আমাদের পূর্ব পুরুষদের শত্রু-মিত্র পর্ব ৪৫
লিখেছেন লিখেছেন আনিসুর রহমান ১৯ এপ্রিল, ২০১৭, ০৯:০৩:২৬ রাত
বাদশানামদার আলাউদ্দিন হোসেন শাহ্ শরীফ মক্কী, শ্রী চৈতন্যের ‘বৈষ্ণব মুভমেন্ট’ এবং ‘বাংলা সাহিত্যের’ পৃষ্ঠপোষকতা করে, কুরআন সুন্নার জ্ঞান শুন্য অসহায় মুসলমানদের মেহেরবানী করে যেরূপ খেতমদ করেছিলেন; এর বাহিরে অতিরিক্ত হিসাবে সেরূপ আর কী কী খেতমদ অসহায় অজ্ঞ মুসলিমদের জন্য তিনি করেছিলেন তার একটি নাতীদীঘ বর্ণনা দিব এই পর্বে।
পূর্বেই আমরা বিস্তারিত আলোচনা করে দেখিয়ে ছিলাম যে, বাংলা সাহিত্যের উপর ভর করে অর্থাৎ মনসামঙ্গল ধর্মমঙ্গল প্রভৃতিতে হিন্দু দেবদেবীর যে আলৌকিক ক্ষমতা ও মহাত্ন বর্ণনা করা হয়েছে তাই পরবতীতে পীরের পুঁথি, কাব্য, নাটক এবং যাত্রাতে ব্যাবহিত হয়েছে পীর/দরবেশদের চরিত্র চিত্রণের ক্ষেত্রে। এই ভাবে চিত্রিত দেবতাদের অধিকাংশই মুসলিম পীর/দরবেশ/ সুফী রূপে ধরা পৃষ্ঠে অবতীর্ণ হয় বাংলা সাহিত্যের হাত ধরে। এর পরের ইতিহাস বিস্ময়কর ইতিহাস, পরবর্তীতে এই কল্পিত পীরেরা কুরআন সুন্নাহ সম্পর্কে অজ্ঞ অসহায় মুসলমানদের কাছে পরিচিতি পায় ও প্রতিষ্ঠা লাভ করে কল্পনার গণ্ডিকে পেরিয়ে বাস্তব চরিত রূপে! মুসলিম নাম ধারন করে, পীর/দরবেশ/ সুফী রূপে, যেমন, সত্য পীর (সত্য পীর হছেন হিন্দুদের দেবতা সত্য নারায়ণের প্রতিরূপ), মাণিক পীর (মাণিক পীর হছেন ছদ্মবেশধারী হিন্দুদেবতা শিব), পীর মছন্দলি (পীর মছন্দলি হছেন হিন্দুদেবতা মৎস্যেন্দনাথের প্রতিরূপ)----------- ইত্যাদি!
তার পরের ইতিহাস অবিশ্বাস অবাক করা ইতিহাস, ঐ সকল কল্পিত ব্যাক্তি বাস্তব চরিত্র রূপে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার পর তাদের জন্য তৈরি করা হয় কল্পিত কবর ও মাজার। শিক্ষা দীক্ষা বঞ্চিত আমাদের পূর্ব পুরুষেরা ইসলাম সম্পর্কে অজ্ঞতা হেতু সহজেই ষড়যন্ত্রকারীদের পাতা ফাঁদে পা দেয়; তলীয়ে যায় পৌত্তলিকতার অতল গহ্বরে। এর অবসম্ভাবি ফলাফল স্বরূপ হিন্দুদের লৌকিক দেবতাদের ন্যায় সৃষ্ট এই পীরদের কাছে তারা বিপদ-আপদ, বালা মুসীবত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য সাহায্য প্রার্থনা করাও শুরু করে দেয়। শুধু তাই নয় সময়ের সাথে সাথে হিন্দুদের লৌকিক দেবতাদের ন্যায় সাহিত্য সৃষ্ট কল্পিত ঐ পীরদের করব ও মাজারকে ভক্তি শ্রদ্ধা ও পূজা আর্চনা করা জোরেশোরে শুরু হয়ে যায়। আর এই ব্যাধি কান্সার ভাইরাসের মত আতি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে মুসলিম সমাজের রন্ধ রন্ধ।
সাহিত্য সৃষ্ট এই সমস্ত কল্পিত পীরদের কিভাবে বাস্তব ব্যাক্তি রূপে বিশ্বাসযোগ্যভাবে প্রতিষ্ঠা করা যায় তা অব্যশই ছিল একটি দুরহ ও জটিল ব্যাপার কিন্তু এই জটিল বিষয়েরও সহজ সমাধান দয়া করে বাতলে দিয়ে গেছেন মহামান্য সুলতান হোসেন শাহ্ শরীফ মক্কী তার রাষ্ট্র যন্ত্রের সকল ক্ষমতাকে ব্যাবহার করে। এ সম্পর্কে আব্বাস আলী খান তার বাংলার মুসলমানদের ইতিহাস গ্রন্থের ৪৩পৃষ্ঠায় বলেন, “ সত্য নারায়ণের পূজা পদ্ধতির উল্লেখ হিন্দু পুরানে আছে। হিন্দুর প্রায় প্রতি ঘরে ঘরে এই পূজার অনুষ্ঠান হয়ে থাকে। কিন্তু মুসলমানকে দিয়ে এ সত্য নারায়ণের পূজা কিছুতেই সম্ভব ছিল না। তাই হিন্দু মুসলমানের বিভেদ মিটাবার মহান (?) উদ্দেশ্যে সুলতান হোসেন সত্য পীরের প্রতিষ্ঠা ও তার পূজা পদ্ধতির প্রবর্তন করেন। প্রকৃত পক্ষে সত্য পীরের দরগা প্রতিষ্ঠা, সত্য পীরের নামে মানৎ সির্নি ও সির্নি বিতরণ। ঢাক ঢোলের বাদ্য বাজনাসহ সত্য পীরের দরগায় অনুষ্ঠানাদি পালন প্রকৃতপক্ষে সত্যনারায়ণ পূজারই মুসলিম সংস্করন যার প্রবর্তক ছিলেন হোসেন শাহ্।”
সাহিত্য সৃষ্ট কল্পিত চরিত্রকে বাস্তব চরিত্র রূপে প্রতিষ্ঠা করার ‘যে প্রক্রিয়া’ হোসেন শাহ্ বাস্তব উদাহরণ তৈরি করে দেখিয়ে দিয়ে গেছেন (অর্থাৎ সাহিত্য সৃষ্ট কল্পিত পীর> বাস্তব পীর> পীরের দরগা প্রতিষ্ঠা> পীরের নামে মানৎ> পীরের নামে সির্নি ও সির্নি বিতরণ> ঢাক ঢোলের বাদ্য বাজনাসহ পীরের দরগায় অনুষ্ঠানাদি পালন।); পরবর্তীতে কম-বেশি হুবহু সে প্রক্রিয়াকেই অনুসরণ করে বাংলা সাহিত্য সৃষ্ট বিভিন্ন কল্পিত পীর যথা মাণিক পীর, গোঁরা পীর ইত্যাদি মুসলিম সমাজে প্রতিষ্ঠা পায়।
কিন্তু সব পীর সাহিত্য সৃষ্ট কল্পিত পীর ছিল না বরং আমাদের সমাজের পীর/ দরবেশ/ সুফীদের বড় অংশটি এসেছিল দুই ভাবে। এক, সমাজের ভিতরে প্রভাবশালী ইসলাম প্রচারক বা দায়ী ইল্লেললাহদের কবরকে পীরের কবরে এবং তাদের ইসলাম প্রচার কেন্দ্রগুলকে পীরের মাজার/খনাকাতে রূপান্তরের মাধ্যমে। দুই, অজ্ঞ মুসলমানদের বোকামিপূর্ণ এরূপ ‘পীর ভক্তিকে’ কিছু প্রতারক চক্র ‘ব্যাবসার পুঁজি’ রূপ ব্যাবহার করে নিজেদেরকে পীর বলে দাবী করার মধ্য নিয়ে ‘হঠাৎ গজিয়ে উঠা পীর’ যারা পরবর্তীতে ব্যাপক পরিচিতি পায় ভন্ড পীর রূপে। এই ‘হঠাৎ গজিয়ে উঠা পীর’ সম্পর্কে আমরা এখানে আলোচনা করবো না, কেননা মানুষের অজ্ঞতার বা বোকামির সুবর্ণ সুযোগ গ্রহনকারী প্রতারকের দল সবসমাজে সবসময়ে তীর্থের কাকের মত হা করে বসে থাকে আর সুযোগ বুঝে ঝাপিয়ে পড়ে।
চলবে-----
বিষয়: বিবিধ
৮৩৪ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন