সফলতার সংবর্ধনা
লিখেছেন লিখেছেন খালেদ সাইফুল্লাহ ১১ মার্চ, ২০১৬, ০৯:৪৬:৫৭ রাত
পিটপিট করে চোখ খুললো হামিদ। ধীরে ধীরে উঠে বসার চেষ্টা করলো। শরীরে একটুও শক্তি পাচ্ছে না সে। কেমন যেন অসার মনে হচ্ছে সব কিছু- যেন হাত পা কিছুই তার নেই, কোন দিনই ছিল না। চোখ দুটো কেন জানি বিদ্রোহ করছে। ভালো করে দেখতেও পাচ্ছে না।
কতক্ষন পড়েছিলো তা মনে নেই হামিদের। শুধু এতটুকুই মনে আছে-সব কিছু অন্ধকার হয়ে যাবার আগে তারা তার মাথাটা একটা ইটের উপর রেখেছিল। বেশ আরাম লাগছিলো তখন। মনে হচ্ছিল, বাহ, এরা খারাপ হলেও মানুষ ভালো। তার কষ্ট দেখে একটা বালিশের ব্যবস্থা করেছে। কিন্তু না, তার আরামের চিন্তা শেষ হবার আগেই আরেকটা ইট তার মাথার উপর নেমে এসেছিল প্রচন্ড গতিতে। ভোতা এক ধরনের শব্দ হল। তারপর সব শেষ-আর কিছু মনে নেই। অন্ধকার নেমে এসেছিল চারদিকে।
“হামি.. দ, হামি…ই….দ......”
কে?? কে ডাকে? এতো মমতা নিয়ে তাকে ডাকে? নিষ্ঠুর পৃথিবীতে এখনো মানুষ মায়া মাখা সুরে ডাকতে পারে? চমকে উঠে হামিদ। চোখ রগড়ে দেখার চেষ্টা করে সে। নাহ, কিছুই দেখতে পাচ্ছে না। চোখের সামনে কেমন যেন কালো এক ধোয়াশা। মনে হচ্ছে আইবল দুটো তার জায়গা মত নেই। লাফ দিয়ে বাইরে চলে এসেছে।
“হামি.. দ, হামি…ই….দ...... উঠো, আমরা তোমাকে নিয়ে যেতে এসেছি”
আবার সেই ডাক! অপরিচিত, কিন্তু মন চাইছে ছুটে যেতে। কেমন যেন পাগল করা এক সম্মোহন! মনে হচ্ছে তার শরীরে শক্তি ফিরে আসছে সে ডাকে। চোখের সামনের ধোয়াশা কেটে যাচ্ছে। হ্যা, ঐ তো, সে মনে হয় তাদের দেখতে পাচ্ছে এবার। সাদা পোষাকে আবৃত দীর্ঘ এক আবয়ব, উজ্জলতা ঠিকরে পড়ছে তাদের চেহারা থেকে। এক জন নয়, দুই জন নয়.........তিন, চার, নাহ, আর গোনা সম্ভব হচ্ছে না। অসংখ্য, অগণিত। যেন একটা মিছিল!
কিন্তু এরা কারা? সে তো এদের চিনতে পারছে না। কখনো এদের দেখেছে বলে মনে হচ্ছে না। হটাত হাসি পেল হামিদের। কি বোকার মত চিন্তা করছে সে! এদের চিনবে কিভাবে? তার তো মগজই নেই। সে গুলো ছিটকে বেরিয়ে গেছে। মগজ না থাকলে স্মৃতিশক্তি থাকে না। কি জোরে আঘাতই না করেছিলো! ইটের আঘাত যে এতোটা ভয়ঙ্কর তা তার জানা ছিলো না। হবে না, মাথার নিচে যে আরেকটা ইট দিয়ে রেখেছিলো। তারপর অন্য আরেকটা ইট দিয়ে উপর থেকে প্রচন্ড আঘাত করেছিলো। সব বেরিয়ে গেছে। কিচ্ছু নেই মাথায়, একেবারে বিলকুল খালি।
ওই তো দেখা যাচ্ছে- তার মগজ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। বিএনসিসি ক্যান্টিনের দেয়ালে, চেয়ারের হাতলে, মেঝেতে ছড়িয়ে আছে। খাবলা খাবলা মগজ। টাটকা খাটি মগজ। ছোট বেলায় গরুর মগজ ভাজি তার খুব প্রিয় ছিল। আব্বাকে প্রায় বলতো গরুর মগজ নিয়ে আসবার জন্য। আব্বা নিয়ে আসতো, আর আম্মা সে গুলো খুব যত্ন করে ভুনা ভুনা করে ভাজি করতো। এখনো জিভে তার স্বাদ লেগে আছে।
আচ্ছা, মানুষের মগজের স্বাদ কেমন? সে কি খাওয়া যায়? নিশ্চয় যায়। ওরা খায়। তা না হলে তারা তার মাথা ফাটিয়ে মগজ বের করলো কেন? তারা রক্ত খেয়েই শান্ত হতে পারতো। রক্ত তো আর কম খায়নি। তার শরীরে এমন কোন জায়গা নেই যেখানে ছুরি, কিরিচ, রামদার আঘাত নেই। ওরা তার শরীরটাকে ফালা ফালা করে ফেলেছে রক্তের নেশায়। হামিদের মনে আছে, স্রোতের মত রক্ত বেরিয়েছিল। ভুল, স্রোত নয়, ফিনকি দিয়ে রক্ত ছুটেছিলো। লাল টাটকা রক্ত। তার রক্তে কোন ভেজাল নেই। কারন সে কোন নেশা করতো না। নিশ্চয় ওরা অনেক পুষ্টি পেয়েছে তার রক্ত পান করে।
কিন্তু এখনো একটা জিনিষ হামিদের বুঝে আসছে না। সে শুনেছে বনের হিংস্র জন্তুরা ঘাড় মটকে রক্ত খায়। তাজা রক্ত তাদের প্রিয় খাদ্য। কিন্তু এরা খেলো কেনো? এদের চেহারা তো তার মতই ছিলো। তাহলে কি এরা মানুষ রুপী কোন পশু অথবা হায়েনা? যারা তার মত নিরীহ মানুষদের রক্ত পান করে? কোন উত্তর নেই হামিদের কাছে।
“হামিদ, এসো, দেরী হয়ে যাচ্ছে”
চিন্তার জাল ছিড়ে যায় হামিদের। সে দেখে সাদা মিছিলটি তার অনেক কাছে চলে এসেছে।
‘না, না, আমি যাব না। আমি কেন যাব? বিশ্বাস করুন আমি কোন অপরাধ করিনি। আমি শুধু মানুষকে ভালো কথা বলতাম। নামাজ পড়ার কথা বলতাম। আমি কারো ক্ষতি করিনি। কাউকে কষ্ট দেইনি। দেখুননা, ঐ পশুরা আমাকে হত্যা করেছে। আমার রক্ত পান করেছে। ওরা আরো অনেক মানুষ মেরেছে। মেরে মাথার ঘিলু খেয়েছে। আমাকে কেনো নিয়ে যাবেন? ওদের নিয়ে যান।’ এক টানা কথা গুলো বলে হাপিয়ে উঠে হামিদ। তার বুক কাপছে। হার্ট জোরে জোরে পাম্প করছে আর বুকের ছিদ্র দিয়ে গল গল করে আবার রক্ত বেরিয়ে আসছে। কি ব্যাপার! বুকে ছিদ্র এল কোথেকে? ওহ, মনে পড়েছে, চে গুয়েভারা টি শার্ট পরা একটা ছেলে তার বুকে পা চেপে ধরে বলেছিলো, ‘বল শালা! আর কুরআনের কথা বলবি কিনা? ঐ বস্তা পচা কাহিনী ছাত্রদের না শোনালে তোকে ছেড়ে দেবো।’
জবাবে সে যেই না বললো, ‘আমি যে সত্য পেয়েছি, আমি যে আলো পেয়েছি, তা থেকে আমি দূরে থাকতে পারবো না’ ওমনি ঘ্যাচ করে হাতের ছোরাটা তার বুকে বসিয়ে দিলো ছেলেটি। তখন বুঝেনি যে তার হার্ট ফুটো হয়ে গেছে। এখন বুঝতে পারছে।
“হামিদ, দুঃখ করছো কেনো? তুমি তো তোমার জান ও মাল আল্লাহর কাছে বিক্রয় করে দিয়েছিলে জান্নাতের বিনিময়ে। তোমার ব্যবসা লাভজনক হয়েছে। চেয়ে দেখো, ফেরেশতারা তোমাকে নিতে এসেছে। তুমি উঠো। দেরি করো না। তুমি দেরি করলে ওরা আরো আসবে। পৃথিবী ভরে ফেলবে। ওদের এখন অনেক কাজ। হাউজে কাউসারে তোমার গোসলের ব্যবস্থা হচ্ছে। জান্নাতের বাগিচায় তোমার সংবর্ধনার আয়োজন চলছে। উঠো... চলে এসো আমাদের সাথে............এ...সো............ ওরা অ...পে......ক্ষা করছে...............”
সহসা হামিদের মনে পড়লো প্রিয় সেই আয়াতটি, “ওয়াসি কল্লাজি নাত্তাকাও রব্বাহুম ইলাল জান্নাতী ঝুমারাহ, হাত্তা ইজা জা উহা ওয়া ফুতিহাত আবওয়াবুহা, ওয়া ক্বলা লাহুম খাজ্বানাতুহা, সালামুন আলাইকুম তিবতুম, ফাদ খুলুহা খল্বিদীন”
সাথে সাথে এক স্নিগ্ধ অপার্থিব সুঘ্রান তার হৃদয় মন আলোড়িত করে তুললো। পরম আবেশে বন্ধ হয়ে এলো চোখ দুটি। ঠোটে ফুটে উঠলো এক অনাবিল হাসি। যে হাসি সাক্ষ্য দিচ্ছে, অবশ্যই হামিদেরা সফলকাম হয়েছে।
(১১ মার্চ শহীদ দিবস। শহীদ আব্দুল হামিদ স্মরনে রচিত।)
বিষয়: সাহিত্য
১৩২৪ বার পঠিত, ৩ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
ভাই আমার, আমি সবে মোট আপনার দুইটা লেখা পড়েছি। সত্যিই আপনি চমৎকার লিখেন, যার প্রতিটি লাইন, কথা অত্যন্ত হৃদয়গ্রাহী। আল্লাহ্ আপনার লিখার হাতকে প্রসারিত করুন।
শহীদ আব্দুল হামিদসহ সকল শহীদদের আল্লাহ্ উত্তম প্রতিদানে ধন্য করুন।
মন্তব্য করতে লগইন করুন