সিয়ামে রমাদান - (প্রথম পর্ব)
লিখেছেন লিখেছেন সত্যের ডাক ২৭ জুন, ২০১৪, ১১:২০:১৫ সকাল
সিয়ামে রমাদান
ফযীলত, উপকারিতা, উদ্দেশ্য ও বিধান
রচনায়ঃ
মাওলানা মুহাম্মাদ হারুন আযিযী নদভী
বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম
মাহে রমাদানূল মুবারক মহাগ্রন্থ আল্ কুরআনুল করীম অবতীর্ণ হওয়ার মাস, আল্লাহ তা’আলার বিশেষ অনুগ্রহ ও দয়া সমূহের মাস। ধৈর্য্য, সহনশীলতা, সহানুভুতি ও রিযিক বৃদ্ধির মাস। জান্নাতে প্রবেশ করা ও জাহান্নাম থেকে মুক্তি লাভের মাস। রহমত, বরকত, মাগফিরাত ও নাজাতের মাস। ভাল কাজের প্রতিদান অগণিত হারে বৃদ্ধি হওয়ার মাস। মহান ইসলামী বিজয় সমূহের মাস।
মাহে রমাদানুল মুবারক সারা বিশ্বের মুসলমানের জন্য যিকির-আযকার, তাসবীহ, তাহলীল, তেলাওয়াতে কুরআন, নফল ইবাদত সমূহ, ছদকা খায়রাত ইত্যাদি প্রত্যেক রকমের ইবাদত বন্দেগী করার আন্তর্জাতিক মৌসুম।
হাদীসের ভাষায় রমাদানুল মুবারকের মত একটি মাস পেয়েও যে ব্যক্তি নিজের পাপ-পঙ্কিলতার প্রায়শ্চিত্ত করতে পারেনি, সে মস্ত বড় বদনছীব। আর যে ব্যক্তি এই মাসের খায়র-বরকত থেকে মাহরুম রয়েছে বাস্তবে সে হতভাগা ও বঞ্চিত ব্যক্তি।
নবীজি এমাসের ইবাদতের জন্য এক মাস পূর্ব থেকেই প্রস্তুতি গ্রহন করতেন। সিয়ামব্রত পালন, তারাবীহর ছলাত আদায়, ই’তিকাফ, কুরআন তেলাওয়াত, ছদকা-খায়রাত ইত্যাদি আরো অনেক ইবাদত এই মাসে করতেন।
সিয়ামের পরিচিতি
‘সিয়াম’ [صيام] বা ‘সাউম’ [صوم] আরবী শব্দ। এর আভিধানিক অর্থ হল, বিরত থাকা। তা যে কোন কাজ থেকে হতে পারে। যথাঃ খাওয়া, পান করা, কথা বলা, চলা ইত্যাদি।
শরীয়তের পরিভাষায় ‘সিয়াম’ বা ‘সাউম’ কিংবা [আমাদের দেশের প্রসিদ্ধ ভাষা মতে] ‘রোযা’ বলা হয়, ‘আল্লাহর ইবাদতের উদ্দেশ্যে ফজরের সময়ের শুরু থেকে সুর্যাস্ত পর্যন্ত খাওয়া, পান করা এবং স্ত্রী সহবাস ইত্যাদি থেকে বিরত থাকা।
ঐতিহাসিক পটভূমি
ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, সিয়ামব্রত পালনের প্রথা প্রায় সকল ধর্মে এবং সকল সম্প্রদায়ের মধ্যে বিদ্যমান ছিল। কুরআন মজীদ এদিকে ইঙ্গিত করে বলেছে- ‘হে মুমিনগণ! তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর যেরূপ সিয়াম ফরয করা হয়েছিল, তোমাদের উপরও তদ্রুপ ফরয করা হল, যাতে তোমরা তাক্কওয়া তথা আল্লাহভীতি অর্জন করতে পার।’ গণনার কয়েকটি দিনের জন্য। অতঃপর তোমাদের মধ্যে যে অসুস্থ থাকবে অথবা সফরে থাকবে, তাকে অন্য সময়ে সে সিয়াম পুরণ করে নিতে হবে। আর এটি যাদের জন্য অত্যন্ত কষ্টদায়ক হয়, তারা এর পরিবর্তে একজন মিসকীনকে খাদ্যদান করবে। যে ব্যক্তি খুশীর সাথে সৎকর্ম করে, তা তার জন্য কল্যাণকর হয়। রমদান হল, সেই মাস, যাতে কুরআন অবতীর্ণ করা হয়েছে। যা মানুষের জন্য হিদায়েত এবং সত্যপথযাত্রীদের জন্য সুস্পষ্ট পথনির্দেশ আর ন্যায় ও অন্যায়ের মাঝে পার্থক্য বিধানকারী। অতএব তোমাদের থেকে যে এই মাস পাবে, সে এ মাসে সিয়াম পালন করবে। আর যে অসুস্থ কিংবা মুসাফির অবস্থায় থাকবে, সে অন্য দিনে গণনা পুরণ করবে। আল্লাহ তোমাদের জন্য সহজ করতে চান, তোমাদের জন্য জটিলতা চান না- যাতে তোমরা গণনা পুরণ কর এবং তোমাদের হিদায়েত দান করার দরুন আল্লাহ তাঅ’ালার মহত্ব বর্ণনা কর, আর যাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা স্বীকার কর।’ (সূরা বাকারাঃ ১৮৩, ১৮৪, ১৮৫।)
এখানে স্পষ্টতঃ বলা হল যে, সিয়াম শুধু মুসলিম উম্মাহর উপর নয়, বরং পূর্বের সকল উম্মাতের উপরও ফরয ছিল।
ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, পৃথিবীতে এমন কোন সম্প্রদায় ছিল না যাদের উপর আল্লাহ তাঅ’ালা সিয়াম ফরয করেন নি।
ইনসাইক্লোপ্যাড়িয়া বৃটেন এর ‘সিয়াম’ বিষয়ক প্রবন্ধকার তার প্রবন্ধে বলেনঃ ‘আবহাওয়া, জাতিয়তা, সংস্কৃতি ও পরিবেশের ভিন্নতার কারণে যদিও সিয়ামের মৌলনীতি ও পদ্ধতি ভিন্ন ছিল। কিন্তু আমরা এমন কোন মাযহাব কিংবা ধর্মনীতি দেখিনা যাতে সিয়ামব্রত পালনকে ধর্মের মৌলনীতি হিসেবে গ্রহন করা হয়নি।’
হিন্দুস্তানেও উপবাস যাপনের নিয়ম প্রচলিত ছিল। প্রত্যেক হিন্দী মাসের এগার ও বার তারিখে ব্রত পালন তথা একাদশী রোযা রাখা ব্রাক্ষ্মণদের উপর জরুরী ছিল। এই হিসেবে বছরে চব্বিশটি রোযা হয়। কোন কোন ব্রাক্ষ্মণ কার্তিক মাসের প্রত্যেক সোমবারে সিয়াম পালন করত। হিন্দু ধর্মজাযকরা কখনো চল্লিশ দিন পর্যন্ত পানাহার ছেড়ে দিত। (ইনসাইক্লোপ্যাড়িয়া, বৃটেনঃ ১০/১৯৩।)
ইহুদীদের মধ্যেও সিয়াম পালন আল্লাহর আবশ্যকীয় বিধান ছিল। মূসা (আঃ) তূর পাহাড়ে চল্লিশ দিন পর্যন্ত সিয়াম পালন করেছিলেন। (খূরোজঃ ৩৪, ৩৮)
তাই ইহুদীরাও তাঁর অনুসরণে চল্লিশ দিন সিয়াম পালন করা ভাল মনে করত। কিন্তু চল্লিশতম সিয়াম তাদের জন্য ফরয ছিল। যা তাদের সপ্তম মাসের দশম তারিখে পড়ে। এই কারণেই তাকে আশুরা বলা হয়। এটি ছিল সেই দিন যাতে মূসা (আঃ) তাওরাত লাভে ধন্য হয়েছিলেন। এ কারণে তাওরাতে এই দিনে সিয়ামের বিশেষ তাকিদ এসেছে। (তাওরাত, সিফরুল আহবার ঃ ১৬, ১৯, ৩৪।)
খ্রীষ্টধর্মেও সিয়ামের প্রথা চালু ছিল। ঈসা (আঃ) চল্লিশ দিন পর্যন্ত জঙ্গলে সিয়াম পালন করেছেন। (আওয়াল সামূয়েলঃ ৬-৭, ইয়ারমিয়াঃ ৩৬/৬।)
ইয়াহয়া (আঃ)ও সিয়াম পালন করতেন এবং তাঁর উম্মাতও সিয়াম পালন করত। (মারক্বাসঃ ২৪)
ইসলামের পূর্বে আরবদের মধ্যেও কোন না কোন ভাবে সিয়ামের প্রথা চালু ছিল। কুরাইশরা আশুরা তথা মুহাররামের দশ তারিখ সিয়াম পালন করত। মদীনা শরীফে ইহুদীরাও সপ্তম মাসের দশ তারিখে সিয়াম পালন করত। (মুসনাদু আহমদঃ ৬/২৪৪, বুখারীঃ ১/৫৬২, সীরাতুন্নবী-আল্লামা সৈয়দ সুলায়মান নদভী, পৃঃ ১৫০।)
বিষয়: বিবিধ
১০৮২ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন