সম্পর্কের টানাপোড়েন

লিখেছেন লিখেছেন বৃত্তের বাইরে ০৫ জুন, ২০১৩, ০৮:২৩:৫৫ রাত

প্রথম দিন কাজে যোগদানের পর নিজের দায়িত্ব বুঝে নেয়ার সময় কোম্পানির এমডি সাহেব বলেছিলেন জানো তো ইংরেজিতে ছোট্ট কিন্তু খুবই গুরুত্বপূর্ণ দুটি শব্দ আছে ‘সরি’ এবং ‘প্লিজ’ এই শব্দ দুটো এখানে অনেক বেশী ব্যবহার করতে হবে। আমাদের কোম্পানি একটা পরিবারের মত আর আমরা সবাই তার সদস্য। আমরা একে অপরের অধীনস্ত কেউ কারো চাকর বা চাকরানী নই। আমি মনে করি কোম্পানির এমডি হিসাবে একে ধাপে ধাপে উন্নতির শিখরে নিতে আমার যেমন অবদান রয়েছে তেমনি এই বিল্ডিংটা আজ যে খুঁটির উপর দাঁড়িয়ে আছে সেটা তৈরিতে সেই পরিশ্রমী, ঘর্মাক্ত শ্রমিকের অবদানও আমার কাছে কোন অংশে কম নয়। কারন, আমাদের দুজনেরই উদ্দেশ্যই ছিল এক আর তা হল কঠোর শ্রম দিয়ে আমাদের কাজকে সফলতার সাথে বাস্তবায়ন করা। একজন শ্রমিক যেমন ইট–কাঠ, পাথরের গাঁথুনি দিয়ে তৈরি ভিত্তির উপর একটা সুন্দর ইমারত তৈরির প্রচেষ্টায় নিরলস কাজ করে যায় তেমনি আমরাও কোম্পানির উন্নতির জন্য যে কোন কাজে প্রত্যেকে প্রত্যেকের অবস্থানে দায়িত্বশীল থেকে মেধা আর যোগ্যতা দিয়ে সেই ইট-সুরকি গুলো একসাথে করে আমাদের স্বপ্নগুলোকে বাস্তবায়ন করি। একজন কর্মী হিসেবে আমাদের প্রধান এবং একমাত্র কাজ হল মানব সেবা। প্রতিটা ক্লায়েন্ট আমাদের কাছে সমান গুরুত্বপূর্ণ কারন কোম্পানির আয় উন্নতি নির্ভর করে তাদের উপর। কাজেই কোন ক্লায়েন্টের সর্বোচ্চ সেবার মানের দিকে লক্ষ্য রেখে এই ‘সরি’ এবং ‘প্লিজ’ শব্দ দুটো ব্যবহার করার সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে।

আমরা যখন উন্নত বিশ্বের দিকে তাকাই তখন দেখি জনসংখ্যাকে তারা কত সুন্দরভাবে উন্নয়নের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে। তাদের মধ্যে মালিক-শ্রমিক ভেদাভেদ নেই, কাজ নিয়ে বিভাজন নেই এমনকি কোন কাজ নিয়ে কোন ধরনের হীনমন্যতা নেই। ম্যানেজার, সুপারভাইজার, শ্রমিক যে যার নিজ নিজ দায়িত্ব থেকে জিনিসপত্র গুছিয়ে রাখছে, ফ্লোর পরিস্কার করছে , ময়লার ব্যাগ ফেলছে। সব কাজে সবাই অংশ নিচ্ছে এবং কোন কাজকেই তারা অসম্মানের মনে করছেনা। স্কুলেও বাচ্চারা তাদের ক্লাস শেষ হওয়ার পর নিজের বই,খাতা,ডেস্ক গুছিয়ে রাখছে। এমনকি স্কুলে গ্রীষ্মকালীন ছুটির সময় অনেক টিনএজারকে দেখা যায় তাদের এলাকা পরিস্কার পরিচ্ছন্ন রাখার জন্য ভলান্টিয়্যার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছে। কোন কাজ ছোট নয় এবং কাজের ক্ষেত্রে মানুষে মানুষে যে কোন ভেদাভেদ নেই এই ধারনা থেকেই অভিভাবকরা তাদের সন্তানদের ছোটবেলা থেকে এভাবে গড়ে তুলছেন।

অথচ আমাদের দেশে মালিক শ্রমিকের এই মধুর সম্পর্কটা প্রভু-ভৃত্যের সম্পর্ক হওয়ায় তা পরস্পরের মধ্যে দূরত্বের সৃষ্টি করে। নিজের চাকরিটা ধরে রাখতে অফিসের বড় কর্তাকে ‘সরি স্যার’, ‘প্লিজ স্যার বলে মুখে ফেনা তুলি ঠিকই কিন্তু ঘরে এসে ভুলে যাই আমার ঘরে আমার অধিনস্ত যারা রয়েছে তাদের প্রতি কতটুকু দায়িত্ব পালন করছি। বাসার কাজের ছেলে যে আমাকে খুশী রাখতে সারাদিন আমার ফুট-ফরমাশ খাটছে, সারাক্ষন আমার হুকুম পালন করার জন্য ভয়ে তটস্থ হয়ে থাকছে তারপরও তার কাজের প্রশংসা তো দূরের কথা সামান্য ভুলের জন্য তার প্রতি নির্দয়- নিষ্ঠুর আচরণ করতে আমাদের হাত এতটুকু কাঁপেনা। আমি ভুলে যাই যে আমার নিজের ছেলে-মেয়ে যেমন আমার অধীন তেমনি সেও আমার অধীন। সে আমার ভৃত্য নয় বরং আমার সাহায্যকারী আর তার প্রতি কোন অন্যায় হলে পরকালে আমাকেই তার জন্য সবচেয়ে বেশী জবাবদিহি করতে হবে।

আমি নিজে আদর্শবান হতে পারি আর না পারি কিন্তু মনে মনে চাই সবাই আমাকে আদর্শ মডেল হিসাবে অনুসরণ করুক। আমার সন্তান ভুল করলে সরি বলবে সেটা আমি চাই কিন্তু আমি কোন ভুল করলে আমাকেও যে আমার সন্তানকে সরি বলতে হবে সেটা আমি ভেবে দেখিনা । আমি ভুলে যাই যে আমারও ভুল হতে পারে এবং অন্যায় করলে যে ক্ষমা চাইতে হয় এই প্র্যাকটিসটা আমাকেই শুরু করতে হবে। জীবনসঙ্গী হিসেবে একে অন্যের সুখ-দুঃখের সাথী হওয়ায় আমরা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ অথচ সামান্য কারনে মতবিরোধ হলে নিজের অহমিকা,আত্মসম্মানবোধ ভুলে কেউ এগিয়ে এসে বলিনা ‘ সরি,আমার ভুল হয়ে গেছে, তুমি কি আমাকে ক্ষমা করতে পার প্লিজ?’ ছোট্ট একটা শব্দ ‘সরি’ বলে এত সহজে যা করা যায় তা না করে যে যার মত জেদ চেপে রাখি আর মনে মনে ভাবি ‘আমি কেন এগিয়ে আসব, সে কেন নয়? আমরা কল্পনার পাহাড় গড়তে পারি, একে নানা রঙয়ে রাঙাতে পারি, মুহূর্তেই আমাদের সুন্দর সম্পর্ক গুলোকে ঠেলে দূরে সরিয়ে দিতে পারি কিন্তু ছোট্ট দুটি শব্দ ‘সরি’ এবং ‘প্লিজ’ দিয়ে আমাদের ভিতর সম্পর্কের যে টানা-পোড়েন চলছে তা দূর করতে এগিয়ে আসতে পারিনা।

বিষয়: বিবিধ

১৮৭০ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File