গল্পঃ আত্মাভিমানী কন্যা
লিখেছেন লিখেছেন খালেদ সাইফুল্লাহ ০৯ মার্চ, ২০১৬, ০৯:৫০:০২ রাত
(১)
বসরার গভর্নরের মহল।
প্রশস্ত এক কক্ষ।
কক্ষের মেঝেতে তুর্কিস্থানের এক বিশাল মানচিত্র বিছানো। উটের পাকা চামড়ায় দক্ষ হাতে আকা মানচিত্রের বিভিন্ন স্থাপনা, কেল্লা আর সেনা চৌকির অবস্থান যাচাই করছেন বয়োবৃদ্ধ এক ব্যক্তি। নিবিষ্ট মনে পর্যবেক্ষনের মাঝে মাঝে তরবারীর তীক্ষ্ম আগা দিয়ে মানচিত্রের বুকে আকছেন নতুন নকশা। জলদ গম্ভীর সে মুখের দিকে তাকালে মনে হবে ইনি কারো হুকুম শোনার জন্য পয়দা হননি, বরং তার জন্ম হুকুম দেয়ার জন্যই। ইনি আর কেউ নন। খলীফা ওলীদের প্রতাপশালী গভর্নর, বসরার শাসনকর্তা হাজ্জাজ বিন ইউসুফ।
স্বশব্দে খুলে গেলো রুদ্ধ কক্ষের দ্বার। খোলা দরজায় দাঁড়িয়ে দ্বার রক্ষী সেনাপতি কুতায়বার দূতের আগমন সংবাদ দিলো। ইশারায় দূত কে ভিতরে নিয়ে আসতে বললেন হাজ্জাজ বিন ইউসুফ। (সেনাপতি কুতায়বা তুর্কিস্থানে জিহাদে লিপ্ত ছিলেন।)
কিছুক্ষণ পর দৃপ্ত পদক্ষেপে বর্ম পরিহিত পনের-ষোল বছরের এক যুবক প্রবেশ করল কক্ষে। তার মস্তকে শোভা পাচ্ছিল তাম্র নির্মিত শিরস্ত্রান। দৃঢ় গঠন, দীপ্ত নয়ন এবং হালকা অথচ বদ্ধ ওষ্ঠ এক অসাধারণ দৃঢ়তা ও মনোবলের পরিচয় দিচ্ছিল। কোমরে বাধা তরবারী যেন প্রকাশ করছিল এ শুধু অত্যাচারীর খুন ঝরাতেই জানে।
পদশব্দে ঘাড় ঘুরিয়ে পিছনে তাকালেন হাজ্জাজ বিন ইউসুফ। কিন্তু হটাত ভুত দেখার মত চমকে উঠলেন তিনি। রুষ্ঠ অথচ পরিহাসের কন্ঠে বললেন, আমি কুতায়বাকে একজন অভিজ্ঞ সেনাপতি প্রেরণ করতে বলেছিলাম। আর সে আমাকে আট বছরের বালককে পাঠিয়ে দিয়েছে!
কুতায়বার দূত জবাব দিল, আমার বয়স ১৬ বছর ৮ মাস। আপনি যাকে পাঠাতে বলেছেন আমি সেই।
শ্লেষের কন্ঠে হাজ্জাজ বিন ইউসুফ বললেন, তুমি কুতায়বার শ্রেষ্ঠতম সেনাপতি? আর কুতায়বার সাথে তোমার সম্পর্কই বা কী?
যুবক যথাসম্ভব শান্ত কিন্তু দৃঢ় স্বরে জবাব দিল, শ্রেষ্ঠতম সেনাপতি হওয়ার জন্য যদি কোন সম্পর্ক থাকা লাগে তাহলে শুনে রাখুন আমরা উভয়েই মুসলমান।
যুবকের স্পষ্ট ভাষনে প্রভাবিত হয়ে হাজ্জাজ বিন ইউসুফ বললেন, আমাকে বুঝিয়ে দাও, যে সৈন্য বাহিনী হিরাতের ন্যায় সামান্য নগর জয় করতে অক্ষম, সে বোখারার মত দৃঢ় ও শক্তিশালী শহর কিভাবে জয়ের আশা করে? ওহ, আগে বল তুমি মানচিত্র পাঠ করতে জান তো?
যুবক কোন প্রশ্নের জবাব না দিয়েই সম্পূর্ণ যুদ্ধ কৌশল এমন ভাবে মানচিত্র ধরে ধরে বুঝালেন যে কিছুক্ষন পরেই হাজ্জাজ বিন ইউসুফ অনুভব করতে বাধ্য হলেন তিনি কুতায়বার এক শ্রেষ্ঠ সেনাপতি ও সমর বিশারদের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। এ যুবকের সামনে তার আরো সাবধানে কথা বলা প্রয়োজন।
যুদ্ধ পরিকল্পনা বর্ণনা শেষ হলে বিস্মিত গভর্নর প্রশ্ন করলেন, তুমি কোন গোত্রের লোক?
যুবক উত্তর দিল, আমি সাকাফি।
হয়রান হয়ে হাজ্জাজ বললেন, তুমি সাকাফি?? তোমার নাম কী?
যুবক উত্তর দিল, মুহম্মদ ইবনে কাশিম।
হাজ্জাজ চমকে বললেন, কাশিমের পুত্রের কাছে আমি এটাই আশা করেছিলাম। তুমি আমাকে চিন?
আপনি বসরার গভর্নর।
হাজ্জাজ বিন ইউসুফ সাথে আরো যোগ করলেন, আমি বসরার গভর্নর এটা যেমন ঠিক, তেমনি তোমার চাচা এটাও ঠিক। তুমি আমার ভ্রাতুস্পুত্র।
যুবক সহজ কন্ঠে জবাব দিলো, আমি জানি।
(আসলে হাজ্জাজ বিন ইউসুফ প্রতাপশালী শাষক ও তার হাতে অনেক এলাকা বিজিত হলেও তার নিষ্ঠুরতা তার ভাইকে হাজ্জাজ পরিবারের সাথে যোগাযোগ না রাখতে বাধ্য করে। তাই কাসিম কে তিনি চিনতে পারেন নি।)
(২)
পরদিন।
বসরার দরবার হল।
গভর্নরের আসনে আসীন হাজ্জাজ বিন ইউসুফ।
তার সামনে দন্ডায়মান মুহম্মদ ইবনে কাশিম। ততক্ষনে খলীফার সমর উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করার জন্য তার নাম ঘোষনা করা হয়ে গেছে।
হটাত হন্তদন্ত হয়ে দরবার কক্ষে প্রবেশ করল মহলের দারোগা। হাজ্জাজ বিন ইউসুফকে লক্ষ্য করে বললো, আলীজাহ, মকরান থেকে এক দূত এসেছে।
তিনি দূতকে আসতে বললেন।
কিছুক্ষন বাদেই দরবারে প্রবেশ করল মকরানের দূত। ঝড়ে বিদ্ধস্ত চেহারা দূতের। বোঝা গেলো সে রাত দিন বিরতিহীন সফর করেছে।
দুতের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে চাইলেন হাজ্জাজ। দূত হাজ্জাজের কাছে এক মুসলিম বালিকার রক্তে লিখা চিঠি দিয়ে সিন্ধু রাজ্যে কিছু মুসলিম এতিম ও নারী-পুরুষের উপর সেখানকার রাজার অত্যাচারের কথা বর্ণনা করল।
ভ্রু কুনচিত হয়ে গেলো হাজ্জাজের। আগ্রহ ভরে পড়তে শুরু করলেন চিঠি।
“দূতের মুখে মুসলমান শিশু ও নারীদের বিপদের কথা শুনে আমার দৃঢ় বিশ্বাস বসরার শাসনকর্তা স্বীয় সৈন্য বাহিনীর আত্মমর্যাদা সম্পন্ন সৈনিককে অশ্ব প্রস্তুত করার আদেশ দিয়েছেন। সংবাদ বাহককে আমার এ পত্র দেখাবার প্রয়োজন হবে না। হাজ্জাজ বিন ইউসুফের রক্ত যদি শীতল হয়ে জমে গিয়ে থাকে তবে হয়ত আমার এ পত্র বিফলও হতে পারে। আমি জাতির এক ভাগ্য বিড়ম্বিত কন্যা। আমি ও আমার ভাই এখনো শত্রুর নাগালের বাইরে। কিন্তু আমার অন্য সকল সঙ্গী শত্রু হাতে বন্দী - যার বিন্দু মাত্র দয়া নাই। বন্দীশালার সেই অন্ধকার কুঠুরির কথা কল্পনা করুন - যেখানে বন্দীরা মুসলিম মুজাহিদদের অশ্ব ক্ষুরের শব্দ শুনার জন্য উৎকর্ণ ও অস্থির হয়ে আছে। আমাদের জন্য অহরহ সন্ধান চলছে। সম্ভবতঃ অচিরেই আমাদেরকেও কোন অন্ধকার কুঠুরিতে বন্দী করা হবে। এও সম্ভব যে, তার পূর্বেই আমাকে মৃত্যুর দুয়ারে পৌঁছে দেয়া হবে এবং আমি সেই দুরদৃষ্ট হতে বেঁচে যাব। কিন্তু মরবার সময় আমার দুঃখ থেকে যাবে যে, যেসব বিদ্যুতগতি অশ্ব তুর্কিস্তান ও আফ্রিকার দরজায় আঘাত করছে, স্বজাতির এতীম ও অসহায় শিশুদের সাহায্যের জন্য তারা পৌছাতে পারল না। এও কি সম্ভব, যে তলোয়ার রোম ও পারস্যের গর্বিত নরপতিদের মস্তকে বজ্রপাতের ন্যায় আপতিত হয়েছিল, সিন্ধুর উদ্ধত রাজার সামনে তা ভোঁতা প্রমাণিত হল! আমি মৃত্যুকে ভয় করি না। কিন্তু হাজ্জাজ, তুমি যদি বেঁচে থাক, তবে আমার আত্মমর্যাদাশীল জাতির এতীম ও বিধবাদের সাহায্যে ছুটে এস।
ইতি,
জাতির এক ভাগ্য বিড়ম্বিত এক কন্যা”
যতক্ষনে চিঠি পড়া শেষ হলো ততক্ষনে দরবারে উপস্থিত সকলের রক্ত টগবগ করে ফুটতে শুরু করেছে। ঘৃনা ও ক্রোধের বদলে তাদের চেহারায় খেলা করছে প্রতিশোধের অগ্নীশিখা। নিজেকে সামলে নিয়ে মুহম্মাদ বিন কাসিমের দিকে ফিরলেন হাজ্জাজ। সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন তিনি।
(সময় সল্পতার কারনে আজকে লেখা শেষ করতে পারিনি। আগামীকাল ইনশাআল্লাহ শেষ করবো।)
বিষয়: বিবিধ
১৩২৩ বার পঠিত, ৭ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
এমন অবস্থায় ছেড়ে দিলেন পাঠকেরো রক্ত টগবগ করে ফুটতে শুরু করেছে.........
আশা করি শেষ করবেন।
মন্তব্য করতে লগইন করুন