আমাদের পূর্ব পুরুষদের শত্রু-মিত্র পর্ব ১৭
লিখেছেন লিখেছেন আনিসুর রহমান ০৭ অক্টোবর, ২০১৬, ১০:২৫:২৫ সকাল
যে সময়টাতে মঙ্গল কাব্য লিখা শুরু হয় সেই সময়ে বাংলা সাহিত্যের একটি উল্লেখযোগ্য ধারা ছিল এই যে, একটি মানবতাবাদী আদর্শ চরিত্রকে কেন্দ্র করে ঘটনা আবর্তিত হওয়া। শ্রী শ্রী চৈতন্য দেবের জীবন চরিত্রের উপর ভিত্তি করে বাংলা সাহিত্যের যে ধারা শুরু হয়ে ছিল, সে ধারাকে অনুসরণ করেই পরবতিতে পীর সাহিত্যের সুচনা ঘটে। সবচেয়ে বেশী বিস্ময়কর বিষয় হল ভারতবর্ষে সর্ব প্রথম লিখিত আকারে যে ইসলামী সাহিত্যের সুচনা ঘটে তা, না কুরআনের উপর ভিত্তি করে, না হাদীসের উপর ভিত্তি করে, না কোন নবী রাসুলেদের জীবনী, এমন কী নবী করিম () আনুসারী সাহাবাদের জীবনিও না। হ্যাঁ দুঃখ জনক হলেও সত্য যে সেই ইসলামী সাহিত্য (আসলেই ইসলামী সাহিত্য ছিল, না কী ইসলামকে ভারতবর্ষ থেকে হাটিয়ে দেওয়ার সাহিত্য ছিল?) ছিল পীর দরবেশদের জীবনি।
ব্যাপারটা বেশ জটিল মনে হচ্ছে তাই না। অসুন এখন আমরা বুঝার সুভিদার্থ নিজেকে নিজে প্রশ্ন করি? যে দেশের সাহিত্যে কুরআন নাই, হাদীস নাই, নবী রসূলদের জীবন কাহিনী নেই এমন কী সাহাবা আকরামদের কথা নেই কিন্ত আছে অতি রঞ্জিত বা কল্পিত ব্যাক্তিদের জীবন চরিত, যারা আবার ইসলামের ধারক বাহক ও প্রচারকও!! সেই দেশে নামে যে ইসলাম থাকবে, তার ধরন কিরূপ হবে? ভাবুন বা একটু সময় নিয়ে গভীর ভাবে চিন্তা করুন, তবেই বুঝতে পারবেন ব্রহ্মবাদীদের পরিকল্পনা কতটা নিখুঁত ছিল। এক কথায় আমরা বলতে পারি, তাদের এই পরিকল্পনার ধরন ছিল অনেকটা “ কাটা দিয়ে কাটা তোলার মত” অর্থাৎ ইসলামের নাম দিয়ে তাওহীতবাদী ইসলামকে হাটিয়ে দেওয়া। কিন্তু পরিকল্পনা যতই নিখুঁত হোক না কেন, শুধু মাত্র সময় মত যোগ্য বীর জন্ম দিতে না পারার জন্য তারা এর থকে শতভাগ বেনিফিট নিতে পারে নাই, আফসোস!!
এই ধরনের সর্ব প্রথম প্রকাশিত কাব্যের নাম হল, “পীর পাঞ্চিলি কাব্য”। উল্লেখ্য থাকে যে, সেই সময়টাতে বাংলা গদ্য সাহিত্যর অনুপস্থিতে তার শুন্য স্থান দখল করেছিল বাংলা পদ্ম সাহিত্য। এই পদ্ম সাহিত্যগুল ছিল ছন্দোবদ্ধ মণ মুগ্ধকর যা মনে রাখা ছিল সহজ।“পীর পাঞ্চিলি কাব্য” সহ অন্যান্য কাব্যও যেমন রামচন্দ্রের পুঁথি, দেবী মনশার মঙ্গল কাব্যা, মানিক পীর, সত্য পীর, বনবিবি ইত্যাদি একই ধারাকে অনুসরণ করে রচিত। কথিত ইসলাম প্রচারক ব্যক্তিদের জীবন চরিত্রের উপর ভিত্তি করে যে সাহিত্য রচিয়িত হয়ে ছিল তাকে আমরা কোন অর্থেই বাংলা সাহিত্যে সার্ব প্রথম মুসলমানদের গৌরব উজ্জ্বল সৃষ্টি বলতে পারি না, তার কোন সুযোগও নেই। কেননা কথিত ইসলাম প্রচারক ব্যাক্তিদের জীবন চরিত্র এর উপর ভিত্তি করে সৃষ্ট এই পীর মঙ্গল কব্যগুলির রচয়িতারা যে শুধু মুসলমানরাই ছিল এমন নয়! বরং অনেক হিন্দু কবিও ইসলাম প্রচারক এই পীর দরবেশ মঙ্গল কাব্য রচনা করেছিল যেমন কৃষ্ণাচন্দ্র দাস, রামঈশ্বর ভট্টাচজ, ভারত চন্দ্রা ইত্যাদি ! এই মঙ্গল কাব্যের রচয়িতার লিস্টও বেশ বড়, প্রায় একশত জনের মত হবে। মঙ্গল কাব্যে মুসলিম পীর দরবেশদেরকে হিন্দু পৌরাণিক দেবতাদের যেমন রামচন্দ্র, ন্যায় অতি মানবিক সত্তা হিসাবে চিত্রিত করা হয়। এই কাব্যের পীরেরা শুধু জ্ঞানী ও পবিত্রই নয়, তাদেরকে চিত্রত করা হয় বান্দা ও আল্লহ মাঝে বন্ধন বা শাফায়াৎ করী রূপে। পীরা তার মুরিদের জন্য যে দোয়া করে আল্লাহ তা কবুল করেন, এই কাব্যের পীরেরা তার মুরিদদের বিপদ আপদ বালা মুসিবত থেকে রক্ষা করতে পারে, এমন কী মৃত্যুর পর এই মঙ্গল কাব্যের পীররা তার মুরিতদের জান্নাতে নিয়ে যেতে পারে! এই সকল কারনে মুসলমানদের মনের মাঝে এই ধারনা জন্মে যে এই রূপ আলৌকিক ক্ষমতা সকল সম্পন্ন পীররা মৃত্যুবরন করতে পারে না বরং তারা অমর অক্ষয়। তাই তারা মৃত পীরের মাজারে আগর বাতি, মোম বাতি জ্বালাইত, বিপদ আপদ থেকে বাচার জন্য তারা পীরদের মাজারে শিরনি দিত এবং তাদের সাহায্য প্রার্থনা করত।
মাঙ্গল কাব্যে বর্ণিত, ইসলাম প্রচারক কল্পিত এই পীররা সময়ের সাথে সাথে কল্পনার গণ্ডিকে অতিক্রম করে বাস্তব ব্যাক্তি রূপে হাজির হয়। ফলে মুসলিম সমাজ ডুবে যেতে থাকে শিরকের অতল গহ্বরে। তবে এই ক্ষেত্রে আমাদের মনে রাখতে হবে যে, পীর মঙ্গল কাব্যের সৃষ্ট সব পীর কল্পিত ছিল না, কোন কোন ব্যাক্তিত্ব ঐতিহাসিকও ছিল কিন্তু ঐতিহাসিক ঐ ব্যাক্তিদেরকেও তারা ঐ কাব্যের মাধ্যমে দেবতার আসনে বসিয়ে ছিল।
পলাশীর প্রান্তে মুসলমানরা ক্ষমতা হারানোর ফলে, “দিল ম্যে বহতাহে রাম রহিম-” এর তাৎপয কঠিন বাস্তবতা রূপে মুসলমানদের সস্মুখে হাজির হয়। কঠিন বাস্তবতা তাদের মাঝে সচেতনতা সৃষ্টিতে ক্যেটালিস্ট(প্রভাবক) এর ভুমিকা পালন করে। মুসলিম ও হিন্দু জাতীয়তাবাদের উথান ঘটে। মুসলমানরা তাদের পরাজয়ের কারন নিয়ে ভাবনা চিন্তা শুরু করে দেয়, ফলে গুমর ফাঁশ হয়ে যাওয়ার ভয়ে মঙ্গল কাব্য লেখা বন্ধ হয়ে যায়।
চলবে----
বিষয়: বিবিধ
১০৪৪ বার পঠিত, ২ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন