আমাদের পূর্ব পুরুষদের শত্রু-মিত্র পর্ব ৪৪
লিখেছেন লিখেছেন আনিসুর রহমান ১৫ এপ্রিল, ২০১৭, ০৪:০১:৫০ রাত
বস্তুত আমরা দেখি যে মনসামঙ্গল ধর্মমঙ্গল প্রভৃতিতে হিন্দু দেবদেবীর যে আলৌকিক ক্ষমতা ও মহাত্ন বর্ণনা করা হয়েছে তাই পরবতীতে পীরের পুঁথি, কাব্য, নাটক এবং যাত্রাতে ব্যাবহিত হয়েছে পীর/দরবেশদের চরিত্র চিত্রণের ক্ষেত্রে। এই সম্পর্কে জাতীয় অধ্যাপক সৈয়দ আলী আহসান তার বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্তি গ্রন্থের ২৬ পৃষ্ঠায় বলেনঃ “ হিন্দু দেবদেবীর মহাত্ন-কাহিনীকে মুসলমান পীর মহাত্ন-কাহিনীতে ঢালাই করবার চেষ্টা করেছিলেন অনেকে। এ সমস্ত পীরের মধ্যে খ্যাতিমান হচ্ছেন মাণিক পীর এবং সত্য পীর (এই দুই কাল্পনিক পীর সম্পর্কে পূর্বেই আমরা বিস্তারিত বলেছি)। আরও অনেক পীর আছেন যেমন পীর মছন্দলি, বড় খাঁ গাজী, পীর কালু শাহ্ এবং পীর গোঁরা চাঁদ। হিন্দুদের অধিকাংশ লৌকিক দেবদেবীই এ সমস্ত পীর হয়েছেন। যেমন মাণিক পীর হছেন ছদ্মবেশধারী শিব। পীর মছন্দলি হছেন মৎস্যেন্দনাথের প্রতিরূপ।”
আর আমাদের সমাজে সৃষ্ট এই পীর/সুফী/দরবেশদের প্রভাব সম্পর্কে ডঃ মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর হোসেন তার লোকসংস্কৃতির অঙ্গনে কুষ্টিয়া গ্রন্থের ১৯ পৃষ্ঠায় বলেন, “ বাঙ্গালী জীবনে অলী পীর দরবেশদের প্রভাব দৃশ্যত; এমন কী তাহাদের মাজারের ক্ষেত্রেও কথাটি প্রযোজ্য। এমন কিছু মাজার আছে যা অজানা বুজুর্গ ব্যাক্তির সাথে সম্পর্ক নেই। আমাদের দরিদ্র ও অশিক্ষিত-অর্ধশিক্ষিত লোক জীবনে অন্ধ ভক্তি ও বিশ্বাসের ফলে সহজেই মাজারের প্রতি বিশ্বাস আরোপিত হয়। আর এ কারনেই ভারতীয় মহাদেশে মাজার ধর্মীয় অনুভুতিতে মাজার কেন্দ্রিক ব্যাবসা গড়ে উঠেছে।”
মুসলিম সমাজের অভ্যন্তরে এই ভাবে তাওহীদ বিরোধী পৌত্তলিক ভাবধারা সুকৌশলে প্রবেশ করিয়ে দিয়ে, সৃষ্ট পীর /দরবেশদের উপর অন্ধ ভক্তি ও বিশ্বাস তাদের অন্তরের মাঝে গেঁথে দেওয়া হয়। ফলে কুরআন হাদীস সম্পর্কে অজ্ঞ মুসলমানরা অতি সহজেই ঐ পাতা ফদে পিছলে পড়ে, ছিটকে পড়ে পৌত্তলিকতার অতল গহ্বরে ফলে সহজেই তাদের ঈমান আকীদাকে হাড়িয়ে ফেলে; বিষয়টা শুধু এর মাঝে সীমাবদ্ধ থাকলেও কথা ছিল। কিন্তু মুসলমানদের এই অজ্ঞতার সুযোগকে কাজে লাগিয়ে এক শ্রেনীর মুসলিম নামধারী জোচ্চোর, চিটার ব্যাটপার ও প্রতারকের দল, ইসলাম সম্পর্কে তাদের এই ভ্রান্ত বিশ্বাসকে ‘ব্যাবসার পুজির’ ন্যায় ব্যাবহার করে তাদের কষ্টার্জিত টাকা পয়সাও হাতিয়ে নয়, এমন কী কোন কোন ক্ষেত্রে তাদের ইজ্জত আব্রুকে ও সস্মানকে করে ভূলুণ্ঠিত! আর এই ভাবেই কুরআন হাদিস সম্পর্কে অজ্ঞ মুসলিমরা তাদের অজ্ঞতার অক্কেল সেলামী গুনতে থাকে যার রেশ আজও বর্তমান। এই প্রতারকের দল কখনও নিজেদের পীর/ দরবেশ/সুফী দাবী করে কিংবা কোন আজানা অচেনা কবর/স্থানকে পীরের কবর বলে দাবী করে কিংবা কোন বিখ্যাত ইসলাম প্রচারকের কবরকে পীর/ দরবেশ/ সুফীর কবরে রপান্তরিত করে তাদের ব্যাবসার ফাঁদ পেতে বসে। ফলে এত ষড়যন্ত্রের পরও মুসলিম সমাজে তাওহীদের যে ‘নূর’ নিভু নিভু করে জ্বল ছিল তাও নির্বাপিত হয় এবং পূর্ণ হয় সর্বনাশের ষোল আনা এদের হাত ধরে। সময়ের সাথে সাথে এই জোচ্চোর, চিটার ব্যাটপার ও প্রতারক দলের অন্যায় আশ্লীল ও হিনিয়াস কার্যকালাপ জনসস্মুখে প্রকাশ হয়ে পড়তে শুরু করলে পীর/ দরবেশ/ সুফী নামধারীরা প্রোমাদ গুনে; মড়িয়া হয়ে নিজেদেরকে রক্ষাকল্পে সর্বাত্নক চেষ্টা চালানো শুরু করে দেয় । ফলে জন্ম নেয়, হাক্কানি পীর, শরীয়তী পীর, কামেল পীর আর ভন্ড পীর---; পরিচিত হই বিভিন্ন তরীকতের সাথে। পরিচিত হই গাউস কুতুব ইত্যাদির সাথে। কিভাবে এই প্রতারকের দল মুসলমানদের কুরআন হাদিস সম্পর্কে অজ্ঞতার সুযোগকে কাজে লাগিয়ে, একজন অজ্ঞাত ব্যাক্তির করবকে পীরের মাজারে রুপান্তরিত করে তার একটি সুন্দর চিত্র পাই আমরা সৈয়দ অয়ালীউল্লাহর ‘লাল সালু’ উপন্যাসে। যেমনঃ
“ আপনারা জাহেল(অজ্ঞ), বে এলেম(অশিক্ষিত), আনপাড়হ। মদাছেল পীরের মাজারকে আপনারা এমন করি ফেলি রাখছেন? গ্রাম থেকে একটু বাহিরে একটা বৃহৎ বাশঝার। মোটাসোটা হলদে তার গুড়ি। সেই বাশঝারের ক-গজ ওধারে একটা পরিত্যক্ত পুকুরের পাশে ঘন সন্নবিস্ট হয়ে আছে গাছপালা। যেন একদিন কার বাগান ছিল সেখানে। তারই একধারে টালখাওয়া ভাঙা এক প্রাচীর করব। ছোট ছোট ইটগুলো বিবর্ণ শ্যাওলায় সবুজ, যুগ যুগের হাওয়ায় কালচে। ভিতরে সুড়ঙ্গের মত। শেয়ালের বাসা হয়তো। ওরা কী করে জানবে এটা মদাছির পীরের মাজার? ( লোকসংস্কৃতির অঙ্গনে কুষ্টিয়া, ডঃ জাহাঙ্গীর হোসেন, পৃষ্ঠা ১৭-১৮)
ইসলাম সম্পর্কে অজ্ঞ মুসলিমদের মাঝে এই সকল পীরদের প্রচার ও প্রসারের জন্য ‘(উ)ওরস’ নামক একটি উৎসব পালন করে থাকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। এই ‘ওরস’ সম্পর্কে ডঃ মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর হোসেন তার লোকসংস্কৃতির অঙ্গনে কুষ্টিয়া গ্রন্থের ১৭ পৃষ্ঠায় বলেন, “ উরস প্রসঙ্গে পবিত্র কুরআন ও হাদীসের কোথাও সরাসরি উল্লেখ নেই; এমন কী আরব দেশেও এর প্রচলন নেই; শুধু ভারতীয় উপমহাদেশে এর ব্যাপক প্রচলন লক্ষনীয়।” উল্লেখ্য পীর/দরবেশদের মৃত্যু দিবস উপলক্ষে পালিত বাৎসরিক উৎসবের নাম ‘উরছেকূল’ এবং পীর/দরবেশদের জীবিত কালে পালিত উৎসবের নাম ‘ওরশ মহফিল’। মজার বিষয় হল দুই ক্ষেত্রে ওরস/উরস শব্দের বানানের পার্থক্য লক্ষণীয়। সবচেয়ে বিস্ময়ের বিষয় হ’ল আমাদের পূর্ব পুরুষদের ধোঁকা দেওয়ার জন্য সৃষ্ট, এই সুফী/পীর/দরবেশ এবং মাজার ও ওরসের ছিলছিলা আজও বাংলাদেশের বাস্তবতা! আরও অদ্ভুদ হল আজকে শুধু আমাদের দরিদ্র ও অশিক্ষিত-অর্ধশিক্ষিত লোকজনই নয় বরং আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত কিন্ত কুরআন সুন্নার জ্ঞান শুন্য ব্যাক্তিদেরকেও বিস্ময়কর ভাবে এই প্রতারক চক্রের হাতে প্রতাররিত হওয়ার সংবাদ আজকের খবরের কাগজে বিরল নয়!
২০১৭ সালের বাংলাদেশকে দেখলে মনে হয় যেন সুলতান আলাউদ্দিন হোসেন শাহ্ শরীফ মক্কীর প্রেতআত্নারা আবার ফিরে এসেছে। বাংলাদেশের কৃষ্টি কালচার বিরোধী, পৌত্তলিক ভাবধারার কৃষ্টি কালচার প্রবেশ করানোর চেষ্টা চলছে জোরে-সোরে সরকারী ও বেসরকারি ভাবে। নিন্মের সংবাদগুল তারই স্বাক্ষ্য বহন করে।
(১) “মঙ্গল শোভাযাত্রার নির্দেশনা প্রত্যাহার দাবি ইসলামী দলগুলোর
পহেলা বৈশাখে মঙ্গল শোভাযাত্রার মাধ্যমে বর্ষবরণ সংক্রান্ত শিক্ষামন্ত্রনালয়ের নির্দেশিকা প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছে ইসলামী দলগুলো। নিজেদের আলাদা আলাদা অনুষ্ঠানে এ দাবি জানায় খেলাফত মজলিশ ও ইসলামী ঐক্যজোট বাংলাদেশ।
আজ বুধবার সন্ধ্যা সোয়া ৭টায় রাজধানীর বিজয়নগরস্থ মিলনায়তনে খিলাফত মজলিসের বৈঠকে নেতৃবৃন্দ বলেন, ৯২ ভাগ মুসলমানের দেশে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পহেলা বৈশাখে মঙ্গল শোভাযাত্রার মাধ্যমে বর্ষবরণ সংক্রান্ত শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশিকা কোনোক্রমেই গ্রহণযোগ্য নয়। মঙ্গল শোভাযাত্রা এ দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের সংস্কৃতির অংশ নয়। সরকার কর্তৃক জোর করে ভিন্ন ধর্মের সংস্কৃতি এদেশের জনগণের উপর চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টার করা হচ্ছে। (০৫ এপ্রিল ২০১৭,বুধবার, ২০:২৬, দৈনিক নয়া দিগন্ত ) ”
(২) মঙ্গল শোভাযাত্রা ছড়িয়ে দেয়ার পরিকল্পনা গ্রহণযোগ্য নয়
ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের আমির মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ রেজাউল করীম বর্ষবরণের নামে মঙ্গল শোভাযাত্রার আয়োজন গ্রামে-গঞ্জেও ছড়িয়ে দেয়ার অশুভ পরিকল্পনার তীব্র সমালোচনা করেছেন। তিনি বলেন, বাঙালি সংস্কৃতির সর্বজনীনতার তত্ত্বের আড়ালে এসব বিধর্মীয় মূর্তির শোভাযাত্রা অনুশীলনের জন্য এ দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ তৌহিদি জনতাকে বাধ্য করার উদ্যোগ গ্রহণযোগ্য নয়। অমুসলিমদের প্রতীক ও উপমা ব্যবহার করা ইসলামে নিষিদ্ধ। তিনি বলেন, মঙ্গল শোভাযাত্রা একটি সংখ্যালঘু হিন্দু জনগোষ্ঠীর ধর্ম ও সংস্কৃতির অংশ। মূলত দেব দেবীকে উদ্দেশ্য করে এসব আচার অনুষ্ঠানের মাধ্যমে একটসংখ্যালঘু গোষ্ঠী কল্যাণ কামনা করে থাকে।------------------------------------------------------ --------- (০৬ এপ্রিল ২০১৭,বৃহস্পতিবার, ০০:৫৫ দৈনিক নয়া দিগন্ত)
চলবে -------
বিষয়: বিবিধ
৮৪৯ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন