হাদিস এর ইতিহাস পোষ্টটি একটু বড় তবে পড়লে অনেককিছু জানতে পারবেন
লিখেছেন লিখেছেন ডাঃ হাবিবুর রহমান ২৬ নভেম্বর, ২০১৩, ০৩:৫৯:৩৫ দুপুর
যাবতীয় প্রশংসা বিশ্বজাহানের প্রতিপালক আল্লাহ তা’আলার জন্য। সালাত ও সালাম তাঁর প্রিয় নবী হাবীব মুহাম্মদুর রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর উপর।
হাদীস শরীফ মুসলিম মিল্লাতের এক অমূল্য সম্পদ, ইসলামী শরই’আতের অন্যতম অপরিহার্য উৎস এবং ইসলামী জীবন বিধানের অন্যতম মূল ভিত্তি। কুরআন মজীদ যেখানে ইসলামী জীবন ব্যবস্থার মৌলনীতি পেশ করে, হাদীস সেখানে এ মৌল নীতির বিস্তারিত বিশ্লেষণ ও তা বাস্তবায়নের কার্যকর পন্থা বলে দেয়। কুরআন ইসলামের আলোকস্তম্ভ, হাদীস তাঁর বিচ্ছুরিত আলো। ইসলামী গান-বিজ্ঞানে কুরআন যেন হৃদপিণ্ড, আর হাদীস এ হৃদপিণ্ডের সাথে সংযুক্ত ধমনী। জ্ঞানের বিশাল ক্ষেত্রে প্রতিনিয়ত তাজা তপ্ত শোণিতধারা প্রবাহিত করে এর অঙ্গ-প্রতঙ্গকে অব্যাহতভাবে সতেজ ও সক্রিয় রাখে। হাদীস একদিকে যেমন কুরআনুল আযীমের নির্ভুল ব্যাখ্যা দান করে, অনুরূপভাবে তা পেশ করে কুরআনের ধারক ও বাহক নবী করীম (সঃ)-এর পবিত্র জীবনচরিত, কর্মনীতি ও আদর্শ এবং তাঁর কথা ও কাজ, হিদায়াত ও উপদেশের বিস্তারিত বিবরণ। এজন্যই ইসলামী জীবন বিধানে কুরআনে হাকীমের পরপরই হাদীসের স্থান।
আল্লাহ তা’আলা জিবরাঈল আমীনের মাধ্যমে নবী করিম (সঃ)-এর উপর যে ওহী নাযিল করেছেন, তা হলো হাদীসের মূল উৎস। ওহী-এর শাব্দিক অর্থ ‘ইশারা করা’ গোপনে অপরের সাথে কথা বলা। ওহী দু প্রকার। প্রথম প্রকার প্রত্যক্ষ ওহী যার নাম ‘কিতাবুল্লাহ’ বা ‘আল-কুরআন’। এর ভাব, ভাষা উভয়ই মহান আল্লাহ্র। রাসুলুল্লাহ (সঃ) তা হুবুহু প্রকাশ করেছেন। দ্বিতীয় প্রকার পরোক্ষ ওহী এর নাম ‘সুন্নাহ’ বা ‘আল-হাদীস’। এর ভাব আল্লাহ্র, তবে নবী (সঃ) তা নিজের ভাষায়, নিজের কথায় এবং নিজের কাজে ও সম্মতির মাধ্যমে প্রকাশ করেছেন। প্রথম প্রকারের ওহী রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর উপর সরাসরি নাযিল হতো এবং তাঁর কাছে উপস্থিত লোকজন তা উপলব্ধি করতে পারত। কিন্তু দ্বিতীয় প্রকারের ওহী তাঁর উপর প্রচ্ছন্নভাবে নাযিল হতো এবং অন্যরা তা উপলব্ধি করতে পারত না।
আখেরী নবী ও রাসূল হযরত মুহাম্মদ (সঃ) কুরআনের ধারক ও বাহক, কুরআন তাঁর উপরই নাযিল হয়। আল্লাহ তা’আলা তাঁর কিতাবে নামব জাতিকে একটি আদর্শ অনুসরণের ও অনেক বিধি-বিধান পালনের নির্দেশ দিয়েছেন, কিন্তু তাঁর বিস্তারিত বিবরণ দান করেন নি। এর ভার ন্যস্ত করেছেন রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর উপর। তিনি নিজের কথা-কাজ ও আচার-আচরনের মাধ্যমে কুরআনের আদর্শ ও বিধান বাস্তবায়নের পন্থা ও নিয়ম কানূন বলে দিয়েছেন। কুরআনকে কেন্দ্র করেই তিনি ইসলামের এক পূর্ণাঙ্গ জীবন-বিধান পেশ করেছেন। অন্য কথায়, কুরআন মজীদের শিক্ষা ও নির্দেশসমূহ ব্যাক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে কার্যকর করার জন্য নবী (সঃ) যে পন্থা অবলম্বন করেছেন, তাই হচ্ছে হাদীস। হাদীসও যে ওহীর সুত্রে প্রাপ্ত এবং তা শরী’আতের অন্যতম উৎস কুরআন ও মহানবী (সঃ)-এর বাণীর মধ্যেই তাঁর প্রমাণ বিদ্যমান। মহান আল্লাহ তাঁর প্রিয় নবী (সঃ) সম্পর্কে বলেনঃ
“ আর তিনি (নবী) মনগড়া কথাও বলেন না, এ তো ওহী যা তাঁর প্রতি প্রত্যাদেশ হয়” (৫৩: ৩-৪)।
“ তিনি (নবী) যদি আমার নামে কিছু রচনা চালাতে চেষ্টা করতেন আমি অবশ্যই তাঁর ডান হাত ধরে ফেলতাম এবং কেটে লইতাম তাঁর জীবনধমনী” (৬৯: ৪৪-৪৬)।
রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেনঃ “ রুহুল কুদস (জিবরাঈল) আমার মানসপটে এ কথা ফুঁকে দিলেন নির্ধারিত পরিমাণ রিযিক পূর্ণ মাত্রায় গ্রহণ না করা পর্যন্ত এবং নির্দিষ্ট আয়ুস্কাল শেষ হওয়ার পূর্বে কোন প্রাণীর মৃত্যু হয় না” ( বায়হাকী, শারহুস সুন্নাহ)। “ আমার নিকট জিবরাঈল (আঃ) এলেন এবং আমার সাহাবীগনকে উচ্চস্বরে তাকবীর ও তাহলীল বলতে আদেশ করার জন্য আমাকে নির্দেশ দিলেন” (নাইলুল আওতার, ৫ম খণ্ড, পৃ. ৫৬)। “ জেনে রাখ, আমাকে কুরআন দেয়া হয়েছে এবং তার সাথে দেয়া হয়েছে এর অনুরূপ আরও একটি জিনিস”- ( আবূ দাঊদ, ইবন মাজা, দারিমী)। রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর আনুগত্য করার জন্য আল্লাহ তা’আলা আমাদেরকে কুরআনুল করিমে নির্দেশ দিয়েছেনঃ
“রাসুল তোমাদের যা দেন তা তোমরা গ্রহণ কর এবং যা তোমাদের নিষেধ করেন তা থেকে বিরত থাক।” ( ৫৯: ৭)
“হাদীস অধ্যয়নের উদ্দেশ্য সম্পর্কে আল্লামা বদরুদ্দীন আইনী (রঃ) বলেন “দুনিয়া ও আখিরাতের পরম কল্যাণ লাভই হচ্ছে হাদীস অধ্যয়নের উদ্দেশ্য ও লক্ষ।” আল্লামা কিরমানী (রঃ) লিখেছেন, “কুরআনের পর সকল প্রকার জ্ঞানের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ, সর্বোত্তম এবং তথ্য তত্ত্ব সমৃদ্ধ সম্পদ হচ্ছে ইলমে হাদীস। কারন এই জ্ঞানের সাহায্যেই আল্লাহ্র কালামের লক্ষ ও তাৎপর্য জানা যায় এবং তাঁর হুকুম-আহকামের উদ্দেশ্য অনুধাবন করা যায়।”
হাদীসের পরিচয়
শাব্দিক অর্থে হাদীস মানে নতুন, প্রাচীন ও পুরাতন-এর বিপরীত বিষয়। এ অর্থে যে সব কথা, কাজ ও বস্তূ পূর্বে ছিল না, এখন অস্তিত্ব লাভ করেছে তাই হাদীসের আরেক অর্থ হলো কথা। ফকীহ গণের পরিভাষায় নবী করীম (সঃ) আল্লাহ্র রাসূল হিসাবে যা কিছু বলেছেন, যা কিছু করেছেন এবং যা কিছু বলার বা করার অনুমুতি দিয়েছেন অথবা সমর্থন জানিয়েছেন তাঁকে হাদীস বলা হয়। কিন্তু মুহাদ্দিসগণ এর সঙ্গে রাসূলুল্লাহ (সঃ) সম্পর্কিত বর্ণনা ও তাঁর গুণাবলী সম্পর্কিত বিবরণকেও হাদীসের অন্তর্ভুক্ত করেন। এ হিসেবে হাদীসকে প্রাথমিক পর্যায়ে তিন শ্রেণিতে ভাগ করা যায়ঃ কাওলী হাদীস, ফে’লী হাদীস ও তাকরীরী হাদীস।
প্রথমত, কোন বিষয়ে রাসূলুল্লাহ (সঃ) যা বলেছেন, অর্থাৎ যে হাদীসে তাঁর কোন কথা বিধৃত হয়েছে তাঁকে কাওলী (বানী সম্পর্কিত) হাদীস বলা হয়। দ্বিতীয়ত, মহানবী (সঃ)-এর কাজকর্ম, চরিত্র ও আচার-আচারণের ভেতর দিয়েই ইসলামের যাবতীয় বিধি-বিধান ও রীতিনীতি পরিস্ফুট হয়েছে। অতএব যে হাদীসে তাঁর কোন কাজের বিবরণ উল্লেখিত হয়েছে তাঁকে ফে’লী ( কর্ম সম্পর্কিত) হাদীস বলা হয়। তৃতীয়ত, সাহাবীগণের যে সব কথা বা কাজ নবী করীম (সঃ)-এর অনুমোদন ও সমর্থনপ্রাপ্ত হয়েছে, সে ধরনের কোন কথা বা কাজের বিবরণ হতেও শরী’আতের দৃষ্টিভঙ্গি জানা যায়। অতএব যে হাদীসে এ ধরনের কোন ঘটনার বা কাজের উল্লেখ পাওয়া যায় তাঁকে তাকরীরী (সমর্থনমূলক) হাদীস বলে।
হাদীসের অপর নাম সুন্নাহ। সুন্নাহ শব্দের অর্থ, কর্মের নীতি ও পদ্ধতি। যে পন্থা ও রীতি নবী করীম (সঃ) অবলম্বন করতেন তাঁকে সুন্নাত বলা হয়। অন্য কথায় রাসূলুল্লাহ (সঃ) প্রচারিত উচ্চতম আদর্শই সুন্নাত। কুরআন মজীদে মহোওম ও সুন্দরতম আদর্শ বলেতে এই সুন্নাতকেই বোঝানো হয়েছে। ফিকাহ পরিভাষায় সুন্নাত বলতে ফরয ও ওয়াজিব ব্যতিত ইবাদত রূপে যা করা হয় তা বোঝায়, যেমন সুন্নাত সালাত। হাদীসকে আরবী ভাষায় খবরও বলা হয়। তবে খবর শব্দটি হাদীস ও ইতিহাস উভয়টিকেই বোঝায়।
আসার শব্দটিও কখনও কখনও রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর হাদীস নির্দেশ করে। কিন্তু অনেকেই হাদীস ও আসার-এর মধ্যে কিছু পার্থক্য করে থাকেন। তাঁদের মতে সাহাবীগণ থেকে শরী’আত সম্পর্কে যা কিছু উদ্বুদ্ধ হয়েছে তাঁকে আসার বলে। তবে এ ব্যাপারে সবাই একমত যে, শরী’আত সম্পর্কে সাহাবীগণ নিজস্ব ভাবে কোন বিধান দেওয়ার প্রশ্নই উঠে না। কাজেই এ ব্যাপারে তাঁদের উদ্ধিৃতিসমূহ মূলত রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর উদ্ধিৃতি। কিন্তু কোন কারণে শুরুতে তাঁরা রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর নাম উল্লেখ করেন নি। উসূলে হাদীসের পরিভাষায় এসব আসারকে বলা হয় ‘মাওকূফ হাদীস’।
ইলমে হাদীসের কতিপয় পরিভাষা
সাহাবিঃ যে ব্যক্তি ঈমানের সঙ্গে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের সাহচর্য লাভ করেছেন বা তাঁকে দেখেছেন ও তাঁর একটি হাদীস বর্ণনা করেছেন, অথবা জীবনে একবার তাঁকে দেখেছেন এবং ঈমানের সঙ্গে মৃত্যুবরণ করেছেন তাঁকে রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর সাহাবী বলে।
তাবীঈঃ যিনি রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর কোন সাহাবীর নিকট হাদীস শিক্ষা করেছেন অথবা অন্ততপক্ষে তাঁকে দেখেছেন এবং মুসলমান হিসাবে মৃত্যুবরণ করেছেন তাঁকে তাবিঈ বলে।
মুহাদ্দিসঃ যে ব্যাক্তি হাদীস চর্চা করেন এবং বহু সংখ্যক হাদীসের সনদ ও মতন সম্পর্কে বিশেষ জ্ঞ্যান রাখেন তাঁকে মুহাদ্দিস বলে।
শায়খঃ হাদীসের শিক্ষাদাতা রাবীকে শায়খ বলে।
শায়খায়নঃ সাহাবীগণের মধ্যে আবূ বকর ও উমরা (রঃ)-কে একত্রে শায়খায়ন বলা হয়। কিন্তু হাদীসশাস্ত্রে ইমাম বুখারী ও ইমাম মুসলিম (রঃ)- কে শায়খায়ন বলা হয়।
হাফিজঃ যিনি সনদ ও মতনের বৃত্তান্ত সহ এক লাখ হাদীস আয়ত্ত করেছেন তাঁকে হাফিয বলা হয় ।
হুজ্জাতঃ অনুরূপভাবে যিনি তিন লক্ষ হাদীস আয়ত্ত করেছেন তাঁকে হুজ্জাত বলা হয়
হাকিমঃ যিনি সব হাদীস আয়ত্ত করেছেন তাঁকে হাকিম বলা হয়
রিজালঃ হাদীসের রাবী সমষ্টিকে রিজাল বলে। যে শাস্ত্রে রাবীগণের জীবনী বর্ণনা করা হয়েছে তাঁকে আসমাউর-রিজাল বলা হয়।
রিওয়ায়তঃ হাদীস বর্ণনা করাকে রিওয়ায়াত বলে। কখনও কখনও মূল হাদীসকেও রিওয়ায়ত বলা হয়। যেমন, এই কথার সমর্থনে একটি রিওয়ায়ত (হাদীস) আছে
সনদঃ হাদীসের মূল কথাটুকু যে সুত্র পরম্পরায় গ্রন্থ সংকলনকারী পর্যন্ত পৌঁছেছে তাঁকে সনদ বলা হয়। এতে হাদীসের বর্ণনাকারীদের নাম একের পর এক সজ্জিত থাকে।
মতনঃ হাদীসের মূল কথা ও তাঁর শব্দ সমষ্টিকে মতন বলে।
মারফূঃ যে হাদীসের সনদ (বর্ণনা পরম্পরা) রাসূলুল্লাহ (সঃ) পর্যন্ত পৌঁছেছে, তাঁকে মারুফূ হাদীস বলে।
মাওকূফঃ যে হাদীসের বর্ণনা-সূত্র ঊর্ধ্ব দিকে সাহাবী পর্যন্ত পৌঁছেছে, অর্থাৎ যে সনদ-সূত্রে কোন সাহাবীর কথা বা কাজ বা অনুমোদন বর্ণিত হয়েছে তাঁকে মাওকূফ হাদীস বলে। এর অপর না আসার।
মাকতূঃ যে হাদীসের সনদ কোন তাবিঈ পর্যন্ত পৌঁছেছে, তাঁকে মাকতূ হাদীস বলা হয়।
তা’লীকঃ কোন কোন গ্রন্থকার কোন হাদীসের পূর্ণ সনদকে বাদ দিয়ে কেবল মূল হাদীস বর্ণনা করেছেন। এরূপ করাকে তা’লীক বলা হয়। কখনো কখনো তা’লীকরূপে বর্ণিত হাদীসকেও তা’লীক বলে। ইমাম বুখারী (রঃ)-এর সহীহ গ্রন্থে এরূপ বহু তা’লীক রয়েছে। কিন্তু অনুসন্ধানে দেখা গিয়েছে যে, বুখারীর সমস্ত তা’লীকেরই মুত্তাসিল সনদ রয়েছে। অনেক সংকলনকারী এই সমস্ত তা’লীক হাদীস মুত্তাসিল সনদে বর্ণনা করেছেন।
মুদাল্লাসঃ যে হাদীসের রাবী নিজেই প্রকৃত শায়খের (উসতাদের) নাম উল্লেখ না করে তাঁর উপরস্থ শায়খের নামে এভাবে হাদীস বর্ণনা করেছেন যাতে মনে হয় যে, তিনি নিজেই উপরস্থ শায়খের নিকট তা শুনেছেন অথচ তিনি তাঁর নিকট হাদীস শুনেন নি, সে হাদীসকে মুদাল্লাস হাদীস এবং এইরূপ করাকে ‘তাদলিস’, আর যিনি এইরূপ করেন তাঁকে মুদাল্লিস বলা হয়। মুদাল্লিসের হাদীস গ্রহণযোগ্য নয়, যে পর্যন্ত না একথা নিশ্চিতরূপে জানা যায় যে, তিনি একমাত্র ছিকাহ রাবী থেকেই তাদলীস করেন অথবা তিনি আপন শায়খের নিকট শুনেছেন বলে পরিষ্কারভাবে উল্লেখ করেন।
মুযতারাবঃ যে হাদীসের রাবী হাদীসের মতন বা সনদকে বিভিন্ন প্রকারে বর্ণনা করেছেন সে হাদীসকে হাদীসে মুযতারাব বলা হয়। যে পর্যন্ত না এর কোনরূপ সমন্বয় সাধন সম্ভভপর হয়, সে পর্যন্ত এই সম্পর্কে অপেক্ষা করতে হবে। অর্থাৎ এই ধরনের রিওয়ায়াত প্রমাণ হিসেবে ব্যাবহার করা যাবে না।
মুদরাজঃ যে হাদীসের মধ্যে রাবী নিজের অথবা অপরের উক্তিকে অনুপ্রবেশ করিয়েছেন, সে হাদীসকে মুদরাজ এবং এইরূপ করাকে ‘ইদরাজ’ বলা হয়। ইদরাজ হারাম। অবশ্য যদি এর দ্বারা কোন শব্দ বা বাক্যের অর্থ প্রকাশিত হয়, তবে দূষণীয় নয়।
মুত্তাসিলঃ যে হাদীসের সনদের ধারাবাহিকতা প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত পূর্ণরূপে রক্ষিত আছে, কোন স্তরেই কোন রাবীর নাম বাদ পড়েনি তাঁকে মুত্তাসিল হাদীস বলে।
মুনকাতিঃ যে হাদীসের সনদের ধারাবাহিকতা রক্ষিত হয়নি, মাঝখানে কোন এক স্তরে কোন রাবীর নাম বাদ পড়েছে, তাঁকে মুনকাতি হাদীস, আর এই বাদ পরাকে ইনকিতা বলা হয়।
মুরসালঃ যে হাদীসের সনদের ইনকিতা শেষের দিকে হয়েছে, অর্থাৎ সাহাবীর নাম বাদ পড়েছে এবং তাবীঈ সরাসরি রাসুলুল্লাহ (সঃ)-এর উল্লেখ করে হাদীস বর্ণনা করেছেন তাঁকে মুরসাল হাদীস বলা হয়।
মুতাবি ও শাহিদঃ এক রাবীর হাদীসের অনুরূপ যদি অপর রাবীর কোন হাদীস পাওয়া যায় তবে দ্বিতীয় রাবীর হাদীসকে প্রথম রাবীর হাদীসের প্রথম রাবীর হাদীসের মুতাবি বলা হয়। যদি উভয় হাদীসের মূল রাবী অর্থাৎ সাহাবী একই ব্যাক্তি হন। তবে এইরূপ হওয়াকে মুতাবা’আত বলে। যদি মূল রাবী একই ব্যাক্তি না হন তবে দ্বিতীয় ব্যাক্তির হাদীসকে শাহিদ বলে। আর এইরূপ হওয়াকে শাহদত বলে। মুতাবা’আত ও শাহাদত দ্বারা প্রথম হাদীসটির শক্তি বৃদ্ধি পায়।
মু’আল্লাকঃ সনদের ইনকিতা প্রথম দিকে হলে, অর্থাৎ সাহাবীর পর এক বা একাধিক রাবীর নাম বাদ পড়লে তাঁকে মু’আল্লাক হাদীস বলা হয়।
মা’রুফ ও মুনকারঃ কোন কোন রাবীর বর্ণিত হাদীস অপর কোন মকবুল (গ্রহণযোগ্য) রাবীর বর্ণিত হাদীসের বিরোধী হলে তাঁকে মুনকার বলা হয় এবং মকবুল রাবীর হাদীসকে মা’রুফ বলা হয়। মুনকার হাদীস গ্রহণযোগ্য নয়।
------
সাহীহঃ যে মুত্তাসিল হাদীসের সনদে উল্লেখিত প্রত্যেক রাবীই পূর্ণ আদালত ও যাবতা-গুণ সম্পন্ন এবং হাদীসটি যাবতীয় দোষত্রুটি মুক্ত তাঁকে সাহীহ হাদীস বলা হয়।
হাসানঃ যে হাদীসের কোন রাবীর যারতগুণে পরিপূর্ণতার অভাব রয়েছে তাঁকে হাসান হাদীস বলা হয়। ফিকহবিদগণ সাধারনত সহীহ ও হাসান হাদীসের ভিত্তিতে শরী’আতের বিধান নির্ধারণ করেন।
যঈফঃ যে হাদীসের রাবী কোন হাসান হাদীসের রাবীর গুণসম্পন্ন নন তাঁকে যঈফ হাদীস বলে। রাবীর দুর্বলতার কারণেই হাদীসকে দুর্বল বলা হয়, অন্যথায় নবী করীম (সঃ)-এর কোন কথাই যঈফ নন।
মাওযূঃ যে হাদীসের রাবী জীবনে কখনও ইচ্ছাকৃতভাবে রাসুলুল্লাহ (সঃ)-এর নামে মিথ্যা কথা রটনা করেছে বলে প্রমাণিত হয়েছে, তাঁর বর্ণিত হাদিসকে মাওযূ হাদীস বলে। এরূপ ব্যাক্তির বর্ণিত হাদীস গ্রহণযোগ্য নয়।
মাতরুকঃ যে হাদীসের রাবী হাদীসের ক্ষেত্রে নয় বরং সাধারণ কাজে-কর্মে মিথ্যার আশ্রয় গ্রহণ করে বলে খ্যাত, তাঁর বর্ণিত হাদীসকে মাতরুক হাদীস বলা হয়। এরূপ ব্যাক্তির বর্ণিত হাদীসও পরিত্যাজ্য।
মুবহামঃ যে হাদীসের রাবীর উত্তমরূপে পরিচয় পাওয়া যায় নি, যার ভিত্তিতে তাঁর দোষগুণ বিচার করা যেতে পারে, এরূপ রাবীর বর্ণিত হাদীসকে মুবহাম হাদীস বলে । এই ব্যাক্তি সাহাবী না হলে তাঁর হাদীসও গ্রহণযোগ্য নয়।
মুতাওয়াতিরঃ যে সহীহ হাদীস প্রত্যেক যুগে এত অধিক লোক রিওয়ায়াত করেছেন যাঁদের পক্ষে মিথ্যার জন্য দলবদ্ধ হওয়া সাধারণত অসম্ভব তাঁকে মুতাওয়াতির হাদিস বলে। এ ধরনের হাদীস দ্বারা নিশ্চিত জ্ঞ্যান লাভ হয়।
খবরে ওয়াহিদঃ প্রত্যেক যুগে এক, দুই অথবা তিনজন রাবী কর্তৃক বর্ণিত হাদীসকে খবরে ওয়াহিদ বা আখবারুল আহাদ বলা হয়।
এই হাদীস তিন প্রকারঃ
মাশহূরঃ যে সহীহ হাদীস প্রত্যেক যুগে অন্ততপক্ষে তিনজন রাবী বর্ণনা করেছেন তাঁকে মাশহূর হাদীস বলা হয়।
আযীযঃ যে সহীহ হাদীস প্রত্যেক যুগে অন্ততপক্ষে দুইজন রাবী বর্ণনা করেছেন তাঁকে আযীয বলা হয়।
গরীবঃ যে সহীহ হাদীস কোন যুগে মাত্রও একজন রাবী বর্ণনা করেছেন তাঁকে গরীব হাদীস বলা হয়।
হাদীসে কুদসীঃ এ ধরনের হাদীসের মূলকথা সরাসরি আল্লাহ্র নিকট থেকে প্রাপ্ত এবং আল্লাহ্র সাথে সম্পর্কিত করে যেমন আল্লাহ্ তাঁর নবী (সঃ)-কে ইলহাম কিংবা সপ্নযোগে অথবা জিবরাঈল (আঃ)-এর মাধ্যমে তা জানিয়ে দিয়েছেন, মহানবী (সঃ) তা নিজ ভাষায় বর্ণনা করেছেন।
মুত্তাফাক আলায়হঃ যে হাদীস একই সাহাবী থেকে ইমাম বুখারী ও ইমাম মুসলিম (রঃ) উভয়ে গ্রহণ করেছেন, তাঁকে মুত্তাফাক আলায়হ হাদীস বলে।
আদালতঃ যে সুদৃঢ় শক্তি মানুষকে তাকওয়া ও শিষ্টাচার অবলম্বনে এবং মিথ্যা আচরণ থেকে বিরত থাকতে উদ্বুদ্ধ করে তাঁকে আদালত বলে। এখানে তাকওয়া বলতে অশোভনীয় ও অভদ্রোচিত কার্য থেকে বিরত থাকা, যেমন হাট-বাজারে বা প্রকাশ্যে পানাহার করা বা রাস্তা-ঘাটে পেশাব-পায়খানা করা ইত্যাদি থেকে বিরত থাকাও বোঝায়।
যাবতঃ যে স্মৃতিশক্তি দ্বারা মানুষ শ্রুত বা লিখিত বিষয়কে বিস্মৃতি বা বিনাশ থেকে রক্ষা করতে সক্ষম হয় এবং যখন ইচ্ছা তা সঠিকভাবে স্মরণ করতে পারে তাঁকে যাবত বলা হয়।
ছিকাহঃ যে রাবীর মধ্যে আদালত ও যাবত উভয় গুণ পূর্ণভাবে বিদ্যমান, তাঁকে ছিকাহ ছাবিত বা ছাবাত বলা হয়।
হাদীস গ্রন্থসমূহের শ্রেণীবিভাগ
হাদীস গ্রন্থ প্রনয়নের বিভিন্ন ধরন ও পদ্ধতি রয়েছে। এসব গ্রন্থের নামও বিভিন্ন ধরনের। নিম্নে এর কতিপয় প্রসিদ্ধ পদ্ধতির নাম উল্লেখ করা হলঃ
১। আল-জামিঃ
যে সব হাদিসগ্রন্থে (১) আকীদা-বিশ্বাস (২) আহকাম ( শরিয়াতের আদেশ-নিষেধ) ৩) আখলাক ও আদব (৪) কুরআনের তাফসীর (৫) সীরাত ও ইতিহাস (৬) ফিতনা ও আশরাত অর্থাৎ বিশৃঙ্খলা ও আলামতে কিয়ামত (৭) রিকাক অর্থাৎ আত্নশুদ্ধি (৮) মানাকিব অর্থাৎ ফযিলত ইত্যাদি সকল প্রকারের হাদীস বিভিন্ন অধ্যায়ে সন্নিবেশিত হয়, তাঁকে আল-জামি বলা হয়। সাহীহ বুখারী ও জামি তিরমিযী এর অন্তর্ভুক্ত।
সহীহ মুসলিমে যেহেতু তাফসীর ও কিরাআতের সংক্রান্ত হাদীস খুবই কম, তাই কোন কোন হাদীসবিশারদের মতে তা জামি শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত নয়।
২। আস-সুনানঃ
যেসব হাদীসগ্রন্থে কেবল মাত্র শরী’আতের হুকুম-আহকাম ও ব্যাবহারিক জীবনের জন্য প্রয়োজনীয় নিয়ম-নীতি ও আদেশ-নিষেধমূলক হাদিস একত্রিত করা হয় এবং ফিকহ গ্রন্থের ন্যায় বিভিন্ন অধ্যায় ও অনুচ্ছেদ সজ্জিত হয় তাঁকে সুনান বলে।
যেমন- সুনান আবূ দাঊদ, সুনান নাসাঈ, সুনান ইবন মাজা ইত্যাদি। তিরমিযী শরীফও এই হিসেব সুনান গ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত।
৩। আল-মুসনাদঃ
যে সব হাদীসগ্রন্থে সাহাবীগণের বর্ণিত হাদীসসমূহ তাঁদের নামের আদ্যাক্ষর অনুযায়ী অথবা তাঁদের মর্যাদা অনুযায়ী পরপর সংকলিত হয়, ফিকাহের পধতিতে সংকলিত হয় না তাঁকে আল-মুসনাদ বা আল-মাসানীদ বলা হয়। যেমন- হযরত আয়িশা (রঃ)কর্তৃক বর্ণিত সমস্ত হাদিস তাঁর নামের শিরোনামের অধীনে একত্রিত করা হলে। ইমাম আহমদ (রঃ)-এর আল-মুসনাদ গ্রন্থ, মুসনাদ আবূ দাঊদ তা’য়ালিসী (রঃ) ইত্যাদি এই শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত।
৪। আল-মু’জামঃ
যে হাদীসগ্রন্থে মুসনাদ গ্রন্থের পদ্ধতিতে এক একজন উস্তাদের নিকট থেকে প্রাপ্ত হাদীসসমুহের পর্যায়ক্রমে একত্রে সন্নিবেশ করা হয় তাঁকে আল-মু’জাম বলে। যেমন- ইমাম তাবারানী (রঃ) সংকলিত আল- মু’জামুল কবীর।
৫। আল-মুসতাদরাকঃ
যেসব হাদীস বিশেষ কোন হাদীসগ্রন্থে শামিল করা হয়নি অথচ তা সংশ্লিষ্ট গ্রন্থকারের অনুসৃত শর্তে পূর্ণমাত্রায় উত্তীর্ণ হয়, সে সব হাদীসযে গ্রন্থে সন্নিবেশ করা হয় তাঁকে আল-মুসতাদরাক বলা হয়। যেমন- ইমাম হাকিম নিশাপুরী (রঃ)-এর আল-মুসতাদরাক গ্রন্থ।
৬। রিসালাঃ
যে ক্ষুদ্র কিতাবে মাত্র এক বিষয়ের অথবা এক রাবীর হাদিসসমূহ একত্র করা হয়াছে তাঁকে রিসালা বা জুয বলা হয়।
৭। সিহাহ সিত্তাহঃ
বুখারী, মুসলিম, তিরমিযী, আবূ দাঊদ, নাসাঈ ও ইবন মাজা- এই ছয়টি গ্রন্থকে একত্রে সিহাহ সিত্তাহ বলা হয়। কিন্তু কতিপয় বিশিষ্ট আলিম ইবন মাজার পরিবর্তে ইমাম মালিক (রঃ)-এর মুওয়াত্তাকে, আবার কিছু সংখ্যক আলিম সুনানুদ- দারিমীকে সিহাহ সিত্তার অন্তর্ভুক্ত করেছেন। শায়খ আবুল হাসান সিন্ধী (রঃ) ইমাম তাহাবী (রঃ) সংকলিত মা’আনীল আসার (তাবারী শরীফ) গ্রন্থকে সিহাহ সিত্তার অন্তর্ভুক্ত করেছেন। এমনকি ইবন হাযম ও আল্লামা আনওয়ার শাহ কাশমীরী (রঃ) তাহাবী শরীফকে নাসায়ী ও আবূ দাঊদ শরীফের স্তরে গণ্য করেছেন।
৮। সাহীহায়নঃ
সাহীহ বুখারী ও সাহীহ মুসলিমকে একত্রে সাহীহায়ন বলা হয়।
৯। সুনানে আরবা’আঃ
সিহাহ সিত্তার অপর চারটি গ্রন্থ আবূ দাঊদ, তিরমিযী, নাসাঈ এবং ইবন মাজাকে একত্রে সুনানে আরবা’আ বলা হয়।
হাদীসের কিতাবসমুহের স্তরবিভাগ
হাদীসের কিতাবসমূহকে মোটামুটিভাবে পাঁচটি স্তরে বা তাবাকায় ভাগ করা হয়েছে। শাহ ওয়ালী উল্লাহ মুহাদ্দিস দেহলবী (রঃ) তাঁর ‘হুজ্জাতুল্লাহহিল বালিগা’ নামক কিতাবে এরূপ পাঁচ স্তরে ভাগ করেছেন।
প্রথম স্তর
এ স্তরের কিতাবসমূহের কেবল সাহীহ হাদিসই রয়েছে। এ স্তরের কিতাব মাত্র তিনটিঃ মুওয়াত্তা ইমাম মালিক, বুখারী শরীফ ও মুসলিম শরীফ। সকল হাদীস বিশেষজ্ঞ এ বিষয়ে একমত যে, এ তিনটি কিতাবের সমস্ত হাদীসই নিশ্চিতরূপে সহীহ।
দ্বিতীয় স্তর
এ স্তরের কিতাবসমূহ প্রথম স্তরের খুব কাছাকাছি। এ স্তরের কিতাবে সাধারনতঃ সহীহ ও হাসান হাদীসই রয়েছে। যঈফ হাদীস এতে খুব কম আছে। নাসাঈ শরীফ, আবূ দাঊদ শরীফ ও তিরমিযী শরীফ এ স্তরের কিতাব। সুনান দারিমী, সুনান ইবন মাজা এবং শাহ ও ওয়ালি উল্লাহ (রঃ)-এর মতে মুসনাদ ইমাম আহমেদকেও এ স্তরে শামিল করা যেতে পারে। এই দুই স্তরের কিতাবের উপরই সকল মাজহাবের ফাকীহগণ নির্ভর করে থাকেন।
তৃতীয় স্তর
এ স্তরের কিতাবে সহীহ, হাসান, যঈফ, মা’রুফ ও মুনকার সকল প্রকারের হাদীসই রয়েছে। মুসনাদ আবী ইয়া’লা, মুসনাদ আবদুর রাযযাক, বায়হাকী, তাহাবী ও তাবারানী (রঃ)-এর কিতাবসমূহের এ স্তরেরই অন্তর্ভুক্ত।
চতুর্থ স্তর
হাদীস বিশেষজ্ঞগণের বাছাই ব্যাতিত এ সকল কিতাবের হাদীস গ্রহণ করা হয় না। এ স্তরের কিতাবসমুহে সাধারনতঃ যইফ হাদীসই রয়েছে। ইবন হিব্বানের কিতাবুয যুআফা, ইবনুল-আছীরের কামিল ও খতীব বাগদাদী, আবূ নুআয়ম-এর কিতাবসমূহ এই স্তরের কিতাব।
পঞ্চম স্তর
উপরের স্তরেগুলোতে যে সকল কিতাবের স্থান নেই সে সকল কিতাবই এ স্তরের কিতাব।
সহীহায়নের বাইরেও সহীহ হাদীস রয়েছে
বুখারী ও মুসলিম শরীফ সহীহ হাদীসের কিতাব। কিন্তু সমস্ত সহীহ হাদীসই যে বুখারী ও মুসলিমে রয়েছে তা নয়। ইমাম বুখারী (রঃ) বলেছেনঃ ‘আমি আমার এ কিতাবে সহীহ ব্যাতীত কোন হাদিসকে স্থান দেই নাই এবং বহু সহীহ হাদীসকে আমি বাদও দিয়েছি।’
এইরূপে ইমাম মুসলিম (রঃ) বলেনঃ ‘আমি এ কথা বলি না যে, এর বাইরে যে সকল হাদীস রয়েছে সেগুলি সমস্ত যইফ।’ কাজেই এ দুই কিতাবের বাইরেও সহিহ হাদীস ও সহীহ কিতাব রয়েছে। শায়খ আবদুল হক মুহাদ্দিস দেহলবীর (রঃ) মতে সিহাহ সিত্তাহ, মুওয়াত্তা ইমাম মালিক ও সুনান দারিমী ব্যাতীত নিম্নোক্ত কিতাবসমূহও সহীহ (যদিও বুখারী ও মুসলিমের পর্যায়ের নয়)।
১. সহীহ ইবন খুযায়মা - আবূ আবদুল্লাহ মুহাম্মাদ ইবন ইসহাক (৩১১ হি.)
২. সহীহ ইবন হিব্বান - আবূ হাতিম মুহাম্মাদ ইবন হিব্বান (৩৫৪ হি.)
৩. আল-মুসতাদরাক – হাকিম-আবূ আবদুল্লাহ নিশাপুরী (৪০২ হি.)
৪. আল-মুখতারা – যিয়াউদ্দীন আল-মাকদিসী (৭০৪ হি.)
৫. সহীহ আবূ আ’ওয়ানা – ইয়াকুব ইবন ইসহাক (৩১১ হি.)
৬. আল-মুনতাকা – ইবনুল জারুদ আবদুল্লাহ ইবন আলী।
এতদ্ব্যতীত মুহাম্মদ ইবন মুহাম্মদ রাজা সিন্ধি (২৮৬হি) এবং ইবন হাযম জাহিরীর (৪৫৬ হি)-ও এক একটি সহীহ কিতাব রয়েছে বলে কোন কোন কিতাবে উল্লেখ দেখা যায়। কিন্তু পরবর্তী মুহাদ্দিসগণ এগুলিকে সহীহ বলে গ্রহণ করেছেন কি না বা কোথাও এগুলির পাণ্ডুলিপি বিদ্যমান আছে কি না তা জানা যায় নাই
হাদীসের সংখ্যা
হাদীসের মূল কিতাবসমূহের মধ্যে ঈমান আহমদ ইবন হাম্বলের মুসনাদ একটি বৃহৎ কিতাব। এতে ৭ শত সাহাবী কর্তৃক বর্ণিত পুনরুল্লেখ (তাকরার) সহ মোট ৪০ হাজার এবং ‘তাকরার’ বাদ ৩০ হাজার হাদীস রয়েছে। শায়খ আলী মুত্তাকী জৌনপুরীর মুনতাখাবু কানযিল উমমাল-এ ৩০ হাজার এবং মূল কানযূল উমমাল-এ (তাকরার বাদ) মোট ৩২ হাজার হাদীস রয়েছে। অথচ এই কিতাব বহু মূল কিতাবের সমষ্টি। একমাত্র হাসান আহমদ সমরকান্দীর ‘বাহরুল আসানীদ’ কিতাবেই এক লক্ষ হাদিস রয়েছে বলে বর্ণিত আছে। মোট হাদিসের সংখ্যা সাহাবা ও তাবিঈনের আসারসহ সর্বমোট এক লক্ষের অধিক নয় বলে মনে হয়। এর মধ্যে সহীহ হাদীসের সংখ্যা আরও কম। হাকিম আবূ আবদুল্লাহ নিশাপুরীর মতে প্রথম শ্রেণীর সহীহ হাদীসের সংখ্যা ১০ হাজারেরও কম। সিহাহ সিত্তায় মাত্র পৌনে ছয় হাজার হাদীস রয়েছে। এর মধ্যে ২৩২৬ টি হাদীস মুত্তাফাকু আলায়হি। তবে যে বলা হয়ে থাকেঃ হাদিসের বড় বড় ইমামের লক্ষ লক্ষ হাদিস জানা ছিল, তাঁর অর্থ এই যে, অধিকাংশ হাদীসের বিভিন্ন সনদ রয়েছে। (এমনকি শুধু নিয়্যাত সম্পর্কীয় হাদিসটিরই ৭ শতের মত সনদ রয়েছে- তাদবীন, ৫৪ পৃ) অথচ আমাদের মুহাদ্দিসগণ যে হাদিসের যতটি সনদ রয়েছে সেটিকে তত সংখ্যক হাদিস বলে গণ্য করেন।
হাদীসের সংকলন ও তাঁর প্রচার
সাহাবায়ে কিরাম (রঃ) মহানবী (সঃ)-এর প্রতিটি কথা মনোযোগ দিয়ে শুনতেন এবং তাঁর প্রতিটি কাজ ও আচরণ সুক্ষ দৃষ্টিতে লক্ষ করতেন। রাসুলুল্লাহ (সঃ) সাহাবীগণকে ইসলামের আদর্শ ও এর যাবতীয় নির্দেশ যেমন মেনে চলার হুকুম দিতেন, তেমনি তা স্মরণ রাখতেন এবং অনাগত মানব জাতির কাছে পৌঁছে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। হাদীস চর্চাকারীর জন্য তিনি নিম্নোক্ত দু’আ করেছেনঃ
“ আল্লাহ সেই ব্যাক্তিকে সজীব ও আলোকোজ্জ্বল করে রাখুন, যে আমার কথা শুনে স্মৃতিতে ধরে রাখল, তাঁর পূর্ণ হিফাযত করল এবং এমন লোকের কাছে পৌঁছে দিল, যে তা শুনতে পায়নি।”( তিরমিযী, ২য় খণ্ড, পৃ ৯০)
মহানবী (সঃ) আবদুল কায়েস গোত্রের প্রতিনিধি দলকে প্রয়োজনীয় উপদেশ দান করে বললেনঃ “এই কথাগুলো তোমরা পুরোপুরি স্মরণ রাখবে এবং যারা তোমাদের পেছনে রয়েছে তাঁদের কাছেয় পৌঁছে দেবে”(বুখারী)। তিনি সাহাবীগণকে সম্বোধন করে বলেছেনঃ “ আজ তোমরা (আমার নিকট দীনের কথা) শুনেছ, তোমাদের নিকট থেকেও (তা) শুনা হবে” – (মুসতাদরাক হাকিম, ১ খ, পৃ ৯৫)।
তিনি আরও বলেনঃ “আমার পরে লোকেরা তোমাদের নিকট হাদীস শুনতে চাইবে)। তাঁরা এই উদ্দেশ্যে তোমাদের নিকট এলে তাঁদের প্রতি সদয় হয়ো এবং তাঁদের নিকট হাদীস বর্ণনা করো।” (মুসনাদ আহমদ)। তিনি অন্যত্র বলেছেনঃ “আমার নিকট থেকে একটি বাক্য হলেও তা অন্যের কাছে পৌঁছে দাও।” (বুখারী) ৮ম হিজরীতে মক্কা বিজয়ের পরের দিন এবং ১০ম হিজরীতে বিদায় হজ্জের ভাষণে মহানবী (সঃ) বলেনঃ “ উপস্থিত লোকেরা যেন অনুপস্থিতদের নিকট আমার কথাগুলো পৌঁছে দেয়।” (বুখারী)
রাসুলুল্লাহ (সঃ)-এর উল্লেখিত বাণীর গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে তাঁর সাহাবীগণ হাদীস সংরক্ষনে উদ্যোগী হন। প্রধানত তিনটি শক্তিশালী উপায়ে মহানবী (সঃ)- এর হাদীস সংরক্ষিত হয়ঃ
(১) উম্মতের নিয়মিত আমল,
(২) রাসুলুল্লাহ (সঃ)-এর লিখিত ফরমান, সাহাবীদের নিকট লিখিত আকারে সংরক্ষিত হাদীস ও পুস্তিকা এবং
(৩) হাদীস মুখস্থ করে স্মৃতির ভাণ্ডারে সঞ্চিত রাখা, তারঃপর বর্ণনা ও শিক্ষাদানের মাধ্যমে লোক পরম্পরায় তাঁর প্রচার।
তদানীন্তন আরবদের স্মরণশক্তি অসাধারণভাবে প্রখর ছিল। কোন কিছু স্মৃতিতে ধরে রাখবার জন্য একবার শ্রবণই তাঁদের জন্য যথেষ্ট ছিল। স্মরণশক্তির সাহায্যে আরববাসীরা হাজার বছর ধরে তাঁদের জাতীয় ঐতিহ্যকে সংরক্ষণ করে আসছিল। হাদীস সংরক্ষণের ক্ষেত্রে প্রাথমিক উপায় হিসেবে এই মাধ্যমটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। মহানবী (সঃ) যখনই কোন কথা বলতেন, উপস্থিত সাহাবীগণ পূর্ণ আগ্রহ ও আন্তরিকতা সহকারে তা শুনতেন, অতঃপর মুখস্থ করে নিতেন। তদানীন্তন মুসলিম সমাজে প্রায় এক লক্ষ লোক রাসুলুল্লাহ (সঃ)-এর বানী ও কাজের বিবরণ সংরক্ষণ করেছেন এবং স্মৃতিপটে ধরে রেখেছেন। আবদুল্লাহ ইবন আব্বাস (রঃ) বলেন, “আমরা রাসুলুল্লাহ (সঃ)-এর হাদীস মুখস্থ করতাম।” (সহীহ মুসলিম, ভূমিকা, পৃ ১০)
উম্মতের নিরবচ্ছিন্ন আমল, পারম্পারিক পর্যালোচনা, শিক্ষাদানের মাধ্যমেও হাদীস সংরক্ষিত হয়। রাসুলুল্লাহ (সঃ) যে নির্দেশই দিতেন, সাহাবীগণ সাথে সাথে তা কার্যে পরিণত করতেন। তাঁরা মসজিদ অথবা কোন নির্দিষ্ট স্থানে একত্র হতেন এবং হাদীস আলোচনা করতেন। আনাস ইবন মালিক (রঃ) বলেন, “আমার মহানবী (সঃ)-এর নিকট হাদীস শুনতাম। তিনি যখন মজলিশ থেকে উঠে চলে যেতেন, আমরা শ্রুত হাদীসগুলো পরস্পর পুনরাবৃত্তি ও পর্যালোচনা করতাম। আমাদের এক একজন করে সবাই হাদীসগুলো মুখস্থ শুনিয়ে দিতেন। এ ধরনের প্রায় বৈঠকেই অন্তত ষাট-সত্তরজন লোক উপস্থিত থাকতেন। বৈঠক থেকে আমরা যখন উঠে যেতাম তখন আমাদের প্রত্যেকেরই সবকিছু মুখস্থ হয়ে যেত”- (আল-মাজমাউয-যাওয়াইদ, ১খ, পৃ ১৬১)
মসজিদে নববীকে কেন্দ্র করে স্বয়ং নবী করীম (সঃ)-এর জীবদ্দশায় যে শিক্ষায়তন গড়ে উঠেছিল সেখানে একদল বিশিষ্ট সাহাবী ( আহলুস সুফফা) সার্বক্ষণিকভাবে কুরআন-হাদীস শিক্ষায় রত থাকতেন। হাদীস সংরক্ষণের জন্য যথাসময়ে যথেষ্ট পরিমাণে লেখনী শক্তিরও সাহায্য নেয়া হয়। প্রাথমিক পর্যায়ে কুরআন মজীদ ব্যাতিত সাধারণতঃ অন্য কিছু লিখে রাখা হত না। পরবর্তীকালে হাদীসের বিরাট সম্পদ লিপিবদ্ধ হতে থাকে। ‘হাদীস নবী করীম (সঃ)-এর জীবদ্দশায় লিপিবিদ্ধ হয়নি, বরং তাঁর ইন্তেকালের শতাব্দী কাল পর লিপিবদ্ধ হয়েছে’ বলে যে ভুল ধারনা প্রচলিত আছে তাঁর আদৌ কোন ভিত্তি নেই। অবশ্য একথা ঠিক যে, কুরআনের সঙ্গে হাদীস মিশ্রিত হয়ে জটিল পরিস্থিতির উদ্ভব হতে পারে- কেবল এই আশংকায় ইসলামী দাওয়াতের প্রাথমিক পর্যায় রাসুলুল্লাহ (সঃ) বলেছিলেনঃ “আমরা কোন কথাই লিখ না। কুরআন ব্যাতিত আমার নিকট থেকে কেউ অন্য কিছু লিখে থাকলে তা যেন মুছে ফেলে।”(মুসলিম) কিন্তু যেখানে এরূপ বিভ্রান্তির আশংকা ছিল না মহানবী (সঃ) সে সকল ক্ষেত্রে হাদীস লিপিবদ্ধ করে রাখতে বিশেষভাবে উৎসাহিত করেন।
আবদুল্লাহ ইবন আমর (রঃ) রাসুলুল্লাহ (সঃ)-এর নিকট উপস্থিত হয়ে বললেন, “হে আল্লাহ্র রাসূল ! আমি হাদীস বর্ণনা করতে চাই। তাই যদি আপনি অনুমতি দেন, তাহলে আমি স্মরণশক্তির ব্যাবহারের সাথে সাথে লেখনীরও সাহায্য গ্রহণ করতে ইচ্ছুক।” তিনি বললেনঃ “আমার হাদীস কণ্ঠস্থ করার সাথে সাথে লিখেও রাখতে পার”(দারামী)। আবদুল্লাহ ইবন আমর (রঃ) আরও বলেন, “আমি রাসুলুল্লাহ (সঃ)-এর নিকট যা কিছু শুনতাম, মনে রাখার জন্য তা লিখে নিতাম। কতিপয় সাহাবী আমাকে তা লিখে রাখতে নিষেধ করলেন এবং বললেন, রাসুলুল্লাহ (সঃ) একজন মানুষ, কখনও স্বাভাবিক অবস্থায় আবার কখনও রাগান্বিত অবস্থায় কথা বলেন।” এ কথা বলার পর আমি হাদীস লেখা থেকে বিরত থাকলাম, অতঃপর তা রাসুলুল্লাহ (সঃ)-কে জানালাম। তিনি নিজ হাতের আঙ্গুলের সাহায্যে স্বীয় মুখের দিকেইঙ্গিত করে বললেনঃ “ তুমি লিখে রাখ। যেই সত্তার কসম, যার হাতে আমার প্রান, এই মুখ দিয়ে সত্য ছাড়া অন্য কিছু বের হয় না” (আবূ দাঊদ, মুসনাদ আহমেদ, দারমী, হাকিম, বায়হাকী)। তাঁর সংকলনের নাম ছিল ‘সাহীফায়ে সাদিকা’ । এ সম্পর্কে তিনি বলেন, “সাদিকা হাদীসের একটি সংকলন – যা আমি নবী (সঃ)এর নিকট শুনেছি” –(উলূমুল হাদীস, পৃ ৪৫)। এই সংকলনের এক হাজার হাদিস লিপিবদ্ধ ছিল।
আবু হুরায়রা (রঃ) বলেন, এক আনসারী সাহাবী রাসুলুল্লাহ (সঃ)-এর কাছে আরয করেলেন, হে আল্লাহ্র রাসুল ! আপনি যা কিছু বলেন, আমার কাছে খুবই ভালো লাগে, কিন্তু মনে রাখতে পারি না। নবী করীম (সঃ) বললেনঃ “ তুমি ডান হাতের সাহায্য নাও।” তারপর তিনি হাত এর ইশারায় লিখে রাখার প্রতি ইঙ্গিত করলেন- (তিরমিযী)
আবূ হুরায়রা (রঃ) বলেন, মক্কা বিজয়ের দিন রাসুলুল্লাহ (সঃ) ভাষণ দিলেন। আবূ শাহ ইয়ামানী (রঃ) আরয করলেন, হে আল্লাহ্র রাসূল ! এ ভাষণ আমাকে লিখে দিন। নবী করীম (সঃ) ভাষণটি তাঁকে লিখে দেওয়ার নির্দেশ দেন-(বুখারী, তিরমিযী, মুসনাদে আহমদ)।
হাসান ইবন মুনাব্বিহ (রঃ) বলেন, আবূ হুরায়রা (রঃ) আমাকে বিপুল সংখ্যক কিতাব (পাণ্ডুলিপি) দেখালেন। তাতে রাসুলুল্লাহ (সঃ)-এর হাদীস লিপিবদ্ধ ছিল ( ফাতহুল বারী)। আবূ হুরায়রা (রঃ)-র সংকলনের একটি কপি ( ইমাম ইবন তাইমিয়ার হস্তলিখিত) দামেশক এবং বার্লিনের লাইব্রেরিতে সংরক্ষিত আছে।
আনাস ইবন মালিক (রঃ) তাঁর (স্বহস্ত লিখিত) সংকলন বের করে ছাত্রদের দেখিয়ে বলেন, আমি এসব হাদীস নবী করীম (সঃ)-এর নিকট শুনে লিখে নিয়েছি। পরে তাঁকে তা পড়ে শুনিয়েছি (মুসতাদরাক হাকিম,৩য় খ, পৃ ৫৭৩)
রাফি’ ইবন খাদীজা (রঃ)-কে স্বয়ং রাসুলুল্লাহ (সঃ) হাদীস লিখে রাখার অনুমুতি দেন। তিনি প্রচুর হাদীস লিখে রাখেন (মুসনাদে আহমেদ)।
আলী ইবন আবূ তালিব (রঃ)-ও হাদীস লিখে রাখতেন। চামড়ার থলের মধ্যে রক্ষিত সঙ্কলনটি তাঁর সঙ্গেই থাকত। তিনি বলতেন, আমি রাসুলুল্লাহ (সঃ)-এর নিকট থেকে এ সহীফা ও কুরআন মজীদ ব্যাতিত আর কিছু লিখিনি। সংকলনটি স্বয়ং রাসুলুল্লাহ (সঃ) লিখিয়ে ছিলেন। এতে যাকাত, রক্তপাত(দিয়াত), বন্দীমুক্তি, মদীনার হেরেম এবং আরও অনেক বিষয় সম্পর্কিত বিধান উল্লেখ ছিল (বুখারী, ফাতহুল বারী)। আবদুল্লাহ ইবন মাসঊদ (রঃ)-এর পুত্র আবদুর রহমান একটি পাণ্ডুলিপি নিয়ে এসে শপথ করে বললেন, এটা ইবন মাসঊদ (রঃ)-এর সহস্তে লিখিত (জামি’বায়নিল ইলম, ১খ, পৃ ১৭)।
স্বয়ং নবী করীম (সঃ) হিজরত করে মদীনায় পৌঁছে বিভিন্ন জাতির সমন্বয়ে যে চুক্তিপত্র সম্পাদন করেন (যা মদীনার সনদ নামে খ্যাত), হুদায়বিয়ার প্রান্তরে মক্কার মুশারিকদের সাথে সন্ধি করেন, বিভিন্ন সুময়ে যে ফরমান জারি করেন, বিভিন্ন গোত্র-প্রধান ও রাজন্যবর্গের কাছে ইসলামের যে দাওয়াতনামা প্রেরন করেন এবং বিভিন্ন ব্যাক্তি ও গোত্রকে যেসব জমি, খনি ও কুপ দান করেন তা সবই লিপিবদ্ধ আকারে ছিল এবং তা সবই হাদীসরূপে গণ্য।
এসব ঘটনা থেকে পরিষ্কারভাবে প্রমানিত হয় যে, নবী (সঃ)-এর সময় থেকেই হাদীস লেখার কাজ শুরু হয়। তাঁর দরবারে বহু সংখ্যক লেখক সাহাবী সব সময় উপস্থিত থাকতেন এবং তাঁর মুখে যে কথাই শুনতেন, তা লিখে নিতেন। রাসুলুল্লাহ (সঃ)-এর আমলে অনেক সাহাবীর নিকট স্বহস্তে লিখিত সংকলন বর্তমান ছিল। উদাহরণস্বরূপ আবদুল্লাহ ইবন আমর (রঃ)-এর সাহীফায়ে সাদিকা, আবূ হুরায়রা (রঃ)-র সংকলিত সমাধিক খ্যাত।
সাহাবীগণ যেভাবেই রাসুলুল্লাহ (সঃ)-এর নিকট থেকে হাদীসের জ্ঞান লাভ করেন। তেমনিভাবে হাজার হাজার তাবিঈ সাহাবীগণের কাছে হাদীসের শিক্ষা লাভ করেন। একমাত্র আবূ হুরায়রা (রঃ)-এর নিকট আটশত তাবিঈ হাদীস শিক্ষা করেন। সাঈদ ইবনুল মুসাইয়াব, উরওয়া ইবনু জুবাইর, ইমাম যুহরী, হাসান বসরী, ইবন সিরীন, নাফি, ইমাম যয়নুল আবেদীন, মুজাহিদ, কাযী শুরাইহ, মাসরূহ, মাকহুল, ইকরিমা, আতা, কাতাদা, ইমাম শা’বী, আলকামা, ইবরাহীম নাখঈ (রঃ) প্রমুখ প্রবীণ তাবিঈর প্রায় সকলে ১০ম হিজরীর পর জন্মগ্রহন করেন এবং ১৪৮ হিজরীর মধ্যে ইন্তিকাল করেন। অন্যদিকে সাহাবীগণ ১১০ হিজরীর মধ্যে ইন্তিকাল করেন। এদিক থেকে বিচার করলে দেখা যায়, তাবিঈগণ সাহাবীগণের দীর্ঘ সহচর্য লাভ করেন। একজন তাবিঈ বহু সংখ্যক সাহাবীর সঙ্গে সাক্ষাত করে নবী করীম (সঃ)-এর জীবনের ঘটনাবলি, তাঁর বানী, কাজ ও সিদ্ধান্তসমূহ সংগ্রহ করেন এবং তা তাঁদের পরবর্তীগণ অর্থাৎ তাবে-তাবিঈনের নিকট পৌঁছে দেন।
হিজরী দ্বিতীয় শতকের শুরু থকে কনিষ্ঠ তাবিঈ ও তাবিঈ-তাবিঈনের এক বিরাট দল সাহাবা ও প্রবীণ তাবিঈনের বর্ণিত ও লিখিত হাদীসগুলো ব্যাপকভাবে একত্র করতে থাকেন। তাঁরা গোটা মুসলিম জাহানে ছড়িয়ে পড়ে সমগ্র উম্মতের মধ্যে হাদীসর জ্ঞান পরিব্যাপ্ত করে দেন। এ সময় ইসলাম বিশ্বের খলীফা উমর ইবন আবদুল্লাহ আযীয (রঃ) দেশের বিভিন্ন এলাকার প্রশাসকদের নিকট হাদীস সংগ্রহ করার জন্য রাজকীয় ফরমান প্রেরন করেন। ফলে সরকারী উদ্যোগ সংগৃহীত হাদীসের বিভিন্ন সংকলন রাজধানী দামেশক পৌঁছতে থাকে। খলীফা সেগুলর একাধিক পাণ্ডুলিপি তৈরি করে দেশের সর্বত্র পাঠিয়ে দেন। এ কালের ইমাম আবূ হানীফা (রঃ)-এর নেতৃত্বে কূফায় এবং ইমাম মালিক (রঃ) তাঁর মুত্তয়াত্তা গ্রন্থ এবং ইমাম আবূ হানীফার দুই সহচর ইমাম মুহাম্মদ ও আবূ ইউসুফ (রঃ) ইমাম হানীফার রিওয়ায়াতগুলো একত্র করে ‘কিতাবুল আসার’ সংকলন করেন। এ যুগের আরও কয়েকটি উল্লেখযোগ্য হাদীস সংকলন হচ্ছেঃ জামি’ সুফইয়ান সাওরী, জামি’ইবনুল মুবারক, জামি’ইমাম আওযাঈ, জামি’ ইবন জুরাইজ ইত্যাদি।
হিজরী দ্বিতীয় শতকের শেষার্ধ থেকে চতুর্থ শতকের শেষ পর্যন্ত হাদীসের চর্চা আরও ব্যাপকতর হয়। এ সময়কালে হাদীসের প্রসিদ্ধ ইমাম-বুখারী, মুসলিম, আবূ ঈসা তিরমিযী, আবূ দাঊদ সিজিস্তানী, নাসাঈ ও ইবন মাজা (রঃ)-এর আবির্ভাব হয় এবং তাঁদের অক্লান্ত পরিশ্রম ও দীর্ঘ অধ্যবসায়ের ফলশ্রুতিতে সর্বাধিক নির্ভরযোগ্য ছয়খানি হাদীস গ্রন্থ (সিহাহ সিত্তাহ) সংকলিত হয়। এ যুগেই ইমাম শাফিঈ (রঃ) তাঁর কিতাবুল উম্ম ও ইমাম আহমেদ (রঃ) তাঁর আল-মুসনাদ গ্রন্থ সংকলন করেন। হিজরীর চতুর্থ শতকে মুসতাদরাক হাকিম, সুনান দারি কুনতী, সহীহ ইবন হিব্বান, সহীহ ইবন খুযায়মা, তাবারানীর আল-মু’জাম, মুসান্নাফুত-তাহাবী এবং আরও কতিপয় হাদীস গ্রন্থ সংকলিত হয়। ইমাম বায়হাকীর সুনানু কুবরা ৫ম হিজরী শতকে সংকলিত হয়।
চতুর্থ শতকের পর থেকে এ পর্যন্ত সংকলিত হাদীসের মৌলিক গ্রন্থগুলোকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন ধরনের সংকলন ও হাদীসের ভাষ্য গ্রন্থ এবং এই শাস্ত্রের সাখা-প্রশাখার উপর ব্যাপক গবেষণা ও বিভিন্ন গ্রন্থ রচিত হয়। বর্তমান কাল পর্যন্ত এ কাজ অব্যাহত রয়েছে। এসব সংকলের মধ্যে তাজরীদুস সিহাহ ওয়াস সুনান, আত-তারগীব ওয়াত তারহীব, আল-মুহাল্লা, মাসাবীহুস সুন্নাহ, নাইলুল আওতার প্রভৃতি সমাধিক প্রসিদ্ধ।
উপমহাদেশে হাদীস চর্চা
বাংলা-পাক-ভারত উপমহাদেশে মুসলিম বিজয়ের প্রাক্কাল (৭১২ খৃ) থেকেই হাদীস চর্চা শুরু হয় এবং এখানে মুসলিম জনসংখা বৃদ্ধির সাথে সাথে ইসলামী জ্ঞান চর্চা ব্যাপকতর হয়। ইসলামের প্রচারক ও বাণী বাহকগণ উপমহাদেশের সর্বত্র ইসলামী জ্ঞান চর্চার কেন্দ্র গড়ে তোলেন। খ্যাতনামা মুহাদ্দিস শায়ক শরফুদ্দীন আবূ তাওয়ামা (মৃ ৭০০ হি) ৭ম শতকে ঢাকার সোনারগাঁও আগমন করেন এবং কুরআন ও হাদীস চর্চার ব্যাপক ব্যবস্থা করেন। বঙ্গদেশের রাজধানী হিসেবে এখানে অসংখ্য হাদীসবেত্তা সমাবেত হন এবং ইলমে হাদীসের জ্ঞান এতদঞ্চলে ছড়িয়ে দেন। মুসলিম শাসনের শেষ পর্যায় পর্যন্ত এই ধারা অব্যাহত ছিল। বর্তমান কাল পর্যন্ত এ ধারা অব্যাহত রয়েছে। দারুল উলূম দেওবন্দ, মাযাহিরুল উলূম সাহারানপুর, মাদ্রাসা-ই-আলিয়া, ঢাকা, মুঈনুল ইসলাম হাটহাজারী, জামিয়া ইসলামিয়া পটিয়া, জামিয়া কুরআনিয়া আরাবিয়া লালাবাগ প্রভৃতি হাদীস কেন্দ্র বর্তমানে ব্যাপকভাবে হাদীস চর্চা ও গবেষণা করে চলেছে। এভাবে যুগ ও বংশ পরম্পরায় মহানবী (সঃ)-এর হাদীস ভাণ্ডার আমাদের কাছে পৌঁছেছে এবং ইনশাল্লাহ অব্যাহতভাবে তা অনাগত মানব সভ্যতার কাছে পৌঁছতে থাকবে।
বিষয়: বিবিধ
২৮৫৯ বার পঠিত, ১ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন