উপমহাদেশের ইসলামী গণবিপ্লবের প্রবক্তা হযরত মাওলানা আব্দুর রহীমের জীবন বৃত্তান্ত, সাহিত্যকর্ম, চিন্তা ও দর্শনের সার সংক্ষেপ-

লিখেছেন লিখেছেন ডাক্তার মেহেদী ০২ জুলাই, ২০১৩, ১১:৫০:২১ রাত

জন্ম- ২মার্চ, ১৯১৮ খৃস্টাব্দ, বরিশাল।

প্রত্যেক নবীর যুগে বিরোধী শক্তির হাতে যে অস্ত্র থাকে, সেই অস্ত্রকে চ্যালেঞ্জ করার মত যোগ্যতা ও বলিষ্ঠ বিচক্ষণতা দিয়েই আল্লাহ্‌ তাআলা নবীদের প্রেরণ করেছেন। যেমন হযরত মুসা(আঃ) এর যুগ ছিল যাদুর, হযরত দাউদ (আঃ) এর যুগ ছিল সুরের, এমনিভাবে শেষ নবী হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) এর যুগ ছিল সাহিত্যের। মুসা(আঃ) কে আল্লাহ্‌ শ্রেষ্ঠতর যাদুর মু'জিযা দিয়ে সে যুগের যাদুকে পরাভুত করেছেন। দাউদ(আঃ) কে শ্রেষ্ঠ সুর দিয়ে সে যুগের সুরের প্রাধান্য খর্ব করেছেন। তেমনি উম্মী নবীকে তুলনাহীন ভাষা অলঙ্কারে অলঙ্কৃত কুরআন দিয়ে আরব পণ্ডিতদের মুখ বন্ধ করেছিলেন। আমাদের এই উপমহাদেশেও বিশেষ করে এই বাংলা ভাষাভাষী এলাকায় ৪০-৬০ এর দশকে ইসলামের উপর যত আঘাত এসেছে বা এখনও আসছে তার অধিকাংশই সাহিত্যনির্ভর। এ সময়ে 'জিহাদ-বিস-সাইফ' তথা তরবারীর যুদ্ধের চেয়ে 'জিহাদ- বিল-কলম তথা কলম যুদ্ধের যোগ্যতারই তীব্র প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হচ্ছিল। মাওালানা আব্দুর রহীম নিঃসন্দেহে কলম যুদ্ধের একজন সফল সিপাহসালার।

মাওলানা মুহাম্মদ আব্দুর রহীম ভারতীয় উপমহাদেশে একজন সাহিত্যিক ও অন্যতম শ্রেষ্ঠ ইসলামী চিন্তাবিদ হিসেবে যত না খ্যাত, তার চেয়ে তিনি একজন আলেম ও রাজনীতিবিদ হিসেবে অধিক খ্যাত। তবে আলেম বলতে আমাদের দেশে যে চিত্র আমাদের মানসে ভেসে উঠে, তার সাথে তাঁর পার্থক্য ছিল। মাওলানা নিজেও এ শব্দের সংজ্ঞায় ভিন্নমত পোষণ করতেন। তাঁর দৃষ্টিতে শুধু মাদ্রাসায় দাওরা-এ- হাদিস বা টাইটেল পাস করলেই তাকে আলেমের সম্মানে ভূষিত করা যায়না। নামায, রোজা, হজ, জাকাত কিংবা শুধুমাত্র ধর্মীয় অনুষ্ঠান পরিচালনাতেই তাঁর কর্তব্য শেষ হয়না। বরঞ্চ একজন আলেম সংশ্লিষ্ট মুসলিম সমাজের সার্বিক দিকই নেতৃত্ব দিবে। অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক,সামাজিক, সাংস্কৃতিক,নেতৃত্বও তাঁকে দিতে হয়, যাতে ঐ সকল ক্ষেত্রের নেতৃত্বের জন্য মুসলমানদের ভিন্নদিকে হাত পাততে না হয়। মূলত মাওলানা আব্দুর রহীম ছিলেন তেমন ধরণের নেতৃত্ব সৃষ্টিকারী একজন আলেম।

সাংবাদিকতায় তার ক্যারিয়ার ছিল অত্যন্ত বর্নাঢ্য। ১৯৪৯-৫০ সালে তিনি বরিশালে 'তানজিম' নামক একটি পত্রিকার সম্পাদনা করতেন। তিনি সাপ্তাহিক 'জাহানে নও' পত্রিকার পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক। ১৯৫৯-৬০ সালে দৈনিক নাজাতের জেনারেল ম্যানেজার হিসেবে কর্মরত ছিলেন। এছাড়াও তিনি বিখ্যাত মাসিক মোহাম্মদী(কলিকাতা ও ঢাকা), মাসিক পৃথিবী, দৈনিক আজাদ, দৈনিক ইত্তেফাক, ঢাকা ডাইজেস্ট, মাসিক মদীনা, মাসিক তাহজীব, দৈনিক সংগ্রাম এবং ইসলামিক ফাউন্ডেনশান পত্রিকার সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন। তার অনুবাদ সাহিত্যগুলো বাংলা ভাষায় ইসলামী সাহিত্যের এক অমূল্য রত্নভাণ্ডার। বিভিন্ন পত্রিকায় তার অনুবাদ সাহিত্যগুলো অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে ছাপা হত।

তাকে এক কথায় বলা চলে ভারতীয় উপমহাদেশে ইসলামী আন্দোলনের সওগাত। ১৯৪৫ সালে মাওলানা মউদুদির বিপ্লবী পুস্তকসমূহের সাথে পরিচিত হবার পর জামাতে ইসলামী হিন্দে যোগদান করেন। পাকিস্তান আলাদা হবার পর তিনি ঢাকাকেন্দ্রিক ইসলামী আন্দোলনের কাজে মনোনিবেশ করেন। ১৯৫১-৫৫ সাল পর্যন্ত তিনি জামাতে ইসলামীর সেক্রেটারী হিসেবে এবং ১৯৫৬-৬৮ সাল পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তান জামাতে ইসলামীর আমীরহিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এরি মধ্যে ১৯৬০-৬২ সালে তৎকালীন ক্ষমতাসীন সামরিকজান্তা আইয়ুব সরকারের বিরুদ্ধে ইসলামী নীতিমালা প্রতিষ্ঠার দাবীতে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তুলেন। ফলশ্রুতিতে প্রায় ৬৪ জন জামাত নেতা সহ মাওলানা কারাগারে নিক্ষিপ্ত হন। দেশে বিরাজমান সকল ইসলামী দল ও শক্তিকে একীভূত করার সুমহান লক্ষ্যকে সামনে রেখে ১৯৭৬ সালে 'ইসলামী ডেমোক্রেটিক লীগ'গঠন করে তিনি তার সহ- সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৭৯ সালে তিনি সহ ৬ জন দল থেকে জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৮৩ সালে দলের নাম পরিবর্তন করে 'ইসলামী ঐক্য আন্দোলন' গঠন করেন।

তিনি আমৃত্যু দেশের ইসলামের পক্ষের সকল দল ও শক্তিগুলোকে একই প্লাটফর্মে নিয়ে আসার প্রচেষ্টায় রত ছিলেন। তিনি ইসলামের সপক্ষের শক্তিগুলোর জোট সৃষ্টির মাধ্যমে গণআন্দোলনে বিশ্বাস করতেন বলে দেশের প্রখ্যাত আলেম-ওলামা, পীর-মাশায়েখ, সাংবাদিক ও বুদ্ধিজীবীদের সমন্বয়ে 'সম্মিলিত সংগ্রাম পরিষদ' ও 'খেলাফত সংগ্রাম পরিষদ' গঠন করেছিলেন।

বাংলা ভাষায় ইসলামী সাহিত্যাঙ্গনে মাওলনা আব্দুর রহীম একজন দিকপাল। ইসলামী বাংলা সাহিত্যে তাঁর অবদান অন্য আরেকটি লিখায় তুলে ধরব ইনশাআল্লাহ্‌। উপমহাদেশের মাটি ও মানুষের গভীরে ইসলামের বীজ বুননের সংগ্রামে যারা সম্মুখ থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন, মাওলানা তাদের অন্যতম। তাদের ফেলে যাওয়া কাজ , তাদের বুনে যাওয়া স্বপ্নকে বাস্তবে রুপদান করার সংগ্রামে যারা নিরলস কাজ করে যাচ্ছে, মাওলানা তাদের নিকট যুগ যুগ ধরে অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে।

বিষয়: বিবিধ

২৩২৮ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File