আমাদের পূর্ব পুরুষদের শত্রু-মিত্র পর্ব ৩৬
লিখেছেন লিখেছেন আনিসুর রহমান ২৫ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭, ০৬:০১:০১ সকাল
আমরা পূর্বেই বলে ছিলাম যে বাংলার সুলতান আলাউদ্দিন হোসেন শাহ কতৃক শ্রী চৈতন্যর সাহায্যে বৈষ্ণব মুভমেন্ট সৃষ্টির উদ্দেশ্য ছিল- এক, এই অঞ্চলের ইসলাম সম্পর্কে অজ্ঞ মুসলিমদের মাঝে পৌত্তিলোকতার বিষবাস্প ঢুকিয়ে দিয়ে অর্ধেক অর্ধেক গুষ্ঠি তৈরি করা যেমন লালন ফকীরের বাউল। এই মিশনে সে যে সফল হয়ে ছিল তার প্রমান আমরা পাই ১৯১১ সালের ভারতের আদমশুমারীর রিপোর্টে। এই রিপোর্টে বলা হয়েছে যে, লোক গণনার সময়ে এমন কিছু গুষ্ঠির সাক্ষাৎ পাওয়া গেছে যারা দাবী করেছে যে তারা হিন্দু এবং একই সাথে মুসলমানও! অর্থাৎ তাদের দাবী তারা উভয় ধর্মের অনুসারী! দুই, বাংলা সাহিত্য ক্ষেত্রে বিপ্লব ঘটিয়ে ‘মঙ্গল কাব্যের’ সাহায্য নিয়ে মুসলমানদের আচার আচরণ ও ধর্ম বিশ্বাসের ক্ষেত্রে তাওহিদকে হাঁটিয়ে পৌত্তলিকতা ঢুকিয়ে দেওয়া। কী কী পদ্ধতি অবলম্বন করে সে সাফল্য পেয়ে ছিল তা বর্ননা করার পূর্বে আমরা সংক্ষিপ্তাকারে দেখব বাংলার সুলতান হোসেন শাহ(১৪৯৩—১৫১৯ খৃঃ) সম্পকে অনন্য বিজ্ঞজনেরা কী বলেছেন।
জামাতে ইসলামী বাংলাদেশের প্রয়াত আমীর জনাব আব্বাস আলী খান তার ‘বাংলার মুসলমানদের ইতিহাস গ্রন্থের ৪৭ পৃষ্ঠায় বাংলার শাসক আলাউদ্দীন হোসেন শাহ্ সম্পর্কে বলেন, “ বাংলার ইতিহাস আলোচনা করলে জানা যায় যে, সর্বপ্রথম হোসেন শাহী আমলেই মুসলমানদের আচার আচরণ ও ধর্ম বিশ্বাসে পৌত্তিলোকতার অনুপ্রবেশ ঘটেছিল। শ্রী চৈতন্য ও বৈষ্ণব সমাজের বিরাট প্রভাব যে মুসলমানদের ধর্ম বিশ্বাস কুলষিত করে ছিল তাতে সন্দেহ নেই। হোসেন শাহ্ কতৃক লক্ষ লক্ষ সম্ভ্রান্ত মুসলমান আমীর ওমরা, ধর্মীক ও পীর অলী নিহত হওয়ায় এবং হোসেন শাহ্ স্বয়ং শ্রী চৈতন্যের শিষ্যত্ব গ্রহণ করার কারনে মুসলিম সমাজে পৌত্তলিক ভাবধারার অনুপ্রবেশ সহজতর হয়েছিল।”
দীনেশ চন্দ্র সেন তার ‘ বঙ্গভাষা ও সাহিত্যে’ বাংলার শাসক আলাউদ্দীন হোসেন শাহ্ সম্পর্কে বলেন, “ কবীন্দ্র পরমেশ্বর ইহাকে (হোসেন শাহ্) কৃষ্ণের আবতার বলিয়া বর্ণনা করিয়াছেন। ----- চৈতন্য চরিত্রামৃত ও চৈতন্য ভাগবতে দৃষ্ট হয়, তিনি চৈতন্য মহাপ্রভুকে ঈশ্বরের আবতার বলিয়া স্বীকার করিয়া ছিলেন। ---- যে গুনে আকবর ভারত ইতিহাসের কণ্ঠহার হইয়া আছেন, সেই গুনে হোসেন শাহ্ বঙ্গের ইতিহাসে উজ্জ্বল রত্ন বলিয়া গণ্য হইবেন।”
আকরাম খাঁ তার মুসলিম বাঙ্গের সামাজিক ইতিহাস গ্রন্থে বলেন, “ প্রকৃত কথা এই যে, বৌদ্ধ সমাজ ও বৌদ্ধ ধর্মকে তাহাদের মাতৃভুমি (ভারত) হইতে সমূলে উৎখাত করার পর তাহাদের নেক নজর পড়িয়াছিল মুসলিম সমাজের উপর। তাই যুগপৎভাবে তাহারা চেষ্টা করিতে লাগিলেন ‘যবন’ রাজাদিগকে রাজনৈতিক কৌটিল্যের মাধ্যমে বিধ্বস্ত ও বিপর্যস্ত করিয়া ফেলিতে। পক্ষান্তরে ধর্মের নামে একটা মহজাল বিস্তার করিয়া (বোকা বানানোর বিভিন্ন তরীকত এবং ঝোলা ভরা কেরামতের সাহায্যে) মুসলমান সমাজকে আত্নবিস্মৃত ও সস্মোহিত করিয়া রাখিতে।”
বাংলার মুসলমানদের ইতিহাস গ্রন্থের লেখক বলেন, আমরা রাখাল দাশ বন্দোপাধ্যায়ের উক্তির পুনঃরাবৃত্তি করে তার মধ্যে কিছু সংশোধনীসহ বলতে চাই-“ দুর্জনদেব গণেশ যাহা করিতে পারেন নাই, আর্যাবর্তের কোন হিন্দু রাজা যাহা করিতে পারেন নাই তাহাই সাধন করিয়া ছিলেন বলিয়া সুলতান হোসেন শাহ্র নাম ইতিহাসে চিরস্মরনীয় থাকিবে” (‘বাংলার মুসলমানদের ইতিহাস-আব্বাস আলী খান)।
বস্তত হোসেন শাহ্ সম্পর্কে রাখাল দাশ বন্দোপাধ্যায়ের এই উক্তি যথারর্থ। কেননা যদিও রাজা গণেশ মুসলমানদের উপরে নিপীড়ন নির্যাতন চালাইয়া ছিলেন কিন্ত তিনি কিভাবে মুসলমানদের প্রভাব প্রতিপত্তিকে খ্রপ করা যায় বা কীভাবে এই অঞ্চলে ইসলামের প্রসারকে রুদ্ধ করা যায় কিংবা বুদ্ধার অনুসারীদের ন্যায় কিভাবে আবার তাদের (সনাতন ধর্ম ত্যাগীদের) পুনঃরায় সনাতন ধর্মে ফিরিয়ে আনা যায় তা নিয়ে কক্ষণও ভাবেন নাই। বাংলার ইতিহাসে সুলতান হোসেন শাহ্ই সর্বপ্রথম ব্যাক্তি যিনি এই সকল বিষয়গুল নিয়ে শুধু ভাবেননি তা বাস্তবায়নের জন্য কাজ করে গছেন। তিনি বৈষ্ণব মুভমেন্টের সাহায্য নিয়ে মুসলিম সমাজে পৌত্তিলোকতার বিষবাস্প অনুপ্রবেশ ঘটিয়েছেন; আর এর মাধ্যমে অর্ধেক অর্ধকে গুষ্ঠিগুল তৈরির জন্য পথ উন্মুক্ত করেছেন। ইসলাম প্রচারক বা দায়ী ইল্লেলল্লাহদের সমাজিক ও রজনৈতিক প্রভাবকে খ্রপ করার জন্য তাদের এক এক জনের পরিচয়কে তুলে ধরেছেন এক জন আলৌকিক ক্ষমতা সম্পন্ন ধর্মীয় গুরু (পীর, ফকীর, দরবেশ এবং সুফী) হিসাবে। আর এই ধর্মীয় গুরুদের উপর ভর করে ইসলামের নামে একটা মহজাল বিস্তার করিয়া মুসলমান সমাজকে আত্নবিস্মৃত ও সস্মোহিত করিয়া রাখিতে সমরর্থ হন যা তাদের পরাজয়কে তরান্বিত করে ছিল। বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজদ্দৌলার পতনের অন্যতম কারন ছিল অর্ধেক অর্ধকে গুষ্ঠির অন্তভুক্ত ব্যাক্তি মীর জাফর আলীর বিশ্বাসঘাতকতা।
চলবে-------
বিষয়: বিবিধ
৯১৩ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন