‘নাম’ বিড়ম্বনা !!
লিখেছেন লিখেছেন বৃত্তের বাইরে ২৭ মে, ২০১৩, ০৯:২৫:২৯ রাত
মোহাম্মদ হাজ্জাজ বিন ইউসুফ। বাপ-দাদার রাখা ভারী সুন্দর, অর্থবহ নাম। নামের ভিতর খানদানি বংশের একটা গন্ধ পাওয়া যায় অনেকটা ‘বৃক্ষ তোমার নাম কি, ফলে পরিচয়’ এর মত। আজকাল এমন হয়েছে যে নাম দেখে কারো বংশের পরিচয় তো দূরের কথা সে হিন্দু না মুসলমান সেটাও বুঝার উপায় নেই। তবে নাম দেখে বংশ পরিচয় জানা না গেলেও সে পাড়ার মাস্তান না সন্ত্রাসী তা সহজেই অনুমান করা যায়। এই যেমন ‘ট্যারা শাকিল’, ‘ল্যাংড়া মজিদ’, ‘কানকাটা রমজান’ জাতীয় তাৎপর্যপূর্ণ নামগুলো শুনলেই বুঝা যায় সে এলাকার কত বড় গণ্যমান্য ব্যাক্তি ! এখন আবার চলছে শর্টফর্মের যুগ। বিজ্ঞানের কল্যাণে পুরো দুনিয়াটাই যেখানে ছোট হয়ে এসেছে সেখানে নামের কাটছাঁটই বা বাদ যাবে কেন? তাই কাটছাঁটের যুগে মুসলিম ‘সিকান্দার মালিক’এর নামের শর্ট ফর্ম যেমন ‘স্যাম’ তেমনি খৃষ্টান ‘স্যাম ইদ্রিস’ এর শর্টফর্মও ‘স্যাম’ হলে আর অসুবিধা কোথায়? সমস্যা শুধু একটাই আগের মত ফল দেখে আর বৃক্ষের পরিচয় জানা সম্ভব নয় যে সে আসলে কোন গোত্রের বা বংশের।
বন্দোপাধ্যায়,চট্টোপাধ্যায় থেকে ব্যানার্জী, চ্যাটার্জী, মুখার্জী উপাধী নিয়ে অনেকে গর্ব বোধ করলেও এ দিক দিয়ে ‘শিখ’ ধর্মাবলম্বীদের অবস্থানটা যে বেশ শক্ত সেটা স্বীকার করতেই হবে। চলনে-বলনে, পোশাকে-আশাকে তাদের অনেকেই আধুনিক হলেও নামের ক্ষেত্রে তারা এখনও সেকেলে। নামটা যত বড়ই হোক না কেন নামের শেষে ‘সুখবিন্দর,‘ পারমিন্দর’,‘ কূলবিন্দর’... ইত্যাদি নানা রকম টাইটেল যোগ করে তারা যেমন তাদের বংশের ঐতিহ্য ধরে রেখেছে, তেমনি অন্যদেরও এহেন টাইটেল যুক্ত নাম দেখলে চিনে নিতে অসুবিধা হয়না যে তারা শিখ প্রজাতিভুক্ত।
একদিকে চলছে কাটছাঁট তার উপর আবার অনেকের রয়েছে পাশ্চাত্য বিলাসিতা। পাশ্চাত্যের বাবুরা ‘ব্রাডলী গালব্রেইথ’ বলতে পারেন কিন্তু ‘বোরহান খান’ বলতে পারেননা। রায়ান জিনেথ স্লেম্প, রাসেল ওয়াং, রব করনেবক এর মত দাঁতভাঙ্গা নাম উচ্চারন করতে পারেন কিন্তু রায়হান নাসের এর মত সহজ নাম উচ্চারন করতে পারেননা। আর পারবেনই বা কিভাবে ? গরু-খাসী জবাই করে, ঢাক-ঢোল পিটিয়ে আকিকা করে আমাদের বাপ-দাদাদের অতি যত্ন করে রাখা নামগুলো তাদের সুবিধামত ডাকার স্বাধীনতা আমরাই তো তাদের দিয়েছি। তাই এখন যখন বোরহান খান ‘বারনি’ আর রায়হান আহমেদ পাশ্চাত্যের আদলে 'রেনডি' হয়ে যায় তখন আমরাও বিনয়ে একেবারে নুয়ে পড়ি এই ভেবে যে 'থাকনা তারা তো আমাদের আদর করেই ডাকছে' !
তবে যত যাই হোক মোহাম্মদ হাজ্জাজ বিন ইউসুফ তার নামের কোন পরিবর্তন করবেনা ঠিক করেছে। যদিও প্রবাসে আসার পর তার বন্ধুরা তাকে বুদ্ধি দিয়েছিল ‘তোর নামের আগে মোহাম্মদ শব্দটা কেটে বাদ দিয়ে দে তা না হলে পরে ঝামেলায় পড়বি, আমরাও তাই করেছি’। ভবিষ্যতে চাকরি পেতে ভবিষ্যতে তাদের চাকরি পেতে সমস্যা হবে এই ভেবে বাচ্চাদের নামের আগেও মোহাম্মদ রাখিনি। সেসময় বন্ধুদের কথা সে হেসে উড়িয়ে দিয়েছিল। তবে বন্ধুরা যে তাকে খারাপ পরামর্শ দিয়েছিল তাও নয়। কারন নামের আগে ‘মোহাম্মদ’ থাকার কারনে প্রথমবার ইমিগ্রেশন পার হওয়ার সময় চেকিং এর নামে তার যে পোস্টমর্টেম করা হয়েছিল সেটা আজও তার মনে আছে । এইত বছরখানেক আগের কথা মোহাম্মদ নামের কোন এক লোক মাঝ রাতে গ্যাস ষ্টেশনে এসে গাড়িতে গ্যাস নেয়ার পর বিল পরিশোধ না করে চলে যায় । দোকানের মালিকের কমপ্লেইনের ভিত্তিতে সাথে সাথে শুরু হয়ে যায় তলব । তদন্তের খাতিরে মাঝ রাতে ওই এলাকার সব মোহাম্মদের বাড়িতে ফোন আসতে থাকে, তার নামও এ থেকে বাদ পড়েনা । যাই হোক আইডি চেক করার পর অবশেষে এই বিড়ম্বনা থেকেও রেহাই মিলে।
প্রথমদিকের এই অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনাগুলোকে সামলে ওঠে পরিশ্রম আর মেধা দিয়ে এতদিনে সে যখন নিজেকে একটা শক্ত সামাজিক অবস্থানে এনে দাঁড় করিয়েছে তখন আবার নতুন করে দেখা দিয়েছে আরেক বিপত্তি। সে একটা নামকরা প্রতিষ্ঠানের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা । গত মাসে তার চাকরিটা চলে যায় । প্রথমে সে ভেবেছিল অর্থনৈতিক মন্দার জন্য কারন অনেকেরই এখন এমন হচ্ছে । কিন্তু একমাস পর জানতে পারল কারণটা আসলে মন্দার জন্য নয়, কারনটা হল তার নাম । এ বছর পরিবার নিয়ে ওমরা করতে যাবে বলে ঠিক করেছিল, সেই অনুযায়ী এজেন্সির কাছে টাকাও জমা দেয়া হয়ে গেছে । নাম নিয়ে ঝামেলার কারনে ভিসা অফিসার ভিসা দিবেনা বলে সাফ জানিয়ে দিয়েছে। তারা জানতে পেরেছে এই নামের কোন এক অপরাধীকে পুলিশ খুঁজছে তাই তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত তারা ভিসা দিবেনা। তার আইডি কার্ডগুলো জব্দ করায় সে অন্য কোন জায়গায় কাজের জন্য চেষ্টা করতে পারছেনা। সে ভেবে পায়না যারা নিজেদের সবচেয়ে বুদ্ধিমান, প্রভাবশালী জাতি হিসেবে পরিচয় দিতে গর্ববোধ করে, যারা বড় বড় পারমানবিক বোমা, যুদ্ধ ক্ষেপণাস্ত্র তৈরিতে বুদ্ধি খাটাতে পারে সেইসব সূক্ষ্ম বুদ্ধিসম্পন্ন হর্তা–কর্তাদের মাথায় এটা ঢুকেনা যে এত বড় দেশে একই নামের দুই ব্যাক্তি থাকতে পারে! কোন প্রমাণ ছাড়া শুধুমাত্র নামের মিলের কারনে তাকে কেন বারবার অপদস্থ করা হচ্ছে? সে তার নিরলস শ্রম, মেধা, যোগ্যতা দিয়ে এই প্রতিষ্ঠানটির জন্য কি না করেছে অথচ আজ দুর্ভাগ্যজনকভাবে তাদেরই নির্বুদ্ধিতার কারনে তাকে বারবার হতে হচ্ছে বিড়ম্বনার শিকার।
বিষয়: বিবিধ
২২৬৬ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন