আমাদের পূর্ব পুরুষদের শত্রু-মিত্র পর্ব ২৭
লিখেছেন লিখেছেন আনিসুর রহমান ২৫ জানুয়ারি, ২০১৭, ০৭:২১:৫৫ সন্ধ্যা
শ্রী শ্রী চৈতন্য মহাপ্রভু ১৮ ই ফেব্রুয়ারি ১৪৮৬ খ্রীঃ নবদ্বীপে** জন্মগ্রহণ করেন। তার প্রকৃত নাম হল বিশ্বংবর, তার ডাক নাম হল নিমাই, বলা হয়ে থাকে সে নিম গাছের নীচে জন্ম গ্রহণ করে ছিল বলে, তার মা তার নাম দিয়েছিল নিমাই। আরেক বর্ণনায় এসেছে সে ছিল তার পিতা মাতার ১০ তম সন্তান, তার আগে তার মাতার আটটি সন্তান মারা যাওয়ার ফলে তার মা অশুভ শক্তির প্রভাব থেকে তার সন্তানকে রক্ষার জন্য নাম দিয়ে ছিল নিমাই অর্থাৎ তিতা বা বিস্বাদ । তার গায়ের রঙয়ের জন্য তাকে গোরা বা গৌরঙ্গ, গৌ(উজ্জ্বল বা ফর্সা) + অঙ্গ (শরীর)= গৌরঙ্গ, নামেও ডাকা হয়। তার পিতা জগন্নাথ মিশ্রা একজন গরীব ব্রাহ্মন ছিলেন। পণ্ডিত নীলাম্বর চক্রবতির মেয়ে সচী দেবী ছিলেন তার মাতা। তাদের আদী নিবাস ছিল বর্তমান বাংলাদেশের সিলেট জেলায়, তার পিতা সিলেট থেকে পশ্চিম বঙ্গের নদীয়া জেলার নবদ্বীপে হিযরত করেন। প্রত্যেক জীবনীকারই তার অনেক আলৌকিক ঘটনার উল্লেখ করেছেন। বস্তুত জন্ম থেকে মৃত্যু/অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার আগ পর্যন্ত তার পুরা জীবনটাই আলৌকিক ঘটনায় সমাহার। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, শিশু কালে সে অন্য শিশুদের ন্যায় খেলনা নয়, জিবন্ত সাপ নিয়ে খেলত অথচ সাপ তাকে কামড়াত না। মজার বিষয় হল এই সাপের কামড়েই তার যুবতী স্ত্রীর মৃত্যু ঘটে! ঘটনা দেখে মনে হয় ‘সাপ’ তাদের প্রভুকে চিনলেও প্রভুর ভালবাসাকে চিনতে ব্যার্থ হয়! ‘চৈতন্য যুগে’ সৃষ্ট পীর মাঙ্গল কাব্যে পীরদের যে কেরামতি দেখতে পাই তার উৎস সম্ভবত এখানে প্রথিত রয়েছে।
বিসংম্বর বা নিমাই আট বছর বয়েসে তার গ্রাম মায়াপুরের নিকটবতী গাঙ্গানগরে গাঙ্গা দাশ পণ্ডিতের পাঠশালাতে ভর্তি হয়। সেখানে সে সংস্কৃতির উপরে দুই বছর পড়াশুনা করে। তার পিতা একজন পণ্ডিত ব্যাক্তি হওয়ায় এবং তার সংগ্রহে প্রচুর বই থাকায় সে ব্যাক্তিগত উৎসাহে পড়াশুনা করে সংস্কৃতি ভাষা, স্মৃতি, অলস্কার শাস্ত্র ও ন্যায় শাস্ত্রে বুৎপত্তি অর্জন করে। অতঃপর এই অসম্ভব মেধাবী নিমাই মাত্র ১৬ বৎসর বয়েসে নিজে স্কুল (বা টোল) খোলেন। সেখানে সে যোগ্যতার সাথে তার ছাত্রদের শিক্ষা দান করেন। নিমাই ছাত্র থাকা অবস্থাতেই তার পিতা জগন্নাথ মিশ্রা মৃত্যু বরন করেন, পিতার মৃত্যুর পর মাত্র ১৪ কি ১৫ বৎসর বয়েসে সে বাল্লাপহা আচারীর কন্যা লাক্সী দেবীকে বিয়ে করে। সে সময়ে তার শ্বশুর ছিল একজন নামকরা ব্যাক্তি, ন্যায় শাস্ত্র অলস্কার সাস্ত্র এবং সংস্কৃততে দক্ষতার জন্য তার খ্যাতি ছিল। নিমাইয়ের জ্ঞান অর্জনের ক্ষেত্রে তার শ্বশুরের অনেক আবদান ছিল। তার বয়স অনেক কম হওয়া সত্বেও ন্যায় শাস্ত্র , অলস্কার শাস্ত্র ও সংস্কৃত ভাষায় তার জ্ঞানের জন্য নদীয়ার চারিদিকে তার সুখ্যাতি ছড়িয়ে পরে; এমন কী এই বিষয়ে বিশেষজ্ঞ ব্যাক্তিরা পর্যন্ত তার সাথে বিতর্ককে বর্জন করে চলত। কাশ্মীরের বিখ্যাত পণ্ডিত ব্যাক্তি কেশব মিশ্রা যে কিনা নিজের জ্ঞানের জন্য গর্ব করত, নিজের পরিচয় দিত ‘দ্বিগজয়ী’ বলে, সেও নদীয়াতে এসে বালক নিমাই এর সাথে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলাপ আলোচনা করার পর নিজের পরাজয়কে মনে নেয়। বস্তুত নিমাই ছিল একজন অত্যান্ত মেধাবী ব্যাক্তি।
বাল্যকাল থেকেই নিমাই সনাতন ধর্মের বিভিন্ন অজব নিয়ম নীতির বিষয়ে প্রশ্ন তুলত। যেমন তার মা একবার মাটির হাড়িতে রান্না করার পর তা অপবিত্র বিবেচনায় ফেলে দেয়; হঠাৎ তার মা মাত্র চার বছর বয়েসী নিমাইকে ঐ হাড়ির উপর বসা দেখে, ঐ হাড়ি অপবিত্র বিধায় ঐ হাড়ীর উপর থেকে তাকে নেমে যেতে বললে, ঐ সময়ে নিমায় তার মাকে বলল, রান্না করার ফলে মাটির হাড়ি অপবিত্র হতে পারে না, মাটির হারী বান্নার করার অগেও যেমণ ছিল রান্নার পরও সেই মাটির হাড়িই আছে। এটা অপবিত্র হতে পারে না। তার মা তখন ঐ শিশু নিমায়ের যুক্তিকে মেনে নেয়। এই ঘটনা থেকে ধারনা করা যায় যে বাল্যকাল থেকেই নিমাইয়ের মনে সনাতন ধর্মের বিভিন্ন আজব নিয়ম নীতি সম্পকে প্রশ্ন ছিল। তার এই চিন্তা চেতনা তার প্রচারিত মতবাদে প্রবল ভাবে বিদ্যমান ছিল। সে ব্রাহ্মন হওয়া সত্বেও,বর্নবাদ প্রথাকে সমর্থন করত না। সে ছিল মানবতাবাদী এবং সাধারন জীবন যাপন করত। এই জন্য আমরা দেখি যে, সে তার মতবাদ প্রচার করার সাথে সাথে যাদের কাছ থেকে প্রবল বাধার সস্মুখীন হয়ে ছিল, তারা ছিল, সনাতন ব্রাহ্মন।
চলবে------
------------------------------------------------------------------
** চৈতন্যের জন্মস্থান আবিষ্কারের একটি আলৌকিক ঘটনা কথা জানা যায়, বৈসব ধর্মের সংস্কারক ভক্তিনিন্দা ঠাকুরের বর্ণনা থেকে। ভক্তিনিন্দা ঠাকুর সরকারী চাকরী থেকে অবসর নেওয়ার পর তার শেষ জীবনটা বিন্দাবনে থাকতে চেয়ে ছিল কিন্ত এক রাতে সে স্বপ্ন দেখে প্রভু চৈতন্য তাকে বিন্দাবনে না যেয়ে নবদ্বীপে যেতে বলেছে। তাই সে নবদ্বীপ থেকে ২৫ কিলোমিটার দূরে শ্রী চৈতন্যের জন্ম স্থান কৃষ্ণা নগরে যায়।
সেখানে মেঘাছন এক রাত্রে সে তার চোখের সামনে একটি উজ্জ্বল স্বর্ণের একটি ঘরকে ভাসতে দেখে। সেখানে উপস্থিত তার বন্ধূ কারনি বাবুকে তখন সে প্রশ্ন করে সে কিছু দেখতে পাচ্ছে কী না? উত্তরে কারনানি বাবু তাকে বলে সে কিছুই দেখতে পারছে না। পরবতিতে সে খোজ নিয়ে জানতে পারে, যে স্থানটিতে সে একটি উজ্জ্বল স্বর্ণের ঘরকে ভাসতে দেখেছিল সেটা ছিল শক্তিশালী হিন্দু রাজা লক্ষণ সেনের দুর্গ, বালাদীঘি এবং সে সময়ে ঐ স্থানের এর নাম ছিল মায়াপুর। অনুসন্ধানের পর সে বুঝতে পারে মহাপ্রভু শ্রী চৈতন্যের প্রকৃত জন্মস্থান কৃষ্ণা নগর নয় বরং রাজা লক্ষণ সেনের দুর্গ, বালাদীঘি, মায়াপুর!!
বিষয়: বিবিধ
১২২৯ বার পঠিত, ২ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন