আমাদের পূর্ব পুরুষদের শত্রু-মিত্র পর্ব ২৮
লিখেছেন লিখেছেন আনিসুর রহমান ২৮ জানুয়ারি, ২০১৭, ০৭:১০:৫৮ সকাল
নিমাই বিবাহেরর পর অর্থিক সচ্ছলতার জন্য পূর্ব বঙ্গের পদ্মার তীরে চলে আসে। এতে বুঝা যায় নিমাইয়ের পরিবার গরিব হলেও অর্থিক ভাবে অসচ্ছল ছিল না। সেখানে সে মানুষকে জ্ঞান বিতরণ করে প্রচুর অর্থ অর্জন করে এবং অবসরে সে তার মতবাদ প্রচার করত। ফলে তার সুখ্যাতি প্রথম বারের মত নবদ্বীপের বাহিরে ছড়িয়ে পরে। তার এই সুখ্যাতি চারিদিকে ছড়িয়ে পরার সাথে সাথে তার জীবনে ঘটতে শুরু করে একের পর এক নাটকীয় ঘটনা। তার স্ত্রী যাকে সে প্রচন্ড ভাবে ভালবাসত,যার মুখে হাসি ফোটাতে সে পূর্ব বঙ্গে এসে ছিল রহস্যজনক ভাবে সাপের কামড়ে তার মৃত্যু ঘটে। ফলে সে নবদ্বীপে ফিরে আশে। সে তার মৃত পিতার শ্রাদ্ধের জন্য গয়াতে গমন করে। সেখানে তার সাথে সাক্ষাৎ ঘটে সন্ন্যাস ঈশ্বর পুরীর, যাকে তার গুরু বলা হয়ে থাকে। সন্ন্যাস ঈশ্বর পুরীর সাথে সাক্ষাৎতের পর তার জীবনে ঘটটে থাকে একের পর এক নাটকীয় পরিবর্তন । তার কাছ থেকে সে দীক্ষা নেয় গোপাল কৃষ্ণা মন্ত্র, এখানে সে মেডিটেশনের দীক্ষাও নেয়, খাবার দাবার কমিয়ে দিয়ে শুধু কৃষ্ণা কৃষ্ণা, হরি হরি বলে উচ্চ স্বরে বিলাপ করত! বলত হে ভগবান তুমি কোথায়? হে পিতা কৃষ্ণা তুমি কোথায়? তোমাকে ছাড়া পরান রাখা দায়। সেই সময়ে নবদ্বীপে বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের নেতৃত্বে ছিল পণ্ডিত আভিটা আচারী কিন্ত বালক নিমাই নবদ্বীপে পৌছে তার কাছ থেকে নেতৃত্ব নিয়ে নেয়। উল্লেখ্য আভিটা আচারী, শ্রীব্যাস প্রমুখ ব্যাক্তিবর্গ চৈতন্যের জন্মের বহু পূর্বে থেকেই বৈষ্ণব ধর্মে বিশ্বাস করত এবং স্থানীয় ভাবে এই গুষ্ঠির নেতৃত্ব দিত। তার কাছ থেকে বৈষ্ণব ধর্মের নেতৃত্ব তরুণ নিমাইয়ের কাছে চলে যাওয়াটা বিরাট বিস্ময়কর। শুধু তাই নয় সে পণ্ডিত শ্রীব্যাসের বাড়িতে কৃত্তনের নৈশ স্কুল খোলে। এখানে নর্তন কর্তন করত, গানবাজনা ও বৈষ্ণব ধর্ম প্রচার করত। কৃত্তনের এই নৈশ স্কুল থেকে ধীরে ধীরে তার দৈবিক ক্ষমতার কথা চারিদিকে রাষ্ট্র হয়ে যায়। ফলে লোকদের মাঝে তার সম্পকে কৌতুহলের সৃষ্টি হয়। এই সময়েই অত্যান্ত আগ্রেসিভ ভাবে চৈতন্য নব উদ্দমে তার মতবাদ প্রচার শুরু করে দেয়।
স্বআভাবিক ভাবেই যে প্রশ্নটি সকলের মনে উদয় হবে তা হ’ল কে এই সন্ন্যাস ঈশ্বর পুরী? কেন নিমাই পণ্ডিতের সুখ্যাতি চারিদিকে ছড়িয়ে পরার সাথে সাথে তার জীবনে নাটকীয় পরিবর্তন ঘটা শুরু হয়? তার গুরু সন্ন্যাস ঈশ্বর পুরী তাকে কী জ্ঞান/মন্ত্র দান করে ছিল, যার ফলে তার জীবনে নাটকীয় পরিবর্তন ঘটা শুরু হয়? কেন আভিটা আচারী (যে কিনা নিমাইয়ের জন্মের পূর্ব থেকেই বৈষ্ণব ধর্মে বিশ্বাস করত) নিমাই তার গুরুর কাছ মন্ত্র শিক্ষা করে নবদ্বীপে প্রত্যাবর্তন করার সাথে সাথে বৈষ্ণব গুষ্ঠির নেতৃত নিমাইয়ের হাতে তুলে দেয়? কী ছিল সেই মন্ত্রে? যে সময়ে নৈশ স্কুল বলতে কোন ধারনা প্রচলিত ছিল না। কেন নিমাই সেই সময়ে প্রচলিত সিষ্টমের বিপরীতে যেয়ে কৃত্তনের জন্য দিনের পরিবর্তে নৈশ স্কুল খোলে?
এই সব গুল প্রশ্নের একটিই উত্তর হয় তা হল অসাধারন মেধা সম্পন্ন নিমাই পণ্ডিত সে চাউক বা না চাউক, ইচ্ছায় হওক বা অনিছায় হওক, অসম্ভব ক্ষমতাশালী কারো পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করেছে মাত্র। সেই অসম্ভব ক্ষমতাশালী ব্যাক্তিটি কে যার পরিকল্পনা সে বাস্তবায়ন করেছে? সে কী স্বয়ং ভগবান কৃষ্ণ? না কি অন্য কেউ? বিষয়টি জটিল বিধায়, বুঝার সুভিদার জন্য আমরা তার জীবনী আলোচনার সময় তার কছুটা ইংগিত দেব। তবে এই বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব তার জীবনীর আলোচনা শেষ হলে পরে।
সন্ন্যাসী ঈশ্বর পুরী এমনই একজন ধর্মীয় ব্যাক্তিত্ব যার সাথে সাক্ষাৎ লাভের পর পণ্ডিত নিমাইয়ের জীবনে বিস্ময়কর পরিবর্তন ঘটে। রাতারাতি যুক্তিবাদী পণ্ডিত নিমাইকে পরিণত করে ভক্তিবাদী নিমাইয়ে। কে ছিল এই ঈশ্বর পুরী? সন্ন্যাস রূপী স্বয়ং ঈশ্বর কৃষ্ণ? না কী সন্ন্যাসী পরিচয়ের আড়ালে অন্য কেউ? প্রথমত ঈশ্বর পুরী স্বয়ং ভগবান কৃষ্ণ হতে পারে না কারন হল শ্রী চৈতন্য কিংবা তার অনুসারী কেউ কখনও তাকে ভগবান কৃষ্ণ বলেনি বরং বলেছ তার কাছ থেকে শ্রী চৈতন্য গোপালা কৃষ্ণ মন্ত্র শিক্ষা লাভ করে ছিল। দ্বিতীয়ত এই ঈশ্বর পুরী ছিল প্রখ্যাত ব্যাক্তি মাধাভেন্ডা পুরীর একজন শিস্য। সুতরাং কোন বিচারেই সে ভগবান কৃষ্ণ হতে পারে না। তবে কী সে কারো গুপ্ত চর ছিল। কিন্ত সমস্যা হল তার মত এক জন ধর্মীয় ব্যাক্তিত্ব এবং সন্ন্যাসীর পক্ষে ততকালে গুপ্ত চরে জড়িত থাকাটা কতটা বাস্তব সস্মত ধারনা।
এই বিষয়ে আমরা কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাই আশোক রায়না লিখিত বই, Inside RAW- The story of Indian’s secret service এর বাংলা অনূদিত গ্রন্থ “ ভারতীয় গুপ্তচর সংস্থার অজানা অধ্যায়- বইটির অনুবাদক হল লেঃ (অবঃ) আবু রুশদ। তিনি বলেন, “কৌটিলর মতানুযায়ী গুপ্তচরদের প্রাথমিক ভাবে দুই ভাগে ভাগ করা যায়। ‘স্থানীয় এজেন্ট’ ও পরিব্রাজক বা ভ্রাম্যমান এজেন্ট---। ‘স্থানীয় এজেন্ট’ তার কতৃত্বাধিনে যাদের নিয়োজিত করবেন তারা বিভিন্ন অবরনে ভিন্ন ভিন্ন নামে চিনহিত। এরা হ’ল শঠ/ অসৎ শিস্য, সন্ন্যাসী, গৃহস্বামী/ গৃহস্থ, ব্যাবসায়ী এবং তপস্যা কাজে নিয়োজিত যগী/তাপস শ্রেনীর ব্যাক্তিত্ব। ---
যদিও কৌটিল্য একটি সুশৃংখল রাষ্ট্র ব্যাবস্থায় বিশ্বাসী ছিলেন কিন্ত জনতার ধর্মীয় অনুভুতির নীতি জ্ঞান বর্জিত যত্রতত্র ব্যাবহারে তাকে যথেষ্ট প্ররোচনা দিতে দেখা যায়।”( উল্লেখ্য কৌটিল্য যিনি ইতিহাসে বিষ্ণুগুপ্ত ও চাণক্য নামে সমাধিক পরিচিত খ্রিষ্টপূর্ব ৩২১ -৩০০ সনে লিখিত তার বিখ্যাত বই ‘অর্থশাস্ত্রে’ মৌর্য ও মৌর্য পরবতী রাষ্ট্র শাসন ব্যাবস্থা সম্পকিত বিভিন্ন ঘটনার উল্লেখ করেছেন।)
সুতরাং এখন আমরা নির্দ্বিধায় বলতে পারি সন্ন্যাসী ঈশ্বর পুরী একজন গুপ্তচর ছিলেন। তিনি যাদের পক্ষ হয়ে এই কাজে নিয়োজিত ছিলেন তাদের হাত যে অনেক লম্বা ছিল তার প্রমান আমরা পদে পদে পাই মহাপ্রভু শ্রী শ্রী চৈত্যনের জীবন চরিত পাঠ করলে। বলা হয়ে থাকে শ্রী চৈত্যন তার গুরু ঈশ্বর পুরীর কাছ থেকে গোপাল কৃষ্ণ মন্ত্র পেয়ে ছিল কন্তু আমার ধারনা যদি ভুল না হয়, তবে প্রকৃত ব্যাপার ছিল, তার গুরু তাকে গোপাল কৃষ্ণ মন্ত্রের আড়ালে ঐ শক্তিশালী মহলটির নির্দেশ পালন কারার জন্য বলে ছিল এবং যা অমান্য করার মত সামর্থ গরীব নিমাই এর ছিল না!
নিমাইয়ের খ্যাতি চারিদিকে ছড়িয়ে পরার সাথে সাথে রহস্যজনক ভাবে সাপের কামড়ে তার স্ত্রীর মৃত্যু, তার পিতার শ্রাদ্ধের জন্য গয়াতে গমন এবং সেখানে হঠাৎ তার গুরু ঈশ্বর পুরীর সাক্ষাৎ লাভ এবং গোপাল কৃষ্ণ মন্ত্র দীক্ষা মনে হয় না এ সব ঘটনা কাঁকতলিয় ভাবে ঘটেছে। গুরুর কাছ থেকে মন্ত্র দীক্ষা লাভের পর রাতারাতি নিমাইয়ের অস্বাভিক পরিবর্তন, একজন অসাধারন জ্ঞান গরিমা ও যুক্তিবাদী ব্যাক্তি থেকে ভক্তিবাদে পরিবর্তন। আভিটা আচারী, শ্রীব্যাস প্রমুখ ব্যাক্তিবর্গ যারা ছিল চৈতন্যের পিতৃতুল্য এবং তার জন্মের বহু পূর্বে থেকেই বৈষ্ণব ধর্মে বিশ্বাস করত এবং স্থানীয় ভাবে এই গুষ্ঠির নেতৃত্ব দিত পণ্ডিত আভিটা আচারী। সেই আভিটা আচারী কাছ থেকে বৈষ্ণব ধর্মের নেতৃত্ব বিস্ময়কর ভাবে বালক নিমাই এর (বালক নিমাই তার গুরুর কাছ থেক মন্ত্র দীক্ষা নিয়ে নবব্দপি প্রত্যাবর্তন করার পর) কাছে চলে যাওয়া। গরীব নিমাইয়ের পণ্ডিত শ্রীব্যাসের বাড়ীতে প্রচলিত প্রথা বিরোধী কিত্তনের ব্যয় বহুল নৈশ স্কুল খোলা ও সেখানে সমাজে প্রতিষ্ঠিত জ্ঞানী গুনীদের আগমন এবং সেখান থেকে শ্রী চৈতন্যকে মানবিক সত্ত্বা থেকে দৈবিক সত্বা রূপে তুলে ধরে জনতার নিকটে প্রচারনা চালান। যেমন ভক্তিবিন্দা ঠাকুর শ্রী চৈতন্যের বায়োগ্রাফিতে এই প্রচারনা সম্পকে বলেন, “It has been described by Murari Gupta, an eye witness that, He showed His heavenly powers in the house of Srivas Pandit in the presence of hundreds of His followers who were mostly well-read scholars. উল্লেখ্য উপরে উল্লেখিত এই মুরারী গুপ্তা হলেন সংস্কৃত ভাষায় শ্রী চৈতন্যর জীবন চরিত রচিতাদের অন্যতম। তার রচিত গ্রন্থের নাম, ‘শ্রী কৃষ্ণা চৈতন্য চরিত্রামুরতাম’ । মনে হয় না এই সব ঘটনা গুলই আলৌকিক বরং চৈতন্যের গুরু ঈশ্বর পুরীর পিছনে যে লম্বা হাত ছিল তার কাজ বলে বিশ্বাস করা সহজ।
উপরে উল্লেখিত ধারনাগুলকে যদি আমরা সত্য বলে সত্য বলে ধরে নেই, তবে আবেশ্যিক ভাবে যে প্রশ্নটি চলে আসে তা হ’ল, ঐ শক্তিশালী মহলটি কারা যারা ভিতর থেকে কলকাঠি নেড়েছে? কেন তারা কলকাঠি নেড়েছে? তাদের উদ্দেশ্য কী ছিল? এ বিষয়ে আমরা পরে বিস্তারিত আলোচনা করব।
চলবে---
বিষয়: বিবিধ
১৪৫৯ বার পঠিত, ২ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন