ছোট গল্পঃ দারিদ্রের উপহাস
লিখেছেন লিখেছেন খালেদ সাইফুল্লাহ ১০ মার্চ, ২০১৬, ০৩:৪৬:২৫ দুপুর
দুপুরে খাওয়া দাওয়া করে বিছানায় চিত হয়ে শুয়ে আছে কায়েস। মাথার উপরে সিলিং ফ্যান ঘুরছে বন বন করে। ফ্যানের সাথে পাল্লা দিয়ে ঘুরছে তার মাথাও। কি করবে এখন সে? ঝড়ের প্রবল ঝাপটার পর সব কিছু যেমন সুনসান হয়ে যায়, তাদের জীবনটাও যেন তেমন নিশ্চল হয়ে গেছে। এক এক করে সব কিছু বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। এই যে ফ্যানটি ঘুরছে সেটিও যে কোন মুহূর্তে বন্ধ হয়ে যেতে পারে। যেকোন সময় লাইন ম্যান এসে লাইন কেটে দিয়ে যাবে। লাইন ম্যানের আর কি দোষ? তিন মাসের বিদ্যুত বিল বাকি।
ছোট ভাই ঢাকায় পড়াশোনা করে। ঠিক মত খাওয়া হচ্ছে না। তার মেসের খাওয়ার টাকা বাকি।
ছোট বোন স্কুলে যেতে চায় না। স্যার নাকি সবার সামনে দাড় করিয়েছিল। স্কুলের বেতন বাকি।
চুলায় তিন বেলা আগুন জ্বললেও ঠিক মত হাড়ির রসদ জুটছে না। দোকানে অনেক বাকি।
বড় বোন সরকারী প্রাইমারী স্কুলের শিক্ষিকা। তার চেহারা শুকনা। চার মাস বেতন বাকি।
বাইরে আম্মার সাথে দুধ ওয়ালা চেচামেচি করছে। ছোট ভাগ্নার জন্য রোজ এক পোয়া দুধ দিয়ে যায় সে। আজ দিতে চাচ্ছে না। দুধের টাকা বাকি।
পাশের ঘরে আব্বা শুয়ে আছেন। ঝড়ে বিদ্ধস্ত চেহারা। পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে চাকুরী, ব্যবসা সব হারিয়েছেন। পুরো সংসারটাই তার কাছে বাকি।
নিজের কথা মনে হল কায়েসের। আজ কত দিন বাড়িতে বসে আছে। হোস্টেলে যেতে পারছে না। যাওয়ার ভাড়া টুকুও তার কাছে নেই। ভাড়া থাকলেও যাওয়ার মুখ নেই। বন্ধু বান্ধবদের কাছে অনেক বাকি।
আগে কিছু টিউশনি করতো। সেগুলো এখন নেই। এই মুহূর্তে একটা প্রবাদই তার মনে পড়ছে, “অভাগা যেদিকে চায়, সাগর শুকিয়ে যায়।”
রিং বেজে উঠলো ফোনের। কায়েস চোখের সামনে যন্ত্রটা নিয়ে ইনকামিং নাম্বার টা দেখলো এবং রেখে দিলো। এই এক যন্ত্রনা। কেন যে মোবাইল আবিষ্কার হয়েছিল! আবিষ্কারকের উপর এই মুহূর্তে তার খুব রাগ হচ্ছে। যদি এই এখন তাকে সামনে পেতো তাহলে আর কিছু না হোক তার কলার ধরে কৈফিয়ত চাইতো, ঐ ব্যাটা? আর কিছু পাস নাই আবিষ্কার করতে?
উদ্ভট চিন্তা করতে করতে নিজেই হেসে ফেললো কায়েস। ব্যাটা বিজ্ঞানীর আর কি দোষ? দোষ তো তার ব্যালেন্সের। মোবাইলে ব্যালেন্স নেই। তাই সুনয়নার ফোনটাও ধরা গেলো না। ধরা গেল না এটা ঠিক না, ধরতে ইচ্ছা করলো না। আজকাল তার ফোন ধরতে ভীষন হীনমণ্যতায় ভোগে কায়েস। খালি সুননয়নাই ফোন দিয়ে যায়। সে ফোন দিতে পারে না। নিজের কাছে দিন দিন ছোট হয়ে যাচ্ছে সে। যদিও এ ক্ষেত্রে সুনয়না কিছুই মনে করে না। মেয়েটির প্রশংসা করতেই হয়। সব কিছু বুঝে সে পরিস্থিতিকে মেনে নিয়েছে। ধৈর্য্য ধরে অপেক্ষা করছে মেয়েটি, সুদিন অবশ্যি আসবে একদিন।
নাহ, আর চিন্তা করতে পারছে সে। চিন্তা করতে করতে তার তন্দ্রা মত এসে গিয়েছিল। তন্দ্রার মধ্যে স্বপ্ন দেখতে শুরু করলো, সে বিশাল বড় একটা অফিসে বসে আছে। তার সামনে একটা বিরাট টেবিল। টেবিলের ওপর পাশে ভারী কিন্তু হাসি মাখা চেহারার কেতাদুরস্ত একজন ভদ্র লোক বসে আছেন। ইনি নাকি এ শহরের নাম করা মনরোগ বিশেষজ্ঞ, প্রফেসর। কায়েস এই মুহূর্তে তার কাছে কিভাবে এলো, কেনো এলো সেটা মনে করতে না পারলেও সে দুম করে একটা প্রশ্ন করে বসলো বিশিষ্ট মনরোগ বিশেষজ্ঞ কে, ‘আচ্ছা, আপনি বলতে পারেন তন্দ্রা ও ঘুমের মধ্যে পার্থক্য কি? নাকি দুটোই একই জিনিষ?’
কায়েসের প্রশ্ন শুনে তিনি কিছুক্ষন চোখ বন্ধ করে রাখলেন। মনে হয় ভেবে নিলেন কি বলবেন। ‘আসলে তন্দ্রা হচ্ছে ঘুমের প্রথম অংশ। অর্থাৎ ঘুম ঘুম ভাব। তন্দ্রার মধ্যে মানুষ স্বপ্ন দেখে। এ অবস্থায় ঘুম আসতেও পারে নাও পারে। আর ঘুম হচ্ছে তন্দ্রার পরের অংশ। খাটি বাংলায় গভীর ঘুম। তুমি এখন তন্দ্রার মধ্যে আছো। কিন্তু আমি তোমার ঘুম আসতে দেবো না। কারন আমার ইনভেস্টিগেশন এখনো শেষ হয় নি।’
কায়েসের মনে হল সে আর শুনতে পাচ্ছে না। তাহলে কি সে ঘুমিয়ে পড়ছে? হটাত মনে হল প্রফেসর সাহেব তার কাধে ধাক্কা দিচ্ছেন। ‘কি ব্যাপার কায়েস, ঘুমিয়ে পড়লে নাকি?’
তন্দ্রাহত ব্যক্তির মত লাফ দিয়ে উঠে বসলো কায়েস। কোথায় প্রফেসর আর তার অফিস? সে তো তার ঘরেই খাটের উপর বসে আছে আর তার বড় বোন মায়মুনা তাকে ডাকছে, ‘কায়েস, কায়েস? উঠ উঠ।’
‘কি ব্যাপার আপা? কখন এলি স্কুল থেকে?’ আলসেমী ভঙ্গীতে কায়েস বলে।
‘দেখতো এই এসএমএস টা ঠিক দেখছি কিনা?’ মায়মুনা তার ফোনটা ভায়ের দিকে এগিয়ে দেয়।
‘কই দেখি.........’ বলে ফোনটা হাতে নিয়ে পড়তে শুরু করে কায়েস।
“Dear IBBL Customer, Your A/C No.105 **45002** balance Tk.55152.00 on 31-Dec-2015. Pls confirm us within 15 days.
Islami Bank.”
বিস্মিত দৃষ্টি নিয়ে বোনের দিকে তাকিয়ে কাপা কাপা স্বরে জিজ্ঞাসা করলো কায়েস, ‘তুই কি বেতন পেয়েছিস?’
বোনের মুখের মিষ্টি ঝিলিক দেখে কায়েসের আর বুঝতে বাকি থাকে না। মনের অজান্তেই বলে উঠে ‘আলহামদুলিল্লাহ’
মায়মুনা চারমাস পরে বেতন পেলো। মুহূর্তে হারানো খুশি আর প্রাণ ফিরে এলো ঘরে।
কায়েস দেখতে পেলো মা আর আপা মিলে সংসারে কি কি লাগবে ঠিক লিস্টি করা শুরু করেছে। তাদের পাশে বসে সে শুনতে থাকে......
ছোট ছেলে-৩০০০ টাকা
বাড়ি ভাড়া-৫০০০ টাকা
ঋন পরিশোধ-৯৫০০ টাকা
চাল কেনা-২০০০ টাকা
ছোট মেয়ের স্কুল-৯০০ টাকা
দোকানীর পাওনা-৫১০০ টাকা
বিদ্যুত বিল-১২০০ টাকা
মায়মুনা বললো, ‘আব্বার চাকরী নেই। তার হাতে কিছু টাকা দেয়া দরকার।
লিস্টে আবার যোগ হল-
কায়েসের আব্বা-১৫০০ টাকা
হটাত আম্মা কায়েসের দিকে ফিরে বললো, ‘তোর কত লাগবে রে?’
‘আপাতত হাজার তিনেক দিলে চলবে।’ মাথা চুলকে বললো কায়েস।
লিস্টে আবার যোগ হল-
কায়েস -৩০০০ টাকা
মোট= ৩১২০০ টাকা
‘আম্মু, আমার স্কুল ড্রেস ছিড়ে গেছে। আমার জামা বানিয়ে দিতে হবে।’ পাশ থেকে ছোট বোন বলে উঠলো।
‘তাহলে আমাল জুটা কিনে দিটে হবে।’ পিচচি ভাগ্নাটাও বাদ পড়তে চাইলো না। মনে হচ্ছে এতো দিন অভাব সবার মুখে বাধ দিয়ে রেখেছিল। টাকার স্রোত না আসলেও সামান্য রহমতের বৃষ্টিতে সে বাধ আজ ধ্বসে পড়ছে।
আম্মা বললেন, ‘কায়েস, তাহলে এটিএম বুথ থেকে ৩৪০০০ টাকা তুলে নিয়ে আয়, যা। কিছু টাকা হাতে রাখা দরকার। সব খরচ করলে সামনে আবার কষ্ট করতে হবে।’
‘আচ্ছা যাচ্ছি’ বলে খুশি মনে উঠলো কায়েস। তার ভীষন ভালো লাগছে। কতদিন পর সবার মুখে হাসি ফুটেছে।
হটাত কায়েস মাকে জিজ্ঞাসা করলো, ‘আম্মা, রাতে কি রান্না করবে?’
‘রাতে কোন বাজার নেই। কিছু ভাঙ্গা চাল আছে। তাই দিয়ে ক্ষীর রেধে দেবো।’
‘না, শুধু ক্ষীর ভালো লাগে না। আপা অনেক দিন পর বেতন পেয়েছে। আজকে পোলাও মুরগী খাবো।’ অনেকটা দাবীর সুরে বললো কায়েস।
‘আচ্ছা ঠিক আছে। বাজার থেকে আসার সময় একটা মুরগী আর কিছু পোলাওয়ের চাল নিয়ে আসিস।’ মধ্যস্ততা করে দিলো মায়মুনা।
‘আমি এখনি রেডি হচ্ছি।’
‘আমার না এখনো বিশ্বাস হচ্চে না বেতন পেয়েছি। তুই আর এক বার ভালো করে দেখবি কায়েস?’ সন্দেহ সংশয় মাখা দৃষ্টিতে বললো মায়মুনা।
কায়েস কিছু না বলে বোনের মোবাইলটা আবার হাতে নিলো। SMS টা আবার বের করে পড়তে শুরু করলো.........
“Dear IBBL Customer, Your A/C No.105 **45002** balance Tk.55152.00 on 31-Dec-2015. ........................ এই পর্যন্ত পড়েই থমকে গেলো কায়েস। মাথার মধ্যে চক্কর দিয়ে উঠলো তার। কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে ভাবতে লাগলো এখন কি বলবে সে। তার হতভম্ব দৃষ্টির দিকে তাকিয়ে মায়মুনা শংকিত হয়ে জিজ্ঞাসা করলো, ‘কি ব্যাপার? কথা বলছিস না কেন? কি হয়েছে?’
কায়েস ফোনটা বোনের দিকে এগিয়ে দিয়ে ছোট করে বললো, ‘দেখ।’
মায়মুনা নিজে আবার পড়লো,
“Dear IBBL Customer, Your A/C No.105 **45002** balance Tk.55152.00 on 31-Dec-2016.
‘তো কি হইছে?’ জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালো মায়মুনা।
‘আপা আজ ১লা মার্চ ২০১৬’ ধরা গলায় বললো কায়েস।
ধপ করে বিছানায় বসে পড়লো মায়মুনা। তার স্পষ্ট মনে পড়ছে, গত বছর ডিসেম্বর মাসে ৫৫০০০ টাকা লোন নিয়েছিলো ব্যাংক থেকে ছোট ভায়ের চিকিতসার জন্য। এটা তখনকার একাউন্ট ব্যালেন্স হিসাব।
মুহূর্তে স্তব্ধতায় ছেয়ে গেলো গোটা বাড়ি। শুধু ছোট বোনের ফিস ফিস শব্দ শোনা গেলো, ‘আম্মু, চলেন ক্ষীর চুলায় চাপিয়ে দিই। একটু গুড় দিলে ভালোই লাগবে খেতে।’
বিষয়: সাহিত্য
১৪০০ বার পঠিত, ৭ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন