ইতিহাসের মানদণ্ডে মাযহাবের (مذهب) উৎপতি ও ক্রম বিকাশ শেষ পর্ব
লিখেছেন লিখেছেন আনিসুর রহমান ১২ ফেব্রুয়ারি, ২০১৪, ০৬:৫৯:২৩ সন্ধ্যা
তেরশ শতকে ইজতিহাদের দরজা স্থায়ী ভাবে বন্ধ হওয়ার ফলে ইসলাম ধর্ম এই চার মাযহাব(হানিফী(রহঃ), শাফিয়ী(রহঃ), মালেকী(রহঃ) ও হাম্বলী(রহঃ)) এর গণ্ডীর মাঝে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে। অনেকের মাঝে এই ধারনার জন্ম নেয় যে, এই চার মাযহাব আল্লাহ() মনোনিত। এই চার মাযহাবের মধ্যে প্রচুর মত ভিন্নতা থাকা সত্বেও এটা দাবী করা হচ্ছিল যে, এই চার মাযহাবই সমান ভাবে সঠিক এবং সত্যিকারের ইসলামের প্রতিনিধিত্ব করে। এমনকি এই সময়ের কিছু আলেম এমন ভাবে হাদীসকে ব্যাখা করছিল যে, নবী করিম() স্বয়ং এই চার মাযহাবের ইমাম ও তাদের মাযহাবের কথা বলে গেছেন বলে প্রমান হত। ফলে মুসলিম সমাজে “তাকলীদ”(কোন প্রশ্ন ছাড়া অন্ধ ভাবে অনুসরণ) ব্যাপক ভাবে প্রসার ঘটে। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, আল-খাতিব কতৃক সংগৃহিত এক হাদীস, যেখানে আবু হুরায়রা নবী করিম() থেকে বর্ণনা করেন, “আমার উম্মতের মাঝে এক ব্যাক্তি আসবে, যার নাম আবু হানীফা, সে হবে আমার উম্মতের আলো স্বরূপ।”১ আল-হাকিম এবং আল-খাতিব স্বয়ং এই হাদীসকে জাল বলে ঘোষণা করেন। অবস্থা এমন দাড়ায় যে আম জনতা তো দুরের কথা প্রতিষ্ঠিত আলেম-ওলেমাদের পক্ষেও তখন এই চার মাযহাবের বাহিরে যেয়ে কোন কিছু বলার উপায় ছিল না। কেননা তখন চার মাযহাবের বাহিরে যেয়ে কোন কিছু বলার অর্থ হ’ল জীন্দীক আথবা কাফের হিসাবে সমাজের কাছে হেয় প্রতিপন্ন হওয়া। যেমন আজকে ইসলাম এবং রাজনীতি নিয়ে কথা বললে, রাজাকার, অঙ্গী- মঙ্গী- জঙ্গী হিসাবে সমাজের কাছে হেয় প্রতিপন্ন হতে হয় সেরূপ। এমনকি কোন কোন গোঁড়া আলেম-ওলেমা এই ফাতয়া জারি করে যে, কেউ যদি নিজস্ব মতামতের ভিত্তিতে এক মাযহাব ত্যাগ করে যদি অন্য মাযহাবে যায় এবং ধরা পড়ে তবে বিচারের মাধ্যমে তার জন্য শাস্তি প্রযোজ্য হবে। হানিফী ও শাফিয়ী মাযহাবের মধ্যে বিয়ে বাতিল করে এক ফাতয়া জারী করে, হানাফী পন্থী আলেমরা ।২ অর্থাৎ হানিফী পন্থী কেউ শাফীয়ী পন্থী কাউকে বিয়ে করলে সেই বিয়ে বাতিল বলে গণ্য হবে।
“তাকলীদের” প্রভাবে ক্রমে ক্রমে গোঁড়া মাযহাব পন্থীদের দ্বারা ইসলামের অন্যতম প্রধান পিলার সালাহও (নামাজ) আক্রান্ত হয়ে পরে। বিভিন্ন মাযহাবের লোকেরা অন্য মাযহাবের ইমামের পিছনে নামাজ পরতে অস্বীকার করে, ফলে মসজিদের ভিতরে ভিন্ন ভিন্ন মাযহাবের জন্য ভিন্ন ভিন্ন নামাজের যায়গার ব্যাবস্থা করা হয়। শুধু তাই নয় পরিস্তিতি এতটাই শোচনীয় হয়ে পরে যে, মুসলমানদের সবচাইতে পবিত্র স্থান “মসজিদুল হারাম” বা ক্কাবা শরীফ, যেখানে এক রাকাত নামাজের ছওয়াব অন্য মসজিদের থেকে এক লাখ গুন বেশী, যা মুসলমানদের ঐক্যের প্রতীক, যা হজ্জ মওশুমে সকল মত ও পথের মিলন স্থান, তাও ঐ গোঁড়া মাযহাব পন্থিদের আক্রমণের হাত থেকে রেহায় পায়নি। যখন সালাতের(নামাজ) জন্য আযান দেওয়া হত তখন মক্কা শরীফে চারটি জামাত হত, এক মাযহাবের লোকেরা তদের ইমামের নেতৃতে নামাজ শেষ করার পর আরেক মাযহাবের লোকেরা তদের নেতৃতে নামাজ শুরু করত। “মসজিদুল হারাম” বা ক্কাবা শরীফ এর মধ্য এরূপ চরম অব্যাবস্থা বজায় ছিল উনবিংশ শতকের প্রথম কোয়াটার পর্যন্ত। সৌদি বাদসা আব্দুল আজিজ ইবন সাউদের নেতৃতে মক্কা বিজয়ের( অক্টোবর ১৯২৪) পর এই অব্যাবস্থার অবসান ঘটে। তার প্রচেষ্টার ফলে পুনরায় এক জন ইমামের নেতৃতে সকল মুসলমান একত্রে জামাতে নামাজ আদায় শুরু হয়। সব চেয়ে মজার ব্যাপার হচ্ছে আজকে এক বিংশ শতাব্দীতে এসেও গোঁড়া মাযহাব পন্থির দেখা মিলে, বিশেষ ভাবে বাংলাদেশ সহ ভারত উপমহাদেশে!!!!
উপসংহারঃ বস্তুত এই চারটি মাযহাব ইসলামী ফিকহ উন্নয়নে অসাধারন অবদান রেখেছে। কিন্ত আজ পর্যন্ত কোন একটি মাযহাবই দাবী করেনি যে তারা সম্পুন ইসলামীক ফিকহ (Total Islam ) কে ধারান করছে। কোন মাযহাবের ইমামই তাদের মাযহাবকে অন্ধ ভাবে অনুসরণ করার কথা কখনও বলে যাননি । বস্তুত মুসলমানদের জন্য একমাত্র অন্ধ ভাবে অনুসরণ যোগ্য মাযহাব হল, নবী করিম () মাযহাব। শারিয়া সম্পকিয় একমাত্র তাঁর ব্যাখা হল আল্লাহ নিদেশিত এবং তা অন্ধ ভাবে সকলকে অনুসরণ করতে হবে কায়ামত পর্যান্ত; এ বিষয়ে কারো কোন দ্বিমত প্রকাশ করার কোন অবকাশ নেই, নিজেকে মুসলমান দাবী করলে। এ বিষয়ে আমরা পূর্বে বিস্তারিত আলোচনা করে দেখিয়ে ছিলাম যে, খেলাফা-এ-রাশেদার যুগে মহান খলীফারা সবার মতামতের উপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত ইজমাকেও বাতিল করে দিতেন যদি তা নবী করিম() হাদীসের আলোকে অগ্রহনযগ্য হত। নবী করিম() মাযহাব ছাড়া অন্য সকল মাযহাব হল মানুষের তৈরি আর এ জন্য তা মানবচিত ভুল-ত্রুটির উদ্ধে নয়। এখানে আমাদের মনে রাখতে হবে মাযহাব সম্পর্কী “দুস্ট ফাঁদে” পরার হাত থেকে বাঁচতে হলে আমাদেরকে অবশ্যই মযহাব সম্পর্কে সঠিক ধারনা/জ্ঞান রাখতে হবে। আল্লাহ() আমাদেরকে দীন ইসলামকে বুঝার ও তা মানার তৈফিক দান করুন। আমীণ
1.Muhammad Ibn Alee ash-Shawkaanee, al-Fawaa’id al-Moomaj’ah
Beirut: al-Kaktab al-Islaamee, 2nd ed, 1972, p320
2. Muhammad Naasir ad-Deen Albaanee, Sifah, Salaah an-Nabee; Beirut: al-Kaktab al-Islaamee, ninth ed, 1972, p51
বিষয়: বিবিধ
২১৭১ বার পঠিত, ৬ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
ধন্যবাদ
একটানা পড়ার পরে মন্তব্য করবো ইনশাআল্লাহ
জাযাকাল্লাহ....
মন্তব্য করতে লগইন করুন