নেত্রী থেকে মা খালেদা জিয়া ।
লিখেছেন লিখেছেন মুহাম্মদ সেলিম ১৪ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮, ০২:০২:১৯ রাত
খালেদা জিয়া বড় অর্জন তিনি এখন নেত্রী থেকে মা। বি এন পি নেতা কর্মীদের কাছে তিনি এখন মা।
পনের বছর বয়েস নিতান্ত কিশোরী বয়েস - এই বয়স চুলের বেণী দুলীয়ে ছি কুত কুত খেলা আর সারা দিন আচার খাবার বয়স। অন্তত ষাট সত্তর এমন কি আশির দশকে মফস্সল বাংলায় এটাই সাধারণত দেখা যেত।
এই অল্প বয়সেই একদিন হুট্ বিয়ে দিয়ে দিলেন বাবা - কনজারভেটিভ ঘরানার সম্ভ্রান্ত পরিবার - ১৯৬০ সালের কথা - এটাই রেওয়াজ। বিয়ে হল সম্পূর্ণ অপিরিচিত এক তরুণ সামরিক অফিসারের সাথে - তরুণও উত্তরবঙ্গের সম্ভ্রান্ত পরিবারের ছেলে। আর বড় কথা হল বাঙালি হওয়া স্বত্বেও তরুণটি কাকুল সামরিক একাডেমি থেকে টপ পজিশন নিয়ে গ্র্যাজুয়েট করেছে।
বিয়ের পর অল্প কিছুদিন কাটলো তরুণ হাজব্যান্ড এর সাথে - কিন্তু বাধলো যুদ্ধের দামামা - তরুণী বধূকে এক বাড়ি ফেলে হাজব্যান্ড চলে গেলো যুদ্ধে।
দেশের সেবা করা আর নিজের পরিবারের প্রতি দায়িত্ব পালন করার মধ্যে একটা মিউচুয়ালি এক্সক্লুসিভ ব্যাপার আছে - দুটো এক সাথে করা যায় না - একটা ভালো করে করতে গেলে আরেকটার প্রতি অবিচার করতে হয়।
এই অবিচারটার ই শিকার ছিলেন এই তরুণী আজীবন|
তরুণীর হাজবেন্ড যুদ্ধ গিয়ে - নিজের পরিবারের কথা না ভেবে দেশের কথা ভেবে জান বাজি রেখে যুদ্ধ করলেন, দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সামরিক খেতাব "হিলাল ই জুড়াত" পদক অর্জন করলেন।
নববধূ কিশোরী এখন ২১ বছরের তরুনী - প্রথম সন্তান নিয়ে প্রেগন্যান্ট। কিন্তু সামরিক অফিসারে ফোকাস তখন অন্য দিক - দিন রাত খেটে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট গড়ে তোলা - - ভারত পাকিস্তান যুদ্ধের মাধ্যমে বাঙালিরা একটা শক্তিশালী ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট গড়ে তোলার অনুমতি পেয়েছে।
প্রথম সন্তান হল দ্বিতীয় সন্তান হল - তরুণীটি একা একাই বড় করেন সন্তান দের ঢাকা সেনানিবাসে - এদের বাবা চট্টগ্রামে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট কে দেশের সেরা রেজিমেন্ট বানানো স্বপ্নে বিভোর।
হঠাৎ করে দেশ স্বাধীন করার যুদ্ধ! আবারো পরিবার পরিজন সন্তানের কল্যাণ অবহেলা করে দেশ সেবা- দেশের জন্যে নিজের, নিজের পরিবারের সবার জীবন শঙ্কায় ফেলা। তরুণী এখন একা , দুই নবজাতক নিয়ে- স্বামীর জন্য উৎকণ্ঠা নিজের জন্য ভয় - সন্তানের অমঙল আশংকা - তরুণীর শুরু হয় কঠিন জীবন।
স্ত্রী পুত্র পরিবারের জন্য কোন কেয়ার না করে এদের নিরাপত্তার কোন ব্যবস্থা না করে - হাজব্যান্ড বিদ্রোহ করে বসল। আবারও দেশের দাবির কাছে হার মানলো বেসিক পিতৃ দায়িত্ব - দু নবজাতক নিয়ে আবার অথৈ জলে পড়লেন এই তরুণী।
এদের বাবা বিদ্রোহী সেনা অফিসার - এই বিদ্রোহে না জয়ী হলে মৃত্যুদণ্ড নিশ্চিত।
ভয় বিপদের মধ্যে দিয়ে গেলো নয় মাস - দুই শিশু সন্তান নিয়ে শত্রু পরিবেষ্টিত হয়ে।
অমানবিক অত্যাচার চলে দিনাজপুরে এই তরুণীর বাবা মা পরিবারের উপর। আর নয় মাস ধরে চলে এই তরুণী মাতার উপর মানসিক নির্যাতন - প্রতিদিন ই খবর দেয়া হয় কিভাবে তার স্বামীকে ধরে মেরে ফেল হয়েছে - কিভাবে ব্যায়োনেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মারা হয়েছে। এবং এর সাথে প্রতিনিয়ত তাকে মনে করিয়ে দেয়া হচ্ছে বিশ্বাসঘাতক এর বাচ্চাদুটোর ও একই পরিণতি হবে। একেবারে নিয়ম করে ২৬ বছর বয়েসী এই মা কে সপ্তাহে দু তিন দিন করে নিয়ে যাওয়া হত মিলিটারি ইন্টাররোগেশন চেম্বারে - তার বিদ্রোহী বিশ্বাসঘাতক স্বামীর খোঁজ খবর বের করার জন্য। এই নয়মাসের মানসিক টর্চার এতো গভীর ছাপ ফেললো এই তরুণীর উপর - সে বিশাল এক দেয়াল তুলে দিলো ওই নয়মাসের দুঃসহনীয় সময়কে ঘিরে - এই নয় মাস নিয়ে সে জীবনে আর কথা বলে নি। পরবর্তী জীবনে দেশের তথা কথিত শিক্ষিত কালচার্ড মুক্তিযুদ্ধের চেতনার চ্যাম্পিয়নরা না না ভাবে নানা সময়ে এই তরুণী বীর মুক্তিযোদ্ধার নয় মাস নিয়ে চরম মিথ্যাচার ও জঘন্য ধরণের নোংরামি করেছে - কিন্তু এই মুক্তিযোদ্ধা তরুণী একটি কোথাও বলেন নি।
যুদ্ধের পরও শান্তি এলো না - ভাতৃঘাতী রক্তক্ষয়ী সংঘাতে জড়িয়ে পড়লো দেশের নবগঠিত সেনাবাহিনী। ৭৫ এর ক্যু - পাল্টা ক্যু র এক পর্যায়ের আবারো বন্দি হলেন এই তরুণী স্বামী সহ সপরিবারে - আবারো ও মৃত্যু ভয় - আবার ও সন্তান নিরাপত্তা নিয়ে টেনশন।
৭৫ গেলো কিন্তু একের পর এক ক্যু চেষ্টা হতে এই লাগলো তার হাজব্যান্ডের বিরুদ্ধে।
হত্যাকারীরা অবশেষে সফল হল ১৯৮১ সালে- গুলি করে ঝাঁজরা করে দিয়ে গেলো তার প্রিয় মানুষটির নশ্বর দেহ ।
দেশের মানুষ লাইভ টিভিতে দেখলো এই সদ্য বিধবার অনাড়ম্বর বৈধব্য - কফিন নিয়ে প্রাণঘাতী কান্না। দেশের শীর্ষ ইংরেজি ডেইলি হেডলাইন করলো home they brought her warrior dead! এই তরুণী বিধবার বয়েস এখন ৩৬।
যেসব মানুষ গুলো সাথে নিয়ে তার স্বামী দেশগড়ার যুদ্ধে নেমেছিলেন- এই বিধবাও চাইলেন তাদের নিয়ে এগিয়ে যেতে। কিন্তু প্রতি পদে পদে বিশ্বাসঘাতকতার শিকার হলেন। যাকেই নিয়ে তিনি আগাতে চান - স্বামীর যারা ছিলেন প্রধান সহযোগী - নির্লজ্জের মতো কাপুরুষের মতো তারা সবাই সামান্য প্রাপ্তি লোভে শত্রুর সাথে হাত মেলালো। শাহ আজিজ, শামসুল হুদা, মতিন, ওবায়দুর রহমান - সবাই বিশ্বাসঘাতকতা করলেন দিনে দিন ইস্পাত দৃঢ় হয়ে ওঠা এই বিধবার রিজলভের সাথে - কিন্তু দশ জন বিশ্বাসঘাতকতা করলে আরো এক লক্ষ মানুষ এসে যোগ দিলেন এই দৃঢ়চেতা নারীর পিছনে। গণতন্ত্রের সংগ্রামে হয়ে উঠলেন এক আইকন। যখন দেশের সব নেতা নেত্রী হয়ে উঠলেন স্বৈরাচারের প্রকাশ্য অথবা অপ্রকাশ্য সহযোগী - এই কিশোরী বধূ থেকে আগুনে পুড়ে উঠে আসা ইস্পাতদৃঢ় বিধবা হয়ে উঠলেন দেশের একমাত্র আপোষহীন নেত্রী।
দেশের মানুষ প্রতিদান দিলো - দেশের প্রথম মুক্ত নিরপেক্ষ নির্বাচনে জয়ী করে প্রধান মন্ত্রীর আসনে বসিয়ে। বাংলাদেশের ইতিহাসের যে পিরিয়ড টা সত্যিকারের লিবারেল ডেমোক্রেটিক টলারেন্ট সরকার পেয়েছে- সেই সময়টা এই আপোষহীন নেত্রীর প্রথম প্রধানমন্ত্রিত্ব। কিন্তু ভালো কিছুর কপাল তো এদেশের নেই - মহিউদ্দিন খান আলমগীরেরা হয়ে উঠলেন এ যুগের জগৎশেঠ। যেই গণতন্ত্রের জন্য এতো সংগ্রাম - সেই গণতন্ত্র গেলো নির্বাসনে- আবার পথে নামলেন এই নেত্রী। অত্যাচার নিষ্পেষণ এর স্টিম. রোলার চললো। তারপরেও আবার নির্বাচিত হলেন।
১৫ বছর বয়সে যার বিয়ে - সার জীবন জুড়ে একের পর এক যেভাবে সংগ্রাম করে এসেছেন - ৬৫, ৭১, ৭৫, ৮১ তার পর ৮৩ থেকে ৯০ - আবার ৯৬ -২০০১ এর ষ্টীম রোলার - এবার এই মহিলা ভাবলেন একটু হ্যান্ডস অফ করি- যাদের দিলেন সরকার চালানোর দায়িত্ব, তারা পারলেন না - তারা আওয়ামী লীগ হবার চেষ্টা করলেন - যা হবার তা হল - আবার ও ভয়াবহ বিপদে পড়ল নেত্রী। এতদিন স্বামীকে নিয়ে টেনশন করেছেন এবার বিপদে পড়লেন যে দুটো সন্তানকে এক এক মানুষ করেছেন মাথার উপর সব ঝঞ্ঝাট নিয়েও, সে দু সন্তানকে নিয়ে।
ছেলে দুটোর উপর অমানবিক অকথ্য অত্যাচার হল - ভেঙে গেলো বড় ছেলের কোমরের হাড় - ছোটটাকে অসুস্থ করে ছেড়ে দেয়া হল। মারাত্নক প্রেসার আসলো - নেত্রীর উপর, দেশ ছাড়ার জন্য - ছেলেদের জীবনের নিরাপত্তার প্রসঙ্গ টেনে আনা হল। কিন্তু আগুন পোড়া ইস্পাত দৃঢ় মনোবল নিয়ে রুখে দাঁড়ালেন ফ্রেইল প্রায় বৃদ্ধ এই বিধবা মা। এই একরোখা বৃদ্ধার মনোবলের কাছে হার মানলো সামরিক শাসক।
সামরিক শাসক গেলো - কিন্তু নেত্রীর খারাপৱদিন শেষ হয় না - দুই ছেলে নির্বাসনে চলে যায় বিদেশে। প্রচন্ড একা হয়ে পড়েন নেত্রী।
এর মাঝে নির্বাসনে থাকা অবস্থায় পরপারে চলে যায় তার সবচেয়ে প্রিয় ছোট ছেলে -
আগুনে পোড়া শোকে অত্যাচারে আজন্ম জ্বলা নেত্রী তীব্র কষ্ট বুক ধরে দাঁড়িয়ে থাকেন মাথা উঁচু করে - দেশের একনায়কতন্ত্রের বিরুদ্ধে - গণতন্ত্র হত্যাকে মোকাবেলা করতে যদি সারা দেশে একটি অস্ত্র থেকে থাকে - তা হচ্ছে এই প্রায় বৃদ্ধা অসুস্থ নেত্রী।
মৃত্যুর মিছিল চলে নেত্রীর জীবনে। তার মা মারা গেলেন - চলে গেলেন ভাই।
এই নিঃসঙ্গ বৃদ্ধাকে নিষ্ঠুর ভাবে উৎখাত করা হয় তার স্বামী সন্তান স্মৃতি জড়ানো বাড়ি থেকে। তার নাতনিরা তার সাথে আর থাকে না। উনি ওদের আর পাননা।
উনি এক এক প্রায় গৃহবন্দীর জীবন যাপন করেন। তারপর ও কি এক অজানা কারণে স্বৈরশাসক তাকে প্রচন্ড ভয় পায়।
কয়েকদিন আগে মিথ্যা মামলা দিয়ে
এই বৃদ্ধা বিধবা সন্তান হারা মা কে জেল পাঠানো হল। বৃদ্ধা সর্বোচ্চ গ্রেসের সাথে কারাবরণ করলেন।
আজ আমরা সবাই যখন নিজের বিছানার কমফোর্টে শুতে যাই- আমাদের যেন মনে থাকে একটা বড় অন্যায় হয়েছে। এক বৃদ্ধা অসহায় ভাবে শুয়ে আছেন পুরোনো জেলের চৌকিতে। বরাদ্দ তিনটা কম্বল। আমাদের কাছে এই বৃদ্ধার চাওয়া পাওয়ার তেমন কিছু নেই - আমাদের ই অনেক প্রয়োজন এই বৃদ্ধাকে।
লেখক: রুমি আহমেদ
বিষয়: বিবিধ
৭৬৫ বার পঠিত, ১ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন