আমাদের পূর্ব পুরুষদের শত্রু-মিত্র পর্ব ৩১
লিখেছেন লিখেছেন আনিসুর রহমান ০৮ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭, ০৭:৫০:৪৩ সকাল
বস্তুত মশাল মিছিল নিয়ে চান্দ কাজীর বাড়িতে যাওয়ার পর শ্রী চৈতন্য ও চান্দ কাজীর মাধ্যে যে কথাকপন হয়ে ছিল তা থেকে আমরা বুঝতে পারব চাঁদ কাজী একজন বিচক্ষন মুসলমান হওয়া সত্বেও কেন শ্রী চৈতন্যের শিরর্কি মতবাদকে মেনে নিয়ে ছিল এবং জনতার সস্মুখে মৌখিক ভাবে স্বীকৃতি দিয়ে ছিল, চৈতন্য হল হিন্দুদের দেবতা হড়ি (কৃষ্ণ)। ‘ইসকনের (ISKCON)’ ** সহায়তায় নির্মিত একটি ভিডিওতে এই ঘটনাকে তুলে ধারা হয়েছে এই ভাবে। শ্রী চৈতন্য মিছিল নিয়ে কাজী সাহেবের বাড়ীতে যাওয়ার পর কাজী সাহেবর দেখা পেয়ে জিজ্ঞাসা করেন, কাজী সাহেব আমি আপনার অভ্যাগত আথচ আমাকে দেখে আপনি লুকালেন কেন? (কাজী সাহেব) নিমাই তোমার ক্রোধ প্রশমিত হওয়ার অপেক্ষায় আমি আত্নগোপন করে ছিলাম। তোমার দাদা মশাই নীলাম্বর চক্রবতি গ্রাম সম্পকে আমার চাচা। তাই তুমি আমার ভাগ্নে। ভাগ্নেতো ভাগ্নের ক্রোধ অব্যশই মামা সয্য করে থাকে। তখন শ্রী চৈতন্য কাজী সাহেবকে পুঃনরায় জিজ্ঞাসা করে, আচ্ছা মামা সংকিত্তন বন্ধ রাখার আপনার নির্দেশ থাকা সত্বেও নগরীতে সংকিত্তন হয়ে ছিল। তবু কেন আপনি দণ্ডের আদেশ দিলেন না। (কাজী সাহেব) ভাগ্নে সেকথা আমি সকলের সস্মুখে বলতে চাই না। আমি নিভৃতে বলতে চাই। কিন্তু শ্রী চৈতন্য কাজী সাহেবের অনুরোধ রক্ষা না করে বলে ছিল, না এখানে সকলের সস্মুখে সেই কথা আমি শুনতে চাই। (কাজী সাহেব) ভাগ্নে “নিতম্ব”(শব্দ করার যন্ত্র) ভেঙ্গে দেওয়ার পর সিংহরূপী এক মানব, যার অর্ধেক মানুষ অর্ধেক সিংহ এক রাত্রে আমাকে ভয় দেখায়। সে আমাকে বলে কিত্তন বন্ধ করলে সে আমাকে সবংশে হত্যা করবে। সেই রাত্রে সেই সিংহরূপী মানব*** হুঙ্কার দিয়ে আমার বুকে এসে বসে। তার জিহব লক লক করে, দন্ত করমর করমর করে উঠে। তার হাতের ধারাল নখর আমার বুকে বিধিয়ে দেয়। দেখ দেখ, এই দেখ, ঐ দাগ এখনও আমার বুকে রয়েছে। (শ্রী চৈতন্যকে উদ্দেশ্য করে), প্রভু আমি (চান্দ কাজী) এখন বুঝেছি তুমি কে? তুমি হিন্দুদের সেই হড়ি (কৃষ্ণ)! আজ থেকে আমার বংশের কেউ কোন দিন কিত্তন বন্ধের আদেশ দিবে না। (তথ্য সুত্রঃ ইসকন, মায়াপুর নিবেদিত “মহাপ্রভু”)
উপরের ঘটনা থেকে স্পস্টত বুঝা যাচ্ছে যে, কাজী সাহেব তার নির্দেশ অমান্য করার পরও রাজার আইন ভঙ্গকারীদের দিরুদ্ধে কোন ব্যাবস্থা নেয়নি বা নিতে পারেনি। তবে এখানে বিস্ময়ের বিষয় হ’ল, কাজী সাহেব তার নির্দেশ অমান্যকারী শ্রী চৈতন্যের শিস্যদের বিরুদ্ধে কোন ব্যাবস্থা না নেওয়া সত্বেও চৈতন্য ও তার অনুসারীরা তার বিরুদ্ধে মশাল মিছিল বের করাটা। কেন সে আইন ভঙ্গকারীদের দিরুদ্ধে ব্যাবস্থা নেয়নি তা সে উত্তেজিত জনতার সস্মুখে নয় বরং একান্তে শ্রী চৈতন্যকে বলতে চেয়ে ছিল। সম্ভবত বিচক্ষন কাজী জনতার সস্মুখে নয় বরং শ্রী চৈতন্যের সাথে একান্তে বসে বিষটির একটা সুরাহা করতে চেয়ে ছিলেন। কিন্তু বুদ্ধিমান শ্রী চৈতন্য পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে চাচ্ছিল চান্দ কাজী উপস্থিত জনতার সস্মুখে তাকে হিন্দুদের দেবতা হড়ি (কৃষ্ণ) হিসাবে স্বীকার করে বক্তব্য দিওক। ফলে উপায়হীন বিচক্ষন কাজী জনতার সস্মুখে সরাসরি সে কথা না বলে বরং ঘুরিয়ে পেচিয়ে, কেন সে শ্রী চৈতন্যকে স্বয়ং হিন্দু দেবতা হড়ি(কৃষ্ণ) মনে করে তা বাখ্যা কল্পে কৌশলে একটি ঘটনা বর্ণনা করেন । সে বলে, এক রাতে সিংহরূপী এক মানব তাকে ভয় দেখায় যে, কিত্তন বন্ধ করলে তাকে সবংশে হত্যা করা হবে। শুধু তাই নয়, সেই সিংহরূপী মানবের নির্যাতনের চিনহ এখনও যে তার শরীরে বর্তমান রয়েছে প্রমান স্বরূপ তাও দেখায়। আমরা যদি খুব মনযোগিতার সাথে এই ঘটনাকে বিশ্লেষন করি তবে দেখব যে, কাজী সাহেব এখানে কৌশলে যে গুরুত্বপূর্ণ তথ্যগুল আমাদের জন্য রেখে গেছেন তা হ’ল, এক, ভয়ংকর এক রাত্রে, সে যে সিংহ রূপী মানব/দানবকে দেখে ছিল তা কোন স্বপ্ন ছিল না বরং তা ছিল বাস্তব সত্য কেননা এখানে সে বলেনি, যে ঘটনা বলছে তা সে স্বপ্নে দেখে ছিল বা স্বপ্ন ছিল। দুই তাদের কথা না শুনলে সেই সিংহরূপী মানব/ দানব (অর্থাৎ পেছনে বসে থেকে যারা কলকাঠি নাড়ছিল তারা) যে তাকে সবংশে হত্যা করার হুমকী দিয়ে ছিল তাও সে কৌশলে বেল গেছে। তিন, তার উপর যে এর-ই মধ্যে চরম নিপীড়ন-নির্যাতন চালান হয়েছে তার প্রমান স্বরূপ নির্যাতনের চিনহও কৌশলে দেখিয়ে দিয়ে সেই ভয়ংস্কর সময়ে বাস্তবতা বুঝার জন্য আমাদের কাছে ক্লু রেখে গেছেন। চার, বস্তুত কৌশলে তিনি তার উপর নির্যাতনের চিনহ দেখিয়ে এক ঢিলে দুই পাখী মেরেছেন, এর মধ্য দিয়ে তিনি প্রমান রেখে যেতে চেয়ে ছিলেন যে, তিনি যে সিংহরূপী মানবের ঘটনা এখানে বলেছেন তা কোন ভাবেই স্বপ্ন ছিল না। কেননা সেই ঘটনা স্বপ্ন হলে তার শরীরে নির্যাতনের চিনহ থাকত না এবং একই সাথে তিনি তার উপর যে নিপীড়ন-নির্যাতন চালানো হয়েছে তার প্রমান দিয়ে গেছেন এই চিনহ দেখানোর মধ্য দিয়ে।
সুতরাং কারা ঘটনার পিছনে বসে কলকাঠি নাড়ছিল তা আমাদের কাছে এখন অনেকটা পরিষ্কার। হ্যাঁ তিনি ছিলেন নিপীড়ন-নির্যাতনের স্বীকার চান্দ কাজীর নিয়োগকর্তা অর্থাৎ বাংলার শাসক আলাউদ্দীন হোসেন শাহ্ (১৪৯৩--১৫১৯)। কেননা চান্দ কাজী ছিলেন তার নিয়োগকৃত কাজী বা বিচারক। সুতরাং কাজীর নির্দেশ অমান্য করা ছিল শাহী নির্দেশকে অমান্য করার সামিল, তাকে অসস্মান জানানো ছিল বাদশাকেই অসস্মান জানানো। আর তার রায়ের বিরুদ্ধে মিছিল বের করে তাকে হুমকী দেওয়া ছিল রাজদ্রোহিতার ন্যায় মারাত্নক অপরাধ। কিন্ত আমরা বিস্ময়ের সাথে লক্ষ্য করি যে বাংলার সুলতান আলাউদ্দীন হোসেন শাহ্ এ বিষয়ে নির্বিকার ভুমিকা পালন করেন। এই অপরাধের সাথে যারা জড়িত ছিল তিনি তাদের বিরুদ্ধে কোন ধরনের ব্যাবস্থা গ্রহণতো দূরের কথা বরং তিনি তাদেরকে সস্মান করেছেন এবং কাছে টেনে নিয়েছেন।
সুতরাং এ কথা বলা কোন বিচারেই ভুল হবে না যে, তিনিই শ্রী চৈতন্যর গুরু ঈশ্বর পুরীকে গুপ্তচর হিসাবে নিয়োগ দান করে ছিলেন। রাতারাতি যুক্তিবাদী নিমাইয়ের ভক্তিবাদে পরিবর্তনের পিছনে ছিল তার হাত। তার জোরেই বালক নিমাই তার পৃত্যিতুল্য পডিত হাত থেকে নবদ্বীপের বৈষ্ণব গুষ্ঠির নেতৃত নিয়ে নেয়। তার সাহায্যেই পণ্ডিত শ্রীব্যাসের বাড়ীতে ব্যয় বহুল কিত্তনের নৈশ স্কুল খুলে গরীব নিমাই পণ্ডিত। তার খুটির জোরেই তার ধর্মীয় মতবাদের আগ্রাসী প্রচারনা চালানোর জন্য নির্দেশ দান করে, শ্রী চৈতন্য তার শিস্যদেরকে। আর তার গ্রীন সিগন্যাল পেয়েই তারা কাজীর নির্দেশকে অমান্য করার সাহস দেখায় এবং তার সাথে বিরোধে জড়িয়ে পড়ে।
একথা বলাও ভুল হবে না যে, হোসেন শাহ্ কতৃক নিয়োগকৃত বিচারক চান্দ কাজীর উপর তার লোকেরই নিপীড়ন নির্যাতন চালিয়ে তাকে ব্যাধ্য করে, নর্তন-কুর্দন ও উচ্চ স্বরে কিত্তনের মাধ্যমে জনতাকে জীবকে যারা অতিষ্ঠ করে দিছিল তাদের বিরুদ্ধে কোন ব্যাবস্থা না নিতে। আর এই বিরুপ পরিস্থিতির সুযোগকে কাজে লাগিয়ে বুদ্ধমান চৈতন্য কাজীর কাছ থেকে মৌখিকভাবে শিরকি উক্তি আদায় করে নেয় যে, সে হল স্বাক্ষাৎ হিন্দুদের দেবতা হড়ি(কৃষ্ণ)!
উপরের তথ্যগুলকে যদি আমরা সত্য বলে মেনে নেই, তবে আবেশ্যিক ভাবেই এখানে যে মিলিয়ন ডলার প্রশ্নগুল চলে আসবে তা হল; আমরা জানি বাংলার শাসক আলাউদ্দীন হোসেন শাহ্ একজন মুসলিম শাসক ছিলেন! সুতরাং কেন তিনি স্ব-উদ্দেগে হিন্দুদের মুভমেন্টে ( আজকে যা হড়ে কৃষ্ণা মুভমেন্ট নামে পরিচিত) নিজেকে জড়িত করবেন? কেন তিনি এর প্রধান পৃষ্ঠপোষক হিসাবে ভুমিকা পালন করবেন? কেন তিনি এই মুভমেন্টকে আর্থিক ও রাষ্ট্রীয় ভাবে মদত দিবেন?
চলবে--------
-------------------------------------------------------------------
** ‘ইসকন’(ISKCON--The International Society for Krishna Consciousness) হল মহাপ্রভু শ্রী চৈতন্য প্রচারিত গৌঢিয়া বৈষ্ণব ধর্মের অনুসারীদের একটি আন্তর্জাতিক সঙ্ঘ। এই সঙ্ঘটির মুভমেন্ট হরে কৃষ্ণা মুভমেন্ট নামেও পরিচিত। আমেরিকার নিউ ইয়র্ক সিটিতে ১৯৬৬ সনে এ সি ভক্তিবিন্দা ঠাকুর স্বামী, ‘ইসকন’ প্রতিষ্ঠা করেন।
***সিংহরূপী মানব ঃ সিংহরূপী মানবকে সংস্কৃত ভাষাতে বলে নরাসিংহা বা নরাসিংহ। এই সিংহ মানবকে হিন্দুদের ভগবান বিষ্ণুর আফতার বলা হয়ে থাকে। এই সিংহ মানব বা নরাসিংহা বৈষ্ণব ধর্মের অনুসারীদের নিকটে প্রধান দেবতা হিসাবে পূজিত এবং আম হিন্দু ধর্মের অনুসারীদের কাছে একজন জনপ্রিয় দেবতা। (তথ্য সূত্র https://en.wikipedia.org/wiki/Narasimha)
বিষয়: বিবিধ
১০৮৩ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন