রমাদান ও আত্নসুদ্ধি
লিখেছেন লিখেছেন আনিসুর রহমান ১৪ জুন, ২০১৬, ০২:২৮:০৮ দুপুর
আরবী ক্যালেন্ডারের নবম মাসকে বলা হয় ‘রামদান’। এই মাসটি সারা বিশ্বের মুসলমানদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ মাস। এই মাসটির এত মর্যাদার কারন হ’ল এই মাসে মানব জাতির পথ প্রদশক কুরআন নাযিল হয়েছে এবং এই মাসে সিয়াম(রোজা) পালন করা ফরয করা হয়েছে, যাতে আমরা এক মাস কঠোর ইবাদত বন্দিগী পালন করার মধ্যদিয়ে মুত্তকী হতে পারি আর মুত্তকী হওয়াটাই মুমিনদের মুল লক্ষ হওয়া উচিত কেননা আল্লাহ্ সূরা বাকারার ২ নং আয়াতে কুরআনকে ‘গাইড বূক’ বলেছে মুত্তাকীদের জন্য (এই সেই কিতাব যাতে কোন সন্দেহ নেই, পথ প্রদর্শক মুত্তাকীদের জন্য।–সূরা বাকারা, আয়াত ২) । এই জন্য ওলেমারা রমাদান মাসকে মুমিনদের জন্য ট্রেনিং এর মাসও বলে থাকে। এই ট্রেনিং হল মুত্তাকী হওয়ার ট্রেনিং তাই এর ব্যাপ্তি অনেক বড় এবং যাহের ও বাতেন এর মত বিষয় গুলও এই ট্রেনিং এর অন্তভুক্ত। যাহের বিষয় অর্থাৎ যে কাজগুল সরাসরি আমাদের অন্তরের সাথে সম্পকিত নয়। যেমন, নামাজ, সিয়াম পালনের নিয়তে সুবহ সাদিক থেকে সূর্যঅস্ত পর্যন্ত খাদ্য পানি ও বৈধ যৌন মিলন থেকে বিরত থাকা, সেহিরি খাওয়া, তারাতারি ইফতার করা, তারাবি নামাজ পড়া, যাকাত ফেতরা দেওয়া অর্থাৎ সব আদেশ মূলক কাজ এই ট্রেনিং এর অন্তভুক্ত । আবার হারাম কাজ থেকে বিরত থাকা যেমন, চুরি ডাকাতি করা, হারাম উপার্জন করা, মানুষকে জুলুম নির্যাতন কারা মিথ্যা বলা অর্থাৎ সব নিষেধ মূলক কাজ এই ট্রেনিং এর অন্তভুক্ত।(আদম ইবন আবূ ইয়াস (র)... আবূ হুরায়রা (রা) থেকে বর্নিত, তিনি বলেন, নবী (ﷺ)বলেছেনঃ যে ব্যক্তি মিথ্যা বলা ও সে অনুযায়ী আমল বর্জন করেনি, তাঁর এ পানাহার পরিত্যাগ করায় আল্লাহ্র কোন প্রয়োজন নেই।-বুখারী )
অপরদিকে বাতেন বিষয় হল যে বিষয়গুল সরাসরি আমাদের অন্তরের(কলব) সাথে সম্পকিত। যেমন, অন্যদের সম্পকে খারাপ ধারনা পোষণ করা, হিংসা করা, অহংকার করা, রাগ করা, চোখের সাহায্যে হারাম দেখা, মনে মনে হারাম চিন্তা করা ইত্যাদি। এই বাতেন বিষয় গুল নিয়ন্ত্রন করার জন্য সিয়াম হল একটি কাযকরী ঢাল। ঢাল যেমন শ্ত্রুর তরবারির আঘাত থেকে আমাদের রক্ষা করে সেরূপ শয়তানের অস্ত্র হিসাবে ব্যাবহিত,এই বাতেন বিষয়গুলর আক্রমণের হাত থেকে সিয়াম আমাদের রক্ষা করে, আমাদের কলবকে পরিষ্কার করে আত্নিক উন্নয়নে সহায়তা করে (আব্দুল্লাহ ইবন মাসলামা (র)... আবূ হুরায়রা (রা) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেনঃ সিয়াম ঢাল স্বরূপ- সহি বুখারী)। একবার রাসূল (ﷺ) তিন বার একজন সাহাবীর জান্নাতী হওয়ার সুসংবাদ দিলে অপর আরেকজন সাহাবী আর কারন অনুসন্ধান কল্পে তার বাড়িতে এক রাত্র বাস করেও তেমন কোন বিশেষ আমল না পেয়ে ঐ সাহাবীকে রসুল(ﷺ) মের সুসংবাদের কারন সম্পকে জিজ্ঞাসা করলে তার জবাবে ঐ সাহাবী বলেন, “ আমি যখন ঘুমাই তখন আমার অন্তর কোন মুসলমানের বিরুদ্ধে হিংসা- বিদ্বেষ ঘৃণা কিংবা ধোঁকাবাজী ও শঠতা থেকে মুক্ত থাকে, (আহমদ, নাসাই)।
ইসলামে যদিও সংসার বিবাগী হওয়াকে সমর্থন করে না; না সমর্থন করে ইবাদত বন্দীগির ক্ষেত্রে অত্যাধিক কঠোরতা অবলম্বন করাকে। কিন্ত ট্রেনিং এর মাস রমাদান এর ব্যাতিক্রম। হাদীসে এসেছে রমাদানের শেষের দশ রাত্র রসুল (ﷺ) ঘুমাতেন না, কঠোর ও লাগতার এবাদতে মশগুল থাকতেন। হযরত আনাস থেকে বর্ণিত রমাদানের শেষের দশ রাত্রে, রসুল ﷺ বিছানা উঠিয়ে ফেলতেন, নিজ স্ত্রীদের থেকে দূরে থাকতেন এবং ভোর রাত্রে সেহরীর সময় সন্ধা বেলার খাবার খেতেন (তাবারানী)। রমাদান মাসের সিয়াম একমাত্র ইবাদত যা আল্লাহ্ ও বান্দার মাঝে হয়ে থাকে। এই জন্য আল্লাহ্ বলেছেন সিয়ামের জাজা আল্লাহ্ নিজে বান্দাদের দিবেন। এই মাসের শেষের দশ দিন ঘর সংসার ত্যাগ করে আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের জন্য মসজিদে ‘এতেকাফে’*** বসে যান, ঘুমকে হারাম করে (অব্যশই নিজের সুস্থ্যতার প্রতি খেয়েল রাখতে হবে কেননা সুস্থতা আল্লাহর নিয়ামত) কঠোর এবাদত বন্দীগির মধ্য দিয়ে আল্লাহ্ নৈকট্য অর্জনের চেষ্টা করুন, এতে শুধু আপনার কলব পরিষ্কার হয়ে আত্নিক উন্নয়নে সহায়তা করবে না। নিশ্চিত ভাবেই আপনি পেয়ে যাচ্ছেন এমন একটি রাত, যে রাতে ইবাদত করা হাজার বছর থেকে উত্তম। আর এই ভাবে ইবাদত বন্দিগী করাটা কোন সূফী বা সাধু বা পীর কতৃক নতুন উদ্ভাবিত পথ নয় বরং এই ভাবে ইবাদত বন্দিগী করার জন্য নবী করীম (ﷺ) বলেছেন এবং নিজে তা করে দেখিয়েছেন এবং সাহাবা আকরামরা তা অনুসরণ করে আমাদের জন্য উদাহরণ রেখে গিয়েছেন। পুরা এক মাস রমাদান পেলেন অথচ শরিয়া নির্দেশিত পথে নিজের কলবকে (অন্তর/নফস) পরিষ্কার করে আত্নিক উন্নতি ঘটাতে পারলেন না, নিজের গোনাহকে মাফ করাতে পারলেন না, আল্লাহ্র নৈকট্য অর্জন করতে পারলেন না এবং জান্নাতকে হাসিল করতে পারলেন না । কিন্ত মনে মনে ভাবছেন সূফী, পীর, ফকিরের উপদেশ, তরিকা অনুসরণ করে কলবকে (অন্তর/নফস) পরিষ্কার করে আত্নিক উন্নতি ঘটাবেন, নিজের গোনাহকে মাফ করাবেন, আল্লাহ্র নৈকট্য অর্জন করবেন এবং জন্নাত হাসিল করবেন এবং এর স্বপক্ষে যুক্তি হিসাবে বলছেন নবী করীম(ﷺ) তো এই পথকে, তরিকাকে নিষেধ করে নাই!! তবে আমি মনে করি আপনি শয়তানের ধোকার মাঝে আছেন। কারন হল কোন সূফী, পীর, ফকিরের পথ নয় বরং নবী করীম (ﷺ) দেখানো পথই শ্রেষ্ঠ পথ, একমাত্র সঠিক পথ। মনে রাখবেন এই পথে আপনি কলবকে (অন্তর/নফস) পরিষ্কার করে আত্নিক উন্নতি ঘটাতে ব্যার্থ হলে, নিজের গোনাহকে মাফ করাতে ব্যার্থ হলে , আল্লাহ্র নৈকট্য অর্জনে ব্যার্থ হলে এবং জন্নাত হাসিল ব্যার্থ হলে। অন্য কোন কোন পথেই সাফ্যলের মুখ দেখবেন না। রমাদান পেয়ে যে কাজে লাগাইনি তাদের সম্পকে রসুল(ﷺ) বলেন, ঐ ব্যাক্তির নাক ধুলায় মলিন হোক যে রমাদান পেয়েছে কিন্তু তার গুনাহ মাফ হয়নি। (তীরমিযী, হাকেম)। কিন্তু যারা কঠোর পরিশ্রমের দ্বারা দেহকে ক্ষুধার্থ রেখে তার আত্নাকে খাবার দিয়ে তার নফসকে ‘মুতমাইন্নাহ’ পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছ তাদের সম্পকে আল্লাহ্ বলেন “ হে প্রশান্ত মন তুমি তোমার পালন কতৃার নিকটে ফিরে যাও সন্তূস্ট ও সন্তষভাজন হয়ে। অতঃপর আমার বান্দাদের অন্তভুক্ত হয়ে যাও। এবং আমার জান্নাতে প্রবেশ কর। (৮৯ঃ ২৭--৩০) ।
------------------------------------------------------------------
এতেকাফের আভিধানিক অর্থ হল, কোন জিনিসকে আঁকড়ে ধরা এবং এর উপর নিজ সত্তা ও আত্নাকে আটকে রাখা। আর পরিভাষিক অর্থ হল, আল্লাহর নৈকট্য লাভের উদ্দেশে কোন ব্যাক্তির মসজিদে অবস্থান করা কোন নিরদৃস্ট সময়ের জন্য। এতেকাফ হল এমন এক নির্জনতা যেখানে বান্দা দুনীয়াবী সকল কাজ কাম থেকে কোন নিরদৃস্ট সময়ের জন্য সম্পক ছেদ করে আল্লাহর আল্লাহর নৈকট্য লাভের উদ্দেশে মসজিদে অবস্থান করে এবং এই সময়ে সে সালাহ, সিওম, কুরআন তেলাওয়াত, ইসলামী জ্ঞান চর্চা ও গবেষণা কাজে নিজেকে সম্পুন রূপে ব্যাস্ত রাখে।
বিষয়: বিবিধ
১১৮৯ বার পঠিত, ৯ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
আশাকরি বেশী বেশী ইবাদত বন্দেগী ও ইতিকাফের প্রতি অনেকেই আগ্রহী হবে আপনার লিখাটি পড়ে।
সর্বোপরি রমাদান ও আত্মশুদ্ধির বিষয়টি চমৎকারভাবে উপস্থাপনের জন্য জাজাকাল্লাহু খাইর।
আবারও আপনাদের রমাদান উপলক্ষে একটি সুন্দর উদ্দেক গ্রহণ করার জন্য ধন্যবাদ জানাই। আপনার মন্তব্য খুবই উৎসাহ মূলক। দেরীতে জবাব দেওয়া থেকেই বুঝতে পারছেন কীভাবে দুনীয়া বিমুখ হয়ে আত্নিক উন্নয়নের জন্য উঠে পড়ে লেগেছি এই রমদানে। দোয়া করবেন
রেদওয়ান কবির সবুজ আপনাকে অনেক ধন্যবাদ আপনার মতামতের জন্য।
রমাদানে যে ট্রেনিং গুলোর উল্লেখ করেছেন, সেগুলোতে উত্তমরূপে প্রশিক্ষিত হতে পারলে কোনো লোকের পক্ষে বাকি জীবনে অন্যায় করা সম্ভব নয়।
আল্লাহ আপনাকে উত্তম জাযা দিক।
রসিক ভাই। পর্ব কিন্তু আরো আছে। সম্ভব হলে বাকি পর্বগুলোতে লেখার অনুরোধ রইলো।
আমরা ইবাদাতের বাহিরের রুপ টাকেই মূল ইবাদাত মনে করছি আর এজন্য রোযার অর্থ ই ধরে নেই উপবাস থাকা ফলে এর সাথে অন্তরের যে সংযোগ আছে, আত্নশুদ্ধির বিষয়য় আছে এটা উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হই।
আপনার লিখাটি আত্নশুদ্ধির প্রশিক্ষণের যথাযথ ভাবটি তুলে ধরেছে মাশা আল্লাহ।
মন্তব্য করতে লগইন করুন