আমাদের পূর্ব পুরুষদের শত্রু-মিত্র পর্ব ৪৮

লিখেছেন লিখেছেন আনিসুর রহমান ০৬ মে, ২০১৭, ০৯:৪১:৫৬ সকাল

হোসেন শাহ্‌ পরস্পর বিপরীত তথ্যের গোলক ধাঁধা – তিন

(ক) সুলতান হোসেন শাহ্‌র মুদ্রায় প্রায়স এই লিখাটি দেখতে পাওয়া যায়, “সুলতান হোসেন শাহ্‌ বিন সৈয়দ আশরাফ উল হোসেনী (সৈয়দ আশরাফ-উল –হোসেনীর ছেলে সুলতান হোসেন শাহ্‌)”। সম্ভবত এর উপর ভিত্তি করে রিয়াদুস সালাতিন এর লেখক সেলিম এবং ফারিস্তা উভয় ইতিহাসবিদই হোসেন শাহ্‌কে ‘সৈয়দ’ বলে উল্লেখ করেছেন। এই ‘সৈয়দ’ লকবটি নির্দেশ করে হোসেন শাহ্‌র পূর্ব পুরুষ ছিলেন আরবের আধীবাসি ছিলেন। এমন কী রিয়াদুস সালাতিনে হোসেনকে বর্ণনা করা হয়েছে, সৈয়দ আশরাফ-উল –হোসেনীর আল ফাতেমি আল মক্কীর ছেলে যিনি মক্কার শরীফ ছিলেন। উল্লেখ্য ‘সৈয়দ’ ও ‘ফাতেমি’ এই উভয় পদবীই নবী করিম () এর সাথে সম্পর্কি।

হোসেনের পিতা আশরাফ উল হোসেনী আরববাসী হওয়া সম্পর্কে জামাতে ইসলামী বাংলাদেশ এর প্রয়াত আমীর আব্বাস আলী খান তার বাংলার মুসলমানদের ইতিহাস গ্রন্থের ৩৮ পৃষ্ঠায় বলেন, “ ----– ন্যায়সংগতভাবেই প্রশ্ন জাগে যে, হোসেনের পিতা মক্কার শরীফ হওয়াতো দূরের কথা, মোটেই আরববাসী ছিলেন কিনা। হোসেনের সৈয়দ হওয়া কেন, মুসলমান হওয়াটাও সন্দেহ মুক্ত নয় বলে মনে করার যথেষ্ট কারন আছে। ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার পর তার আচরণ ও কার্যকালাপই তার স্বাখ্য দান করে।”

আর তার পিতার মক্কার শরীফ হওয়া সম্পর্কে ঐ একই গ্রন্থের ৩৮ পৃষ্ঠায় আব্বাস আলী খান বলেন, “ প্রথমতঃ তার বংশ পরিচয়ের কথাই ধরা যাক। তার পিতা সৈয়দ আশরাফ মক্কার অধিবাসী ও শরীফ ছিলেন- যার কোন নির্ভরযোগ্য প্রমান ইতিহাস থেকে পাওয়া যায় না। উপরন্তূ মক্কার শরীফ তার দুই পুত্রসহ ভাগ্য অন্বেষণের জন্য বাংলায় অগমন করেন, এ এক অলীক কল্পনা মাত্র। ----- --- কেউ কেউ আবার তাকে তিরমিজের অধীবাসীও বলেছেন। তাহলে কোনটাকে সত্য বলে গ্রহণ করা যাবে? উল্লেখ্য যে, মক্কার শরীফ ছিলেন সেকালে হেজাজের সর্বময় কর্তা, একচ্ছত্র বাদশা, বিপুল ঐশ্বর্যের মালিক, অতুলনীয় রাজপ্রাসাদের ভোগদখলকারী। ইতিহাসে এমন কোন তথ্য খুঁজে পাওয়া যায় না যে, মক্কার কোন শরীফ কোন কালে তার মসনদ ত্যাগ করে ভাগ্যোন্নয়নের জন্য স্ত্রী পুত্রসহ বাংলাতে এসে অপরের আশ্রয়প্রার্থী হয়েছেন। সম্ভবত সুচতুর ও প্রতারক হোসেন নিজেকে সৈয়দ বংশীয় ও শরীফপুত্র বলে পরিচয় দিয়ে মুসলমানদের ভক্তি শ্রদ্ধা আকর্ষণ করেছিলেন।”

উল্লেখ্য অধিকাংশ ইতিহাসবিদ হোসেনকে আরবের অধিবাসী বললেও কিন্তু তার পিতা তার স্ত্রী পুত্রসহ কেন, কখন এবং কীভাবে আরব থেকে বাংলাতে এসে ছিলেন তার কোন বিবরণ দেননি। অর্থাৎ এসম্পর্কিত কোন তথ্য তারা খুঁজে পাননি! আপর দিকে শ্রদ্ধেয় আব্বাস আলীর তথ্য অনুসারে ইতিহাসে এমন কোন তথ্য খুঁজে পাওয়া যায় না যে, মক্কার কোন শরীফ কোন কালে তার মসনদ ত্যাগ করে ভাগ্যোন্নয়নের জন্য স্ত্রী পুত্রসহ বাংলাতে এসে অপরের আশ্রয়প্রার্থী হয়েছেন। যে সময়ে মুসলমানরা ‘সুপার পাওয়ার’ ছিল সে সময়ে মুসলমানদের প্রানকেন্দ্র মক্কার একজন শরীফ ভাগ্যোন্নয়নের জন্য স্ত্রী পুত্রসহ বাংলাতে এসেছেন অথচ তা ইতিহাসে নেই নিঃসন্দহে তা অসম্ভব, অবাস্তব এবং হতে পারে না। কেননা মক্কা নগরী হল এমন একটি সমৃদ্ধ নগরী যেখানে প্রতি বৎসর হজ্জের মৌসুমে বিভিন্ন দেশ থেকে প্রচুর সংখ্যক নরনারী হজ্জ পালনের জন্য যেয়ে থাকে। সেখানকার একজন শরীফের ভাগ্যোন্নয়নের জন্য স্ত্রী পুত্রসহ বাংলাতে অগমন নিঃসন্দেহে ছিল আলোচিত ঘটনা। কিন্ত আশ্চর্যের বিষয় হল এই এসম্পর্কিত কোন তথ্য ইতিহাসে খুঁজে পাওয়া যায় না! তাই শ্রদ্ধেয় আব্বাস আলীর সাথে একমত পোষণ করে বলতে চাই সুচতুর ও প্রতারক হোসেন নিজেকে সৈয়দ বংশীয় ও শরীফপুত্র বলে পরিচয় দেওয়ার পিছনে মুল উদ্দেশ্য ছিল মুসলমানদের ভক্তি শ্রদ্ধা অর্জন করে মুসলমানদের ক্ষতি করা।

হোসেন শাহ্‌ পরস্পর বিপরীত তথ্যের গোলক ধাঁধা – চার

প্রশ্ন হ’ল সুলতান হোসেন শাহ্‌ যদি আরব দেশ থেকে না এসে থাকে তাহলে তাহার প্রকৃত পরিচয় কী? এর কোন পরিষ্কার উত্তর নেই কেননা হোসেন শাহ্‌র বংশ পরিচয় এবং জন্মস্থান নিয়ে ঐতিহাসিকদের মাঝে মতভিন্নতা দেখা যায়। ঐতিহাসিকদের মাঝে এই মতভিন্নতা সম্পর্কে জামাতে ইসলামী বাংলাদেশ এর প্রয়াত আমীর আব্বাস আলী খান তার বাংলার মুসলমানদের ইতিহাস গ্রন্থের ৩৭ পৃষ্ঠায় বলেন,“কোন কোন ঐতিহাসিক বলেন, হোসেনের পিতা সৈয়দ আশরাফ মক্কার শরীফ ছিলেন। কিন্তু দীর্ঘকাল তিরমিজে বাস করেন। বুকানন হ্যামিলন্টন বলেন,হোসেন রংপুর জেলার অধীবাসী ছিলেন বলেও জনশ্রুতি আছে। গোবিন্দগঞ্জ থেকে ষোল মাইল দূরে দেবনগরে তাহার জন্ম। কোন কোন ঐতিহাসিক আবার তাকে গৌড়ের সুলতান ইব্রাহীম শাহের প্রপৌত্র বলেও উল্লেখ করেছেন।” স্পষ্টতই দেখা যাচ্ছে যে হোসেনের প্রকৃত পরিচয় পরস্পর বিপরীত তথ্যের গোলক ধাঁধার মধ্যে গাঁথা। কেউ কেউ বলেছেন হোসেনের পিতা মক্কার শরীফ ছিলেন কিন্তু মক্কাতে নয় দীর্ঘকাল তিরমিজে বসবাস করেছিলেন! আবার কেউ কেউ বলেছেন হোসেনর জন্ম স্থান হল দেবনগর যা গোবিন্দগঞ্জ থেকে ষোল মাইল দূরে অবস্থিত অর্থাৎ তিনি বর্তমান বাংলাদেশের রংপুর জেলার অধীবাসী ছিলেন! আবার কেউবা বলেছেন না হোসেন ছিলেন গৌড়ের সুলতান ইব্রাহীম শাহের প্রপৌত্র!

চলবে-----------

বিষয়: বিবিধ

৮৮৭ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File