আমাদের পূর্ব পুরুষদের শত্রু-মিত্র পর্ব ১৮
লিখেছেন লিখেছেন আনিসুর রহমান ২৭ অক্টোবর, ২০১৬, ০৭:০১:১৯ সকাল
এই পর্বে আমরা মঙ্গল কাব্যের মধ্য দিয়ে কথিত ইসলাম প্রচারক, পীর দরবেশ যাদের হাত ধরে শিরক ভারতের মুসলিম সমাজের রন্ধে রন্ধে প্রবেশ করিয়ে দেওয়া হয় তাদেরকে আবিস্কারের চেষ্টা করব। এখানে আমার উদ্দেশ্য হল সত্যকে আবিস্কারের চেস্টা করা, কোন ভাবেই কোন ব্যাক্তি, ধর্ম, বা জাতিকে আক্রমণ করা নয়।
মানিক পীরঃ মানিক পীর ঐতিহাসিক না কল্পিত চরিত্র তা নিয়ে দুই ধরনের মতবাদ প্রচলিত আছে।( কেউ কেউ মনে করে) মানিক পীর ছিলেন ইসলাম পূর্ব অগ্নি উপাসক ইরানের একজন সাধু । তাকে পীর-দরবেশদের গুরু বলা হয় এবং খ্রিষ্টানদের যিশুর ন্যায় ব্যাক্তি হিসাবে গণ্য করা হয়। (ibid, p 196 )। অপর দিকে ডাঃ আব্দুল করিম সাহিত্য বিশারদের মতে অন্যান্য কল্পিত পীর যেমন গোঁরা পীর, মাদারী পীরের ন্যায় মানিক পীরও একজন কল্পিত পীর এবং যার কোন ঐতিহাসিক ভিত্তি নেই। এই প্রসঙ্গে উল্লেখ্য যে, বাংলাদেশে পীরইজম বা পীর পূজার প্রচলন সম্পকে ডাঃ আব্দুল করিমের মতামদ হল, এর প্রচলন ঘটেছে উত্তর ভারত থেকে আগত লোকদের দ্বারা, বঙ্গবাসীদের হাত ধরে নয়। অপর দিকে ডাঃ অঞ্জলি চাট্টাজি, ডাঃ আব্দুল করিমের মতের সাথে ভিন্ন মত প্রসন করে বলেছেন, বাংলাতে সপ্তাদশ শতকে পীরইজম বা পীর পূজার প্রচলন ঘটেছে হিন্দু ধর্ম থেকে। এই দুই বিখ্যাত ব্যাক্তির মতামত থেকে বাংলাতে কীভাবে “পীরইজম বা পীর পূজার প্রচলন ঘটেছে” তার কোন সমাধানে পৌছা না গেলেও, এটা পরিষ্কার যে, পীরইজম ভারতবর্ষের সৃষ্ট এবং ইসলামের সাথে এর কোন সম্পক নেই।
মাণিক পীর কল্পিত না বাস্তব ব্যাক্তিত্ব ত্তার কোন সঠিক তথ্য না থাকা সত্বেও প্রচারনার গুনে আমরা দেখি যে সেই সময়ে (১৫০০-১৬০০ খ্রাঃ) বাংলার গ্রামে গ্রামে মানিক পীরের সস্মানে বন্দনা সংগীত গাওয়া হত, যা মানিক পীরের “যহুর নামা” নামে খ্যাত! সময়ের সাথে সাথে এই মানিক পীর হিন্দু দেবতা শিবের অনুগত বা শিবের ন্যায় ক্ষমতা সম্পন্ন ব্যাক্তি রূপে সমগ্র বাংলাতে প্রতিষ্ঠা পায়। বাংলার আনাচে কানাচে তৈরী হয় মানিক পীরের বন্দনার জন্য মানিক পীরের মাজার ও দরগাঁ । একজন পীরের এত গুল মাজার তৈরী হয় কীভাবে যদি এই প্রশ্ন আসে, তবে তার উত্তর হল হিন্দু দেবী কালী অথবা দুর্গাতো একজন তাদের নামে কেন এত মন্দির। একজন দেব দেবীর নামে যদি অনেক গুল মন্দির হয় তবে মানিক পীরের ন্যায় একজন যে কিনা অসম্ভবকে সম্ভব করে ফেলতে পারে তার নামে কেন নয়? শীতের “নবান্ন উৎসবে” এই মানিক পীরকে হিন্দু মুসলিম নিরবিশেষে সমগ্র বাংলার লোকেরা শিরনি হিসাবে নতুন উঠা চালের তৈরি পায়েস দিয়ে বন্দনা করত। মাণিক পীরের নামে প্রচলিত আছে অনেক বন্দনা সঙ্গীত, পুঁথি, নাটক ইত্যাদি।
নিন্মের মাণিক পীরের বন্দনা সঙ্গীতের চরণ দুটি আমাদের অনেক কিছু বলে দেয়
“সে জনে আমি (আল্লাহ) দিব দুনীয়ার ভার
কলি কালে মানিক হবে আফতার(গাউস-কুতুব)”
এই বন্দনা সঙ্গীতের কথা থেকে বুঝা যাচ্ছে কল্পিত এই মানিক পীরকে কলি কালে ( কেয়ামতের আগে) দুনীয়া রক্ষা কল্পে পাঠানো হবে। অনেকটা ঈসা () মত ব্যাক্তিত্ব দেওয়ার চেস্ট করা হয়েছে। এই ধরনের ক্ষমতা সম্পন্ন পীরদেরকে ইসলামী টাইটেল দেওয়া হয়, গাওস বা কুতুব। এ ছাড়াও মাণিক পীরের নামে বিভিন্ন প্রকারের আলৌকিক কিচ্ছা- কাহিনী প্রচলিত আছে। যেমন মাণিক পীর এক গৃহস্থের কাছে ফকিরের বেশে যেয়ে দুধ পান করতে চাইলে গৃহস্থ জানাল তার গরুর বাটে কোন দুধ নেই। তখন মাণিক পীরের কৃপায় সেই দুধ না দেওয়া গাভী থেকে আলৌকিক ভাবে দুধের বন্য বয়ে যায় ইত্যাদি ইত্যাদি। আবার ফকির মোহাম্মদ (১৮ শতকে) তার নাটকে মাণিক পীরকে চিত্রিত করেছে, জনৈক গয়ালীনির মেয়ের সাহায্যকারী রূপে। যেখানে মাণিক পীর গয়ালীনির মেয়ের সাথে রাজকুমারের বিয়ের পথে শকল বাধাকে দূর করনে সহায়তা করে।
কল্পিত এই মানিক পীরের বিভিন্ন ধরনের জীবন বিতান্ত পাওয়া যায়। এক বর্ননায় পাওয়া যায়, একদা নবাব কন্যা দুধ বিবি যখন নদীর তীরে গোসল করতে যায় তখন সেখানে একটি বালককে সে একাকী দেখতে পায়। দুধ বিবি বালককে তার পরিচয় জিজ্ঞাসা করিলে , সে জানায় তার নাম মাণিক এবং তার পিতা-মাতা নেই। দুধ বিবি দয়া করে এই বালককে তার সাথে নিয়ে যায় এবং আশ্রয় দেয়।
বর্তমান অবস্থা হল এখনও বিভিন্ন জায়গায় এই কল্পিত ইসলাম প্রচারক সূফী, ফকীর মাণিক পীরের মাজার আছে এবং হিন্দু ধর্ম বিশ্বাসীদের কাছে তার কদর এখনও থকলেও, মুসলমানদের কাছে তার প্রভাব ক্রমানয়ে হ্রাস পাচ্ছে। এর অন্যতম প্রধান কারন হল, মুসলমানদের মাঝে শিক্ষার বিস্তার ও ইসলামী জ্ঞানের প্রভাব।
কলকাতাঃ খোদ কলকাতাতে রয়েছে এই মাণিক পীরের মাজার। যে স্থানটিতে এই মাণিক পীরের মাজার ও একটি মসজিদ রয়েছে সেই স্থানটির নামও রাখা হয়েছে এই কল্পিত পীরের নামের অনুকরণে “মানিক তলা”। এই মাণিক তলা ক্রসিং হল ভিভেক আনন্দা রোড (মাণিক তলা প্রধান সড়ক) ও আচয প্রফুল্ল চন্দ্রা রোড(আপার সার্কুলার রোড) এর মিলন স্থান। হিন্দুদের দুর্গা পূজার সময়ে এই মাণিক তলাতে কলকাতার সবচেয়ে বড় পুজা হয়ে থাকে। কেন কলকাতার ব্রাহ্মবাদীরা এই মাণিক পীরকে এত কদর করে থাকে তা বুঝতে মনে হয় না বেশী বুদ্ধি খরচ করতে হবে।
পশ্চিম বঙ্গের মত করে না হলেও, বর্তমান বাংলাদেশে রয়েছে মাণিক পীরের অনেক মাজার/খানকা। মজার বিষয় হচ্ছে, অনেক ক্ষেত্রেই এই মাজার খানকা গুলির সংস্কার কাজের সাথে যাদের নাম দেখা যায় তাদের অনেকেই স্যেকুলার পন্থী নয়। যেমন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের প্রয়াত প্রভাবশালী নেতা, সাবেগ অর্থ মন্ত্রী সাইফুর রহমানের নাম দেখা যায় সিলেট মাণিক পীরের খানকাতে অবস্থিত ম্যেমরন্ডামে খানকার কাজ শেষে এর উদ্বোধক হিসাবে (https://www.youtube.com/watch?v=OyXfOElLuS4 )।
চলবে----
বিষয়: বিবিধ
১১৯৪ বার পঠিত, ২ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন