রয়টার্সের বিশ্লেষণ : কেমন চলছে ইসলামিক স্টেটের সরকার ব্যবস্থা?
লিখেছেন লিখেছেন আনিসুর রহমান ০৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৪, ০৭:০৩:৩৫ সকাল
সিরিয়ার পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশ রাকা তাদের শাসন পদ্ধতির একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ। ইসলামিক স্টেটের সদস্যরা এ রাকা প্রদেশের জনজীবনে ইসলামি খেলাফতের শাসনকে একটি দৃষ্টান্ত হিসেবে উপস্থাপন করেছে।
ইসলামিক স্টেটের সদস্যরা আশা করছে, একদিন চীন থেকে ইউরোপ পর্যন্ত ইসলামিক খেলাফত বিস্তৃত হবে।
রাকা প্রদেশের ধূলিময় শহরকে ইসলামিক স্টেট তার সরকারের রাজধানী করেছে। সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে শহরটি ছিল প্রায় ২-৩ লাখ লোকের আবাস। এ প্রাদেশিক রাজধানীতে ইসলামিক স্টেট কোনো প্রতিষ্ঠানকেই তার নিয়ন্ত্রণের বাইরে রাখেনি।
যেমনটা বলছিলেন রাকার একজন কর্মী, যিনি এখন তুরস্কের সীমান্তবর্তী একটি শহরে বাস করেন। তিনি রয়টার্সকে দেওয়া সাক্ষাত্কারে বলেন, সত্য বলতে তারা (ইসলামিক স্টেট) ব্যাপক প্রাতিষ্ঠানিক কাজকর্ম করছে। আর এটা বেশ হৃদয়গ্রাহী।
ব্যক্তিগতভাবে তিনি ইসলামিক স্টেটের বিরোধী।
রাকার প্রত্যন্ত এলাকায় চালানো কয়েকটি সাক্ষাত্কারে অধিবাসীরা যারা ইসলামিক স্টেটের যোদ্ধাদের এমনকি সংগঠনটির কর্মীদের বিরোধিতা করেছিল তারা বর্ণনা করেছে কিভাবে এ যোদ্ধারা তাদের প্রধান নেতা আবু বকর আল বাগদাদির অধীনে এক বছরেরও কম সময়ে আধুনিক সরকারের মতো একটি সরকার কাঠামো প্রতিষ্ঠা করেছে।
ইসলামিক স্টেট বিদ্রোহী গোষ্ঠীর অগ্রগতি ইতোমধ্যে আঞ্চলিক ও পশ্চিমা ক্ষমতাধরদের মধ্যে আতঙ্ক তৈরি করেছে।
গত মাসে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ইসলামিক স্টেটকে ক্যান্সার হিসেবে আখ্যায়িত করে বলেছেন, এটাকে মধ্যপ্রাচ্য থেকে সরিয়ে ফেলতে হবে। এ লক্ষ্যে যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধবিমান ইরাক ও সিরিয়ার আইএস নিয়ন্ত্রিত এলাকায় ব্যাপক বোমা হামলা করেছে।
কিন্তু ইসলামিক স্টেট রাকার মতো জায়গাগুলোতে জনগণের দৈনন্দিন জীবনের সঙ্গে এমনভাবে মিশে গেছে যে, যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধবিমান, এমনকি ইরাকি, সিরিয়ান এবং কুর্দি বাহিনীর কোনো শক্তিই তাদের মূলোত্পাটন করতে পারছে না।
রাকাই প্রথম শহর যেটা সর্বপ্রথম সিরিয়ার আসাদ বিরোধী বিদ্রোহী যোদ্ধাদের কাছে পতন হয়। আর তাই তারা এই শহরকে বলছে ‘ব্রাইড অব দ্য রিভোলিউশন’।
এক বছরের মধ্যেই ইসলামিক স্টেট প্রতিদ্বন্দ্বীদের বিতাড়িত করে শহরটিতে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছে। গোষ্ঠীটির সমালোচনাকারীদের কারো কারো হত্যা করা হয়েছে। আবার কেউ কেউ তুরস্কে পালিয়ে গেছেন।
কেমন চলছে ইসলামিক স্টেটের শাসন?
ইসলামিক স্টেট তাদের খেলাফতের অধীনস্থ এলাকায় মদ নিষিদ্ধ করেছে। এখান সন্ধ্যার মধ্যে দোকানপাট বন্ধ এবং রাত হওয়ার আগে রাস্তা-ঘাট ফাঁকা হয়ে যায়। নিকটস্থ শহর ও নগরগুলোসহ বহির্বিশ্বের সঙ্গে যে কোনো যোগাযোগ শুধুমাত্র ইসলামিক স্টেট মিডিয়া সেন্টারের মাধ্যমে করতে দেয়া হয়।
যেসব বিদ্রোহী এবং কর্মীরা ইসলামিক স্টেটের বিরোধী ছিল তারা আবু বকর আল বাগদাদীর কাছে অনুতপ্ত হয়ে ক্ষমা চেয়ে আনুগত্যের প্রতিশ্রুতি দিলে তাদের অপরাধ ক্ষমা করে দেয়া হচ্ছে। ক্ষমাপ্রাপ্তরা কেউ বাড়িতে চলে যাচ্ছে কেউ যোদ্ধাদের সঙ্গে যোগ দিচ্ছে।
আইএস বিদ্রোহী গোষ্ঠী অভিযান শুরু করার পরপরই জনসেবা ও প্রতিষ্ঠান তৈরি করতে শুরু করে। তারা স্পষ্টতই ঘোষণা দেয় যে জাতীয় সীমানা দূর করে একটি ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যে এ এলাকাটিকে তারা তাদের ভিত্তি হিসেবে ব্যবহার করবে।
বিদ্রোহী গোষ্ঠীর একজন সদস্য রয়টার্সকে বলেন, ‘এ প্রদেশটিতে আমরা একটি রাষ্ট্র। আমাদের এক আমির। এখানে সবকিছুই ভালোভাবে চলছে। কারণ আমরা আল্লাহর আইনের ভিত্তিতে রাষ্ট্র শাসন করছি।’
বেসামরিক নাগরিক যাদের কোনো রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা নেই তারা ইসলামিক স্টেটের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিয়েছে।
এর কারণ লোকজন বেশ ক্লান্ত ও বিধ্বস্ত এবং তাদের মতে আইএস রাকা এলাকায় জনসেবামূলক কর্মকাণ্ড চালাচ্ছে।
রাকার একজন অধিবাসী রয়টার্সকে বলেন, গোষ্ঠীটি ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ কার্যালয় এবং আদালতসহ রাকা এলাকার সব জনসেবামূলক প্রতিষ্ঠানকে আবার চালু করেছে।
আইএসের একজন যোদ্ধার মতে, আসাদ সরকারের সাবেক একজন কর্মকর্তা বর্তমানে মিল-কারখানার দায়িত্বে আছেন এবং রাকার বেকারিগুলোতে ময়দা বিতরণ করছেন। যারা রাকা বাঁধের দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন যেখান থেকে শহরে বিদ্যুত্ এবং পানি সরবরাহ করা হয় তারা সে পদেই বহাল রয়েছেন।
রাকার অধিবাসীরা বলছেন, আসাদ সরকারের সাবেক কর্মকর্তাদের কাজে নিয়োগ করার ইচ্ছাই ইসলামিক স্টেটের বাস্তববাদিতাকেই তুলে ধরে এবং দখলকৃত এলাকায় তাদের নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখার ক্ষেত্রে বেশ কাজে দিয়েছে।
উত্তর আফ্রিকা এবং ইউরোপসহ অন্যান্য দেশ থেকে এসেছে এমন অনেক বিশেষজ্ঞই তাদেরকে সাহায্য করেছে। যেমন আবু বকর আল বাগদাদী রাকার টেলি যোগাযোগ ব্যবস্থা পরিচালনার জন্য পিএইচডি ডিগ্রিধারী একজন তিউনিশীয়কে নিয়োগ দিয়েছেন। তিউনিশীয় এ ইঞ্জিনিয়ার আইএস গোষ্ঠীর সঙ্গে যোগ দিতে এবং ইসলামি রাষ্ট্রকে সেবা দেয়ার উদ্দেশে নিজ দেশ ত্যাগ করেছেন।
‘ইসলামিক স্টেট শুধুমাত্র একটি সামরিক গোষ্ঠী নয় বরং এটি একটি ইসলামি রাষ্ট্রীয় সরকার ব্যবস্থা’ এমন দাবির প্রতিফলন ঘটাতে বাগদাদী পুলিশ ও সেনা হিসেবে যোদ্ধাদের নিয়োগ করে বেসামরিক প্রশাসন থেকে সামরিক বিভাগকে আলাদা করেছেন।
অন্যদিকে বাগদাদী প্রতিষ্ঠানসমূহের ব্যবস্থাপনা এবং সেগুলোর উন্নয়নে ওয়ালি নামে মন্ত্রী মর্যাদার কর্মকর্তা নিয়োগ করেছেন।
প্রশাসনিক অঞ্চলগুলোকে ওয়ালিয়েহ বা প্রদেশে বিভক্ত করা হয়েছে।
যোদ্ধা এবং কর্মাচারীরা মুসলিম ফিন্যান্সিয়াল হাউজ নামে একটি বিভাগ থেকে বেতন নিচ্ছে যেটা অনেকটা অর্থ মন্ত্রণালয় এবং ব্যাংকের মতো। এর সঙ্গে প্রতিষ্ঠানটি দারিদ্র্য দূর করার লক্ষ্যে কাজ করছে।
যোদ্ধারা বাড়ি পাচ্ছে। এ বাড়িগুলো স্থানীয় অ-সুন্নী বা সরকারি কর্মচারীদের থেকে বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে।
এছাড়া তারা প্রতি মাসে ৪০০ থেকে ৬০০ ডলার বেতন পাচ্ছে যা সিরিয়ার উত্তর-পূর্ব এলাকার একটি পরিবারের জীবনযাপনের জন্য যথেষ্ট।
একজন যোদ্ধা জানিয়েছে, দরিদ্র পরিবারগুলোকে টাকা দেয়া হয়েছে। এছাড়া যাদের বাচ্চা আছে এমন বিধবারা ১০০ ডলার করে পাচ্ছে।
জিনিসের দাম কম রাখা হচ্ছে। যে ব্যবসায়ী দাম বেশি রাখছে তাকে সতর্ক করে দেয়া হচ্ছে। পরে আবার ধরা পড়লে শাস্তি দেয়া হচ্ছে এবং দোকান বন্ধ করে হচ্ছে।
গোষ্ঠীটি ধনবান ব্যবসায়ী ও পরিবারের ওপর ইসলামি করও আরোপ করেছে।
যেমন একজন যোদ্ধা বলেন, আমরা শুধু ইসলামের বাস্তবায়ন করছি আর জাকাত আল্লাহর আরোপিত একটি ইসলামি কর ব্যবস্থা।
ইসলামি রাষ্ট্র ব্যবস্থার কেন্দ্রে রয়েছেন আইএসের নেতা আবু বকর আল বাগদাদী, যিনি আল কায়েদার থেকে বেরিয়ে এসে গত জুন মাসে নিজেকে খলিফা বা সমগ্র মুসলিম বিশ্বের নেতা বলে ঘোষণা দিয়েছিলেন।
রাকার অধিবাসী, যোদ্ধা এবং কর্মীদের মতে, বাগদাদী বর্তমানে রাকার প্রশাসনে ব্যাপকভাবে জড়িত এবং কর্মকর্তাদের কাজের ওপর শেষ সিদ্ধান্ত তিনিই নেন। এমন কি স্থানীয় পণ্যদ্রব্যের দর বেঁধে দেয়ার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত তার নিকট থেকেই আসছে।
অধিবাসীরা বলেন, ইসলামি আদালতের বিচারে দেয়া শিরশ্ছেদ ও মৃত্যুদণ্ড এবং অন্যান্য শাস্তিও তিনি অনুমোদন করেন।
যোদ্ধাদের বর্ণনায়, যুদ্ধক্ষেত্রে তিনি একজন ভয়ঙ্কর যোদ্ধা এবং একজন অভিজ্ঞ কমান্ডার। যুদ্ধক্ষেত্রে তিনি কখনও সহযোদ্ধাদের ফেলে আসেন না। সিরীয় সেনাদের কাছ থেকে ডিভিশন-১৭ পুনর্দখল নিতে গিয়ে আহত হয়েছেলেন। এখন তিনি সুস্থ আছেন।
তারা আরও জানায়, তিনি সব সময় ঘুরে বেড়ান। কখনো এক জায়গায় স্থির থাকেন না। রাকা, দিয়ার আল জর এবং মসুলের মধ্যে তিনি টহল দেন।
যদিও গোষ্ঠীটির সফলতার মূলে তাদের বাস্তববাদিতা অনেকাংশে কাজ করেছে, গোষ্ঠীটির সফলতার জন্য মতাদর্শও বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।
খেলাফত ঘোষণা করে এবং সরকার প্রতিষ্ঠা করে বাগদাদি বিদেশী জিহাদি এবং বিশেষজ্ঞদের আকর্ষণ করার চেষ্টা করেছেন।
জিহাদিরা জানিয়েছে, একই সঙ্গে বিশ্বের সম্পদশালী ইসলামপন্থীরা ইসলামি খেলাফতকে সহায়তার করতে অর্থ পাঠিয়েছেন।
রাকার একটি সূত্রমতে, এ গোষ্ঠীটি ৩টি অস্ত্র কারখানা চালায় যেখানে প্রধানত ক্ষেপণাস্ত্র উন্নয়নে কাজ করা হয়। বিদেশি বিজ্ঞানীরা বিশেষ করে চীন থেকে আসা মুসলিম বিজ্ঞানীরা এখানে কাজ করেন।
একজন আরব জিহাদি জানান, বিজ্ঞানী এবং বিভিন্ন ডিগ্রিধারী লোক ইসলামি রাষ্ট্রের সেবায় এগিয়ে আসছে।
পরবর্তী প্রজন্ম তথা শিশুদেরকে ইসলামি মতাদর্শে উজ্জীবিত করতে ইসলামিক স্টেট ব্যাপক বিনিয়োগ করছে। প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত অধিক পারমাণে ইসলামি বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
গোষ্ঠীটি যুদ্ধ করতে চায় এমন নারীদের সামরিক বাহিনীতে নিচ্ছে। তাদেরকে প্রকৃত ইসলাম বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়।
এছাড়া নবাগত যোদ্ধাদের শিক্ষার জন্য মসজিদে ইসলামি শিক্ষা প্রদানকারী দল রাখা হয়েছে।
রাকার যোদ্ধাদের মতে, খেলাফত ঘোষণার পর থেকে নবাগত যোদ্ধারা ইসলামিক স্টেট নিয়ন্ত্রিত এলাকায় দলে দলে ভিড় করছে।
এ ব্যাপারে একজন আরব জিহাদি বলেন, প্রতি তিনদিনে আমরা কমপক্ষে ১ হাজার যোদ্ধা গ্রহণ করছি। গেস্ট হাউজগুলো নবাগত যোদ্ধায় সয়লাব হয়ে যাচ্ছে।
সূত্র: রয়টার্স
বিষয়: বিবিধ
৯৪৫ বার পঠিত, ৭ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
এইবার আল্যার ফেরেস্তারা আকাশে আজাইরা ঘুড়াঘুড়ি বাদি দেয়ে জেহাদীদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাফেরদের কল্লা কেটে ইসলামের সুশীতল শাস্তি কায়েম করবেন।
Once Islam won people hearts and rule the world and all the incident happening around us, tell us that Islam should be regain is love, respect and power again.I do believe that like you. Thanks again.
মন্তব্য করতে লগইন করুন