আমাদের পূর্ব পুরুষদের শত্রু-মিত্র পর্ব ৪২
লিখেছেন লিখেছেন আনিসুর রহমান ০৭ এপ্রিল, ২০১৭, ০৮:০৩:০৯ সকাল
আমরা আলোচনা করছিলাম হোসেন শাহ্ এবং নাসিরদ্দিন নসরৎ শাহর পৃষ্ঠপোষকতায় কী ধরনের বাংলা সাহিত্য রচিত হয়ে ছিল সে বিষয়ে----
(খ) মালাধর বসুর ভ্রাতা গোপীনাথ বসু ওরফে পুরান্দর খান শ্রীকৃষ্ণের প্রণয়লীলা বিষয়ক একটি মহাকাব্য রচনা করেন।
(গ) ব্রাহ্মান বিপ্রদাস মানসামঙ্গল কাব্য রচনা করেন। একই সময়ে বিজয় গুপ্তাও মানসামঙ্গল কাব্য রচনা করেন। বিজয় গুপ্তা, হোসেন শাহ্র অনেক গুন কিত্তন ও স্তোস্ত্রি করেন। সে সুলতানকে মহাভারতে বর্ণিত চরিত্র ‘অর্জুনের’ সাথে তুলনা করেন। বিজয় গুপ্তা কতৃক হোসেন শাহকে মহাভারতে বর্ণিত চরিত্র ‘অর্জুনের’ সাথে তুলনা করা অত্যান্ত তাৎপর্যবহ। কেননা আমরা দেখি যে মহাভারতে বর্ণিত হিন্দু পৌরানিক চরিত্র ‘অর্জুন’ শ্রীকৃষ্ণের একজন একনিষ্ঠ সহচর, যে সর্বতভাবে কুরুক্ষেত্রর যুদ্ধ শ্রীকৃষ্ণকে সাহায্য সহযোগিতা করে ছিল। এখন আমরা যদি সতর্কতার সাথে হোসেন শাহ্ যে বাংলা সাহিত্যকে পৃষ্ঠপোষকতা করে ছিল তা নিরীক্ষা করি তবে দেখবো যে, তার একটা বড় অংশই ছিল শ্রীকৃষ্ণের গুন কিত্তন। এমন কী তার সার্বিক সহয়তায় শ্রী চৈতন্য যে বৈষ্ণব ধর্ম প্রচার করছিল তার মুলমন্ত্রও ছিল ভগবান শ্রীকৃষ্ণর কিত্তন। এ সম্পর্কে “Islam In Bangladesh through ages” গ্রন্থে ডঃ মইনউড্ডীন আহামেদ খান চার নং অধ্যায়ের ১২৭ পৃষ্ঠায় “Impact of Islam on religio-social and cultural life of the people of Bangladesh” এই শিরোনামে এক নিবন্ধে বলেন, “ According to his(Mahaprvu chaintny) teaching, Sri Krishna is god and the the supreme reality. The world is in Him and He is in the world (Creation). --- Krishnadas Kaviraj writes: ‘the world has been created at the desire of Krishna, he is one and has no two bodies”
বিজয় গুপ্তা তার পদ্মা পুরানাতে সুলতান হোসেন শাহ্কে ‘নরপতি তিলক (তিলক চিনহ ধারী রাজা )* উপাধিতে ভূষিত করেন।
*সনাতন হুসেন সাহ নৃপতি-তিলক (Bangla Literature by Romesh Detta, Page 42)
(ঘ) হোসেন শাহর নিয়োগকৃত চিটাগাং এর শাসনকর্তা পরগল খানের পৃষ্ঠপোষকতায় ‘মহাভারতের’ বাংলা সংস্করণ ‘পাণ্ডব বিজয়’ লিখেন কবিন্দ্র পরমেশ্বর। কবিন্দ্র পরমেশ্বর সুলতান হোসেন শাহ্র অনেক গুন কিত্তন ও স্তোস্ত্রি করেন তার কাব্যে। উল্লেখ্য মহাভারত হ’ল সংস্কৃত ভাষায় রচিত প্রাচীন দুইটি হিন্দু পৌরানিক কাহীনির অন্যতম একটি, অন্যটির নাম রামায়ণ। কবিন্দ্র পরমেশ্বর হোসেন শাহ্র স্তোস্ত্রি করে মহাভারতে লিখেনঃ
নৃপতি সনাতন হুসেন সাহ হয় মহামতি (Bangla Literature by Romesh Detta, Page 42)
(ঙ) যোশরাজ খান ছিলেন আলাউদ্দিন হোসেন শাহ্ নিয়োগকৃত একজন উচ্চপধস্ত আফিসার, তিনি আনেকগুল বৈষ্ণব পদাবলী রচনা করেন। তিনিও অন্যানদের ন্যায় হোসেন শাহ্র গুন কিত্তন ও স্তোস্ত্রি বর্ণনায় পঞ্চমুখ ছিলেন। তিনি হোসেন শাহ্র স্তোস্ত্রি করে সঙ্গীত রচনা করেনঃ শ্রীযুক্ত হসন, জগত ভুযন(বিশ্বজগতের ভূষণ),সেহ এহি, রস, জান (Bangla Literature by Romesh Detta, Page 42)
উপরে উল্লেখিত আলোচনার আলোকে যদি আমরা বলি, আলাউদ্দিন হোসেন শাহ্র সময়ে বাংলা সাহিত্যের উপর ভর করে হিন্দু জাতির ‘রেনেসাঁ আন্দোলন’ জোরদার হয়ে ছিল, তবে তা কোন বিচারেই ভুল হবে না । উল্লেখ্য প্রাচীন ও মধ্যযুগে হিন্দু সমাজে কবি সাহিত্যিকদের অনেক উচ্চ মর্তবা ছিল। আম জনতা তাদেরকে দেবতা সদৃশ্য জ্ঞান করত যা এই ‘রেনেসাঁ আন্দোলন’কে নিঃসন্দেহে বেগবান করতে ভূমিকা রেখে ছিল। হিন্দু জাতির এই ‘রেনেসাঁ আন্দোলন’ সম্পর্কে শ্রদ্ধেয় মাওলানা আকরাম খাঁ মুসলিম বঙ্গের সামাজিক ইতিহাস গ্রন্থের ৯৮ পৃষ্ঠায় বলেন, “ হিন্দু লেখকগনের মতে হোসেন শাহ্র সিংহাসনে আরোহণের পর হইতে গৌড় দেশে ‘রামরাজ্য’ আরাম্ভ হইয়া গেল। মাননীয় দীনেশচন্দ্র সেন মহাশয় এ বিষয়ের ভূমিকা হিসাবে বলিতেছেন ঃ মুসলমান, ইরান, তুরান প্রভৃতি স্থান হইতেই আসুক না কেন, এ দেশে আসিয়া সম্পুন বাঙ্গালী হইয়া পড়িলেন। মসজিদের পাশে দেব মন্দিরের ঘণ্টা বাজিত লাগিল, মহরম, ঈদ, শবে বরাত প্রভৃতির পাশে দুর্গোৎসব, রাম, দোল উৎসব চলিতে লাগিল। ----- এহেন পরিস্থিতির মধ্যে সুলতান আলাউদ্দিন হোসেন শাহ্র অভ্যুদয় হইল।”( বাংলার মুসলমানদের ইতিহাস, আব্বাস আলী খান)।
যে সময়টাতে, দায়ী ইল্লেলল্লাহ বা ইসলাম প্রচারকদের অন্যায়ের বিরুদ্ধে এবং কল্যাণের পক্ষে দীঘ সংগ্রাম ও প্রচেস্টা এবং মুসলমানদের জাতপাত বিহীন উদার ও ইনসাফ ভিত্তিক সমাজনীতির কাছে ব্রাহ্মবাদীদের পরাজিত হওয়া প্রতিদিনের রুটিনে পরিণত হয়ে গিয়ে ছিল; ধীরে ধীরে মুসলমানরা শুধু রাজনৈতিক ভাবেই নয় সামাজিক ভাবেও বিজয় অর্জন করছিল। ফলে মুসলমানদের এই উদার ও ইনসাফ ভিত্তিক সমাজনীতির কাছে প্রতিদিন পরাজিত হওয়া থেকে বের হয়ে আসার জন্য কী কী পরিকল্পনা করা যায় আর কী ভাবেই বা তা বাস্তবায়ন করা যায় তা নিয়ে চিন্তা ভাবনা করতে ব্যাধ্য হয়ে ছিল, সচেতন হিন্দু সমাজ ।
ঠিক সেই সময়ে, এই অসহনীয় ও বিব্রতকর পরিস্থিতি থেকে বের হয়ে আসার জন্য তৎকালীন রাজনৈতিক ও অর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে যে যে পরিকল্পনা ও তার বাস্তবায়ন দরকার ছিল, তা নিয়ে হাজির হন আলাউদ্দিন হোসেন শাহ্ । তিনি শুধু সেই পরিকল্পনা করেই ক্ষান্ত হননি বরং সাফল্যের সাথে তা বাস্তবায়নও করেছিলেন। আর এ কারনেই হোসেন শাহ্ কে অবতার জ্ঞান করে হিন্দু সমাজঃ
নৃপতি হুসেন শাহ্ হয়ে মহামতি
পঞ্চম গৌড়তে যার পরম সুখ্যাতি।
অস্ত্র শস্ত্রে সুপণ্ডিত মহিমা অপার।
কলিকালে হবু যেন কৃষ্ণ অবতার। (বংগ ভাষা ও সাহিত্য, দীনেশ চন্দ্র সেন)
দীনেশ চন্দ্র সেন তার বংগ ভাষা ও সাহিত্যে আরও বলেন, কবীন্দ্র পরমেশ্বর (যিনি মহাভারতের বাংলা সংস্করণ ‘পাণ্ডব বিজয়’ লিখেছিলেন) ইহাকে (হোসেন শাহ্) কৃষ্ণের অবতার বলিয়া বর্ণনা করিয়াছেন।
উপরের আলোচনায় আমরা বেশ কিছু মজার তথ্য পাই। যেমন আলাউদ্দিন হোসেন শাহ্ মক্কী নিজের মুসলিম নামের জন্য গর্ববোধ করলেও তার অনুগত লোকদের অর্ধেক অর্ধেক নাম রাখাকে পছন্দ করতেন। যেমন তার উজির ও প্রধান কর্মকর্তার নাম ছিল গোপীনাথ বসু ওরফে পুরন্দর খান! এমন কী গুনী ব্যাক্তিদের উপাধি দেওয়ার ক্ষেত্রেও তিনি এই অর্ধেক অর্ধেক সুত্রকে অনুসরণ করতেন। যেমন তিনি মালাধর বসুকে ‘গুণরাজ বসু’ উপাধি না দিয়ে ছিলেন ‘গুণরাজ খান’ উপাধি। অপর দিকে তার অনুগতরা তার স্ত্রোস্তি ও গুন কিত্তন করে তাকে যে উপাধিতে ভূষিত করে ছিলেন তার সবই ছিল হিন্দু উপাধি! যেমন, বিজয় গুপ্তা তার পদ্মা পুরানাতে সুলতান হোসেন শাহ্কে ‘নরপতি তিলক (তিলক চিনহ ধারী রাজা ) উপাধিতে ভূষিত করে ছিলেন এবং তাকে তুলনা করে ছিলেন মহাভারতের পৌরানিক চরিত্র ‘অর্জুনের’ সাথে। যোশরাজ খান আলাউদ্দিন হোসেনকে সম্মান করেন ‘শ্রীযুক্ত হসন’ বলে সম্বোধন করে ছিলেন এবং তাকে জগত ভূষণ(বিশ্বজগতের ভূষণ) উপাধিতে দেন। বলার অপেক্ষা রাখে না যে এর সবগুলই ছিল হিন্দু উপাধি।
এখানে বলার অপেক্ষা রাখে না যে, বাদশা আলাউদ্দিন হোসেন শাহ্ শরীফ মক্কীর অনুগতরা তাদের মনিবকে ভালভাবেই চিনতেন; তিনি কে? তারা জানতেন তাদের বাদশানামদার, কী পছন্দ করেন আর কী অপছন্দ করেন। কী করলে/বললে সন্তুষ্ট হন আর কী করলে/বললে অসন্তুষ্ট হন। তারা জানতেন তাদের বাদশা তাদের থেকে কোন ধরনের প্রশংসা শুনতে চায়, কোন সম্মান আশা করেন। বাদশা নামদারকে কোন উপাধিতে ভূষিত করলে সবচেয়ে বেশী খুশী হবেন এবং কার সাথে তুলনা করলে সন্তুষ্ট হবেন আর কার সাথে তুলনা করলে অসন্তুষ্ট হবেন। কেননা এ বিষয়ে পরিপূর্ণ জ্ঞান থাকাটা তাদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার ছিল, শুধু চাকরি রক্ষা করার জন্য নয় বরং এর সাথে তাদের জীবন রক্ষা করার মত বিপদজনক বিষয়ও জড়িত ছিল। বাদশানামদার তার অপছন্দের ব্যাক্তিবর্গদের সাথে কী ধরনের আচরণ করেন তার বাস্তব উদাহরণ তাদের চোখের সামনেই ছিল। উল্লেখ্য হোসেন শাহ্ হাজার হাজার সৈন্য, মুসলিম আমীর ওমরাকে হত্যা করে তার ক্ষমতাকে সুসংহত করেন। সুতরাং তৎকালের ঐ সকল বিজ্ঞজন কতৃক বাদশামদারকে দেও এই সকল উপাধি, তুলনা ইত্যাদিই যথেষ্ট, সুলতান হোসেন শাহ্ কী প্রকৃতির লোক ছিলেন তা বুঝার জন্য, এ কথা কোন প্রশ্ন ছাড়াই নির্দ্বিধায় মেনে নেওয়াই যুক্তিযুক্ত। হোসেন শাহ্ সম্পর্কে আব্বাস আলী খান তার বাংলার মুসলমানদের ইতিহাস গ্রন্থের ৩৬ পৃষ্ঠায় বলেছন, “ ইতিহাসের এক অতি বিস্ময় এ হোসেন শাহ্।” বস্তুত আলাউদ্দিন হোসেন শাহ্ শরীফ মক্কীর ঐতিহাসিক ব্যাক্তিত্বকে এক কথায় বলার/বুঝার জন্য আব্বাস আলী খানের এই উক্তিই যথেষ্ট; “ ইতিহাসের এক অতি বিস্ময় এ হোসেন শাহ্।”
চলবে ----------
বিষয়: বিবিধ
৯৩৭ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন