প্রেম এক নিগূঢ় বন্ধন।

লিখেছেন লিখেছেন পলাশ দোহার ২১ মে, ২০১৩, ০৩:৫৩:১২ রাত

“প্রেম” নামক একটি কবিতায় জীবনানন্দ দাস লিখেছেন,

“সকল ক্ষুধার আগে তোমার ক্ষুধায় ভরে মন!

সকল শক্তির আগে প্রেম তুমি, তোমার আসন

সকল স্থলের ’পরে, সকল জলের ’পরে আছে!

যেইখানে কিছু নাই সেখানেও ছায়া পড়িয়াছে

হে প্রেম; তোমার!- যেইখানে শব্দ নাই তুমি আলোড়ন

তুলিয়াছ!- অঙ্কুরের মতো তুমি যাহা ঝরিয়াছ

আবার ফুটাও তারে!- তুমি ঢেউ-হাওয়ার মতন!

আগুনের মতো তুমি আসিয়াছ অন্তরের কাছে!

আশার ঠোঁটের মতো নিরাশার ভিজে চোখ চুমি

আমার বুকের ’পরে মুখ রেখে ঘুমায়েছ তুমি!”

প্রেম হলো জীবনের প্রতিবিম্ব। নিঃসঙ্গ হৃদয়ে পাওয়ার আকাক্ষাই এক ধরনের প্রেম।ভালোলাগা, ভালোবাসার পর্বতে পা রাখার প্রথম সিঁড়ি।ভালোলাগা নিজেই সে পর্বতের প্রতি পদক্ষেপে প্রতি ইঞ্চি পথে আলো জ্বেলে পথ দেখায়।প্রেমে পড়লে মাঝে মাঝে চিন্তার চলন্ত সিঁড়িগুলো থেমে যায়। প্রেমকে তখন দুর্বোধ্য অনুভূতির সমষ্টি আখ্যা দিতে ভালো লাগে। প্রেম-ভালোবাসা কাছাকাছি দুটি শব্দ। একটা অপরটার পরিপূরকও হতে পারে;

‘প্রেম’। ছোট্ট একটি শব্দ। কিন্তু বিশালতায় যে কোনো কিছুকে হারমানাতে পারে এটি। প্রেমকে বিচিত্র ধরনের অসংখ্য অনুভূতির সমষ্টি মনে হয়। অর্থাৎ প্রেমের গভীরতার রূপকার হিসেবে আবেগ অনুভূতিই প্রধান। আবেগই প্রেমের ভেতর-বাহির নিয়ন্ত্রণ করে। মনের আবেগ থেকে মস্তিষ্কে নানা ধরনের অনুভূতির সৃষ্টি হতে পারে। যার সঙ্গে আমি প্রেম করি, যাকে আমি ভালোবাসি। তার প্রতি আমার আবেগ এতটাই গায় যে তাকে আমি আমার সারা অস্তিত্ব জুড়ে কল্পনা করি, অনুভব করি। আমার নিজের ভিতর তার উপস্থিতি টের পাই। তাই আমি স্বপ্নে বার বার তার কাছে ছুটে যাই। দুজনে একসঙ্গে বসে থাকি নরম তুলতুলে সবুজ ঘাসের উপর। আমার হাতের আঙ্গুলগুলো খুঁজে নেয় ওর হাতের আঙ্গুল। শিহরণ বয়ে যায়। দেহের ভেতর দিয়ে। তৃপ্তি লাভ করি আমি। এটাই তো প্রেম!তারপর সূর্যের কমলা আভা এসে পড়ে ওর মুখে। আমি মুগ্ধ হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে থাকি। ওর সুন্দর চোখ দুটি দেখি। পাতলা ঠোঁট দুটির দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে তাতে চুমু খেতে ইচ্ছা হয়। তার অপরূপ মুখমন্ডলের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকি আমি। সে আমার মনের মানুষ। আমার মনটা শুধুই তার জন্য। এটাই তো প্রেম।

প্রেমের এই বিশালতার মাঝে কামের ধাপটা আসবেই। প্রেম-কাম কামনাটা মনের দুয়ারে বন্দি থাকে। একটা সময়ে নিজেই বেরিয়ে আসে। আর এটাই সাদার ক্যানভাসে কালোর ছোপ। স্নিগ্ধতা আর পবিত্রতার মাঝে একটু কালিমা। হুমায়ূন আজাদ লিখেছেন, ‘নারী ও পুরুষ পরস্পরের প্রতি আকর্ষণ বোধ করবে। এটা তাদের নিয়তি এবং আরও মর্মান্তিক নিয়তি হচ্ছে। তাদের আকর্ষণ দীর্ঘস্থায়ী হবে না।’ প্রেম হচ্ছে অফুরন্ত রহস্যের এক বিশাল সাগর; সেই সাগরে ক্রমাগত ঢেউ উঠছে। আবেগ আর অনুভূতির ঢেউ।শরীর আর মনের গোপন খেলার নাম প্রেম। আকাশের মতো বিশাল উদার দুইটি মনের মিল হলো প্রেম। সমুদ্রের মধ্যে গহীন জলের মাঝে ছোট্ট একটি কোণে, দুইটি মনের গোপন কক্ষে বসবাস। দুজন দুজনের দিকে প্রেমাকাত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা। অনুভূতি হারিয়ে যাওয়া প্রেমের স্বর্গপুরীতে। তখনই নিজেকে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সুখী-শান্তিময় মানুষ মনে হয়। প্রেম কি এক মধুমাখা দুর্বল শব্দ আমার কাছে। প্রেমের কাছ থেকে পালিয়ে যাওয়ার কোন সম্ভাব্য রাস্তা মানবসন্তানদের জন্য খোলা নেই।আমি আমার ক্ষুদ্র মস্তিষ্কে যতটুকু বুঝি, প্রেম হলো একটি বিশেষ ধরনের বন্ধুত্বও। এই বন্ধুত্বের দায়-দায়িত্ব অন্যগুলোর তুলনায় অনেক বেশি। এই বন্ধুত্ব অপরিচিত কারো সঙ্গে হাত মিলিয়ে করে ফেলার মতো সহজ নয়। এটিকে জয় করে নিতে হয় দীর্ঘদিনের বিশ্বাস আর একসঙ্গে পথ চলার মধ্য দিয়ে। আমি যখন কাউকে ভালোবাসব তখন সে যেইরকম, সেই ভালো-মন্দ মিশানো মানুষটাকেই ভালোবাসব।

প্রেম পবিত্র স্বর্গীয়। প্রেম বিস্ময়কর বিশ্বাস। প্রেম এক দুর্নিবার মানসিক আকর্ষণ। প্রেম সেই বস্তু যার জন্য নিজেকে সুদৃঢ় করে প্রতিষ্ঠিত করা যায়, বিশ্বাসে বিশ্বাস করে নিজেকে মেলে দেয়া যায়, প্রতিস্থাপন করা যায়, প্রতিভাত করা যায়। নির্ভয়ে বিশ্বাসে স্বর্গ জয় করা যায়। প্রেম হলো অন্যতম বিস্ময়। আবার প্রেম বিশ্বাসের স্ফটিক। যা ভেঙে গেলে জোড়া লাগে না। আবার জোড়া দিলেও অমসৃণ দাগ থেকে যায়। প্রেম এক চিরন্তন প্রবাহের ফল্গুধারা। প্রেম হলো সীমাহীন আবেগ। পবিত্র মান-অভিমানের ধারক-বাহক। প্রেম হলো ইচ্ছা। যা চির স্বাধীন। প্রেম রাগ-অনুরাগের সংমিশ্রণ। আবার প্রেম সেই বস্তু যে ফুলের আঘাতও সহে না। প্রেম হাসি-কান্না, আনন্দ-বিরহ। প্রেম বহুরূপী। প্রেম এক মৌনমুখর সঙ্গীত। আবার প্রেম কখনো সৃষ্টি, কখনো লয়। প্রেম জানে ভাঙতে, প্রেম জানে গড়তে। কখনো আবার প্রেম দৈহিক কামনা। তারপরেও প্রেম চিরন্তন। আমার ধারণা বিশ্বাসে প্রেম সর্বময়। প্রেম যেন পরম যত্মে লালন করা মনের কোণে পবিত্র এক গোপন স্বপ্ন। প্রেম এক আনন্দদায়ক কষ্ট অথবা কষ্টদায়ক আনন্দ। অব্যক্ত সুখও বটে। প্রেম কখনো উদ্বেগ, কখনো কর্মপ্রেরণা। প্রেমময় শক্তির উৎস। শুদ্ধ মানবতার এক নাম প্রেম। প্রেম কামনার এক অফুরন্ত শ্রাবণ ধারা। প্রেম সে এক দুরন্ত বৈশাখী। হেমন্ত শীত-বসন্ত। প্রেম সে তো অফুরন্ত শ্যামল ছায়ার নীড়। প্রেম এক নিগূঢ় বন্ধন। প্রেম এক আধ্যাত্মিক জ্ঞান। ‘প্রেম একটি লাল গোলাপ’। এর সৌন্দর্য অমলিন, সৌরভ হৃদয় হরণকারী, তুলনায় অদ্বিতীয়। এ কারণে এটা কোনো বিভেদ- বৈষম্যকে পাত্তা দেয় না, উঁচু-নিচুর দেয়াল মানে না, বরং মানবতার মুক্তি ঘোষণা দেয়। মানব-জীবনকে ধন্য এবং পূর্ণ করে প্রেম। কেননা ভালোবাসা সর্বপ্রাণীর স্বভাবজাত, কিন্তু প্রেম শুধু মানুষের।অনুভবের বিচিত্রতাকে স্থায়িত্ব দিতে মানুষ যে প্রতিজ্ঞায় আবদ্ধ হয় সেটাই প্রেম।

‘আত্মার পারস্পরিক আকর্ষণে জন্ম নেয় বন্ধুত্ব।

মনের পারস্পরিক আকর্ষণে জন্ম নেয় শ্রদ্ধা।

দেহের পারস্পরিক আকর্ষণে জন্ম নেয় কামনা।’

আর এই তিনের যোগফল প্রেম।

*************

বিষয়: সাহিত্য

১২৯৫ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File