ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর আবির্ভাব কালের সার্বিক চিত্র- মূল : আল্লামা আলী আল কুরানী

লিখেছেন লিখেছেন হৈচৈ ১৯ জুন, ২০১৩, ০৬:২১:৩০ সন্ধ্যা

যদিও পবিত্র কুরআন মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর চিরন্তন মুজিযা এবং সব যুগে সকল প্রজন্মের জন্য তা নতুন, এতদসত্ত্বেও ইসলাম ধর্মের চির জীবন্ত মুজিযাসমূহের অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে মহানবী (সা.) কর্তৃক বর্ণিত ঐ সব হাদীস ও রেওয়ায়াত (বর্ণনা) যা ইসলাম ধর্মের (প্রতিশ্রুত) পুনর্জাগরণ পর্যন্ত মানব জাতির ভবিষ্যৎ জীবন এবং ইসলাম ধর্মের ভবিষ্যৎ গতিধারা সম্পর্কে বর্ণিত হয়েছে। আর এটি হবে ঐ সময় যখন মহান আল্লাহ্ তাঁর ধর্মকে কাফির ও মুশরিকদের আশা-আকাঙক্ষার বিপরীতে পৃথিবীর সকল ধর্ম ও মতাদর্শের ওপর বিজয়ী করবেন।

ইসলাম ধর্মের পুনঃপ্রতিষ্ঠা ও বিজয়ের এ যুগই হচ্ছে ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর আবির্ভাবের যুগ যা এ গ্রন্থের আলোচ্য বিষয়। আর সাহাবী, তাবেয়ী ও সহীহ হাদীস গ্রন্থসমূহের রচয়িতাগণের মাধ্যমে মহানবী (সা.)-এর নিকট হতে বর্ণিত সুসংবাদ প্রদানকারী শত শত রেওয়ায়াতেও এ দুই যুগ ও মহাঘটনা (ইসলামের পুনঃপ্রতিষ্ঠা ও ইমাম মাহ্দীর আবির্ভাব) সম্পর্কে বর্ণনা রয়েছে। আসলে এ দুই মহাঘটনার মধ্যে কোন পার্থক্য নেই যদিও এ সব রেওয়ায়াতে (বর্ণনার ক্ষেত্রে) পদ্ধতিগত পার্থক্য বিদ্যমান। যদি আহ্লে বাইতের ইমামদের রেওয়ায়াতসমূহ এ সব রেওয়ায়াতের সাথে যোগ করা হয়, তাহলে এতদসংক্রান্ত রেওয়ায়াতসমূহের সংখ্যা ১০০০-এরও অধিক হবে। যদিও ইমামগণ তাঁদের হাদীসগুলো সবসময় মহানবী (সা.)-এর সাথে সম্পর্কিত করেননি, তবে তাঁরা অসংখ্যবার তাগিদ দিয়েছেন যে, তাঁরা যা বর্ণনা করেছেন তা তাঁদের পবিত্র পূর্বপুরুষগণ এবং তাঁদের শ্রদ্ধেয় প্রপিতামহ মহানবী (সা.) থেকেই তাঁরা লাভ করেছেন।

এ সব রেওয়ায়াতে আবির্ভাবের যুগে পৃথিবী, বিশেষ করে যে অঞ্চলে ইমাম মাহ্দী (আ.) আবির্ভূত হবেন সেই অঞ্চল, যেমন ইয়েমেন, হিজায, ইরান, ইরাক, শাম (সিরিয়া, লেবানন ও জর্দান), ফিলিস্তিন, মিসর ও মাগরিবের (মরক্কো, আলজেরিয়া, তিউনিসিয়া ও লিবিয়া) যে চিত্র অঙ্কিত হয়েছে তা ছোট-বড় অনেক ঘটনা এবং বহু ব্যক্তি ও স্থানের নামকে শামিল করে।

আমি অগণিত রেওয়ায়াত ও হাদীসের মধ্য থেকে এ সব রেওয়ায়াত ও হাদীস বাছাই করে যতটা সম্ভব সূক্ষ্ম ও স্পষ্ট করে এবং ধারাবাহিকতা সহকারে সাধারণ মুসলিম পাঠকবর্গের কাছে উপস্থাপন করার চেষ্টা করেছি।

এ সব রেওয়ায়াত নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করার আগে এ অধ্যায়ে এগুলোর একটি সার সংক্ষেপ উল্লেখ করব যাতে করে ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর আবির্ভাব কালের একটি সাধারণ চিত্র বা ধারণা আমরা পেতে পারি। বেশ কিছু সংখ্যক রেওয়ায়াত ও হাদীসে বর্ণিত হয়েছে যে, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রস্ত্ততি সম্পন্ন হওয়ার পরপরই পবিত্র মক্কা নগরী থেকে হযরত ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর আবির্ভাবের বিপ্লব ও আন্দোলন শুরু হয়ে যাবে।

এ সব রেওয়ায়াত অনুযায়ী আন্তর্জাতিক পর্যায়ে রোমানদের (পাশ্চাত্য) সাথে তুর্কী এবং তাদের সমর্থকদের (রুশ) বাহ্যত একটি ভয়ঙ্কর যুদ্ধ সংঘটিত হবে- যা বিশ্বযুদ্ধে রূপান্তরিত হবে।

কিন্তু আঞ্চলিক পর্যায়ে ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর সমর্থক দু’টি সরকার ও প্রশাসন ইরান ও ইয়েমেনে প্রতিষ্ঠিত হবে। মাহ্দী (আ.)-এর ইরানী সঙ্গী-সাথীরা তাঁর আবির্ভাবের বেশ কিছুকাল আগে নিজেদের জন্য একটি সরকার গঠন করে একটি দীর্ঘমেয়াদী যুদ্ধে জড়িয়ে পড়বে। অবশেষে তারা ঐ যুদ্ধে বিজয়ী হবে।

ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর আবির্ভাবের কিছুকাল আগে ইরানীদের মধ্যে দু’ব্যক্তি (একজন খোরাসানী সাইয়্যেদ যিনি হবেন রাজনৈতিক নেতা এবং অপরজন শুআইব ইবনে সালিহ্ যিনি হবেন সামরিক নেতা) আবির্ভূত হবেন এবং এ দু’ব্যক্তির নেতৃত্বে ইরানী জাতি তাঁর আবির্ভাবের আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।

কিন্তু ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর আবির্ভাবের কয়েক মাস আগে তাঁর ইয়েমেনী সঙ্গীদের বিপ্লব বিজয় লাভ করবে এবং তারা বাহ্যত হিজাযে যে রাজনৈতিক শূন্যতার সৃষ্টি হবে তা পূরণ করার জন্য তাঁকে সাহায্য করবে।

হিজাযের এ রাজনৈতিক শূন্যতা সৃষ্টি হওয়ার কারণ হচ্ছে হিজাযের কোন এক বংশের আবদুল্লাহ্ নামের এক নির্বোধ ব্যক্তি সে দেশের সর্বশেষ বাদশাহ্ হিসেবে নিহত হবে এবং তার স্থলাভিষিক্ত কে হবে- এ বিষয়কে কেন্দ্র করে এমন এক মতবিরোধের সৃষ্টি হবে যা ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর আবির্ভাব পর্যন্ত চলতে থাকবে।

রেওয়ায়াতে বলা হয়েছে : ‘যখন আবদুল্লাহ্র মৃত্যু হবে, তখন জনগণ কোন্ ব্যক্তি তাঁর স্থলাভিষিক্ত হবে- এ ব্যাপারে কোন ঐকমত্যে পৌঁছতে পারবে না। আর এ অবস্থা ‘যুগের অধিপতি’র (ইমাম মাহ্দীর) আবির্ভাব পর্যন্ত চলতে থাকবে। বহু বছর রাজত্ব করার দিন শেষ হয়ে কয়েক মাস বা কয়েক দিনের রাজত্ব করার অর্থাৎ ক্ষণস্থায়ী শাসনের পালা চলে আসবে।’

আবু বসীর বলেন : ‘আমি জিজ্ঞাসা করলাম : এ অবস্থা কি দীর্ঘকাল স্থায়ী হবে? তিনি বললেন : কখনই না। বাদশাহ্র (আবদুল্লাহ্) হত্যাকান্ডের পরে এ দ্বন্দ্ব হিজাযের গোত্রসমূহের মধ্যকার অন্তর্দ্বন্দ্ব ও কলহে পর্যবসিত হবে।’

‘(ইমাম মাহ্দীর) আবির্ভাবের নিদর্শনসমূহের অন্যতম হচ্ছে ঐ ঘটনা যা দু’হারামের (মক্কা ও মদীনা) মাঝখানে সংঘটিত হবে। আমি বললাম : কোন্ ঘটনা ঘটবে? তিনি বললেন : দু’হারামের মাঝে গোত্রীয় গোঁড়ামির উদ্ভব হবে এবং অমুকের বংশধরদের মধ্য থেকে এক ব্যক্তি বিরোধী গোত্রের পনের জন নেতা ও ব্যক্তিত্বকে অথবা তাদের সন্তানদেরকে হত্যা করবে।’

এ সময়ই ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর আবির্ভাবের নিদর্শনসমূহ স্পষ্ট হয়ে যাবে এবং সম্ভবত এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড় নিদর্শন হচ্ছে আসমানী আহবান বা ধ্বনি যা তাঁর নামে ২৩ রমযানে শ্রুত হবে।

সাইফ ইবনে উমাইরাহ্ বলেছেন : ‘আমি আবু জাফর আল মনসূরের (দ্বিতীয় আববাসীয় খলীফা) নিকটে ছিলাম। তিনি কোন ভূমিকা ছাড়াই বললেন : হে সাইফ ইবনে উমাইরাহ্! নিঃসন্দেহে আকাশ থেকে একজন আহবানকারী আবু তালিবের বংশধরগণের মধ্য থেকে এক ব্যক্তির নাম ঘোষণা করবে। আমি বললাম : আমি আপনার জন্য উৎসর্গীকৃত, হে আমীরুল মুমিনীন! আপনি কি এ কথা বর্ণনা করেছেন? তিনি বললেন : হ্যাঁ, যাঁর হাতে আমার প্রাণ তাঁর শপথ, এ কথা আমি আমার নিজ কানে শুনেছি। আমি বললাম : হে আমীরুল মুমিনীন! আমি এখন পর্যন্ত এ ধরনের হাদীস কারও কাছ থেকে শুনিনি। তিনি বললেন : হে সাইফ! এ কথা সত্য। যখন ঐ ঘটনা ঘটবে তখন আমরাই সর্বপ্রথম এ আহবানে সাড়া দেব। তবে ঐ ধ্বনি আমাদের একজন পিতৃব্যপুত্রের প্রতি নয় কি? আমি বললাম : সে কি ফাতিমার বংশধর হবে? তিনি বললেন : হ্যাঁ, হে সাইফ! অনন্তর যদি আমি এ রেওয়ায়াতটি আবু জাফার মুহাম্মাদ ইবনে আলী আল-বাকির থেকে না শুনতাম তাহলে সমগ্র জগৎবাসী আমাকে বললেও আমি তা মেনে নিতাম না। কিন্তু এর বর্ণনাকারী তো ইমাম মুহাম্মাদ ইবনে আলী।’

এ সব রেওয়ায়াত অনুসারে এই আসমানী আহবান শোনা যাওয়ার পরই ইমাম মাহ্দী (আ.) গোপনে তাঁর কতিপয় সঙ্গী ও সমর্থকের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করবেন। তখন তাঁর ব্যাপারে সমগ্র পৃথিবীব্যাপী আলোচনা হতে থাকবে এবং তাঁর নাম সবার মুখে মুখে উচ্চারিত হতে থাকবে। তাঁর প্রতি ভালবাসা সবার হৃদয়ে আসন লাভ করবে।

তাঁর শত্রুরা তাঁর আবির্ভাবের ব্যাপারে খুব ভীত হয়ে পড়বে এবং এ কারণে তারা তাঁকে গ্রেফতার করার চেষ্টা করবে। জনগণের মাঝে ছড়িয়ে যাবে যে, তিনি মদীনায় অবস্থান করছেন।

বিদেশী সামরিক বাহিনী অথবা হিজায সরকার সে দেশের অভ্যন্তরীণ অবস্থা নিয়ন্ত্রণে আনয়ন এবং সরকারের সাথে গোত্রসমূহের দ্বন্দ্ব-সংঘাত নিরসন করার জন্য সিরিয়াস্থ সুফিয়ানী সেনাবাহিনীর সাহায্য চাইবে। এ সেনাবাহিনী মদীনায় প্রবেশ করে হাশেমী বংশীয় যাকে পাবে তাকেই গ্রেফতার করবে। তাদের অনেককে এবং তাদের অনুসারীদেরকে হত্যা করবে এবং অবশিষ্টদেরকে জেলখানায় বন্দি করে রাখবে।

‘সুফিয়ানী তার একদল সৈন্যকে মদীনায় প্রেরণ করবে এবং তারা সেখানে এক ব্যক্তিকে হত্যা করবে। মাহ্দী ও মানসূর সেখান থেকে পলায়ন করবে। তারা মহানবীর সকল বংশধরকে গ্রেফতার করবে। আর এর ফলে কোন ব্যক্তিই মুক্ত থাকবে না। সুফিয়ানী বাহিনী ঐ দু’ব্যক্তিকে ধরার জন্য মদীনা নগরীর বাইরে যাবে এবং ইমাম মাহ্দী (ফিরআউনের কবল থেকে রক্ষা পাওয়ার ব্যাপারে) হযরত মূসা (আ.)-এর মতো ভীত ও চিন্তিত অবস্থায় সেখান থেকে বের হয়ে মক্কাভিমুখে চলে যাবে।’

অতঃপর ইমাম মাহ্দী (আ.) মক্কা নগরীতে তাঁর কতিপয় সঙ্গী-সাথীর সাথে যোগাযোগ করবেন যাতে তিনি পবিত্র হারাম থেকে এশার নামাযের পরে মুহররম মাসের দশম রাতে (আশুরার রাতে) তাঁর আন্দোলনের সূচনা করতে পারেন। তখন তিনি মক্কার জনগণের উদ্দেশে তাঁর প্রথম ভাষণ দান করবেন। এর ফলে তাঁর শত্রুরা তাঁকে হত্যা করার চেষ্টা করবে। কিন্তু তাঁর সঙ্গী-সাথীরা তাঁকে চারদিক থেকে ঘিরে ফেলবে এবং শত্রুদেরকে বিতাড়িত করে প্রথমে মসজিদুল হারাম ও তারপর পবিত্র মক্কানগরীর ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করবে।

মুহররম মাসের দশম দিবসের (আশুরার দিবস) প্রভাতে ইমাম মাহ্দী সমগ্র বিশ্ববাসীর উদ্দেশে বিভিন্ন ভাষায় তাঁর বাণী প্রদান করে বিশ্বের জাতিসমূহকে আহবান জানাবেন যাতে তারা তাঁকে সাহায্য করে। তিনি ঘোষণা করবেন যে, যে মুজিযার প্রতিশ্রুতি তাঁর শ্রদ্ধেয় প্রপিতামহ হযরত মুহাম্মাদ (সা.) দিয়েছিলেন তা ঘটা পর্যন্ত তিনি পবিত্র মক্কা নগরীতে অবস্থান করবেন। আর উক্ত মুজিযা হবে ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর আন্দোলন দমন করার জন্য পবিত্র মক্কাভিমুখে অগ্রসরমান সুফিয়ানী প্রেরিত বাহিনীর ভূ-গর্ভে প্রোথিত হওয়া।

এ প্রতিশ্রুত মুজিযা বাস্তবায়িত হবে এবং যে সুফিয়ানী বাহিনী পবিত্র মক্কা অভিমুখে রওয়ানা হয়েছিল তা ধ্বংস হয়ে যাবে।

এ মুজিযার পর ইমাম মাহ্দী (আ.) দশ হাজারেরও অধিক সৈন্য নিয়ে মক্কা থেকে মদীনা অভিমুখে রওয়ানা হবেন এবং শত্রুবাহিনীর সাথে যুদ্ধের পর সেখানে অবস্থান গ্রহণ এবং মদীনা শত্রুমুক্ত করবেন। এরপর তিনি দুই হারাম (মক্কা ও মদীনা) মুক্ত করার মাধ্যমে হিজায বিজয় এবং সমগ্র অঞ্চলের (আরব উপদ্বীপ) ওপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করবেন।

কতিপয় রেওয়ায়াত থেকে প্রতীয়মান হয় যে, ইমাম মাহ্দী (আ.) হিজায বিজয়ের পর দক্ষিণ ইরান অভিমুখে রওয়ানা এবং সেখানে খোরাসানী ও শুআইব ইবনে সালিহের নেতৃত্বাধীন ইরানী সেনাবাহিনী ও সেদেশের জনগণের সাথে মিলিত হবেন। তারা তাঁর হাতে বাইআত করবে। তিনি তাদের সহায়তায় বসরায় শত্রুবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হবেন যার ফলে তিনি এক সুস্পষ্ট ও বিরাট বিজয় লাভ করবেন।

এরপর তিনি ইরাকে প্রবেশ করবেন এবং সেখানকার অভ্যন্তরীণ পরিবেশ পরিস্থিতির উন্নতি সাধন করবেন। তিনি সেদেশে সুফিয়ানী বাহিনীর অবশিষ্টাংশ এবং অন্যান্য দলের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়ে তাদেরকে পরাভূত ও হত্যা করবেন।

এরপর তিনি ইরাককে তাঁর প্রশাসনের কেন্দ্র এবং কুফা নগরীকে রাজধানী হিসাবে মনোনীত করবেন। আর এভাবে ইয়েমেন, হিজায, ইরাক এবং পারস্য উপসাগরীয় দেশসমূহ সর্বতোভাবে তাঁর শাসনাধীনে চলে আসবে।

রেওয়ায়াতসমূহ এ কথা স্মরণ করিয়ে দেয় যে, ইরাক বিজয়ের পর ইমাম মাহ্দী (আ.) সর্বপ্রথম যে যুদ্ধের উদ্যোগ নেবেন তা হবে তুর্কীদের সাথে তাঁর যুদ্ধ। হাদীসে বর্ণিত হয়েছে :

أول لواء يعقده يبعثه إلى التّرك فيهزمهم

‘প্রথম যে সেনাদল তিনি গঠন করবেন তা তিনি তুর্কীদের বিরুদ্ধে প্রেরণ করবেন। অতঃপর তা তাদেরকে পরাজিত করবে।’

বাহ্যত তুর্কী বলতে রুশদেরকেও বোঝানো হতে পারে যারা রোমানদের (পাশ্চাত্যের) সাথে যুদ্ধের পর দুর্বল হয়ে পড়বে।

ইমাম মাহ্দী (আ.) সেনাদল গঠন করার পর তাঁর বিশাল সেনাবাহিনীকে কুদ্সে (জেরুজালেম) প্রেরণ করবেন। এ সময় তাঁর সেনাবাহিনী দামেস্কের কাছে ‘মার্জ আযরা’ এলাকায় আগমন করা পর্যন্ত সুফিয়ানী পশ্চাদপসরণ করতে থাকবে এবং তাঁর ও সুফিয়ানীর মাঝে আলোচনা অনুষ্ঠিত হবে। তবে ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর প্রতি জনসমর্থন বহুগুণ বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে তাঁর সামনে সুফিয়ানীর অবস্থান এতটা দুর্বল হয়ে পড়বে যে, সুফিয়ানী তাঁর কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে চাইবে। কিন্তু এ কাজের জন্য তার ইহুদী-রোমান মিত্র ও পৃষ্ঠপোষক এবং তার সঙ্গী-সাথীরা তাকে তীব্র ভৎর্সনা করবে।

তারা তাদের সেনাবাহিনী মোতায়েন করার পর ইমাম মাহ্দী (আ.) ও তাঁর সেনাবাহিনীর সাথে এক বিরাট যুদ্ধে লিপ্ত হবে। এ যুদ্ধের উপকূলীয় অক্ষরেখাসমূহ ফিলিস্তিনের আক্কা (عكّا) থেকে তুরস্কের আনতাকিয়াহ্ (انطاكية) পর্যন্ত এবং ভিতরের দিকে তাবারীয়াহ্[1] থেকে দামেস্ক ও কুদ্স পর্যন্ত বিস্তৃত হবে।

এ সময় সুফিয়ানী, ইহুদী এবং রোমান সেনাবাহিনী মহান আল্লাহ্র (ঐশী) ক্রোধে পতিত হবে এবং তারা মুসলমানদের হাতে এমনভাবে নিহত হতে থাকবে যে, তাদের মধ্য থেকে কোন ব্যক্তি যদি কোন প্রস্তরখন্ডের পিছনেও লুকায় তখন ঐ প্রস্তরখন্ড চিৎকার করে বলে উঠবে : ‘হে মুসলমান! এখানে একজন ইহুদী লুকিয়ে আছে। তাকে হত্যা করো।’

এ সময় মহান আল্লাহ্র সাহায্য ইমাম মাহ্দী (আ.) ও মুসলমানদের কাছে আসবে এবং তাঁরা বিজয়ী বেশে আল কুদ্সে প্রবেশ করবেন।

খ্রিস্টান পাশ্চাত্য আকস্মিকভাবে ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর হাতে ইহুদী ও তাদের পৃষ্ঠপোষক শক্তিসমূহের পরাজয় বরণের কথা জানতে পারবে। তাদের ক্রোধাগ্নি প্রজ্বলিত হবে এবং তারা ইমাম মাহ্দীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করবে। কিন্তু আকস্মিকভাবে হযরত ঈসা (আ.) আকাশ থেকে পবিত্র কুদ্সের ওপর অবতরণ করবেন এবং তিনি সমগ্র বিশ্ববাসী, বিশেষ করে খ্রিস্টানদের উদ্দেশে ভাষণ দেবেন।

হযরত ঈসা মসীহ্ (আ.)-এর অবতরণ বিশ্ববাসীর জন্য এমন এক নিদর্শন হবে যা হবে মুসলমান ও খ্রিস্টানদের জন্য আনন্দের কারণ। সম্ভবত হযরত ঈসা (আ.), ইমাম মাহ্দী ও পাশ্চাত্যের মাঝে মধ্যস্থতা করবেন এবং এ কারণে দু’পক্ষের মধ্যে সাত বছর মেয়াদী একটি সন্ধিচুক্তি স্বাক্ষরিত হবে।

কতিপয় রেওয়ায়াত অনুসারে পাশ্চাত্য দু’বছর পরে সন্ধিচুক্তি ভঙ্গ করবে। সম্ভবত এ চুক্তি ভঙ্গ করার কারণ হচ্ছে ঐ ভয়-ভীতি যা ঈসা (আ.) কর্তৃক পাশ্চাত্যের জাতিসমূহের মাঝে গণজাগরণ ও সংহতির জোয়ার সৃষ্টির মাধ্যমে উদ্ভূত হবে। বহু পাশ্চাত্যবাসী ইসলাম ধর্ম গ্রহণ এবং ইমাম মাহ্দী (আ.)-কে সাহায্য ও সমর্থন দান করবে। এ কারণেই রোমানরা দশ লক্ষ সৈন্যসহকারে সিরিয়া ও ফিলিস্তিনে অকস্মাৎ আক্রমণ চালাবে।

আর মুসলিম বাহিনী তাদের মোকাবিলা করবে এবং হযরত ঈসা (আ.) ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর নীতি অবস্থানের সাথে সামঞ্জস্যশীল করে তাঁর নীতি ঘোষণা করবেন এবং ইমাম মাহ্দীর পেছনে বায়তুল মুকাদ্দাসে নামায আদায় করবেন।

রোমানদের (পাশ্চাত্য) বিরুদ্ধে মহাযুদ্ধ যে সব স্থান বা অক্ষ বরাবর আল কুদ্স মুক্ত করার যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল সে সব স্থানে অর্থাৎ আক্কা থেকে আনতাকিয়া, দামেস্ক থেকে আল কুদ্স (বাইতুল মুকাদ্দাস বা জেরুজালেম) এবং মার্জ দাবিক[2] পর্যন্ত বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে সংঘটিত হবে। এ মহাযুদ্ধে রোমীয়রা শোচনীয় পরাজয় বরণ করবে এবং (ইমাম মাহ্দীর নেতৃত্বে) মুসলমানগণ স্পষ্ট ও বৃহৎ এক বিজয় লাভ করবে।

এ যুদ্ধের পর ইমাম মাহ্দীর সামনে খ্রিস্টান ইউরোপ ও পাশ্চাত্য বিজয়ের দ্বার উন্মুক্ত হয়ে যাবে। আর দৃশ্যত অনেক জাতি বিপ্লবের মাধ্যমে নিজ নিজ দেশে ইমাম মাহ্দী ও হযরত ঈসা (আ.)-এর বিরোধী সরকারসমূহের পতন ঘটাবে এবং ইমাম মাহ্দীর সমর্থক প্রশাসন প্রতিষ্ঠা করবে।

ইমাম মাহ্দী (আ.) কর্তৃক সমগ্র পাশ্চাত্য বিজয় এবং তা তাঁর শাসনাধীনে চলে আসার পর অধিকাংশ পাশ্চাত্যবাসী ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করবে। এ সময় হযরত ঈসা (আ.) ইন্তেকাল করবেন। মাহ্দী (আ.) ও মুসলমানগণ তাঁর জানাযার নামায পড়বেন। হাদীসের বর্ণনা অনুসারে ইমাম মাহ্দী হযরত ঈসা (আ.)-এর জানাযার নামায ও দাফন অনুষ্ঠান প্রকাশ্যে জনতার উপস্থিতিতে সম্পন্ন করবেন যাতে অতীতের মতো তাঁর ব্যাপারে কেউ পুনরায় অগ্রহণীয় উক্তি করতে না পারে। অতঃপর ইমাম মাহ্দী তাঁকে তাঁর মা হযরত মারইয়াম সিদ্দীকা (আ.) নিজ হাতে যে বস্ত্রটি বয়ন করেছিলেন তা কাফন হিসাবে পরিধান করাবেন এবং বাইতুল মুকাদ্দাসে তাঁর মায়ের কবরের পাশে দাফন করবেন।

ইমাম মাহ্দী (আ.) কর্তৃক সমগ্র বিশ্ব বিজয় এবং বিশ্বের সকল দেশ, রাষ্ট্র ও প্রশাসন একটি একক ইসলামী প্রশাসনের আওতায় একীভূত হওয়ার পর তিনি বিশ্বের বিভিন্ন জাতির মাঝে বিভিন্ন পর্যায়ে ঐশী লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যসমূহ বাস্তবায়নের জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন। তিনি পার্থিব জীবনের উন্নতি ও বিকাশ এবং মানব জাতির সচ্ছলতা, কল্যাণ ও সুযোগ-সুবিধা বাস্তবায়ন কল্পে বাস্তব উদ্যোগ গ্রহণ করবেন। তিনি সংস্কৃতি ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রসার এবং মানব জাতির ধর্মীয় ও পার্থিব জ্ঞানের পর্যায়কে উন্নীত করার চেষ্টা চালাবেন।

কতিপয় হাদীস অনুযায়ী ইমাম মাহ্দী (আ.) মানব জাতির জ্ঞানের সাথে আরও যে জ্ঞান যোগ করবেন তার প্রবৃদ্ধির হার হবে ২৫ : ২ অনুপাতে। অর্থাৎ মানব জাতি এর আগে জ্ঞানের যে দু’ভাগের অধিকারী ছিল তার সাথে আরও ২৫ ভাগ যুক্ত করবেন এবং সার্বিকভাবে মানুষের জ্ঞান তখন ২৭ ভাগ হবে।

সম্ভবত অভিশপ্ত দাজ্জালের অভ্যুত্থান ও ফিতনা ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর যুগে মানব জাতি যে ব্যাপক ও অভূতপূর্ব বৈজ্ঞানিক, প্রযুক্তিগত ও বৈষয়িক উন্নতি সাধন করবে তার ফলে ঘটবে অর্থাৎ দাজ্জাল এসবের অপব্যবহারের মাধ্যমে একটি বিচ্যুত ধারা সৃষ্টি করবে। সে মূলত যুবক ও নারীদেরকে ধোঁকা দেয়ার জন্য চোখ ধাঁধানো উন্নত মাধ্যম ও পদ্ধতি ব্যবহার করবে এবং এ শ্রেণীই তার অনুসারী হবে।

দাজ্জাল সমগ্র বিশ্বব্যাপী ফিতনা এবং বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করবে। তার ধোঁকাবাজি ও প্রতারণার দ্বারা অনেকেই প্রতারিত হবে। অনেকেই তার কথা বিশ্বাস করবে। কিন্তু ইমাম মাহ্দী দাজ্জালের ধোঁকাবাজি প্রকাশ্যে ধরিয়ে দেবেন এবং তাকে ও তার অনুসারীদেরকে হত্যা করবেন।

যা সংক্ষেপে আলোচনা করা হল তা হচ্ছে প্রতিশ্রুত হযরত মাহ্দী (আ.)-এর বিশ্বজনীন আন্দোলন ও বিপ্লবের একটি সার্বিক চিত্র ও পটভূমি। কিন্তু যে যুগে এ সব ঘটনা ঘটবে সে যুগের সবচেয়ে স্পষ্ট নিদর্শন ও ঘটনাবলী রেওয়ায়াতসমূহে বর্ণিত হয়েছে।

প্রথমে যে ফিতনা সমগ্র মুসলিম উম্মাহ্র ওপর আপতিত হবে এবং রেওয়ায়াতসমূহে যা সর্বশেষ ও সবচেয়ে কঠিন ফিতনা বলে অভিহিত হয়েছে তা ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর আবির্ভাবের মাধ্যমে বিদূরিত হয়ে যাবে।

উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে, এ বিশৃঙ্খলা ও গোলযোগের যাবতীয় সাধারণ ও বিস্তারিত বৈশিষ্ট্য এ শতাব্দীর (বিংশ শতক) শুরুতে পাশ্চাত্য এবং তাদের মিত্র প্রাচ্য দেশসমূহের সৃষ্ট ফিতনার সাথে মিলে যায়। কারণ, এ গোলযোগ ও বিশৃঙ্খলা সকল মুসলিম দেশ ও এ দেশগুলোর সকল পরিবারকে আক্রান্ত করবে। রেওয়ায়াতে বর্ণিত হয়েছে : ‘এমন কোন ঘর বিদ্যমান থাকবে না যেখানে এ ফিতনা প্রবেশ করবে না এবং এমন কোন মুসলমান থাকবে না যে এ ফিতনা দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হবে না।’

আরেকটি রেওয়ায়াতে বর্ণিত হয়েছে : ‘যেভাবে লোভাতুর ক্ষুধার্ত হরেক রকমের সুস্বাদু খাবাবের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে গোগ্রাসে গিলতে থাকে ঠিক সেভাবে কাফির জাতিসমূহ মুসলিম দেশগুলোর ওপর আক্রমণ চালাবে।’

উল্লেখ্য, আমাদের শত্রুরা তাদের কালো সাম্রাজ্যবাদী কর্তৃত্ব ও আধিপত্যের এ প্রক্রিয়া (ফিতনা) শামদেশ (সিরিয়া ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চল) থেকে শুরু করবে এবং সে দেশকে তারা সভ্যতার আলো বিকিরণের উৎস বলে অভিহিত করবে। এর ফলে এমন একটি ফিতনার উদ্ভব হবে যা রেওয়ায়াতসমূহে ‘ফিলিস্তিনের ফিতনা’ নামে উল্লিখিত হয়েছে। মশকের ভিতরে পানি যেমন আন্দোলিত হয়ে থাকে তেমনি এ ফিতনার কারণে শাম তীব্রভাবে আন্দোলিত হবে এবং লন্ডভন্ড হয়ে যাবে।

রেওয়ায়াতসমূহ সে যুগের মুসলমানদের সন্তান ও প্রজন্মসমূহকে এভাবে বর্ণনা করেছে যে, তারা এমনভাবে এ ফিতনা ও বিশৃঙ্খলাময় সংস্কৃতির মধ্যে বেড়ে উঠবে যে, তারা ইসলামী কৃষ্টি ও সংস্কৃতি সম্পর্কে একেবারেই অনবগত থেকে যাবে। সে সব অত্যাচারী শাসনকর্তা অনৈসলামিক বিধি-বিধান এবং প্রবৃত্তির কামনা-বাসনার ভিত্তিতে মুসলমানদের ওপর শাসন করবে এবং তাদের ওপর সবচেয়ে নিকৃষ্ট পন্থায় নির্যাতন চালাবে।

হাদীসসমূহে উল্লিখিত হয়েছে যে, এ গোলযোগ ও বিশৃঙ্খলার উদ্গাতা হবে রোমান এবং তুর্কীরা। তুর্কীরা বাহ্যত রুশ জাতি হতে পারে। আর যখন ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর আবির্ভাবের বছরে কতিপয় বড় ঘটনা ঘটবে তখন তারা তাদের সেনাবাহিনীকে ফিলিস্তিনের রামাল্লা, আনতাকিয়া এবং তুরস্ক-সিরীয় উপকূলে এবং সিরিয়া-ইরাক-তুরস্ক সীমান্তে অবস্থিত জাযীরায় (দ্বীপে) মোতায়েন করবে।

বর্ণিত হয়েছে : ‘যখন রোমান ও তুর্কীরা (রুশ জাতি) তোমাদের ওপর আক্রমণ চালাবে তখন তারা নিজেরাও পরস্পর দ্বন্দ্ব-সংঘাতে লিপ্ত হবে এবং বিশ্বব্যাপী যুদ্ধ-বিগ্রহ ও সংঘর্ষ উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাবে। তখন তুর্কীদের সমর্থকবৃন্দ জাযীরাহ্ এলাকায় এবং রোমের বিদ্রোহীরা রামাল্লায় অবস্থান গ্রহণের জন্য রওয়ানা হয়ে যাবে।’

রেওয়ায়াতসমূহে আরও বর্ণিত হয়েছে যে, ইরান থেকে ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর আবির্ভাবের সূত্রপাত হবে। তাঁর আবির্ভাব ও প্রকাশের সূত্রপাত প্রাচ্য থেকে হবে এবং যখন ঐ সময় উপস্থিত হবে তখন সুফিয়ানী আবির্ভূত হবে।

অর্থাৎ সালমান ফারসী (রা.)-এর জাতি ও কালো পতাকাবাহীদের হাতে ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর আবির্ভাব ও আত্মপ্রকাশের পটভূমি রচিত এবং কোম নগরী থেকে এক ব্যক্তির হাতে তাদের আন্দোলনের সূত্রপাত হবে।

রেওয়ায়াতে বলা হয়েছে : ‘কোম থেকে এক ব্যক্তি উত্থিত হবে এবং জনগণকে (ইরানী জাতি) সত্যের দিকে আহবান করবে। যে দলটি তার চারপাশে জড়ো হবে তাদের হৃদয় ইস্পাত-কঠিন দৃঢ় হবে এবং তারা এতটা অক্লান্ত ও অকুতোভয় হবে যে, যুদ্ধের প্রচন্ড চাপও তাদের ভীত-সন্ত্রস্ত করবে না এবং তারা যুদ্ধে ক্লান্ত হবে না। তারা সব সময় মহান আল্লাহ্র ওপর নির্ভর করবে। আর শুভ পরিণতি কেবল মুত্তাকী-পরহেজগারদের জন্যই নির্ধারিত।’

তারা (ইরানী জাতি) তাদের অভ্যুত্থান এবং বিপ্লব সফল করার পর তাদের শত্রুদের (পরাশক্তিসমূহের) কাছে অনুরোধ করবে যে, তারা যেন তাদের সার্বিক কর্মকান্ডে হস্তক্ষেপ না করে। কিন্তু তারা এ ব্যাপারে জবরদস্তি করবে।

বর্ণিত হয়েছে : ‘তারা তাদের অধিকার দাবি করবে কিন্তু তাদেরকে তা দেয়া হবে না। তারা পুনরায় তা চাইবে। আবারও তাদের অধিকার প্রদান করা হবে না। তারা এ অবস্থা দর্শন করতঃ কাঁধে অস্ত্র তুলে নেবে এবং তাদের দাবি বাস্তবায়িত না হওয়া পর্যন্ত তারা তাদের সংগ্রাম অব্যাহত রাখবে। (অবশেষে তাদের অধিকার প্রদান করা হবে) কিন্তু এবার তারা তা গ্রহণ করবে না। অবশেষে তারা রুখে দাঁড়াবে এবং তোমাদের অধিপতির (অর্থাৎ ইমাম মাহ্দীর) হাতে বিপ্লবের পতাকা অর্পণ করা পর্যন্ত সংগ্রাম অব্যাহত রাখবে। তাদের নিহত ব্যক্তিরা হবে সত্যের পথে শহীদ।’

বিভিন্ন রেওয়ায়াত অনুসারে অবশেষে তারা তাদের দীর্ঘমেয়াদী যুদ্ধে বিজয়ী হবে এবং যে দু’ব্যক্তির প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে তারা তাদের মাঝে আবির্ভূত হবেন। এ দু’জনের একজন ‘খোরাসানী’ যিনি ফকীহ্ ও মারজা অথবা রাজনৈতিক নেতা হিসাবে এবং অপরজন শুআইব ইবনে সালিহ্ যিনি হবেন শ্যামলা বর্ণের চেহারা ও স্বল্প দাঁড়িবিশিষ্ট এবং রাই অঞ্চলের অধিবাসী তিনি প্রধান সেনাপতি হিসাবে দায়িত্ব পালন করবেন।

ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর কাছে এ দু’ব্যক্তি ইসলামের পতাকা অর্পণ করে তাঁদের সর্বশক্তি নিয়ে তাঁর আন্দোলনে অংশগ্রহণ করবেন। আর শুআইব ইবনে সালিহ্ ইমামের সেনাবাহিনীর সর্বাধিনায়ক নিযুক্ত হবেন। ঠিক একইভাবে বেশ কিছু রেওয়ায়েতে এমন একটি অভ্যুত্থানের কথা বর্ণিত হয়েছে যা সিরিয়ায় উসমান সুফিয়ানীর নেতৃত্বে সংঘটিত হবে। এই উসমান সুফিয়ানী হবে পাশ্চাত্যপন্থী ও ইহুদীদের সমর্থক। সে সিরিয়া ও জর্দানকে একত্রিত করে নিজ শাসনাধীনে নিয়ে আসবে।

এ হচ্ছে এক ধরনের অশুভ ঐক্য যা সুফিয়ানীর মাধ্যমে শামদেশে বাস্তবায়িত হবে। কারণ এর উদ্দেশ্য হবে ইসরাইলের পক্ষে একটি (আরব) প্রতিরক্ষা ব্যূহ এবং ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর হুকুমতের (সরকার ও প্রশাসনের) ক্ষেত্র প্রস্ত্ততকারী ইরানীদের প্রতিরোধ করার জন্য একটি শক্তিশালী ঘাঁটি ও ফ্রন্ট লাইন গড়ে তোলা। এ কারণেই সুফিয়ানী ইরাক দখল করার পদক্ষেপ নেবে এবং তার সেনাবাহিনী ইরাকে প্রবেশ করবে।

‘সে (সুফিয়ানী) এক লক্ষ ত্রিশ হাজার সৈন্য কুফার দিকে প্রেরণ করবে এবং তারা ‘রাওহা’ ও ‘ফারুক’ নামক একটি স্থানে অবতরণ করবে। তাদের মধ্য থেকে ষাট হাজার সৈন্যকে কুফার দিকে প্রেরণ করা হবে এবং তারা নুখাইলায় হযরত হূদ (আ.)-এর সমাধিস্থলে অবস্থান গ্রহণ করবে। আর আমি যেন সুফিয়ানীকে (অথবা তার সহযোগী ও সঙ্গীকে) দেখতে পাচ্ছি যে, সে কুফা ও তোমাদের সুবিস্তৃত ও চিরসবুজ জমিগুলোতে অবস্থান নিচ্ছে। তার পক্ষ থেকে একজন আহবানকারী উচ্চৈঃস্বরে ঘোষণা করতে থাকবে যে, যে ব্যক্তি আলীর অনুসারীদের (কর্তিত) মাথা আনবে তাকে এক হাজার দিরহাম দেয়া হবে। আর এ সময় প্রতিবেশী প্রতিবেশীর ওপর আক্রমণ চালিয়ে বলবে যে, এ ব্যক্তি তাদের অন্তর্ভুক্ত।’

তখন হিজাযে উদ্ভূত রাজনৈতিক শূন্যতা পূরণ করার জন্য সুফিয়ানীকে উদ্বুদ্ধ করা হবে। ইমাম মাহ্দীর সরকার- যার কথা সবার মুখে মুখে আলোচিত হতে থাকবে এবং মক্কা নগরী থেকে যার শুভ সূচনা হবে তা ধ্বংস করার জন্য সুফিয়ানী সরকারকে শক্তিশালী করা হবে।

এতদুদ্দেশ্যে সুফিয়ানী হিজাযে তার সেনাবাহিনী প্রেরণ করবে। তার সেনাবাহিনী মদীনা নগরীতে প্রবেশ করেই সেখানে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করবে। এরপর তারা পবিত্র মক্কাভিমুখে রওয়ানা হবে। ইমাম মাহ্দী (আ.) মক্কা নগরী থেকেই তাঁর আন্দোলন শুরু করবেন। এরপর পবিত্র মক্কা নগরীতে পৌঁছানোর আগেই সুফিয়ানী বাহিনীকে কেন্দ্র করে যে মহা অলৌকিক ঘটনা (মুজিযা) ঘটার প্রতিশ্রুতি মহানবী (সা.) দিয়েছিলেন তা বাস্তবায়িত হবে অর্থাৎ সুফিয়ানী বাহিনী ভূগর্ভে প্রোথিত হয়ে ধ্বংসপ্রাপ্ত হবে।

ইরাকে ইরানী ও ইয়েমেনীদের হাতে পরাজয় বরণ এবং ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর হাতে হিজাযে ভূগর্ভে দেবে যাওয়ার মুজিযা সংঘটিত হওয়ার মাধ্যমে সুফিয়ানী বাহিনীর পরাজয় বরণ করার পর সুফিয়ানী পশ্চাদপসরণ করবে। আর ইমাম মাহ্দী সেনাবাহিনী নিয়ে দামেস্ক ও বাইতুল মুকাদ্দাস (আল কুদ্স) অভিমুখে রওয়ানা হবেন। সুফিয়ানী ইমাম মাহ্দী (আ.)-কে মোকাবিলা করার জন্য শামদেশে তার সেনাবাহিনী সংগ্রহ ও পুনর্গঠনে ব্যস্ত থাকবে।

রেওয়ায়াতসমূহে এ যুদ্ধকে ‘এক মহা বীরত্বপূর্ণ ঘটনা’ বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে যা উপকূলীয় এলাকায় আক্কা থেকে সূর (سور) ও আনতাকিয়াহ্ পর্যন্ত এবং শামের অভ্যন্তরে দামেস্ক থেকে তাবারীয়াহ্ ও কুদ্স পর্যন্ত বিস্তৃত হবে। একইভাবে কতিপয় রেওয়ায়েতে অপর একটি আন্দোলনের কথা উল্লিখিত হয়েছে যা ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর সরকারের ক্ষেত্র প্রস্ত্ততকারী এবং ইয়েমেনে সংঘটিত হবে। এ আন্দোলন ও বিপ্লবের নেতা ইয়েমেনীকে এ সব রেওয়ায়েতে ভূয়সী প্রশংসা করা হয়েছে এবং তাঁকে সাহায্য করা মুসলমানদের ওপর ওয়াজিব বলে গণ্য করা হয়েছে :

‘পতাকাসমূহের মধ্যে ইয়েমেনীদের পতাকার চেয়ে হেদায়াতকারী আর কোন পতাকা নেই। ইয়েমেনীর আবির্ভাব ও উত্থানের পর জনগণের কাছে অস্ত্র বিক্রি করা হারাম হয়ে যাবে। আর যখন সে আবির্ভূত হবে এবং আন্দোলন করবে তখন তাকে সাহায্য করার জন্য দ্রুত ছুটে যাবে। কারণ, তার পতাকা হবে হেদায়াতের পতাকা। তার বিরোধিতা করা কোন মুসলমানের জন্য জায়েয হবে না। যদি কোন ব্যক্তি এ কাজ করে তাহলে সে জাহান্নামে প্রবেশ করবে। কারণ, ইয়েমেনী জনগণকে সত্য ও সৎ পথের দিকে আহবান জানাবে।’

অনুরূপভাবে কতিপয় রেওয়ায়াতে ইয়েমেনী ও সুফিয়ানী বাহিনীর আবির্ভাবের আগে একজন মিসরীয় ব্যক্তির আন্দোলনের কথা বর্ণিত হয়েছে। আবার মিসরীয় সেনাপ্রধানের নেতৃত্বে পরিচালিত আরেকটি আন্দোলন এবং মিসরের আশপাশের কিবতীদের পরিচালিত তৎপরতার কথাও ঐ সব রেওয়ায়েতে বর্ণিত হয়েছে। এরপর ঐ সব রেওয়ায়াত মিসরে পাশ্চাত্য অথবা মাগরিবী (মরক্কো, আলজেরিয়া, তিউনিসিয়া ও লিবিয়ার সাথে সংশ্লিষ্ট) সেনাবাহিনীর অনুপ্রবেশ এবং এর পরপরই শামদেশে সুফিয়ানীর আবির্ভাব ও উত্থানের কথা আমাদেরকে অবহিত করে।

তবে অনেক রেওয়ায়াত অনুযায়ী মুসলিম দেশ মাগরিবের (মরক্কো ও পার্শ্ববর্তী দেশসমূহ) সেনাবাহিনী শাম ও মিসরে প্রবেশ করবে। এদের একটি অংশ ইরাকেও প্রবেশ করবে। তাদের ভূমিকা হবে বাধাদানকারী আরব অথবা আন্তর্জাতিক বাহিনীর ভূমিকার ন্যায়। তাই তারা ইসলাম ও মুসলমানদের স্বার্থ সংরক্ষণকারী হবে না; বরং এ বাহিনী শামে ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর সরকারের ক্ষেত্র প্রস্ত্ততকারীদের এবং ইরানী সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হবে। এরপর তারা জর্দানের দিকে পশ্চাদপসরণ করবে এবং তাদের অবশিষ্টাংশ সুফিয়ানীর অভ্যুত্থানের পর পশ্চাদপসরণ করবে অথবা তার সাথে যোগ দেবে। অতঃপর তারা মিসরীয়দের আন্দোলন ও গণঅভ্যুত্থানের সম্মুখীন মিসর সরকারের সাহায্যার্থে অথবা শামে সুফিয়ানীর উত্থানের প্রাক্কালে যে পাশ্চাত্য-বাহিনী মিসরে প্রবেশ করবে তাদেরকে সাহায্য করার জন্য মিসরের দিকে দ্রুত অগ্রসর হবে।

ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর আবির্ভাবের যুগের সাথে সংশ্লিষ্ট রেওয়ায়াতটি আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে, শেষ যামানায় ইহুদীরা পৃথিবীর বুকে ফিতনা সৃষ্টি এবং দম্ভ প্রকাশ করবে। তারা নিজেদের সকলের চেয়ে শ্রেষ্ঠ বলে মনে করবে। মহান আল্লাহ্ পবিত্র কুরআনে তাদের এ বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করেছেন। তাদের দম্ভ এবং শ্রেষ্ঠত্ব অন্বেষী মনোবৃত্তি ঐ সব পতাকাবাহীর হাতে চূর্ণ হয়ে যাবে যারা খোরাসান (ইরান) থেকে বের হবে।

‘ইসলামের ঝান্ডাসমূহ আল কুদ্সে পত্পত্ করে ওড়া পর্যন্ত তাদেরকে (খোরাসানীদের) তাদের সিদ্ধান্ত থেকে কোন কিছুই বিরত রাখতে পারবে না।’

কতিপয় রেওয়ায়াত অনুসারে ইমাম মাহ্দী (আ.) আনতাকিয়ার একটি গুহা, ফিলিস্তিনের একটি পাহাড় এবং তাবারীয়ার হ্রদ থেকে তাওরাতের আসল কপিগুলো বের করে আনবেন। তিনি তাওরাতের সেই সব কপির ভিত্তিতে ইহুদীদেরকে দোষী সাব্যস্ত করবেন এবং তাদের কাছে নিদর্শন ও মুজিযাসমূহ স্পষ্ট করে প্রকাশ করবেন।

আল কুদ্স মুক্ত করার যুদ্ধের পর যে কিছু সংখ্যক ইহুদী বেঁচে যাবে তারা ইমাম মাহ্দীর কাছে আত্মসমর্পণ করবে এবং যারা আত্মসমর্পণ করবে না তাদেরকে আরব দেশগুলো থেকে বিতাড়িত করা হবে।

রেওয়ায়াতসমূহ থেকে প্রতীয়মান হয় যে, ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর আবির্ভাবের কিছু দিন পূর্বে রোমান ও তুর্কীদের মধ্যে অর্থাৎ পাশ্চাত্য ও রাশিয়ার মধ্যে একটি বিশ্বযুদ্ধ সংঘটিত হবে যার সূত্রপাত হবে পূর্ব দিক হতে। আরও কিছু সংখ্যক রেওয়ায়াত থেকে এটি স্পষ্ট হয়ে যায় যে, উপরিউক্ত যুদ্ধ আসলে একাধিক আঞ্চলিক যুদ্ধ আকারে সংঘটিত হবে।

ঠিক একইভাবে আরও কিছু সংখ্যক হাদীস থেকে জানা যায় যে, এ যুদ্ধের ফলে সংঘটিত জান-মালের ক্ষয়ক্ষতি ছাড়াও তার আগে ও পরে সমগ্র বিশ্বব্যাপী যে প্লেগ বা মহামারী দেখা দেবে তাতে বিশ্বের মোট জনসংখ্যার দুই-তৃতীয়াংশ ধ্বংস হবে। তবে পরোক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া ব্যতীত মুসলমানগণ সরাসরি এ ক্ষয়ক্ষতির শিকার হবে না।

কিছু কিছু রেওয়ায়াতে ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, এ যুদ্ধ বেশ কয়েকটি ধাপে সংঘটিত হবে। আর ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর আবির্ভাব, তাঁর হিজায মুক্তকরণ এবং ইরাকে তাঁর প্রবেশ করার পরই এ যুদ্ধের সর্বশেষ পর্যায় এসে যাবে।

অনুবাদ : মোহাম্মাদ মুনীর হোসেইন খান

[ড. জহির উদ্দিন মাহমুদ কর্তৃক প্রকাশিত, লেবাননের বিশিষ্ট আলেম আল্লামা আলী আল কুরানী প্রণীত ‘আস্্রে যুহুর’ গ্রন্থের বাংলা অনুবাদ গ্রন্থ ‘ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর আত্মপ্রকাশ’ থেকে সংকলিত।]

সৌজন্যে : প্রত্যাশা, একটি মানব উন্নয়ন বিষয়ক ত্রৈমাসিক, বর্ষ ২, সংখ্যা ১

[1]. এ শহর এবং এ শহরের প্রসিদ্ধ হ্রদটি জবরদখলকৃত ফিলিস্তিনে অবস্থিত।

[2]. জবরদখলকৃত ফিলিস্তিনের একটি এলাকার নাম।

বিষয়: বিবিধ

১৪৫৮ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File