আমাদের পূর্ব পুরুষদের শত্রু-মিত্র পর্ব ১৯
লিখেছেন লিখেছেন আনিসুর রহমান ০৪ নভেম্বর, ২০১৬, ০৮:২১:৩১ সকাল
সত্যপীরঃ সত্য পীর বলতে নিদৃস্ট করে কোন মুসলিম পীর ফকিরকে বুঝায় না। বরং সত্য পীর হল হিন্দু দেবতা সত্য নারায়নের (হিন্দু দেবতা বিষ্ণুর অনেক নামের মধ্যে একটি নাম হল সত্য নারায়ণ ) মুসলিম নাম। হিন্দু লেখকরা হিন্দু দেবতা নারায়নের নাম পরিবর্তন করে রেখেছে সত্য পীর, যাতে করে হিন্দুদের অধিক হারে মুসলমান হওয়াকে ঠেকানো যায়; বস্তুত সত্য নারায়ণ ও সত্য পীরের মাঝে পার্থক্য টানা খুব কঠিন।
হিন্দু দেবতা সত্য নারায়ণের, মুসলিম ফকীর “সত্য পীরের” রূপ ধারন সম্পকে যে কিচ্ছা কাহিনী বর্ণিত আছে তা অনেকা এই রকম। একদা সত্য নারায়ণ মুসলিম ফকীরের রূপ ধরে এক গরীব ব্রাহ্মনের কাছে এসে তাকে উদ্দেশ্য করে বলে তুমি আমাকে পূজার শিরনি দিলে, আমি তোমার দারিদ্র দূর করে ধনী করে দিব। কিন্ত গরীব ব্রাহ্মন তা দিতে অস্বীকার করে। তার উত্তরে ফকীর বলে, সত্য নারায়ণ ও সত্য পীরের মাঝে কোন পার্থক্য নেই এবং সে ফকীরের বেশ ছেড়ে তার স্বমূর্তিতে দেখা দেয়। এই দেখে গরীব ব্রাহ্মন সত্য পীররূপী হিন্দু দেবতা নারায়ণকে পূজার শিরনি দেয় এবং ধনী হয়ে যায়। গরীব ব্রাহ্মনের সন্তানেরা পিতার পদাঙ্ক অনুসরণ করে এই সত্য পীরকে শিরনি দিয়ে পূজা করত। লেখক দ্বিজেন্দ্রনাথ নিউজী (১৯১৬) কী ভাবে হিন্দু দেবতা নারায়ণ মুসলিম সত্য পীর হয়ে গেল সে সম্পকে দুইটি মতামত বক্ত করেন। তার একটি মতামত অনুসারে, মুসলমানদের শাসনের সময়ে ব্রাহ্মনরা নারায়ণের নাম পরিবর্তন করে সত্য পীর করে ফেলে, যাতে মুসলমানরা মনে করে তারা মুসলিম পীরের পুজা করছে ( হিন্দু দেবতা নারায়ণের নয়)। অপর মতামতে তিনি বলেন, প্রথমে মুসলমানরা পীরের পুজা শুরু করে পরে তা হিন্দু দেবতা নারায়নে পরিবর্তিত হয়ে যায়।
Neogi, Dwijendra Nath (1916). Sacred Tales of India. London , UK: MacMillan & Company. pp. 95–100. Retrieved 20 June 2016.
কেন একজন হিন্দু দেবতাকে মুসলিম পীর ফকীর হিসাবে চিত্রিত করা? বস্তুত একজন হিন্দু দেবতাকে মুসলিম পীর হিসাবে চিত্রিত করা বা প্রচার করার মধ্যে রয়েছে অনেক ফায়দা। বর্ন বিভক্ত সমাজে নির্যাতিত নিন্ম বর্নভুক্ত আমাদের পূর্ব পুরুষেরা যখন মুসলিম দায়ী ইল্লেললা বা নায়েবে রসূলদের কাছে আসত তখন তাদের কুরআন সুন্নাহর আলোকে আলোকিত অসাধারন মানবিক গুণাবলীকে দেখে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যেত, তাদের জীবন যাপনের ধরন তাদেরকে প্রবলভাবে আকৃষ্ট করত। তাদের প্রতি এই নায়েবে রসুলদের সম্মান ও ব্যাহারে মুগ্ধ হয়ে তারা দলে দলে ইসলামের ভ্রাতৃতের বন্ধনে অবাদ্ধ হত ও ইসলামের শান্তির ছায়া তলে আশ্রয় নিত। কিন্ত যখন এই কথাকে প্রচার করা হত যে, তারা যাকে মুসলমান ভাবছে সে প্রকৃত পক্ষে তাদেরই অতি পরিচিত দেবতা নারায়ণ ছাড়া আর কেউ নয়। স্বাভাবিক ভাবেই তখন আমাদেরে মনোজগতে বিভিন্ন প্রশ্নের উদয় হত। তারা হয়ত ভাবত একজন চন্ডাল(মুসলমান) কীভাবে এত ভাল হতে পারে! একজন চন্ডালের কাজ অকল্যাণ করা (আজকে যেমন ব্যাপক ভাবে মুসলমানদের সন্ত্রাসী, বোমাবাজ ইত্যাদি প্রচারনা চালনা হচ্ছে তৎকালে মুসলমান বিরোধী বিভিন্ন প্রচারনা ছিল ) সে কীভাবে এত কল্যাণ করতে পারে, ভাল হতে পারে! দেবতার লীলা-খেলা বুঝা ভার, নিশ্চয় সে আমাদের দেবতা সত্য নারায়ণ, সত্য পীরের বেশে আমাদের কাছে এসেছে আমাদের পরীক্ষা করতে। মুসলমান হয়ে, চন্ডালের খাতায় নাম লিখিয়ে কী নীজেদের জাত কুল হাড়িয়ে দেবতার রোষানলে পড়ব। ব্যাপক হারে হিন্দু থেকে মুসলমান হওয়া বন্ধ হওয়ার ক্ষেত্রে, সৃষ্ট এই সত্য পীর ছিল একটি প্রমানিত কার্যকর অস্ত্র।
এই বিষয়ে আমরা গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাই, উড়িষ্যা রিভিউ (Odisha Review) ১৫-ই জানুয়ারী সংখ্যাতে সুস্মিতা পেটনায়েক “ কিডাপার বুখারী পীর সাহেব- যেখানে মুসলিম সুফীইজম ও হিন্দু ধর্ম মিলেমিশে একাকার” এই শিরোনামে এক আর্টিকেলে, উড়িষ্যার কিডাপার সত্য পীর বুখারী পীর সাহেবের সম্পকে আলোচানা শেষে লিখন, “The Muslim conquest of Odisha was not only late chronologically compared to other regions of India, but it also failed to attain the strength and permanence as it did in neighbouring Bengal. Islam failed to penetrate among the Muslim population. In Odisha conversion did not take place on a large scale. Although he embraced Islam, the Raja of Khordha Ram Chandra Deva II tried to protect Jagannath from falling into the hands of the invading army of the Subedar of Bengal, Bihar and Odisha. As the Madalapanji records, he was allowed to perform ritual services to Jagannath despite being a conver Moreover, Sufism gained popularity in Odisha and led to the emergence of Satyapir tradition. Even today Hindus worship Satyanarayan and Pir together, which is an example of the synthesis of Sufism and Hinduism.
মুসলমানরা ভারতের অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় সবার শেষে উড়িষ্যা জয় করেছিল শুধু তাই নয় বরং তারা উড়িষ্যাতে তার প্রতিবেশী বাংলার তুলনায় কম শক্তি অর্জন করেছিল; এমন কী ইসলাম স্থানীয় মুসলমানদের মাঝে প্রবেশ করতে ব্যার্থ হয়েছে (সম্ভবত লেখক এখানে ইসলামের তৌহীদের বানী, মূসলীম নামধারী পীর পুজারীদের মধ্যে প্রবেশ করতে ব্যার্থ হওয়ার কথা উল্লেখ্য করেছেন) । উড়িষ্যাতে ব্যাপক হারে ধর্মান্তিকরন ঘটেনি। যদিও রাজা রাম চন্দ্রা দেব-২, ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিল কিন্তু তার উদ্দেশ্য ছিল বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার বহিরাগত আক্রমণকারী শক্তি, নবাবদের হাত থেকে হিন্দু দেবতা জগন্নাথকে রক্ষা করা (মুসলিম শাসকদেরকে হিন্দু ধর্ম বিরোধী ও ধবংস কারক হিসাবে চিত্রিত করার চেষ্টা) ! মাডালপাপঞ্জ অনুসারে সে ধর্মান্তরিত হওয়া সত্বেও হিন্দু দেবতা জগন্নাথের পূজা করত! অধিকিন্ত সত্য পীর সংস্কারকে অনুসরণ করে উড়িষ্যাতে সুফীইজম জনপ্রিয়তা পেয়ে ছিল। এমন কী আজকেও হিন্দুরা সত্য নারায়ণ ও পীরকে একত্রে পূজা করে, যা হিন্দুইজম ও সুফীইজম মিলেমিশে একাকারের এক সুন্দর উদাহরণ।
তার এই ভাস্য থেকে স্পষ্টত-ই বিঝা যাচ্ছে যে, উড়িষ্যার এই সত্য পীর ভারতীয়দের হিন্দূ ধর্ম ত্যাগ রোধে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালণ কড়েছে (উড়িষ্যাতে ব্যাপক হারে ধর্মান্তিকরন ঘটেনি।)। শুধু তাই নয় এই সত্য পীরের প্রভাবে এমনকি উড়িষ্যার মুসলমানদের অন্তরে ইসলামের তৌহীদের বানী প্রবেশ করতে ব্যার্থ হয়।
চলবে---
বিষয়: বিবিধ
১১৬৯ বার পঠিত, ৬ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন