অনিয়মে ভরা ৭৩ সালে শেখ মুজিবের জাতীয় নির্বাচন!

লিখেছেন লিখেছেন অবুঝ চিন্তাশীল ২২ অক্টোবর, ২০১৯, ০১:৩২:৫৭ রাত

আওয়ামিলীগ যে শুধু ২০১৪ বা ২০১৮ সালে ভুয়া নির্বাচন করে ক্ষমতায় আসে সেটা নয় ১৯৭৩ সালেও স্বাধীনতার পর প্রথম নির্বাচনে ব্যপক অনিয়মের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসে।সেসময় প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বে ছিলেন শেখ মুজিবর রহমান।৭৩ সালের নির্বাচনে আওয়ামিলীগের পরাজিত হবার সম্ভাবনা ছিলনা কিন্তু তারপরও ব্যপক অনিয়ম মাধ্যমে ক্ষমতায় আসে দলটি।অনিয়মের সেই নির্বাচনে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্নকে ধুলিস্যাৎ করে ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার বীজ বপন করে।আজকের রাজনৈতিক সংকটের বীজও তার মধ্য নিহিত ছিল।

স্বাধীনতার পরেই বিরোধীদের ন্যুনতম সহ্য করার সহ্য করার মানসিকতা ছিল না মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দেয়া আওয়ামিলীগের।ভুয়া নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসার প্রচেষ্টা মূলত আওয়ামিলীগের জেনেটিক্যাল ক্যারেক্টার।অদ্ভুতভাবে ২০১৮এর মত ১৯৭৩ সালের নির্বাচনেও বিরোধীরা মাত্র সাতটি আসন পেয়েছিল।

২৩ মার্চের ১৯৭৩ এর নির্বাচনে অনেক প্রার্থীকেই মনোনয়ন দাখিল করতে দেয়নি ক্ষমতাসীন আওয়ামিলীগ নেতারা।অনেককে মনোনয়ন প্রত্যাহারে বাধ্য করা হয়।

মাগুরার সোহরাব হোসেন,ফরিদপুরের কেএম ওবায়দুর রহমান,মোতাহার উদ্দিন আহমেদ বিরোধীপ্রার্থীদের মনোনয়ন জমা দিতে দেননি।

বিরোধী প্রার্থীকে মনোনয়ন জমা দিতে দেননি ভোলার তোফায়েল আহমেদ(বাংলাদরশের রাজনীতি-হালিম দাদ খান,পৃঃ৪৭)

তোফায়েল আহমেদ ৪৫ বছর পর এবারও ভোলার তাঁর আসনের সবগুলো কেন্দ্র দখল করে নেন।

ভোলায় আরেকটি আসনে মনোনয়ন জমা দেয়ার কথা ছিল ডাঃআজহারউদ্দিনের।তিনি ১৯৭০ সালের নির্বাচনে জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন।মনোনয়ন জমা দেয়ার আগে তাঁকে অপহরণ করায় তাঁর মনোনয়ন জমা পড়েনি।ফলে ঐ আসনে আওয়ামিলীগের প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয় লাভ করে(জাসদের উত্থান পতনঃঅস্থির সময়ের রাজনীতি, পৃঃ৯৮)

হালিম দাদ খান তাঁন বইয়ে উল্লেখ করেন 'রাজশাহীর এইচএম কামরুজ্জামান,ময়মনসিংয়ের রফিকউদ্দিন ভূঞা,কিশোরগঞ্জের সৈয়দ নজরুল ইসলাম,জিল্লুর রহমান ও মনোরঞ্জন ধর বিরোধীপ্রার্থীদের মনোনয়ন প্রত্যাহারে বাধ্য করেন।(বাংলাদেশের রাজনীতি-হালিম দাদ খান-পৃঃ৪৭)।

মনোনয়ন প্রত্যাহারে বাধ্য করে এমন দুজন সৈয়দ নজরুল ইসলাম প্রবাসী সরকারের উপ রাষ্ট্রপতি ও কামরুজ্জামান স্বরাষ্ট্র, কৃষি,ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করেন।কিন্তু এ ব্যক্তিরাই যাদেরকে জাতীয় চার নেতা হিসেবে ধরা হয় তারাই প্রার্থীদের ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে মনোনয়ন প্রত্যাহারে বাধ্য করেন।অধ্যাপক আনিসুজ্জামান বলেন "১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত যারা মুক্তিযোদ্ধা ছিল-দেশ স্বাধীন করতে প্রাণ দেয়ার জন্য সদা প্রস্তুত থাকতো তারাই ১৬ডিসেম্বরে লুটপাটকারীতে পরিণত হয়"।খান আতাউর তাঁর 'আবার তোরা মানুষ হ' ছবিতে সে বিষয়টিই দেখিয়েছেন।এ কারণে ছবিটি ব্যান করা হয়।

নির্বাচনে প্রার্থী অলি আহাদ তাঁর বইয়ে লেখেন

"১৯৭৩ এর মার্চের এই সাধারণ নির্বাচনে প্রশাসনিক ক্ষমতার মারাত্মক অব্যবহার,চরম দূর্ণীতির আশ্রয় গ্রহণ,মিডিয়া ক্যু,দলীয় বাহিনীর যথেচ্ছ আগ্রেয়াস্ত্র ব্যবহার ও ঢালাও হুমকির সহায়তায় প্রধানমন্ত্রী........৩০০টি আসনের মধ্যে ২৯২ টি দখল করেন।

আমি যেখানে ২৬ হাজার ভোটের ব্যবধানে নিশ্চিত জয়ের পথে তখন বেতার ও টেলিভিশনের মাধ্যমে আমাকে ১০ হাজার ভোটে পরাজিত ঘোষণা করা হয়(জাতীয় রাজনীতি -অলি আহাদ,পৃঃ৪৬৪)।

ক্ষমতার অব্যবহার করে শুধু অলি আহাদকে জিতেও পরাজিত ঘোষণা নয়,বেসরকারিভাবে বিজয়ী ঘোষণা করা চট্টগ্রামে(২৯৪ নং আসন) ন্যাপের প্রার্থী মোশতাক আহমদ চৌধুরীরিকেও ১০মার্চ বেতারে পরাজিত ঘোষণা করা হয়।

টাঙ্গাইলের মন্ত্রী আবদুল মান্নান ভাসানী ন্যাপের ড.আলীম আল রাজীর কাছে,বরিশালের হরনাথ বাইন ও আবদুল মান্নান জাসদের মেজর জলিলের কাছে(দুটি আসনে),ক্যাপ্টেন সুজাত আলী অধ্যাপক মোজাফর আহমেদের কাছে পরাজিত হয়েও জয়ী হয়েছেন বলে দেশবাসী মনে করে।।শেখ মুজিব পাশের আসন থেকে কম ভোটে জয়ী হলে সেটা মুজিবের জন্য সম্মানহানি হবে মনে করে প্রাপ্ত ভোট ১লাখ ৫হাজার থেকে বাড়িয়ে ১লাখ ১৪ হাজার ঘোষণা করা হয়।(বাংলাদরশের রাজনীতি-হালিম দাদ খান,পৃঃ৪৩)।

খান আতাউর রহমানের মত ব্যক্তিকে হারানোর জন্য সরকার উঠে পড়ে লাগে।সরকারের এমন আচরণে বিষ্ময় প্রকাশ করে আবুল মনসুর আহমেদ বলেন "তাঁর মত ধীরস্থীর অভিজ্ঞ গঠনাত্মক চিন্তাবিদ পার্লামেন্টের অপযিশন বেঞ্চের শুধু শোভা বর্ধনই করেন না,সরকারের গঠনমূলক উপদেশ দিয়া এবং গোটা অপযিশনকে পার্লামেন্টারি রীতি কানুনের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখিয়া পার্লামেন্টারি পদ্ধতিকে সুপ্রতিষ্ঠিত করিয়া থাকেন।এমন একজন ব্যক্তিকে পার্লামেন্টে ঢুকিতে না দিবার সর্বাত্মক চেষ্টা আওয়ামী নেতৃত্ব কেন করিলেন,তা আমি আজও বুঝিতে পারি নাই" (আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর-আবুল মনসুর আহমদ,পৃঃ৬২৮)

নির্বাচনী প্রচার প্রচার প্রচারণা চালাতে বিরোধীদলগুলো তেমন সুবিধা পাননি "রেডিও টেলিভিশনে অপজিশন নেতাদের বক্তৃতা দূরের কথা, যানবাহনের অভাবে তাঁরা ঠিকমত প্রচার চালাইতেও পারিলেন না।পক্ষান্তরে প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিব দেশময় ঘুর্ণিঝড় টুওর করিতে লাগিলেন।মন্ত্রীরাও সরকারি যানবাহনের সুবিধা নিলেন"(আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর-আবুল মনসুর আহমদ পৃঃ৬২৬)।

নির্বাচন পরবর্তী অনিয়ম তুলে ধরে সংবাদ সম্মেলন করে প্রতিবাদ করে বিভিন্ন দল।

"নির্বাচনে স্বচ্ছতা নিয়ে অভিযোগ ছিল কমবেশী সব দলেরই।৯মার্চ সংবাদ সম্মেলনে নির্বাচন পরবর্তী প্রতিক্রিয়া জানায় জাসদ।আসম আবদুর রব একটা লিখিত বিবৃতিতে বলেন,বিরোধী দলের প্রার্থীদের পরাজিত হতে বাধ্য করা হয়েছে।এক প্রশ্নের জবাবে মেজর জলিল বলেন,তাঁর দলকে পোলিং এজেন্ট দিতে দেওয়া হয়নি।জাল ভোট দেয়া হয়েছে,সন্ত্রাস সৃষ্টি করা হয়েছে এবং নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণায় কারচুপি করা হয়েছে"(গণকণ্ঠ, ১০মার্চ১৯৭৩;জাসদের উত্থান পতনঃঅস্থির সময়ের রাজনীতি, পৃঃ৯৯)

১০মার্চ কমিউনিস্ট পার্টি বিবৃতিতে বলেন " কতগুলো আসনে যেখানে আওয়ামীলীগ প্রার্থীরা শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বিতার সম্মুখীন হয়, সেই সকল স্থানে আওয়ামী প্রার্থীদের তরফ হইতে সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনের পরিপন্থী অগণতান্ত্রিক কার্যকলাপ অনুষ্ঠিত হইয়াছে বলিয়া বহু অভিযোগ রহিয়াছে"(সংবাদ, ১১মার্চ ১৯৭৩;জাসদের উত্থান পতনঃঅস্থির সময়ের রাজনীতি, পৃঃ৯৯-১০০)

ন্যাপের সভাপতি অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ ও সম্পাদক পঙ্কজ ভট্টাচার্য ৯মার্চ একটি যৌথ বিবৃতিতে বলেন "কমপক্ষে ৭০টি নির্বাচনী আসনে যেখানে ন্যাপ ও অন্যান্য বিরোধী রাজনৈতিক দলের সুনিশ্চিত বিজয়ের সম্ভাবনা ছিল,সেই আসন সমূহে শাসক দল রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অপব্যবহার,অস্ত্রের ঝনঝনানি,ভয়ভীতি, সন্ত্রাস প্রয়োগ,গুন্ডাবাহিনী ব্যবহার, ভুয়া ভোট, পোলিং বুথ দখল,পোলিং এজেন্ট অপহরণ, বিদেশী সাহায্য সংস্থা, জাতিসংঘ,সরকারি গাড়ি এবং রেডক্রসের গাড়ির অপব্যবহার প্রভৃতি চরম অগণতান্ত্রিক কার্যকলাপের মাধ্যমে উক্ত নির্বাচনী কেন্দ্রসমূহে নির্বাচনকে প্রহসনে পরিণত করিয়াছে এবং বিরোধী দলের প্রার্থীদের জোরপূর্বক পরাজিত করিয়াছে" (সংবাদ,১০মার্চ১৯৭৩;জাসদের উত্থান পতনঃঅস্থির সময়ের রাজনীতি, পৃঃ৯৯)

নির্বাচনে বিরোধীদের বিজয়েয় সম্ভাবনা ছিল না কিন্তু আওয়ামিলীগ নিজেদের বিজয় নিয়ে কনফিডেন্স ছিল না।পরিস্থিতি এমন দাঁড়ায় শেখ মুজিব সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জনসভা করলে, ভাসানী পল্টনে জনসভা করছেন;লোকদের মুখে বিতর্ক হত কার জনসভায় লোক বেশী।

আবুল মনসুর আহমেদ মনে করেন কনফিডেন্সহীনতার জন্য আওয়ামিলীগ নির্বাচনে অনিয়ম নীতিতে পরিণত করেছিল।তিনি মনে করেন বিরোধীদের নির্বাচন নিয়ে অতিরিক্ত উচ্ছসিত এবং আওয়ামিলীগের অতি আস্থাহীনতা যৌক্তিক ছিল না কিন্তু সেই আস্থাহীনতাই আওয়ামীলীগকে ম্যানেজড নির্বাচনের দিকে নিয়ে যায়।

৭৩এর নির্বাচন থেকে শিক্ষা নিয়ে ঐ বছরের ডাকসু নির্বাচনে ছাত্রলীগের পরাজয়ের সম্ভাবনা দেখা দিলে ছাত্রলীগ ব্যালট বাক্স ছিনতাই করে নির্বাচন বানচাল করে দেয়।২০১৪/২০১৮/২০১৯ এ এসেও তারা ঠিক সেই কাজটি করে যা করেছিল তাদের পূর্ববর্তীরা।এভাবেই যুগ যুগ ধরে তাদের ঐতিহ্য বহন করে যাচ্ছে ঐতিহ্যবাহী এ দলটি..............

বিষয়: রাজনীতি

৮৯৮ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File