ইসলামের রাজনীতি
লিখেছেন লিখেছেন মোঃ সুজন আতিক ৩১ মে, ২০১৩, ১০:২৩:২০ রাত
ইসলামের রাজনীতির বুনিয়াদ তিনটি মূলনীতির উপর স্থাপিত : তাওহীদ, নবুয়াত এবং খিলাফত। এ তিনটি মূলনীতিকে বিস্তৃতভাবে বুঝতে না পারলে ইসলামী রাজনীতির বিস্তারিত বিধান হৃদয়ংগম করা বড়ই কঠিন ব্যাপার। কাজেই সর্বপ্রথম আমি এ তিনটি বিষয়ে সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা করব।
তাওহীদ
তাওহীদের অর্থ এই যে, আল্লাহ তায়ালা এ দুনিয়া এবং দুনিয়ার মানুষ সহ সবকিছুরই সৃষ্টিকর্তা, পালনকর্তা এবং একমাত্র মালিক। প্রভুত্ব, শাসন এবং আইন রচনার নিরংকুশ অধিকার একমাত্র তারই। কোন কিছু করার আদেশ দেয়া এবং কোন কাজের নিষেধ করার ক্ষমতা শুধু তারই কাছে বর্তমান। আল্লাহ তায়ালার সাথে মানুষ কাউকে শরীক করবে না। আমরা যে সত্তার দরুন বেচে আছি, আমাদের যে শারীরিক অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ও বল-শক্তি দ্বারা আমরা কাজ করি, দুনিয়ার সকল জিনিসেরই উপর আমাদের এই যে অধিকার ও ব্যবহার ক্ষমতা প্রয়োগ করি - তার কোনটাই আমাদের উপার্জিত নয়। এর সৃষ্টি ও অবদানের ব্যাপারে আল্লাহ তায়ালার সাথে অন্য কেউ শরীক নেই। আমাদের নিজেদের এ অস্তিত্বের উদ্দেশ্য এবং আমাদের ক্ষমতা ও ইচ্ছাশক্তির সীমা নির্ধারণ করা আমাদের করণীয় কাজ নয়, আর না এতে অন্য কারোও একবিন্দু অধিকার আছে। এ সবকিছু শুধু সেই আল্লাহর করণীয় যিনি আমাদের সৃষ্টি করেছেন। তিনিই আমাদের এত শক্তি ও স্বাধীনতা দান করেছেন এবং দুনিয়ার অসংখ্য জিনিসকে আমাদের ভোগ-ব্যবহারের জন্য দিয়েছেন। তাদের এ ধারণা মানবীয় প্রভুত্বকে সম্পূর্ণরূপে বাতিল করে দেয়। একজন ব্যক্তি মানুষই হোক কিংবা একটি পরিবার বা একটি শ্রেণী হোক কিংবা মানুষের একটি বড় দল, একটি জাতি কিংবা সামগ্রিকভাবে সারা দুনিয়ার মানুষ হোক, সার্বভৌ্ম ক্ষমতার অধিকারী একমাত্র আল্লাহ তায়ালা, তার আদেশই হচ্ছে মানুষের জন্য একমাত্র আইন।
নবুয়াত
আল্লাহ তায়ালার এ আইন যে উপায়ে মানুষের নিকট এসে পৌছেছে, তার নাম নবুয়াত। এ নবুয়াতের ভিতর দিয়ে আমরা দু’টি জিনিস লাভ করে থাকি। এক : কিতাব - যাতে আল্লাহ তায়ালা তার নিজের আইন-কানুনের বিবরণ দিয়েছেন। দুই : সেই কিতাবের বিশুদ্ধ ব্যাখ্যা - যা রাসূল (সা) আল্লাহর প্রতিনিধি হিসেবে নিজের কথা ও কাজের ভিতর দিয়ে সুস্পষ্টরূপে পেশ করেছেন। যে মূলনীতির উপর মানুষের ধর্মীয় জীবনের ভিত্তি স্থাপিত হওয়া উচিত আল্লাহ তায়ালা সবই তার কিতাবে এক এক করে বর্ণনা করেছেন এবং রাসূল (সা) আল্লাহর কিতাবের সেই উদ্দেশ্য অনুসারে কার্যকরীভাবে জীবন যাপনের একটি পরিপূর্ণ ব্যবস্থা তৈরী করেছেন। আর তার আবশ্যকীয় ব্যাখ্যা বলে দিয়ে আমাদের জন্য একটি উজ্জল আদর্শ রূপে উপস্থিত করেছেন। ইসলামের পরিভাষায় এ দু’টি জিনিসের সমষ্টিগত নাম হচ্ছে শরীয়াত। ইসলামী রাষ্ট্র এ বুনিয়াদী নীতির উপরই প্রতিষ্ঠিত হয়ে থাকে।
খিলাফত
এখন খিলাফতের কথা আলোচনা করা যাক। আরবী ভাষায় এ শব্দ প্রয়োগ করা হয় প্রতিনিধিত্বের অর্থ বুঝার জন্য। ইসলামের দৃষ্টিতে মানুষ এ দুনিয়ায় আল্লাহ তায়ালার দেয়া স্বাধীনতা অনুযায়ী কাজ করবে। আপনি যখন কারো উপর আপনার জায়গা-জমির ব্যবস্থাপনার ভার অর্পণ করেন, তখন চারটি কথা আপনার মনে অবশ্যই বর্তমান থাকে। প্রথম এই যে, জমির প্রকৃত মালি সে নয়, - আপনি নিজে। দ্বিতীয়, আপনার জমিতে সে কাজ করবে আপনারই দেয়া আদেশ-উপদেশ অনুসারে। তৃতীয়, আপনি তাকে কাজকর্ম করার যে সীমা নির্দিষ্ট করে দেবেন, সেই সীমার মধ্যে থেকেই তাকে কাজ করতে হবে - আপনার দেয়া স্বাধীনতাকে সেই সীমার মধ্যেই তার ব্যবহার করতে হবে। আর চতুর্থ এই যে, আপনার জমিতে তাকে - তার নিজের নয়-আপনার উদ্দশ্যকে পূর্ণ করতে হবে। এ চারটি শর্ত প্রতিনিধিত্বের ধারণার মধ্যে এমনভাবে মিলে-মিশে আছে যে, ‘প্রতিনিধি’ শব্দ উচ্চারণ করার সঙ্গে সঙ্গেই আপনা আপনিই মানুষের মনে এটা জেগে উঠে। আপনার কোন প্রতিনিধি যদি এ চারটি শর্ত পূর্ণ না করে তবে আপনি অবশ্যই বলবেন যে, সে প্রতিনিধিত্বের সীমালংঘন করেছে এবং সে সেই প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেছে, যা ‘প্রতিনিধির’ শব্দের অর্থেই নিহিত রয়েছে। ইসলাম মানুষকে দুনিয়ায় আল্লাহ তায়ালার ‘প্রতিনিধি’ বলে নির্দিষ্ট করেছে। এই খিলাফত বা প্রতিনিধিত্বের ধারণার মধ্যেই উক্ত চারটি শর্ত অনিবার্য রূপে বিদ্যমান। ইসলামী রাজনীতির এ মহান আদর্শ অনুসারে যে রাষ্ট্র কায়েম হবে, মূলত তা হবে আল্লাহ তায়ালার নিরংকুশ প্রভুত্বের অধীনে মানুষের খিলাফত। আল্লাহর এ রাজ্যে তারই দেয়া আদেশ-উপদেশ অনুসারে তার নির্ধারিত সীমার মধ্যে থেকে কাজ করে তার উদ্দেশ্যকে পূর্ণ করা হচ্ছে এ দুনিয়ায় মানুষের একমাত্র কাজ।
খিলাফতের এ ব্যাখ্যা প্রসংগে আর একটি কথা বুঝে নেয়া দরকার। তা এই যে, ইসলামের এ রাজনৈতিক মত কোন ব্যক্তি বিশেষকে কিংবা কোন পরিবার বা কোন শ্রেণী বিশেষকে ‘প্রতিনিধি’ বলে আখ্যা দেয়নি, বরং মানুষের সেই গোটা সমাজকেই এ খিলাফতের পদে অভিষিক্ত করেছে, যারা তাওহীদ ও রেসালাতের মূলনীতিগুলোকে স্বীকার করে খিলাফতের উল্লেখিত শর্তাবলী পূর্ণ করতে প্রস্তুত হবে, এমন সমাজই সমষ্টিগতভাবে খিলাফতের অধিকারী - এ খিলাফত এহেন সমাজের প্রত্যেকটি মানুষের প্রাপ্য।
গণতন্ত্র
ইসলামের রাজনীতিতে এখান থেকেই শুরু হয় গণতন্ত্রের পদক্ষেপ। ইসলামী সমাজের প্রত্যেকটি ব্যক্তিই খিলাফতের অধিকারী ও আযাদীর মালিক। এ অধিকার ও স্বাধীনতার সমগ্র মানুষই সমান অংশের অংশীদার। এ ব্যাপারে কেউ কারো চেয়ে শ্রেষ্ঠ নয়, কোন মানুষ অন্য কোন ব্যক্তিকে তার এ অধিকার ও স্বাধীনতার স্বত্ব হতে বঞ্চিত করতে পারে না। রাষ্ট্রের শাসন শৃংখলা বিধানের জন্য যে সরকার গঠিত হবে তা এ সমাজেরই ব্যক্তিদের মত অনুযায়ী গঠন করতে হবে। এরাই নিজ নিজ খিলাফতের অধিকার হতে এক অংশ সেই সরকারকে দান করবে। রাষ্ট্র গঠনের ব্যাপারে তাদের মতের মূল্য অনিবার্যরূপে স্বীকৃত হবে। তাদেরই পরামর্শক্রমে গভর্ণমেন্ট চলবে। তাদের আস্থা যে ব্যক্তি লাভ করতে পারবে। আর যে তাদের আস্থা হারাবে, সে অবশ্যই খিলাফতের পদ হতে বিচ্যুত হেত বাধ্য হবে। এ দিক দিয়ে ইসলামী গণতন্ত্র একটি পরিপূর্ণ গণতন্ত্র। একটি গণতন্ত্র যতদূর পরিপূর্ণ, পূর্ণাঙ্গ ও নিখুত হতে পারে, এটা ঠিক ততখানিই পরিপূর্ণ ও নিখুত। কিন্তু ইসলামের এ গণতন্ত্র পাশ্চাত্য গণতন্ত্র হতে মূলতই সম্পূর্ণ আলাদা। এদের মধ্যে আকার-পাতালের পার্থক্য বিদ্যমান। পার্থক্য এ দিক দিয়ে যে, পাশ্চাত্য রাজনীতি ‘জনগণের প্রভুত্বকে’ বুনিয়াদরূপে স্বীকার করে, কিন্তু ইসলাম স্বীকার করে জনগণের ‘খিলাফত’কে। পাশ্চাত্য রাজনীতিতে জনগণই হচ্ছে বাদশাহ, আর ইসলামের দৃষ্টিতে বাদশাহী একমাত্র আল্লাহর, জনগণ তার প্রতিনিধি মাত্র। পাশ্চাত্য রাজনীতিতে জনগণ নিজেরাই দেশের শাসনতন্ত্র ও আইন রচনা করে, কিন্তু ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থায় জনগণকে সেই শরীয়াত বা আইনের অনুসরণ করে চলতে হয়, যা আল্লাহ তায়ালা তার রাসূলের মাধ্যমে পাঠিয়েছেন। পাশ্চাত্য রাজনীতিতে গভর্ণমেন্টের কর্তব্য হচ্ছে রাজ্যের জনগণের ইচ্ছাকে পূর্ণ করা আর ইসলামী গভর্ণমেন্ট এবং তার প্রতিষ্ঠাতা জনগণ সকলেরই কর্তব্য হচ্ছে দুনিয়ায় আল্লাহ তায়ালার উদ্দেশ্যকে সার্থক করা। মোটকথা, পাশ্চাত্য গণতন্ত্র হচ্ছে আযাদ, নিরংকুশ ও বল্গাহারা প্রভৃত্ত - যার নিজ অধিকার ও স্বাধীনতাকে স্বেচ্ছাচারিতার সাথে ভোগ করে। এর সম্পূর্ণ বিপরীত - ইসলামী গণতন্ত্র হচ্ছে আল্লাহর দেয়া আইনের অনুসরণ করা। এখানে মানুষ তার অধিকার ও স্বাধীনতাকে আল্লাহর দেয়া বিধান অনুসারে তারই নির্ধারিত সীমার মধ্যে ব্যবহার করা।
http://www.islam.net.bd/content/view/65/41/1/3/
বিষয়: বিবিধ
১৩৫৫ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন