইজ দিতে ভালবাসে। অনেক কথা আছে যা মুখে বলা যায়না, দূর থেকে ‘বাবা তোমাকে ভালোবাসি’ বলে জড়িয়ে ধরা যায়না সেই কাজটা যদি ছোট্ট একটা কার্ড পাঠিয়ে মনের আবেগ গুলোকে অক্ষরে লিখে প্রকাশ করা যায় তাহলে ক্ষতি কি! মেয়ের কাছ থেকে পাঠানো কোন সারপ্রাইজ গিফট পেয়ে খুশিতে বাবার সেই চকচকে মুখটা কল্পনা করতে ভাল লাগে প্রিয়ার। ছোটবেলায় বাবা দিবস পালন না করলেও বাবার জন্মদিনের কথা ভুলতোনা প্রিয়া। স্কুলের টিফিনের পয়সা জমিয়ে বাবার জন্য মাকে দিয়ে গিফট কিনে লুকিয়ে রাখত। মাঝে মাঝে কোথায় লুকাতো প্রিয়া নিজেও খুঁজে পেতোনা। কি যে মন খারাপ হতো তখন, কেঁদে কেটে অস্থির হয়ে যেত। বাবা তার মন ভাল করতে ইচ্ছে করে দাবা খেলায়, ক্যারাম খেলায় হেরে যেতো। বাবাকে খেলায় হারাতে পেরে খুব খুশি হতো প্রিয়া, সে বুঝতোনা বাবা তার জন্য ইচ্ছে করে হেরেছে। বাবারা কেন এত ভাল হয়! ভেবে চোখে পানি চলে আসে প্রিয়ার।
প্রিয়া বাবার এত ভক্ত ছিল মনে পড়ে খুব ছোটবেলায় একবার মা কে জিজ্ঞেস করেছিল ‘আচ্ছা মা, বিয়ে করলে কি অন্য বাড়িতে চলে যেতে হয়? মা বলেছিল, ‘হ্যাঁ তা তো হয়ই । সব মেয়েকেই অন্য বাড়িতে চলে যেতে হয়। প্রিয়া অবুঝের মত বাবাকে জড়িয়ে ধরে বলেছিল তাহলে আমি বাবাকেই বিয়ে করতে চাই। এ কথা শুনে বাবা-মা তো হেসে খুন। বড় হয়ে প্রিয়া যখন বুঝতে শিখেছে এ কথা মনে হলে খুব লজ্জা পেত। কি বোকাই না ছিল সে!
প্রিয়ার ভাইয়াটা ছিল খুব ভীতু, সে বাবাকে যমের মত ভয় পেত। সারাদিন বন্ধুদের সাথে বাইরে বাইরে ঘুরত আর যেই বাবাকে দূর থেকে বাড়ি আসতে দেখত সময় নেই অসময় নেই পড়িমরি করে দৌড়ে ঘরে এসে বই নিয়ে বসত। বাবা ভাইয়ার এই ফাঁকিবাজি ধরতে পারতোনা বরং ভাইয়াকে পড়ার টেবিলে দেখতে পেয়ে খুশি হত। আর এদিকে ভাইয়া বাইরে বন্ধুদের সাথে খেলতে না পেরে মনে মনে বাবার উপর রাগ করত আর প্রিয়াকে বলত ‘জানো আপু আমি যেদিন বাবার মত বড় হব তখন বাবাকে জিজ্ঞেস করব, আচ্ছা বাবা তুমি যে আমাকে সারাক্ষন পড়ার টেবিলে দেখতে চাইতে তোমার কি একবারও মনে হতোনা এখন পড়ার সময় নয় বা অনেক পড়েছ এখন বরং বাইরে থেকে একটু খেলে আসো।
ভাইয়ার এমন অভিযোগের কথা শুনে হাসি পেত প্রিয়ার। যে বাবাকে নিয়ে এত অভিযোগ ছিল ভাইয়ার এখন সেই বাবাই তার গর্ব, তার অহংকার।
বাবার নানামুখী ব্যস্ততার কারনে বাবাকে খুব একটা কাছে পায়নি প্রিয়া। আজ ওল্ড হোমে এসে বাবাকে অনেক বেশী মনে পড়ছে। প্রিয়া ঠিক করেছে পার্কের বাচ্চাদের নিয়ে ওল্ড হোমের সব বাবাদের আজ সারপ্রাইজ দিবে। প্রিয়া দোকান থেকে একটা কেক, কিছু বেলুন আর কার্ড নিয়ে আসলো। কার্ডগুলো বাচ্চাদের হাতে দিয়ে বাবা দিবস উপলক্ষে যার যা খুশী কার্ডে লিখতে বলল। পরে বেলুন, কার্ড, কেকসহ বাচ্চাদের নিয়ে ওল্ড হোমে গিয়ে হাজির হল। ওল্ড হোমের সুপারভাইজারকে আগেই বলা হয়েছিল। এমনিতেই প্রিয়াকে সবাই খুব পছন্দ করে তার উপর এতগুলো বাচ্চাকে একসাথে দেখে সবাই তো মহাখুশী। একসাথে কেক কাটা হল, ছবি তোলা হল, কার্ডগুলো বাবাদের হাতে দেয়া হল। বাচ্চাদের দেয়া কাঁচা হাতে কিন্তু গভীর ভালোবাসায় বাবাদের উদ্দেশ্যে লেখা সেই কার্ডগুলো দেখে অনেকেই আবেগাপ্লুত হয়ে পড়লো। কেউ কেউ তাদের ফেলে আসা দিনগুলোর অভিজ্ঞতার কথা শেয়ার করল। সবাই মিলে গল্প করতে করতে কখন যে বিকেল গড়িয়ে গেছে! সবাইকে নিয়ে একসাথে মেসেজ লেখা বেলুনগুলো উড়িয়ে দিল প্রিয়া। ছোটবেলায় যখন ভাইয়ার সাথে ঘুড়ি উড়াতো তখন সূতা ছেড়ে দিয়ে ঘুড়িকে শুন্যে মিলিয়ে যেতে দেখে আনমনা হয়ে যেত। আজ বেলুনগুলো উড়িয়ে যেন সেই অনুভূতি ফিরে পেল প্রিয়া।
দেখতে দেখতে সন্ধ্যা ঘনিয়ে আকাশে বড় থালার মত এত্ত বড় একটা চাঁদ উঁকি দিল। প্রিয়ার মনে পড়ল দেশে বাবা এই সময় ফজরের নামাজের পর হাঁটতে বের হন। প্রিয়া বাবাকে ফোন করল,‘বাবা আমাদের এখানে আকাশে এত্ত বড় একটা চাঁদ উঠেছে, তোমাদের তো এখনও ভোরের আলো ফোটেনি দেখ তো দেখা যায় কিনা। বাবা বললেন,“হ্যাঁ দেখতে পাচ্ছি। কেনরে মা, তোর কি মন খারাপ?’ প্রিয়ার কথা জড়িয়ে এল। ‘না তো বাবা! দেখেছো,পৃথিবীর দু’প্রান্তে থেকেও আমরা দু’জনে একই দৃশ্য দেখছি! আমি তোমার কাছেই আছি। আজ মন চেয়েছে তোমাকে বলি ‘তোমাকে আমার সব সময় মনে পড়ে, তোমাকে আমি অনেক ভালবাসি বাবা’।
বিষয়: বিবিধ
১৬০৮ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন