আমাদের পূর্ব পুরুষদের শত্রু-মিত্র পর্ব ৩৯
লিখেছেন লিখেছেন আনিসুর রহমান ২৫ মার্চ, ২০১৭, ০৪:৪৬:৫০ রাত
প্রশ্ন হ’ল শাহবাগীরা কেন ‘বাউল’ কালচার ও সংস্কৃতিকে এত গুরুত্ব দিয়ে তুলে ধরে ছিল, তাদের মুভমেন্টের মধ্যমে? ‘বাউল’ কালচার ও সংস্কৃতিকে এত গুরুত্ব দেওয়ার পিছনে কী কারনই বা লুকায়িত ছিল? এই বিষয়টি নিয়ে যদি আমরা অনুসন্ধান করি তবে দেখব যে, অন্যান্য অর্ধেক-অর্ধেক গুষ্ঠিগুল কালের আবর্তে হারিয়ে গেলেও কিছু কিছু অর্ধেক-অর্ধেক গুষ্ঠি এখনও বাংলাদেশে অত্যান্ত সীমিত পরিসরে হলেও বর্তমান আছে এবং তার মধ্যে অন্যতম হ’ল এই ‘বাউল’ সম্প্রদায়। এই বাউল সম্প্রদায়ের উৎপত্তি ও বিকাশ সম্পর্কে পূর্বে আমরা আলোচনা করে ছিলাম। বুঝার সুভিদার জন্য এখন আমরা দেখব এই বাউল সংস্কৃতিটা কী?
১১ থেকে ১৩ ই মার্চ ২০১৭ ছিল বাউল সম্রাট লালন শাহ্ স্মরনৎসব। লালন অনুসারীদের বিশ্বাস অনুসারে লালন ফকীর তার আখড়ায় ফাল্গুনের শেষে বা চৈতের শুরুতে দোল পূর্ণিমায় সাধুসঙ্গ করতেন। তার স্মরণে প্রতি বছর দোল পূর্ণিমায় লালন স্মরনৎসব হয়ে থাকে। এই লালন স্মরনৎসবের উপর, ৯-ই মার্চ ২০১৭, দৈনিক মানব জমিনের একটি সংবাদের শিরোনাম ছিল, “লালন উৎসবে গাজা সেবন ও নারী পুরুষ রাত্রি যাপন নজরদারিতে।” নিন্মে সংবাদটির বিস্তারিত বর্ণনা তুলে ধরা হলঃ--
“লালন স্মরণোৎসব অনুষ্ঠানে প্রকাশ্যে গাঁজা সেবন বা বিক্রি সীমাবদ্ধ রাখতে হবে। এছাড়া নারী ও পুরুষেরা এক সঙ্গে দিন-রাত্রি যাপন করতে পারবেন না। এ দুই বিষয় নজরদারিতে রাখতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে চিঠি দিয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। পাশাপাশি কুষ্টিয়ার জেলা প্রশাসককেও এ বিষয়ে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। -----এবারের লালন স্মরণোৎসব অনুষ্ঠানটি হবে তিন দিনব্যাপী এবং ১লা কার্তিক লালনের পরলোকগমন দিবস উপলক্ষে ৫ দিনব্যাপী লালন তিরোধান দিবস পালিত হবে। এ দুই অনুষ্ঠানে কুষ্টিয়া জেলাসহ সারা দেশ এবং পার্শ্ববর্তী ভারত থেকে লালন ভক্ত, শিল্পী, আলোচক ও বিশিষ্ট গবেষকসহ গণ্যমান্য ব্যক্তিরা লালন একাডেমিতে আসেন। প্রতিটি অনুষ্ঠানে প্রতিদিন প্রায় লক্ষাধিক লোকের সমাগম ঘটে। এসব অনুষ্ঠানে দেশ-বিদেশের বরেণ্য আলোচক, ব্যক্তি, শিল্পীরা লালনের উপর আলোচনা ও লালন সংগীতসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করে থাকেন। বিশেষ প্রতিবেদনে এ অনুষ্ঠান সম্পর্কে বলা হয়, এ অনুষ্ঠানকে ঘিরে লালন অনুসারীদের মধ্যে অনেকেই গাঁজা সেবন ও গাঁজা বিক্রি করে থাকে। প্রকাশ্যে গাঁজা সেবন এবং গাঁজা বিক্রি করায় স্থানীয় এলাকাবাসী এবং প্রকৃত লালন ভক্তদের মধ্যে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।‘লালন স্মরণোৎসব’ এবং ‘লালন তিরোধান দিবস’ অনুষ্ঠানে লালনের অনুসারী মহিলা ও পুরুষ এক সঙ্গে লালন একাডেমি প্রাঙ্গণে দিন-রাত্রি যাপন করে থাকে। বাংলাদেশ একটি মুসলিম অধ্যুষিত দেশ হওয়ায় নারী-পুরুষ এক সঙ্গে থাকার বিষয়টি স্থানীয় জনগণসহ একশ্রেণির লালন ভক্তরা নেতিবাচক দৃষ্টিতে দেখছেন। এর আগে ২০০০ সালে লালন একাডেমির পরিচালনা পর্রিষদের হস্তক্ষেপে গাঁজা সেবন নিষিদ্ধ করা হলে কিছু সংখ্যক লালন অনুসারী লালন মেলা প্রাঙ্গণ ত্যাগ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করায় মেলা বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়। পরে লালন একাডেমি কর্তৃপক্ষ গাঁজা সেবন নিষিদ্ধ প্রত্যাহার করে নেন। এছাড়া ২০১১ সালে সাবেক জেলা প্রশাসক ও লালন একাডেমির সভাপতি বনমালী ভৌমিক লালন স্মরণোৎসব অনুষ্ঠানে প্রকাশ্যে গাঁজা সেবন এবং গাঁজা বিক্রি নিষিদ্ধ করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। (দৈনিক মানব জমিন, ৯ ই মার্চ, ২০১৭)।
যদিও উপরের বর্ণিত খবরে উল্লেখ্য করা হয়েছে যে, গাজা-ভাং বিক্রি এবং নারী-পুরুষের একত্রে রাত্রি যাপন প্রকৃত লালন ভক্তদের মধ্যে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। এমন কী বাংলাদেশ এবং পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের লালন ভক্তকূল, শিল্পী, আলোচক ও বিশিষ্ট গবেষকরা সর্বদাই ঐ একই কথার প্রতিধ্বনি করে থাকে। আসুন আমরা দেখি প্রকৃত ঘটনা আসলে কী। এই বাউলদের কৃষ্টি কালচার সম্পর্কে বাংলার মুসলমানদের ইতিহাস গ্রন্থের লেখক, শ্রদ্ধের মাওলানা আকরাম খাঁর মুসলিম বঙ্গের সামাজিক ইতিহাস গ্রন্থের রেফারেন্স টেনে বলেন, “ ভন্ড ফকীরের দল বিভিন্ন সম্প্রদায় ও উপ সম্প্রদায়ে বিভক্ত ছিল। আউল, বাউল, কর্তাভজা, সহজিয়া প্রভৃতি। এগুল হচ্ছে হিন্দু বৈষ্ণব ও চৈতন্য সম্প্রদায়ে মুসলিম সংস্করণ যাতে করে সাধারন অজ্ঞ মুসলমানদেরকে বিপথগামী করা যায়।
এদের মধ্যে ‘বাউল’ সম্প্রদায় মনে হয় সর্বপেক্ষা জঘন্য ও যৌনপ্রবন। মদ্য পান, নারী পুরুষে অবাধ যৌনক্রিয়া এদের সকল সম্প্রদায়েরই সাধন পদ্ধতির মধ্যে অনিবার্যরূপে শামিল। -------শ্রদ্ধের মাওলানা আকরাম খাঁ তার উপরে বর্ণিত গ্রন্থে (মুসলিম বঙ্গের সামাজিক ইতিহাস) বলেনঃ ‘ কোরআন মজিদের বিভিন্ন শব্দ ও মুলতত্বের যে ব্যাখা এই সমস্ত শয়তান নেড়ার ফকীরের দল দিয়াছে, তাহাও অদ্ভুত। ‘হাওজে কাউসার’ বলিতে তাহারা বেহশতী সঞ্জীবনী সুধার পরিবর্তে স্ত্রীলোকের রজঃ বা ঋতুস্রাব বুঝে। যে পূজাপদ্ধতিতে এই ঘৃন ফকীরের দল বীর্য পান করে, তাহার সূচনায় বীজ মে আল্লাহ (মায়াযাল্লাহ, মায়াযাল্লাহ ) অর্থাৎ বীর্যে আল্লাহ অবস্থান করে—এই অর্থে ‘বসমিল্লাহ’ শব্দ উচ্চারন করে থাকে।-------
এই মুসলিম ভিক্ষোপজীবী নেড়ার ফকীরের দলের পুরোহিত বা পীরেরা শ্রীকৃষ্ণ কতৃক গোপিনীদের বস্ত্র হরণের অনুরূপ এক অভিনয়ের অনুষ্ঠান করিয়া থাকে। যখন পীর তার মুরীদের বাড়ী তাশরিফ আনে, তখন গ্রামের সকল যুবতী ও কুমার উত্তম বসনে সজ্জিত হইয়া, বিন্দাবনের গোপিনীদের অনুকরণে একটি গৃহকক্ষে পীরের সহিত মিলিত হয়। নাটকের প্রথম অংকে এই সকল স্ত্রীলোক নৃত্যগীত শুরু করে। নিন্মে এই সঙ্গীতের গদ্যরূপ প্রদত্ত হইলঃ
ও দিদি যদি শ্রীকৃষ্ণকে ভালোবাসিতে চাও,
আর আন্তপ্রতারণা না করিয়া শীঘ্র আস,
দেখ, প্রেমের দেবতা আসিয়াছে।
আখি তোল, তাহার প্রতি তাকাও
গুরু আসিয়াছে তোমাদের উদ্ধারের জন্য
এমন গুরু আর কোথাও পাইবে না।
হ্যাঁ, গুরুর যাহাতে সুখ
তাহা করিতে লজ্জা করিও না-------।
গানটি গীত হইলে পর এ সমস্ত নারী তাহাদের গাত্রাবরন খুলিয়া ফেলে।, সম্পুর্ণ উলঙ্গ হইয়া পড়ে এবং ঘুড়িয়া ঘুড়িয়া আনন্দে নৃত্য করিতে থাকে। পীর এখানে কৃষ্ণের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয় এবং শ্রীকৃষ্ণ যেমন গোপিনীদের বস্ত্র হরণ করিয়া বৃক্ষে আরোহণ করিয়া ছিলেন, সেও তদ্রূপ এই সমস্ত উলঙ্গ নারীর পরিত্যাক্ত বস্ত্র তুলিয়া লইয়া গৃহের একটি উচ্চু তাকে রক্ষা করে। এই পীর-কৃষ্ণের যেহেতু বাঁশি নাই, তাই সে নিন্মক্তভাবে মুখে গান গাহিয়াই এই সব উলঙ্গ রমণীদিগকে যৌনভাবে উত্তেজিত করিয়া তোলেঃ ‘ হে যুবতীগণ। তোমাদের মোক্ষের পথ ভক্তকুলের পুরোহিতকে অর্ঘ স্বরূপ দেহদান কর।’
কোনরূপ সংকোচ বোধ না করিয়া পীরের যৌন লালসা পরিতৃপ্তি করাই ইহাদের প্রধান ধর্মীয় কর্তব্য, তাহা বলাই বাহুল্য।” (মুসলিম বঙ্গের সামাজিক ইতিহাস)।
বস্তুত আমরা যদি সে সময়কার শাহবাগের ঘটনাকে সতর্কতার সাথে পর্যবেক্ষণ করি তবে দেখব যে তারা ছিল এই ‘বাউল’ কালচারেরই অবিকল প্রতিমূর্তি। তারাও বাউলদের ন্যায় মদ,গাজা ভাং খেয়েছে এবং নারী পুরুষ তাবুর ভিতরে একত্রে রাত্রি যাপন করেছে! সম্ভবত সেজন্যই সেই সময়ে শাহবাগ মঞ্চ ‘যৌন জাগরন মঞ্চ’ নামে খ্যাতি লাভ করে ছিল। ব্যাক্তিগত ভাবে আমি মনে করেছিলাম এটা শাহবাগী অর্ধেক অর্ধেক গুষ্ঠি বিরোধীদের প্রচারনা মাত্র। কিন্তু অনলাইন পত্রিকা ঢাকা ট্রিবিউনের একটি সংবাদ আমার এই ধারনাকে পাল্টে দেয়। ঢাকা ট্রিবিউনের সংবাদটি শিরোনাম ছিল, “Police bar sex workers rally at SHAHBAGH” (Dhaka Tribune, Published at 04:34 PM March 03, 2017; Last updated at 09:31 PM March 03, 2017) । এখানে ঘটনা পরিষ্কার, কোন ব্যাখা বিশ্লেষণের দরকার পড়ে না। এই ঘটনা বাংলাদেশে প্রচলিত এই প্রবাদটি স্মরন করিয়ে দেয়, মানিকে মাণিক চিনে।
সুতরাং স্পস্টতই বুঝা যাচ্ছে যে, সুলতান আলাউদ্দিন হোসেন শাহ্ কতৃক উদ্ভাবিত এবং শ্রী চৈতন্যের দেখানো পথকে অনুসরণ করে সৃষ্ট অর্ধেক- অর্ধেক গুষ্ঠিগুলর উপস্থিত আজকের বাংলাদেশ বিলুপ্তপ্রায় হলেও তাদের কুলষিত মতবাদের প্রভাব প্রবল। আজকে তারা শ্রী চৈতন্যের বৈষ্ণব মুভমেন্টের ন্যায় ‘পাষান্ড’ দলনের কাজে ব্যাস্ত। এই অঞ্চলের বৃহৎ জনগুষ্ঠির কৃষ্টি কালচারের বিরুদ্ধে কাজ করছে; ইসলাম প্রচারক বা দায়ীইল্লেলল্লা, ইসলামী দল এবং মুমিনদের বিরুদ্ধে কাজ করছে। সব চেয়ে বিস্ময়ের বিষয় হ’ল মুসলিম নামধারী আমাদের সমাজের একটি উল্লেখ্যযোগ্য অংশ অজ্ঞতা হেতু তাদেরকে সমর্থন করছে। এটাই আজকের বাংলাদেশের বাস্তবতা, আমরা মানি বা না-মানি, স্বীকার করি বা না-করি তাতে কিছু আসে যায় না।
চলবে------
বিষয়: বিবিধ
৯৪০ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন