আমাদের পূর্ব পুরুষদের শত্রু-মিত্র পর্ব ১১
লিখেছেন লিখেছেন আনিসুর রহমান ২৬ মে, ২০১৬, ০৬:১৩:১৫ সন্ধ্যা
তৎকালে বাংলাতে আগত ইসলাম প্রচারকরা, যাদেরকে আমরা, সূফী, দরবেশ, পীর, ফকীর হিসাবে চিনি তারা কী প্রকৃত পক্ষে সূফী, দরবেশ, পীর, ফকীর ছিলেন না কী দায়ী ইলাল্লাহ বা নায়েবে রসুল ছিলেন?
এই অঞ্চলে যারা ইসলাম প্রচারের জন্য এসেছিলেন তাদের অধিকাংশের মাঝেই কতকগুল বৈশিষ্ট কমন ছিল যেমন তারা কারো উপদেশ পেয়ে বা অনুরোধ রক্ষার জন্য এই অঞ্চলে এসে ছিল। অর্থাৎ উপদেশ দানকারী ব্যাক্তি কোন না কোন ভাবে এই অঞ্চলে ইসলাম প্রচারের প্রয়োনীয়তা উপলদ্ধ করে তাদেরকে উপদেশ দিয়ে ছিল। এই কথা আমরা আগেই উল্লেখ করেছি যে এই অঞ্চলের সাথে আরবদের ব্যাবসা ব্যানিজ্য ও যাতায়াত ছিল বিভিন্ন উপয়ে।
এই আঞ্চলে যারা ইসলাম প্রচারের জন্য এসে ছিল, তাদের অধিকাংশই দুনীয়া বিমুখ হয়ে আত্নিক উন্নয়নের দিকে নিজেদের নিযোজিত রাখেননি বরং দুনিয়ামুখী বিভিন্ন কল্যাণ কর কাজে নিজেদের ব্যাস্ত রেখে ছিলেন।
এই আঞ্চলে যারা ইসলাম প্রচারের জন্য এসে ছিল, তাদের অধিকাংশই সংসার ত্যাগী হয়ে জিকির আযগারের মাধ্যমে আল্লাহর সাথে গভীর সম্পক স্থাপনের জন্য সর্বদা নিজেদের ব্যাস্ত রাখেনি বরং তারা আল্লাহর সাথে গভীর সম্পক স্থাপনের সাথে সাথে মানুষের বিভিন্ন দুনিয়াবি সমস্যা সমাধানের চেস্টা করেছেন, এমন কী একজন যোগ্য নায়েবে রাসুলের ন্যায় প্রয়োজনে জেহাদও করেছেন।
এখন একটি কেছ স্টাডির (Case Study) মাধ্যমে এই বিষয়গুলর উপর তুলনামূলক বিশ্লেষণ ও আলোচনা মধ্য দিয়ে পাঠকের কাছে একটি পরিষ্কার চিত্র তুলে ধরতে চেস্টা করব।
কেছ স্টাডির (Case Study) ১ : ইসলাম প্রচারক ও যোদ্ধা খান জাহান আলী(১৪৫৯)
এটা মনে করা হয় যে খান জাহান আলী বিখ্যাত ইসলাম প্রচারক ও যোদ্ধা ছিলেন। সে উলূগ খান এবং খান ই আযম নামেও পরিচিত। তার নামের সাথে উলূগ শব্দীটি তার জন্মা স্থান তুরস্ককে নির্দেশ করে।
উপরের এই তথ্য থেকে আমরা বুঝতে পারছি যে, খান জাহান আলী (রঃ) জন্মস্থান বাংলাদেশ নয় বরং তুরস্ক। যতটুকু জানা যায় সে বাগদাদ থেকে বাংলাতে এসেছিল টার্কি বাংশভুত দীল্লীর সুলতানের আমন্ত্রণ পেয়ে। এটা পরিষ্কার ভাবেই বুঝা যাচ্ছে যে, জাহান আলী (রঃ) সংসার ত্যাগী সূফী দরবেশদের ন্যায় নির্জন নিবাস বা দুনীয়ার সাথে সম্পক ত্যাগ করে আত্নার উন্নয়নের জন্য এখানে আসেননি বরং এসে ছিলেন নায়েব রসুলের ন্যায় দায়িত্ব নিয়ে, ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্য নিয়ে।
খান-ই-আযম উপাধিটি নির্দেশ করে যে সে বাংলার সুলতান নাসিরদ্দিন মাহামুদ শাহর একজন প্রতিনিধি বা অফিসার ছিলেন। সে বাংলার সুলতানের কাছ থেকে সুন্দরবন অঞ্চল জায়গীর হিসাবে পেয়েছিলেন।
এই তথ্যটি পরিষ্কার ভাবে আমদের বলে দিচ্ছে যে, খান জাহান আলী (রঃ) সংসার ত্যাগী সূফী দরবেশদের ন্যায় দুনীয়ার বড় বড় পজিশন, পদ, জটিল রাজনীতি, অর্থনীতি প্রভৃতি থেকে দূরে থকেননি কিংবা দুনিয়া বিমুখ হয়ে বৈরাগ্য জীবনকে বেছেও নেননি। বরং তিনি যোগ্য একজন নায়েবে রসুলের ন্যায় দুনিয়া মুখী হয়ে সুন্দর বনের নেয় দুর্গম অঞ্চলকে আবাদ ও ইসলাম প্রচারের জন্য চ্যলেজ হিসাবে নিতে পিছপা হনটি।
তিনি দিন রাত্র অক্লান্ত চেষ্টা করে গভীর বনাঞ্চলকে পরিষ্কার করে মানুষ বসবাসের উপযোগী করেছিলেন। তিনি প্রচুর রাস্ত ঘাট, পুল কালভাড নির্মাণ করেন।
সুফীদের সকল ধ্যান, জ্ঞান, চেস্টা প্রচেস্ট হল দুনিয়াবি উন্নয়ন নয় বরং আত্নীক উন্নয়ন। এই জন্য তারা দুনীয়া বিমুখ হয়ে সর্বদা যিকির আযগারে ব্যাস্ত থাকত। কিন্তু উপরে তথ্যটি আমাদের স্পষ্ট ভাবেই বলে দিচ্ছে যে, খান জাহান আলী (রঃ) সুফীদের ন্যায় দুনীয়া বিমুখ হয়ে নয় বরং একজন যোগ্য নায়েবে রসুলের ন্যায় মানুষের কল্যানের জন্য প্রচুর উন্নয়ন মূলক বৈষয়িক কাজ করেছেন। তিনি সুন্দর বনের ন্যায় দুর্গম অঞ্চলকে বেছে নিয়ে ছিলন তার কাজের স্থান হিসাবে, সুফীদের ন্যায় লোক চোখের আড়ালে নির্জন বসবাসের জন্য নয়। শুধু তাই নয় তিনি হিংস্র জীব জন্ত সমৃদ্ধ ঐ বিরান ভুমিকে আবাদ করে বাসবাসে উপযোগী করে ছিলেন কঠোর প্ররিশ্রমের দ্বারা। অর্থাৎ তিনি তার খানকাতে (ইসলাম প্রচার কেন্দ্র) বসে আত্নিক উন্নয়ের জন্য দুনিয়া বিমুখ হয়ে শুধু যিকির আযগারে নিজেকে ব্যাস্ত রাখেননি বরং একজন যোগ্য নায়েবে রসুল হয়ে মানুষের কল্যাণের জন্য প্রচুর দুনিয়াবী কাজ করেছেন।
ইসলামী শিল্প স্থাপনার একটি সুন্দর নির্দেশন হল তার নির্মিত বাগেরহাটের ষাট্ট গম্বুজ মসজিদ যা বর্তমানে ইউনেস্ক ঘোষিত ‘বিশ্ব ঐতিহ্য’ (World heritage) অন্তগত। খান জাহান আলী (রঃ) নির্মিত বিল্ডিংগুলোও ইসলামী নির্মাণ শিল্পের উজ্জ্বল নির্দেশন ছিল। যোশহর, খুলনা এবং বরিশাল অঞ্চলের নির্মিত অনেক বিল্ডিং এ শৈল্পিক নির্দেশনার ছাপ দেখা যায়।
সুফীরা বাহুল্য খরচ বর্জন করত, শুধু মাত্র সহজ সরল জীবন যাপনের জন্য যা দরকার তারা শুধু মাত্র তা রাখতেন। এ জন্য তাদেরকে অনেকে ফকিরও** বলে থাকে। পূর্বেই আমরা উল্লেখ করেছি যে, সুফীইজম বা তাসাউফের উন্থানের প্রধান কারন ছিল মুসলমানদের বিলাসী জীবন যাপন। কেননা এই তাসাউফ পন্থীরা(সূফী) মুসলমানদের বিলাসী জীবন যাপনের প্রতি বীত শ্রাদ্ধ হয়ে তার প্রতীবাদ স্বরূপ দুনিয়া বিমুখ বৈরাগ্য জীবনকে বেছে নেয়। কিন্ত খান জাহান আলীর জীবন যাপন কোন ভাবেই সুফীদের সাথে মিলান যায় না। তিনি একজন উচ্চ পদস্ত রাজ প্রতিনিধি ছিলেন এবং কোন ভাবেই ফকীর ছিলেন না। সুফীরা যেখানে মুসলমানদের প্রয়োজন অতিরিক্ত খরজের জন্য তাদের প্রতি ব্রীত শ্রাদ্ধ ছিলেন সেখানে খান জাহান আলী (রঃ) ইসলামী শিল্প স্থাপনার পিছনে খরচকে বাহুল্য খরচ মনে করেননি বরং তিনি দেখিয়ে গিয়েছেন যে মুসলমানরাও নন্দনিক শিল্প সৌন্দয সৃষ্টি করতে পারে। বুঝাতে চেয়েছেন “মুসলমান” কোন দুনীয়া বিমুখ পশ্চাৎপদ জাতীর নাম না, যা বর্তমানে নাস্তিক মুরতাদ ও মুনাফিক সহ ইসলাম বিরোধীরা প্রচার করে থাকে।
*** ইসলামী শরিয়া অনুসারে যার কাছে ‘নিসাব’ পরিমাণ মাল থাকে তাকে ‘যাকাত’ দিতে হয়। নিসাব পরিমাণ মাল বলতে ঐ পরিমাণ মালকে বুঝায়, যা তার বেচে থাকার জন্য জরুরী দরকার, যেমন, খাদ্য, পানিয়, বস্ত্র, বাসস্থান ইত্যাদি। কিন্ত যার কাছে ঐ (উপরে বর্ণিত) পরিমাণ মাল নেই যা দ্বারা সে তার জরুরী প্রযোজন মিটানর মত খরচ করতে পারে তাকে ফকীর বলে। ইসলামী শরিয়ার পরিভাষায় যার কাছে ‘নিসাব’ পরিমাণ মাল থাকে না তাকে ফকীর বলে।
এই অঞ্চলে খান জাহান আলীর(রঃ) ইসলাম প্রচারের ফলাফল স্বরূপ বৌদ্ধ ও হিন্দু ধর্মের অনুসারী মুসলমান হন।
লোকাল ঐতিয্য এবং সেকুলারদের দেওয়া তথ্য থেকে দেখা যায় যে, বাংলার সুফীরা তাদের খানকাতে বসবাস করত এবং আত্নিক উন্নয়নের জন্য সর্বদা ইবাদত বন্দীগিতে লিপ্ত থাকত। তাদের জীবন যাপনের ধরন ছিল খুবই সাধারন। তাদের এই সহজ সরল জীবন যাপনের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে বৌদ্ধ ও হিন্দু ধর্মের অনুসারী মুসলমান হন। কিন্ত খান জাহান আলী (রঃ) তার ইসলাম প্রচার কেন্দ্রে (খানকাতে) বসে থাকেননি বরং একজন যোগ্য নায়েবে রসুলের ন্যায় ইসলাম প্রচার করেন ফলাফল স্বরূপ বৌদ্ধ ও হিন্দু ধর্মের অনুসারী মুসলমান হন। তিনি নব দীক্ষিত মুসলমানদের জন্য অনেক কল্যাণকর কাজ করে ছিলেন।
হযরত খান জাহান আলী (রঃ) শুধু তার অধিকৃত অঞ্চলে ইসলাম প্রচার করে ক্ষান্ত হননি বরং ইসলামী শাসন কায়েম করে ছিলেন। তার শাসিত অঞ্চলকে বলা হত খলিফাবাদ।
সুফীরা রাজকীয় পদ পদবী ও শাসন কাজের সাথে জড়িত থাকা সহ সকল প্রকারের দুনিয়ামুখী কার্য কালাপ থেকে নিজেদের দূরে সরিয়ে রাখত। তারা নিজেদের দুনিয়াবী উন্নয়ন নয় বরং আত্নিক উন্নয়ের জন্য সর্বদা চেষ্টা করত। এই জন্য তার ইবাদত বন্দীগির ক্ষেত্রে অত্যাধিক কঠোরতা অবলম্বন করত। হযরত খান জাহান আলী (রঃ) ক্ষেত্রে আমরা দেখি এর বিপরীত চিত্র। তিনি তার অধিকৃত অঞ্চলে শুধু ইসলাম প্রচার করে ক্ষান্ত হননি বরং তিনি “ দুনীয়াতে মানুষ আল্লাহ্র প্রতিনিধি বা খলীফা” (খলীফা আল্লাহ্ ফিল আরদ) কুরানের এই বানীকে প্রতিষ্ঠা করে ছিলেন। আল্লাহ্ ও তার রসুলের আনুগত্যই ছিল তার অধিকৃত অঞ্চলের শাসন পরিচালনার মুলমন্ত্র। এই জন্য তিনি তার শাসনকৃত অঞ্চলের নাম দিয়ে ছিলেন ‘খলিফাবাদ’।
এটা বিশ্বাস করা হয় হযরত খান জাহান আলী জেহাদের মাধ্যমে হিন্দু রাজাদের হাত থেকে যোশহর, খুলনা এবং বরিশাল অঞ্চলকে উদ্ধার করে মুসলিম সালতানাতের অন্তভুক্ত করে ছিলেন।
সুফী বলতে আমরা বুঝি এমন ব্যাক্তত্বকে যারা নিজেদের দুনীয়াবি উন্নয়ন নয় বরং অত্নিক উন্নয়ের জন্য ব্যাস্ত; সেখানে যুদ্ধ বিগর্হের ন্যায় কোন দুনীয়াবি ব্যাপারে জড়িত হওয়ার কথা চিন্তাও করা যায় না। হযরত খান জাহান আলী (রঃ) ক্ষেত্রে আমরা দেখি এর বিপরীত চিত্র। তিনি শুধু তার অধিকৃত অঞ্চলে শুধু ইসলামি শাসন কায়েম করে ক্ষান্ত হননি বরং স্থানীয় হিন্দু রাজাদের সাথে যুদ্ধ করে মুসলমানদেরকে তাদের অত্যাচারের হাত থেকে রক্ষা করে ছিলেন এবং ইসলামী সালতানাতের সীমানা বর্ধিত করেছিলেন।
এই ভাবে যদি আমরা খান জাহান আলীর মত অনান্য ইসলাম প্রচারকদের নিয়ে রিসার্চ গবেষণা করি তবে দেখব যে তারা কোন ভাবেই সূফী (সূফী বলতে আমরা যা বুঝ সেই অর্থে) ছিলেন না বরং তারা প্রত্যেকে ছিলেন এক এক জন দায়ি ইল্লেললা বা নায়েবে রসুল এবং আমি মনে করি না এ বিষয়ে দ্বিমত থাকার কোন অবকাশ আছে।
চলবে-------
বিষয়: বিবিধ
১১৩৯ বার পঠিত, ৪ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
তবে এ কথাও ঠিক যে নবী করীম (ﷺ) সময়েও এই ধরনের কিছু লোকদের দেখা আমরা পাই যারা দুনীয়ার জীবনের প্রতি মোহ ত্যাগ করে কঠোর ইবাদত বন্দিগী করার জন্য প্রতিজ্ঞা করেছিল। এ ধরনের একটি ঘটনার কথা আমরা দেখতে পাই, নবী করীম (ﷺ) এক হাদিস থেকে। এক দিন তিন জন লোক নবী করীম (ﷺ) বসায় এসে উম্মহাতুন মুমেনিনদের(মুমিনদের মাতা) কাছে জানতে চেয়ে ছিল নবী করীম(ﷺ) ইবাদত বন্দীগি সম্পকে। যখন তাদেরকে জানান হ’ল নবী করীম (ﷺ) এরকম এরকম ইবাদত বন্দীগি করে; তখন তারা তাদের ইবাদত বন্দীগিকে তুচ্ছ মনে করল। তারা নিজেদের মধ্যে আলাপ আলোচনা করে বলল, আল্লাহ () নবী করীমের (ﷺ) আগের ও পিছের সকল গুনাহ মাফ করে দিয়েছেন। তখন তাদের মধ্যে একজন বলল, “ আমি আমার সারা জীবন রাতভর ইবাদত বন্দীগি করে কাটিয়ে দিব, ঘুমাব না”। অপর আরেক জন বলল, “ আমি সারা বছর রোজা রেখে পার করে দিব, কখনও তা ভাঙব না”। তখন তৃতীয় ব্যাক্তি বলল, “ আমি মহিলাদের কাছ থেকে অনেক দূরে থাকব এবং কখনও বিয়ে করব না”। এ কথা নবী করীম (ﷺ) জানতে পেরে, তিনি ঐ তিন ব্যাক্তিকে ডেকে জিজ্ঞাসা করলেন, “তোমরা কী সেই লোক যে এরকম এরকম বলেছ”। জবাবে তারা ‘হ্যাঁ’ বললে তিনি বললেন, “যার হাতে আমার প্রান, সেই আল্লাহ্র শপথ, আমি তোমাদের চাইতে সবচেয়ে বেশী পরহেজগার ও খোদাভিরু ব্যাক্তি। তা সত্বেও আমি রোজা রাখি এবং রোজা ভেঙ্গে ফেলি, আমি ঘুমাই এবং মহিলাদের বিয়ে করি। যে আমার অনুসরণ করে না সে আমার দলের(অর্থাৎ মুসলমানদের অন্তভুক্ত) নয়। (সহি বুখারী, খন্ড ০০৭, বই ০৬২, হাদিস ০০৭)
মন্তব্য করতে লগইন করুন