ধারাবাহিক বড় গল্পঃ যখন রাত্রী আধার (২য় পর্ব)
লিখেছেন লিখেছেন খালেদ সাইফুল্লাহ ০৬ এপ্রিল, ২০১৫, ১২:৩১:৩৭ রাত
ধারাবাহিক বড় গল্পঃ
যখন রাত্রী আধার
=============
(২য় পর্ব)
ওমায়ের বেডে আধাশোয়া হয়ে সেদিনকার বাসি পত্রিকাটি পড়ছিল। রান্নাঘর থেকে টুং টাং শব্দ ভেসে আসছে। রাতে খাওয়ার পর এটো প্লেট বাসন গুলো ধুয়ে রাখছে ফারহানা।
খাওয়ার পর ওমায়ের তার প্লেটটি নিয়ে সিঙ্কের দিকে যেতে উদ্যত হতেই তার হাত থেকে প্লেটটি কেড়ে নিয়েছে সে। ঘরকন্নার কাজ গুলোকে সে একান্ত নিজের করে নিয়েছে। অন্য কারো হস্তক্ষেপ ফারহানা পছন্দ করে না। তাই বৌ এর সাথে না পেরে বাধ্য ছেলের মত খাওয়া শেষে বই এর আশ্রয় নিয়েছে সে।
“বিপ বিপ” শব্দ হল বেড সাইড টেবিলে। মুঠোফোনের মেসেজ টোন। হাত বাড়িয়ে মোবাইলটি নিল ওমায়ের। ‘Read’ বাটনে ক্লিক করে মোবাইলটি সামনে ধরলো।
“রেড জোন, নিরাপদ থাকুন”
ছোট্ট মেসেজ, কিন্তু এর অর্থ অত্যন্ত পরিষ্কার তার কাছে। মনটা খারাপ হয়ে গেলো। নিজের জন্য নয়, ফারহানার জন্য। এই পথে কেউ তাকে জোর করে নিয়ে আসেনি। স্বেচ্ছায় জেনে বুঝে এসেছে। সে জানে, যে পথে সে পা বাড়িয়েছে তাতে তার অনেক ক্ষতি হতে পারে, এমনকি মৃত্যু পর্যন্ত। তাই সে নিজের জন্য কখনো চিন্তা করে না। তার হারাবার কি আছে? নিজের কাছে সে তো কিছুই রাখেনি। সব কিছু তার প্রতিপালকের সাথে সওদা করে ফেলেছে জান্নাতের বিনিময়ে।
কিন্তু ফারহানা? হ্যা, সেও একই পথের পথিক। দুজন লক্ষ্য অভিন্ন। কিন্তু সে তো নারী। নারীর সহজাত বৈশিষ্টই হল নমনীয়তা। যদিও ওমায়ের জানে ফারহানা তাকে হাসি মুখে বিদায় দেবে। কিন্তু সেই বিদায়ের পিছনে তার হৃদয়ের রক্ত ক্ষরন ওমায়ের ছাড়া আর কে জানে? কান্নার চেয়ে করুন সে হাসি। যাই হোক, “আল্লাহ ভরসা” বলে উঠে পড়লো সে। পাশে রাইটিং টেবিলে বসে ডাইরিটা টেনে নিল। অনেক দিন ডাইরী লেখা হয়না। আজ খুব লিখতে ইচ্ছা করছে তার। খস খস শব্দে সাদা ডাইরীর বুকে অগ্রাসন শুরু করলো তার কলম,
“আজ ১৫ই মার্চ ২০১৫। ফেরারী জীবনের ৭৪৫তম দিন। ২০১৩ সালের ২৮শে ফেব্রুয়ারীর এক নিশুতী রাতে ঘর ছেড়ে ছিলাম আমি। ছাড়তে চাইনি, বাধ্য করা হয়েছিল। ঘরে নব বিবাহিত স্ত্রী, অসুস্থ্য মা। সব কিছু ছেড়ে অজানার উদ্দেশ্যে পা বাড়াতে হয়েছিল সে রাতে।
তখন রাত একটা। ভেবেছিলাম কিছু হবে না। কিন্তু আমার ভাবনা কে মিথ্যা প্রতিপন্ন করে সেদিনও ঠিক একই রকম মেসেজ এসেছিল ফোনে। অর্থ পরিষ্কার। সুখের দিন শেষ, সামনে অনাগত অন্ধকার। তড়িঘড়ি করে বিদায় নিতে হল আপন আলয় ছেড়ে। স্ত্রী কাদলো। মা কাদতে পারেনি। কেননা তিনি আগেই ঘুমের ঔষধ খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছেন। তাকে ডাকা যাবে না, ডাক্তারের নিষেধ। শুধু মায়ের মুখটা একবার দেখে নিয়ে পা বাড়ালাম। কিন্তু ফারহানা? সে কোথায়? তাকে দেখছিনা যে? কিন্তু আমি অপারগ, হাতে একটুও সময় নেই। পা বাড়ালাম দরজার বাইরে। হটাত ফুপানোর শব্দে চমকে উঠে তাকালাম শব্দ উৎসের দিকে। দেখি করিডোরের দেয়ালে হেলান দিয়ে কোন রকম নিজের পতন ঠেকিয়ে রেখেছে ফারহানা। মন বলছে পালাও, সময় শেষ, জান হারিও না। বেচে থাকলে আবার দেখা হবে। কিন্তু মনের কথা পছন্দ হলনা আমার। দ্রুত এগিয়ে গেলাম তার দিকে। অশ্রু মুছে দিয়ে কপালে একটা ভালবাসার চিহ্ন একে বললাম, ‘বিদায়, নিজের ও মায়ের খেয়াল রেখো। আল্লাহ হাফেজ’ বলে হাটা শুরু করলাম। পিছনে তাকাবার সাহস আমার ছিল না। জানি না পিছনে কি ঘটছে। আল্লাহ নিগাহবান।
কিন্তু কোথায় যাব? চারিদিকে একই অবস্থা, তার উপর রাত। রাস্তায় উঠা যাবে না। সেখানে টহল দিচ্ছে সরকারী তল্পি বাহক বাহিনী। দেখা মাত্র গুলি। নির্দেশ আছে আপাতত এলাকা ছাড়তে হবে। কিন্তু হেটে আর কত দূর? সকাল হলে গ্রামের ভিতর দিয়ে হেটে বড় রাস্তায় উঠে না হয় বাস ধরা যাবে। ভাবছি আর হাটছি। রাত কাটানোর মত নূন্যতম একটা আশ্রয় দরকার। আশেপাশে কারো বাড়ি নিরাপদ নয়। সবার একই অবস্থা।
এক সময় ক্লান্ত হয়ে বসে পড়লাম সবুজ ঘাসের উপর ধান ক্ষেতের কোলে। হাত ঘড়িতে দেখলাম রাত তিনটা। ভাবলাম একটু বিশ্রাম নিই। আর কত! সে সকাল থেকে অনবরত দৌড়াদৌড়ি, হামলা হাঙ্গামা, অবরোধ মিছিল, গোলাগুলী চলছে। যদিও আমি মিছিলে ছিলাম না। একজন ডাক্তার হিসেবে আমার দায়িত্ব ছিল আহত ভাইদের চিকিতসা দেয়া। সকাল থেকে অনবরত আহত ভাইদের নিয়ে আসা হচ্ছে আমাদের অস্থায়ী মেডিকেল ক্যাম্পে। স্রোতের মত আসছে আহতদের ঢেউ। একসময় ক্লান্ত হয়ে পড়লাম। সন্ধায় একটু বিশ্রাম নেয়ার চিন্তা করছি। ততক্ষনাত আর একজন আহত ভাই কে আনা হল। হাটুর নিচে পায়ে কমপক্ষে ৭-৮ টি গুলি লেগেছে তার। অনবরত ব্লিডিং হচ্ছে ক্ষতস্থান থেকে। এই দৃশ্য দেখে ঈমান আবার চাঙ্গা হয়ে উঠলো। ভাবলাম, আমিতো কর্তব্যে গাফেলতি করছি। যেখানে আমার ভাইয়েরা ময়দানে জীবন দিয়ে দিচ্ছে, রক্ত দিচ্ছে সেখানে আমি সুস্থ সবল একজন মানুষ কিনা বিশ্রামের কথা ভাবছি!
যত দ্রুত ভাবনা তার চেয়ে দ্রুত কাজ। গুলিতে আহত ভাইটির ম্যানেজমেন্টের জন্য পর্যাপ্ত সাপোর্ট আমাদের অস্থায়ী ক্যাম্পে নেই। কোন রকম চেষ্টা করলাম রক্তক্ষরন বন্ধ করতে। যত গুলি লেগেছে মনে হয় পায়ের কোন হাড়ই তার অক্ষত নেই। জরুরী অপারেশন করতে হবে। তার চেয়ে জরুরী রক্তক্ষরন বন্ধ করা। কারন রোগীই যদি না বাচে অপারেশন করবো কার? বেশ কিছুক্ষনের চেষ্টায় রক্তক্ষরন কমে আসলো। এবার অন্য চিন্তা আমাদের শঙ্কিত করে তুললো। রোগীর শরীরে রক্ত অনেক কমে গেছে। জরুরী ভাবে রক্ত দেয়া প্রয়োজন। কিন্তু কোথায় পাব রক্ত? দ্রুত রক্তের গ্রুপ দেখা হল। তার পর ক্যাম্পের বাইরে অপেক্ষারত ভাইদের বললাম, ‘খুব দ্রুত রক্ত দরকার। নইলে রোগীকে বাচানো যাবেনা’।
চারিদিক থেকে শত কন্ঠ একসাথে বলে উঠলো, ‘আমি রক্ত দেব। রক্তের গ্রুপ বলুন’। চোখটা অজান্তেই ভিজে উঠলো। আমি জানি এরা শুধু রক্ত কেনো, নিজের জীবনও দিতে প্রস্তুত। কোন রকম নিজেকে সামলে নিয়ে জানালাম যে ‘এ’ পজেটিভ রক্ত দরকার। পাশ থেকে কয়েকজন এক সাথে বলে উঠলো, “আমার এ পজেটিভ, আমার টা নিন”। দেখলাম তাদের ভিতরে অলিখিত একটা প্রতিযোগীতা শুরু হয়ে গেছে কে রক্ত দেবে তা নিয়ে। হস্তক্ষেপ করলাম আমি। একজন সবল মানুষ দেখে তাকে নিয়ে গেলাম ভিতরে। যাকে পছন্দ করলাম তার সেই আনন্দে উদ্ভাসিত চেহারা এখনো মনে পড়ে। যাবার বেলায় অন্যদের যে মলীন মুখ দেখেছিলাম তাও ভুলিনি আজো।
যাই হোক, রাত ১১টার পরে মোটামুটি কাজ কমে এলো। গ্রুপের সদ্য আগত একজনের উপর দায়িত্ব দিয়ে একটু বাড়িতে গিয়েছিলাম বিশ্রামের উদ্দেশ্যে। তাও হল না। ততক্ষনে আমাদের অস্থায়ী মেডিকেল ক্যাম্পের খবর পৌছে গেছে সরকারী উপর মহলে। হন্যে হয়ে খুজছে তারা আমাকে। দেখা মাত্র গুলির নির্দেশ। অবশেষে এখন এই অন্ধকার রাতে সবুজ ঘাসের উপর আশ্রয় নেয়া। যদিও শীতের শেষ, তারপরও ঠান্ডা একটা আমেজ ছিল। আল্লাহ হয়তো চাইলেন তার বান্দাকে একটু বিশ্রাম দেবার। এক সময় ইচ্ছার বিরুদ্ধে চোখ দুটি বন্ধ হয়ে আসলো।
পরের দিন সকালে সূর্যের আলো চোখে লেগে ঘুম ভাংলো। ইশশ, ফজরের নামাজ কাজা হয়ে গেছে। দ্রুত আশেপাশে তাকালাম কোন পানির আশায়। ওজু করতে হবে। পাশে একটা ধান ক্ষেতে পানি ছিল। তাই দিয়ে কাজা আদায় করে আবার পা বাড়ালাম। এক সময় এ গ্রাম সে গ্রাম করে পৌছালাম বড় রাস্তায়। চারদিকে হরতাল অবরোধ। বাস ট্রাক সব বন্ধ। ইঞ্জিন চালিত ভ্যান গাড়িতে করে পৌছালাম আমার শ্বশুরালয়ে। সেখানে খবর আগেই পৌছে গিয়েছিল। আমাকে দেখে তাদের শঙ্কার মেঘ কাটলো। গোসল করে সকালের নাস্তা করে জানালাম আমাকে এবার বিদায় দিতে হবে, কেননা ওদের খবর পেতে দেরী হবে না যে আমি এখানে। আমাকে ধরার জন্য চারিদিকে লোক লেলিয়ে দিয়েছে। কারন খুবই সোজা। একজন ডাক্তার, পাশাপাশি বিরোধী জোটের একজন অন্যতম সংগঠক হিসেবে আমাকে শেষ করতে পারলেই আমাদের এলাকাটা তাদের হাতে এসে পড়বে। এ কথা শোনার পর তাদের মুখচ্ছবি কেমন হয়েছিল তা লিখে বোঝানো সম্ভব না। কোন রকম আব্বা আম্মা কে বুঝিয়ে আবার রাস্তায় নামলাম অজানার উদ্দেশ্যে।
এরপর কত দিন গেলো, কত আধার রাত পেরিয়ে আবার সূর্য উদয় হল..................কিন্তু বাড়িতে ফিরতে পারিনি। আমার মমতাময়ী মা মারা গেলেন, কিন্তু বাড়িতে ফিরতে পারিনি। আমার এলাকার চতুর্দিকে সর্বক্ষন লোক লাগিয়ে রাখা হয়েছে। কখন আমি বাড়িতে আসবো এটা জানার জন্য। মায়ের জানাজা নাকি ডিবি পুলিশের লোকেরাই পড়েছিল বেশি। একটাই উদ্দেশ্য আমাকে ধরা। এসেছিলাম ঠিকই, কিন্তু তারা আমাকে চিনতে পারেনি। চিনবে কিভাবে? ততদিনে ফেরারী জীবন যাপনে আমার চেহারাই বদলে গেছে। এসেছিলাম একজন ভিক্ষুকের ছদ্মবেশে। যে মা তার ছেলে কে নিজের জানাজ পড়ার উপযোগী করে গড়ে তুলেছিলেন সেই মায়ের জানাজা দিলাম, কিন্তু এই অধম জানাজা পড়াতে পারিনি। কিভাবে পড়াবো? একজন ভিক্ষুককে কি কেউ জানাজা পড়াতে দেবে? দেবে না। দূর থেকে দেখলাম মাকে কবরে নামানো হচ্ছে। ধীরে ধীরে তাকে সমাধীস্ত করা হল। কান্নার প্রবল বেগ আগ্নেয়গিরীর জ্বালামুখের মত বাইরে বেরিয়ে আসতে চাচ্ছিল, কিন্তু পারেনি। চারিদিকে শত শত রক্ষী বাহিনীর রক্ত চক্ষু তাকে দমিয়ে রেখেছিল।
কিন্তু ফারহানা? এতো কাছে এসে তাকে একবার না দেখে কিভাবে ফিরে যাব? কিন্তু না, সে ইচ্ছাও শক্ত হাতে দমন করতে হল। অবশ্য তাকে দূর থেকে মহিলাদের ভিড়ে একনজর দেখেছিলাম। সাথে সাথে মুখটা ফিরিয়ে নিয়েছিলাম। পুলিশের চোখকে ফাকি দেয়া যেতে পারে কিন্তু স্ত্রীর চোখ কি ফাকি দেয়া সম্ভব? সম্ভব নয় বলেই হয়তো সেদিন তাকে জানায়নি যে আমি আসবো। সে জানলে স্থির থকাটা তার জন্য কঠিন হত। জানলে হয়তোবা বুদ্ধিমতী ফারহানার চক্ষুদ্বয় শত শত পুলিশ বা সেই ভিক্ষুকের মাঝেও আমাকে খুজে বেড়াতো। আর খুজে পেলে পরবর্তী প্রতিক্রিয়ায় তার জন্য তেমন কিছু না হলেও বিপদ হত আমার। আমি তাকে সেই কঠিন পরীক্ষায় ফেলতে চাইনি। আর চাইনি বলেই হয়তো আবার অজানার উদ্দেশ্যে পা বাড়ালাম.............................
(চলবে)
বিষয়: সাহিত্য
১৬৭০ বার পঠিত, ১৩ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
বাস্তবতার নিরীখে লিখাটি সত্যি মন নাড়া দিয়ে গেলো! কঠিন সময়ের পার করা অনুভূতিগুলো নিয়ে আরো লিখে যাবেন সেই প্রতীক্ষায়!
শুভকামনা রইলো!
মন্তব্য করতে লগইন করুন