জিয়ার স্বাধীনতা ঘোষণায় মুক্তিযুদ্ধের প্রকাশ ঘটে : একে খন্দকার
লিখেছেন লিখেছেন আনিসুর রহমান ১০ সেপ্টেম্বর, ২০১৪, ০৬:৪৩:৩১ সকাল
মহান মুক্তিযুদ্ধে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতার ঘোষণা দেয়ার ক্ষেত্রে তত্কালীন মেজর জিয়াকে যোগ্য মনে না করলেও এ কে খন্দকার তার সদ্য প্রকাশিত ১৯৭১ ভেতরে ও বাইরে বইতে লিখেছেন, জিয়ার স্বাধীনতা ঘোষণার মধ্যে দিয়েই মুক্তিযুদ্ধের প্রকাশ ঘটে। বইটির স্বাধীনতার ঘোষণা ও অস্থায়ী সরকার গঠন অধ্যায়ে স্বাধীনতার ঘোষণা কিভাবে এসেছিল সে সম্পর্কে বিস্তারিত ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তাতে তিনি এও লিখেছেন, মেজর জিয়ার ঘোষণাটিকে কোনোভাবেই স্বাধীনতার ঘোষণা বলা চলে না। মেজর জিয়া রাজনৈতিক নেতাও ছিলেন না বা স্বাধীনতার ঘোষণা দেয়ার মতো উপযুক্ত ব্যক্তিও ছিলেন না। যে ঘোষণা চট্টগ্রাম বেতার থেকে তিনি দিয়েছিলেন, ঠিক একই ধরনের একাধিক ঘোষণা ২৬ ও ২৭ মার্চ চট্টগ্রাম বেতার থেকে বেশ কয়েকজন রাজনৈতিক ও ছাত্রনেতাও দিয়েছিলেন, এমনকি বেতারকর্মীরাও একই ধরনের ঘোষণা দিয়েছিলেন। তবে মেজর জিয়ার এই ঘোষণাটি প্রচারের ফলে সারাদেশের ভেতরেও সীমান্তে যারা মুক্তিযুদ্ধ শুরু করেছিলেন. তাদের মধ্যে এবং সাধারণ মানুষের মনে সাংঘাতিক একটা ইতিবাচক প্রভাব পড়ে। সেই সংকটময় মুহূর্তে জিয়ার ভাষণটি বিভ্রান্ত ও নেতৃত্বহীন জাতিকে কিছুটা হলেও শক্তি ও সাহস জোগায়। যুদ্ধের সময় অনেক মুক্তিযোদ্ধার কাছ থেকে শুনেছি এবং যুদ্ধের পরবর্তী সময়ও শুনেছি, মেজর জিয়ার ঘোষণাটি তাদের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণে কতটা উদ্দীপ্ত করেছিল। মেজর জিয়ার ঘোষণায় মানুষ বিশ্বাস করতে শুরু করে, হ্যাঁ, এবার বাংলাদেশ সত্যিই একটা যুদ্ধে নেমেছে। হান্নান সাহেব বা অন্য ব্যক্তিদের ঘোষণা ও মেজর জিয়ার ঘোষণার মধ্যে তফাতটা শুধু এখানেই ছিল। মেজর জিয়া যে কাজটি করতে পেরেছিলেন, তা করা উচিত ছিল জাতীয় পর্যায়ের প্রধান রাজনৈতিক নেতাদের এবং এর জন্য তাদের একটা পূর্বপরিকল্পনাও থাকা প্রয়োজন ছিল।
স্বাধীনতা ঘোষণা দেয়ার প্রেক্ষাপট নিয়ে এ কে খন্দকার তার বইতে লিখেছেন, ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি বাহিনীর অভিযানের পর ইস্ট পাকিস্তান রেডিওর চট্টগ্রাম কেন্দ্রের বাঙালি কর্মকর্তারা বেতারের মাধ্যমে কিছু করার পদক্ষেপ নেন। চট্টগ্রাম সান্ধ্য আইনের মধ্যেই তারা স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করে সেখান থেকে কিছু প্রচার করতে উদ্যোগী হন। সেখানকার বেতার কেন্দ্রের বাঙালি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা মিলিত হয়ে সিদ্ধান্ত নেন যে বেতারে কিছু-না-কিছু বলা অত্যন্ত প্রয়োজন। তারা সবাই মিলে স্বাধীনতা ঘোষণার একটা খসড়া তৈরি করেন। ২৬ মার্চ বেলা দুইটায় কালুরঘাট বেতার কেন্দ্রে গিয়ে তারা সেই খসড়াটি নিজেদের কণ্ঠে প্রচার করেন। পরবর্তী সময়ে সেই ঘোষণা চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এম এ হান্নানও পাঠ করেন। তার ভাষণটি সেদিন সাড়ে চারটা-পাঁচটার দিকে পুনঃপ্রচার করা হয়। তাতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়েছে- এমন কথা বলা হয়েছিল। তবে প্রথম যে ঘোষণাটি পাঠ করা হয়েছিল, তার থেকে পরবর্তী সময়ে পাঠ করা ঘোষণাটি একটু আলাদা ছিল।
এ সময় বেতারের কর্মীরা দুটি বিষয় নিয়ে চিন্তা করতে লাগলেন। প্রথমত, যদি কোনো সামরিক ব্যক্তিকে দিয়ে এই কথাগুলো বলানো যায়, তাহলে এর প্রভাব আরও ব্যাপক হবে। দ্বিতীয়ত, নতুন চালুকৃত বেতার কেন্দ্রটির নিরাপত্তা প্রদানের জন্য সামরিক বাহিনীর লোক প্রয়োজন। তারা জানতে পারলেন, সেনাবাহিনীর বাঙালি সৈনিকরা চট্টগ্রাম সেনানিবাস থেকে বিদ্রোহ করে পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধযুদ্ধ করছেন। তারা খোঁজ নিয়ে আরও জানতে পারেন যে মেজর জিয়াউর রহমান নামের একজন ঊর্ধ্বতন বাঙালি সামরিক কর্মকর্তা অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অন্যান্য কর্মকর্তা, সৈনিকসহ পটিয়ায় রয়েছেন। ২৭ মার্চ সকাল ১০টার দিকে এসব বেতারকর্মী পটিয়ায় যান। তারা মেজর জিয়াকে বেতার কেন্দ্রের প্রতিরক্ষার জন্য কিছু বাঙালি সেনাসদস্য দিয়ে সাহায্য করার অনুরোধ জানান। মেজর জিয়া সঙ্গে সঙ্গে এ ব্যাপারে সম্মতি দেন। এ সময় তাদের মধ্যে কেউ একজন মেজর জিয়াকে অনুরোধ করে বলেন, কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে স্বাধীনতার একটি ঘোষণা তিনি পড়তে রাজি আছেন কি না। মেজর জিয়া বেশ আগ্রহের সঙ্গে এই প্রস্তাবে রাজি হন। তিনি পটিয়া থেকে কালুরঘাট বেতার কেন্দ্রে এসে প্রথম যে ঘোষণা দিলেন, সেটা ভুলভাবেই দিলেন। কারণ, তিনি প্রথম ঘোষণায় নিজেকে পেসিডেন্ট বলে সম্বোধন করেছিলেন। পরে সংশোধন করে মেজর জিয়া বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেন। সেটি টেপে ধারণ করা হয় এবং ২৭ মার্চ সন্ধ্যার কিছু আগে তা পুনঃপ্রচার করা হয়। আর এভাবেই আমাদের মুক্তিযুদ্ধের প্রকাশ ঘটল।
রেডিওতে আমি মেজর জিয়ার ঘোষণা শুনেছি। আমি ওই সময় জিয়াকে চিনতাম না। তবে এই ঘোষণায় আমি স্বস্তিবোধ করলাম এবং আশ্বস্ত হলাম যে অন্তত মেজর পর্যায়ের একজন সেনাবাহিনীর কর্মকর্তা এই যুদ্ধে জড়িত হয়েছেন। আমি পরে শুনেছি, চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের সভাপতি শিল্পপতি এম আর সিদ্দিকী ও সাধারণ সম্পাদক এম এ হান্নানও এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। এই ঘোষণা সারা বাংলাদেশের মানুষ শুনেছে। আমার ধারণা, আমার মতো অনেকে যারা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে দৃঢ়ভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন যে তারা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করবেন। স্বাধীনতা অর্জনের জন্য যে যুদ্ধ আমরা আরম্ভ করেছি, তা সফল হবেই। এই ঘোষণা শুনে আমি নিজেও খুব উত্ফুল্ল এবং আনন্দিত হয়েছিলাম। তবে এটাও সত্য, যা আমি আগেই উল্লেখ করেছি, স্বাধীনতার ঘোষণা বেতারকর্মীরা নিজ নিজ মতো করে আগেই দিয়েছিলেন।
এখানে একটি কথা বলা প্রয়োজন, ২৭ মার্চ চট্টগ্রাম বেতারের কয়েকজন কর্মকর্তা-কর্মচারী নিজ উদ্যোগে মেজর জিয়ার কাছে গিয়েছেন এবং তাকে স্বাধীনতার ঘোষণা দেয়ার প্রস্তাব দিয়েছেন। মেজর জিয়া নিজস্ব উদ্যোগে তাদের কাছে আসেননি। এটা ঠিক, জিয়া তাদের প্রস্তাবে সাড়া দিয়ে একটি ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করেছেন। কিন্তু তিনি নিজে স্বপ্রণোদিত হয়ে ব্যক্তিগতভাবে এই উদ্যোগ নেননি। ২৬ মার্চ দুপুরে এমএ হান্নান সাহেব স্বাধীনতার যে ঘোষণাটি পড়েছিলেন এবং ২৭ মার্চ সন্ধ্যার দিকে মেজর জিয়া যেটা পড়েন, তার মধ্যে বেশ কিছু পার্থক্য ছিল। ২৬ মার্চেরটা অনেকে হয়তো শুনতে পাননি। কারণ, সেদিন তো সবাই বিভিন্ন কারণে উদ্বিগ্ন-হতবিহ্বল ছিলেন। তবে হান্নান সাহেবের কথারও একটা মূল্য ছিল, যদিও তিনি বেসামরিক লোক ছিলেন এবং জাতীয়ভাবে পরিচিত ছিলেন না। অন্যদিকে যুদ্ধের সময় সামরিক বাহিনীর একজন বাঙালি মেজরের মুখে স্বাধীনতার ঘোষণা শোনা সম্পূর্ণ অন্য ব্যাপার ছিল।
স্বাধীনতার ঘোষণা সম্পর্কে আরেকটি চরম সত্য ও বাস্তব কথা হলো, ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি বাহিনীর দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার পর স্বাধীনতার ঘোষণা হলো কি না, তা শোনার জন্য সাধারণ মানুষ কিন্তু অপেক্ষা করেনি। পাকিস্তানি বাহিনীর আক্রমণের সঙ্গে সঙ্গেই মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। কোনো ঘোষণা বা কারও আবেদন বা কারও নিবেদনের জন্য বাংলাদেশের মানুষ অপেক্ষা করেনি। যে মুহূর্তে তারা আক্রমণের শিকার হয়েছে, সেই মুহূর্তে তারা দেশের বিভিন্ন স্থানে, যেমন চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, জয়দেবপুর, ঢাকা, কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা, নওগাঁ, রাজশাহী, দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও, ময়মনসিংহসহ প্রায় সর্বত্র পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। বাঙালি সামরিক বাহিনী, ইপিআর, পুলিশ ও আনসার বাহিনীর সদস্যসহ সাধারণ মানুষ যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। সুতরাং, কে স্বাধীনতার ঘোষণা দিল বা কখন দিল, সেটা খুব একটা মূল্য রাখে না। স্বাধীনতার ঘোষণা আর ঘোষকের বিষয়টি আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে খুব বেশি প্রভাবিত না করলেও পরবর্তী সময়ে অনেক বিভ্রান্তির জন্ম দিয়েছে। আমি মনে করি, এই বিভ্রান্তির অবসান হওয়া উচিত। জিয়ার ২৭ মার্চের ঘোষণা শোনার সঙ্গে সঙ্গে সারাদেশে এবং বাংলাদেশের বাইরে যেসব বাঙালি ছিল, তাদের মধ্যে একটা প্রচণ্ড উদ্দীপনা সৃষ্টি হয়, এ সম্পর্কে কারও সন্দেহ থাকার কথা নয়। তবে এই ঘোষণাই কারও মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেয়ার একমাত্র কারণ নয়। আমার নিজের বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে আমি এই কথাগুলো বলছি। আমি যুদ্ধে যাব, সেজন্য কারও ঘোষণার অপেক্ষা করিনি। আমি নিজেই সিদ্ধান্ত নেই যে আমি যুদ্ধে যাব।
বিষয়: বিবিধ
৯৬২ বার পঠিত, ৬ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন