আমাদের পূর্ব পুরুষদের শত্রু-মিত্র পর্ব ৩০
লিখেছেন লিখেছেন আনিসুর রহমান ০৫ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭, ০৯:২৮:২৭ সকাল
ধর্ম প্রচারের কৌশল হিসাবে মহাপ্রভু চৈতন্যের আগ্রাসী নীতি গ্রহণ অর্থাৎ ধর্ম প্রচারের জন্য ‘পাবলিক প্লেসের’(Public Place) পরিবর্তে নগরীর প্রত্যেক বাড়ী বাড়ী যেয়ে নর্তন কুর্তন ও উচ্চ স্বরে কিত্তন করে তাদের দলে যোগদানের জন্য আহ্বান জানানো এবং দিনের পর দিন তার অনুশীলন ছিল অসহনীয় ও বিরক্তিকর। কী কারনে এই কৌশল গ্রহণ করা হয়ে ছিল তা সুনিশ্চিত ভাবে জানা না গেলেও দুই ভাবে এর ব্যাখ্যা দাঁড়া করানো যেতে পারে। এক, প্রচারের কৌশল হিসাবে প্রথম ধাপে ব্যয়বহুল কিত্তনের নৈশ স্কুল খুলে চৈতন্য মহাপ্রভুকে মানবিক সত্তার উদ্ধে তুলে ধরে দৈবিক সত্তা হিসাবে প্রচারনা চালনো সত্বেও তা হয়ত আম জনতাকে তেমন ভাবে আকৃষ্ট করতে পারেনি, ফলে ফলাফল আশানুরূপ না হয়ায় এই প্রচারনার পিছনে বসে যারা কলকাঠি নাড়ছিল তারা হয়ত রাগান্বিত হয়ে এই কৌশল গ্রহণের নির্দেশ দিয়ে ছিল এই জন্য এই কৌশলকে আমরা “কর্তার ইচ্ছায় কিত্তন” নাম দিতে পারি। দুই, নিমাই পণ্ডিত স্বয়ং হয়ত তার ইচ্ছা বিরুদ্ধ এই মুভমেন্টে থেকে নিস্কান্ত পাওয়ার জন্য এই কৌশল গ্রহণ করে ছিল। এ কথা বলা ভুল হবে না যে নিমাই পন্ডিতের ন্যায় একজন বিজ্ঞ ও যুক্তিবাদী ব্যাক্তির পক্ষে রাতারাতি ভক্তিবাদী বনে গিয়ে “কর্তার ইচ্ছায় কিত্তন” গাওয়া ছিল অস্বআভাবিক।
দিনের পর দিন এই ভাবে নর্তন কুর্তন ও উচ্চ স্বরে কিত্তনের ফলে বিরক্ত নবদ্বীপবাসীগণ এর থেকে পরিত্রাণের জন্য আবশেষে স্থানীয় বিচারক চান্দ কাজীর কোর্টে নালিশ জানায়। উল্লেখ্য যে কোন ধর্মীয় বা আদর্শিক প্রচারনার ক্ষেত্রে প্রতিপক্ষের সাথে বিরোধের কারনটি অত্যান্ত গুরুত্বপূর্ণ। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায় ইসলামের নবী মোহাম্মদ () তৎকালে মক্কার মোশরেকদের কাছে তৌহিদের বানী প্রচারের সাথে সাথে তাদের বেইনসাফপূর্ণ (Injustice) সমাজ ব্যাবস্থার বিরুদ্ধে চ্যলেঞ্চ ছুড়ে দিয়ে ছিল, ফলে তারা এর বিরোধীতা করা শুরু করে দেয়। তাই আমরা এখানে বিরোধের মুল কারন উদ্ঘাটনের চেস্টা করব। এই বিরোধের কারন সম্পকে আমরা দুই ধরনের তথ্য পাই। এক, নর্তন কুর্তন ও উচ্চ স্বরে কিত্তনের ফলে নবদ্বীপবাসীরা বিরক্ত হয়ে কাজীর কাছে নালিশ জানায়। দুই নবদ্বীপের ব্রাহ্মনরা শ্রী চৈতন্যের সাফল্যে হিংসা বিদ্বেষ এর বশবর্তী হয়ে কাজীর দরবারে নালিশ জানায়, যে শ্রী চৈতন্যের একজন অহিন্দু! এই অভিযোগ সম্পকে শ্রীল ভক্তিবিন্দা ঠাকুর চৈতন্যের বায়োগ্রাফিতে লিখেন, “The Smarta Brahmins became jealous of Nimai Pandit's success and complained to Chand Kazi against the character of Chaitanya as un-Hindu. The Kazi came to Srivas Pandit's house and broke a Mridanga {khol) there and declared, that unless Nimai Pandit would cease to make noise about His queer religion, he should be obliged to enforce Mohammedanism on Him and His followers.” কাজীর দরবারে প্রকৃত পক্ষে কী অভিযোগ আনা হয়ে ছিল সেটা পরিষ্কার ভাবে না জানা গেলেও, এই অভিযোগের জন্য কাজী সাহেব কী রায় দিয়ে ছিল তা নিশ্চিত ভাবেই যানা যায়। কেননা তার প্রত্যেক জীবনীকার এই সম্পকে একই কথা বলেছে। আর সেই রায়টি ছিল, কাজীর লোকেরা শ্রীব্যাসের বাড়িতে নর্তন কুর্তন ও উচ্চ স্বরে কিত্তনের জন্য প্রতিষ্ঠিত নৈশ স্কুলে যেয়ে শব্দ করার যন্ত্র ‘ডম্বেল’টি ভেঙ্গে ফেলে ও নর্তন কুর্তন ও উচ্চ স্বরে কিত্তনের চর্চা বন্ধ করার জন্য আদেশ দান করে। এই আদেশ থেকে সহজেই বুঝা যায় যে, মুসলমানরা বা ব্রাহ্মনরা নয় বরং নর্তন কুর্তন ও উচ্চ স্বরে কিত্তনের ফলে বিরক্ত নবদ্বীপ বাসীরাই কাজীর দরবারে অভিযোগ এনে ছিল। এটা যদি বিরোধের কারন হয় তবে কী উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে তারা প্রচারনা করছিল তা বুঝা মনে হয় না খুব একটা কঠিন বিষয়।
তৎকালে বাংলার সুলতান বা নবাবরা ইসলামী জ্ঞান সম্পন বিচক্ষণ ও মেধাবী ব্যক্তিদের বিচার কাজের জন্য কাজী হিসাবে নিয়োগ দিতেন; এবং সাধারণত ক্ষমতার হাত বদল হলেও এই কাজীরা স্বপদে বাহল থাকত। সুলতানের নিয়োগকৃত কাজীর বিরুদ্ধে যাওয়া মুলত সুলতানের বিরুদ্ধে যাওয়া হিসাবে গণ্য হত। চান্দ কাজীর এই রায়টি ছিল অত্যন্ত বিজ্ঞচিত। এই রায়ে সে নর্তন কুর্তন ও উচ্চ স্বরে কিত্তনের সাহায্য আমজনতাকে বিরক্ত করার জন্য কোন ব্যাক্তি অর্থাৎ কোন প্রচারককে জেল জরিমানা করেননি। বরং তিনি এই ধর্ম প্রচারের মুল কেন্দ্র শ্রীব্যাসের বাড়ীতে যেয়ে শব্দ করার যন্ত্রটি ভঙ্গে দেয় এবং উচ্চ স্বরে কিত্তন বন্ধ করার জন্য নির্দেশ দেয়। সম্ভবত চান্দ কাজীর এই রায়টি যারা ঘটনার পিছনে বসে কলকাঠি নাড়ছিল তাদেরকে উভয় সংকটে ফেলে দেয়। কারন হ’ল প্রথমত কাজীর আদেশ মানার অর্থ হ’ল কিত্তন বন্ধ করে দেওয়া যা তাদের প্লানের মৃত্য ঘণ্টা বাজাবে, যা অসম্ভব। দ্বিতিয়ত, কাজীর নির্দেশ অমান্য করে কিত্তন বন্ধ না করলে, কাজীর নিয়োগ কর্তা হিসাবে সুলতান যথাযথ পদক্ষেপ নিতে বাধ্য অন্যথায় বিভিন্ন প্রশ্নের জন্ম নিবে। তৃতীয়ত কাজীকে গোপনে বা প্রকাশ্যে যে ভাবেই হত্যা করা হোক না কেন তার সমস্ত দায় দায়িত্ব যেয়ে পড়ত শ্রী চৈতন্যের কাঁধে। বস্তুত এই জটিল সমস্যা থেকে বের হয়ে আসার একমাত্র উপায় ছিল চান্দ কাজীর শ্রী চৈতন্যের ধর্মকে মেনে নেওয়া। বস্তুত আমরা শ্রী চৈতন্যের জীবন চরিত পাঠ করলে দেখি যে, চান্দ কাজীর কিত্তন বন্ধ সংক্রান্ত রায় ঘোষনার পর তার প্রতিক্রিয়া স্বরূপ কিত্তনের নৈশ স্কুল থেকে মশাল জ্বালিয়ে চৈতন্যের নেতৃতে, ভারত উপমহাদেশে ইতিহাসে সার্ব প্রথম বারের মত সুলতান বিরোধী বিরাট একটি মিছিল বের হয়ে চান্দ কাজীর বাড়িতে যায়। সেখানে চান্দ গাজীর সাথে শ্রী চৈতন্যের আলাপ চারিতার শেষে বিচক্ষন চান্দ কাজী নিজের ভুল বুঝতে পেরে চৈতন্যের শিরর্কি মতবাদকে মেনে নেয়!
এখানে যে প্রশ্নগুল চলে আসে তা হ’ল, এক, চান্দ কাজী একজন বিচক্ষন মুসলমান হওয়া সত্বেও কেন শ্রী চৈতন্যের শিরর্কি মতবাদকে মেনে নিয়ে ছিল? দুই, সেই সময়ে বাংলার শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিল সুলতান আলাউদ্দিন হোসেন শাহ্, সুলতান কী তার বিরুদ্ধে গর্জে উঠা এই মুভমেন্টের বিরুদ্ধে কোন প্রতিকারের ব্যাবস্থা গ্রহণ করেছিল? যদি না নিয়ে থাকে, কেন ব্যাবস্থা নেয়নি? এই প্রশ্নগুলর উত্তর খোঁজার মধ্য দিয়ে আমরা আবিস্কার করব তৎকালে মুসলিম বিরোধী এক গভীর ষড়যন্ত্রের কথা যার ফলাফল আজও আমরা ভোগ করে যাচ্ছি।
চলবে ------------------------------
বিষয়: বিবিধ
৯৭৩ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন