আমাদের পূর্ব পুরুষদের শত্রু-মিত্র পর্ব ৪৩

লিখেছেন লিখেছেন আনিসুর রহমান ১৩ এপ্রিল, ২০১৭, ০৬:৩০:৩৮ সন্ধ্যা

এই পর্বে তৎকালে সুলতান হোসেন শাহ্‌ শরীফ মক্কী কতৃক সৃষ্ট সাহিত্যের মধ্য দিয়ে ‘হিন্দু রেনেসাঁ আন্দোলন’ মুসলিম সমাজকে কতখানি প্রভাবিত করে ছিল তা আমরা আলোচনা করব একটি কেস স্টাডির মধ্যদিয়ে।

কেস স্টাডি (Case Stusy):

বিষয়ঃ সুলতান আলাউদ্দিন হোসেন শাহ্‌ শরীফ মক্কীর পৃষ্ঠপোষকতায় সৃষ্ট কাব্যের প্রভাব মুসলিম সমাজে।

নির্বাচিত কাব্যের নামঃ মনসামঙ্গল। এই পর্যন্ত প্রায় ষাটটি বিভিন্ন লেখক কতৃক বিভিন্ন সময়ে লিখিত মনসামঙ্গল কাব্যের কথা জানা যায়। (Bangla Literature by Romesh Detta, Page 276)

কাব্যের বিষয় বস্তুঃ দ্রাবিড়দের (স্থানীয় ভারতীয়দের) সাপের দেবী ‘মনসার’ সাথে বহিরাগত আর্যদের দেবতা ‘শিবের’ লড়াই এবং দ্রাবিড়দের দেবী মনসার বিজয়। এই লড়াইকে বহিরাগত আর্যদের সাথে দ্রাবিড়দের প্রতীকি লড়াই হিসাবেও বিবেচনা করেছন কেউ কেউ।

লেখকঃ বিজয় গুপ্তা/ বিপ্রদাশ। উল্লেখ্য বাংলাতে প্রথম মনসামঙ্গল কাব্য লিখেন এক চোখ অন্ধ হরি দত্ত। তবে রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকতায় বিজয় গুপ্তা কতৃক লিখিত মনসামঙ্গল কাব্য ব্যাপক লোক জনপ্রিয়তা পায়, বলাই বাহুল্য এর পিছনে কাজ করেছে রাষ্ট্রীয় মদদ। হরি দত্তের মনসামঙ্গল কাব্য সম্পর্কে বিজয় গুপ্তা তার পদ্মা পুরানে বলেনঃ

মূর্খে রচিল গীত না জানে মাহত্ন্য।

প্রথমে রচিল গীত কানা হরি দত।।

হরিদত্তের যত গীত সুপ্ত হৈল কালে।

যোড়াগাঁথা নাহি কিছু ভাবে মোরে ছলে।।

কথার সঙ্গতি নাই নাহিক সুস্বর।

এক গাইতে আর গায় নাই মিত্রাক্ষ।।

গীতে মতি না দেয় কিছু মিছা লাফ ফাল।

দেখিয়া শুনিয়া মোর উপজে বেতাল।।

(সুত্রঃ Bangla Literature by Romesh Detta, Page 278)

কাব্যের পৃষ্ঠপোষকঃ বাংলার সুলতান আলাউদ্দিন হোসেন শাহ্ শরীফ মক্কী

মুসলিম সমাজে এই মনসামঙ্গল কাব্যের প্রভাব: ---

মুসলিম সমাজে এই মনসামঙ্গল কাব্যের প্রভাব সম্পর্কে মাওলানা আকরাম খাঁ তার মুসলিম বঙ্গের সামাজিক ইতিহাস গ্রন্থের ৭৮-৭৯ পৃষ্ঠায় বলেনঃ—

“ মহাভারত ও দেবী ভাগবতে আমরা মনসার আংশিক বিবরণ দেখিতে পাই। তাহার জীবন বৃতান্ত সম্পর্কে মতভেদ থাকিলেও আমরা তাহাকে শিবের কন্যা বলিয়া ধরিয়া লইতে পারি। ভাষার শালীনতা রক্ষা করিয়া মনসার কাহিনী বর্ণনা করা সম্ভব নহে। মোদ্দাকথা, জন্মের পর মুহুতেই তিনি পরিপূর্ণ যৌবনবতী হইয়া উঠেন এবং শিব বা মহাদেব তাহাকে স্বগৃহে লইয়া যান। শিবের পত্নী চন্ডী বা দুর্গা যে কারনেই হউক তাহাকে দেখা মাত্র আক্রোশে ফাটিয়া পড়েন। ফলে দুই দেবীর মধ্যে যে সংঘস বাধে তাহাতে মনসা একটি চক্ষু হারান। মনসা দুর্গার প্রতি ক্রোধে ক্ষিপ্ত হইয়া উঠিলেন। শিবও তাহার রোষ হইতে বাদ পড়িলেন না। (সাপ নাচানোর বর্ণনা এখানে আমরা বাদ দিতেছি- মনসা কিন্তু সাপের দেবী হিসাবে পূজিত হন)। মনসা প্রতিজ্ঞা করিলেন যে তাহার এই অপমানের প্রতিশোধ না লইয়া ছাড়িবেন না। তাহার সহচরী নেত্রবতীর সাহিত পরামর্শ করিয়া তিনি শিব ও দুর্গা – ভক্তদের মনসা পূজায় বাধ্য করিবেন বলিয়া স্থির করিলেন। এই উদ্দেশ্য লইয়া বাংলাদেশে তিনি এক বিশেষ রূপে আবির্ভূত হইলেন এবং অতি অল্পায়াসে ধীরে ধীরে রাখাল, জেলে এবং গরীব মুসলমানদের তাহার পূজায় প্রবৃত্ত করিতে সমর্থ হইলেন। (বাংলা সাহিত্যের কথা, পৃষ্ঠা ১৬)

চাঁদ সদাগরের স্ত্রী একজন মনসাভক্ত নারী ছিলেন। কিন্তু তাহার স্বামী কোন ক্রমেই মনসার পূজা করিতে রাজি হইলেন না। রাগান্বিত হইয়া মনসা তাহাকে নানা বিপদ ও ক্ষয়ক্ষতির মধ্যে ফেলিতে লাগিলেন। কিন্তু সাতটি সন্তান ও প্রচুর ধনসম্পদসহ তাহার সমুদয় জাহাজ সমুদ্রে নিমজ্জিত হওয়া সত্বেও সওদাগর নিজের মতে অটল রহিলেন। অবশেষে কঠোর সতর্কতা সত্বেও তাহার একমাত্র জীবিত পুত্র লখিন্দর সর্পাঘাতে নিহত হয় এবং লখিন্দরের স্ত্রী বেহুলা তাহার প্রগার ভক্তি ও মনসার দয়ায় তাহাকে পুনঃজীবিত করিতে সক্ষম হয়। চাঁদ সওদাগরের হারানো সকল পুত্র ও ধনৈশ্বর্ষ পুনরায় তাহাকে ফিরাইয়া দেওয়া হয়।

এই মনসা পূজা এবং ইহার সহিত সম্পর্কযুক্ত বেহুলার ভাসান বিংশতি শতাব্দীর প্রথম পাদ পর্যন্ত যশোহর, খুলনা ও চব্বিশ পরগনা প্রভৃতি অঞ্চলের মুসলমানদের মধ্যে প্রচলিত ছিল।”

মুসলিম সমাজে এই মনসামঙ্গল কাব্যের প্রভাব সম্পর্কে আব্বাস আলী খান তার বাংলার মুসলমানদের ইতিহাস গ্রন্থের ৪৭ পৃষ্ঠায় মাওলানা আকরাম খাঁর উপরে বর্ণিত বর্ণনার রেফারেন্স দিয়ে বলেনঃ “ শুধু দক্ষিণ বংগেই নয় বাংলার প্রায় সকল অঞ্চলের একশ্রনীর মুসলমান শিরক এবং কুফরী ধারনা পোষণ করে গ্রামে গ্রামে বেহুলার ভাসান বা ভাসান যাত্রা উৎসাহ উদ্যম সহকারে অনুষ্ঠিত করত।”

মুসলিম সমাজে এই মনসামঙ্গল কাব্যের প্রভাব সম্পর্কে জাতীয় অধ্যাপক সৈয়দ আলী আহসান তার বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্তি গ্রন্থের ২০ পৃষ্ঠায় বলেনঃ “ আমরা দেখতে পাই যে, সতের এবং আঠারো শতকের ধর্মমঙ্গল মনসামঙ্গল কাব্যে পীরের বন্দনা আছে। পীর ইসমাইল গাজীই পরবর্তীকালে বড় খাঁ গাজী রূপে বন্দনা পেয়েছেন। ” (বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্তি, মুহাম্মদ আব্দুল হাই, সৈয়দ আলী আহসান)।

তার এই বর্ণনা থেকে এটা পরিষ্কার যে, ভারতীয় মুসলিম সমাজে “পীর” ধরনার সৃষ্টি এবং পরবর্তীতে তা সুদৃঢ় ভাবে ক্যানসারের মত মুসলিম সমাজের গভীরে ছড়িয়ে পড়ার পিছনে রয়েছ এই সকল মঙ্গল কাব্যের বিরাট ভূমিকা।

চলবে-------

বিষয়: বিবিধ

৯৯৩ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File