সন্ত্রাসবাদ নিয়ে বিশ্ব নেতাদের দ্বিমুখী নীতি
লিখেছেন লিখেছেন মাজহারুল ইসলাম ১৮ নভেম্বর, ২০১৫, ০৬:৫০:০০ সন্ধ্যা
কোনো হামলার ঘটনায় ন্যূনতম মুসলিম সম্পৃক্ততা পেলেই সারা বিশ্বের মিডিয়ায় হুলস্থূল পড়ে যায়। কিন্তু মুসলমানরা শুধু এসব হামলায় সম্মিলিতভাবে নিন্দাই জানায় না, তারা এর প্রতিক্রিয়ার আগুনেও দগ্ধ হয়।
যুক্তরাষ্ট্রে ৯/১১’র হামলার পরে পশ্চিমা বিশ্বের যেখানেই সন্ত্রাসী হামলা হোক না কেন বিশ্বনেতারা তাৎক্ষণিকভাবে মুসলিমদের উপরে দায় চাপানোর প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়ে পড়েন। তাদের হাতে যথেষ্ট প্রমাণের অভাব থাকলেও, সম্ভবত মুসলিম বিদ্বেষী মনোভাবের প্রাবল্যই সকল অভিযোগে মুসলিমদেরকে অভিযুক্ত করতে বিশ্বনেতাদের উদ্বুদ্ধ করে।
প্রকৃত প্রমাণ অনুসন্ধানে জানা যায়, ২০০৯ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত ইউরোপে সন্ত্রাসী হামলাগুলোর মাত্র ২% ধর্মীয় উগ্রবাদীদের দ্বারা সংঘটিত হয়েছে।
২০১৩ সালের ১৫২টি সন্ত্রাসী হামলার মধ্যে মাত্র ১% ও ২০১২ সালের ২১৯টি হামলার মধ্যে মাত্র ৩% হামলা ধর্মীয় উগ্রবাদের ফসল।
ওই সময়ের আক্রমণগুলোর সিংহভাগই উগ্র জাতীয়তাবাদী অথবা বিচ্ছিন্নতাবাদীদের দ্বারা সংঘটিত। ২০১৩ সালের ৫৫% হামলার কারণ উগ্র জাতীয়তাবাদ এবং ২০১২ সালের অধিকাংশ হামলা অর্থাৎ ৭৬% হামলার কারণ জাতীয়তাবাদ ও বিচ্ছিন্নতাবাদ।
তবুও কুসংস্কারাচ্ছন্ন পণ্ডিতরা সবকিছুর পেছনে মুসলিমদের ষড়যন্ত্রের গন্ধ খুঁজে পান।
গত শুক্রবারে প্যারিসে এক ভয়াবহ হামলায় কমপক্ষে ১২৯ জন মানুষ নিহত হন। এ হামলার পরেই বিভিন্ন জনের প্রতিক্রিয়ায় প্রচ্ছন্নভাবে একটি কথাই উচ্চারিত হয়েছে, তা হলো এমন নৃশংস হামলা মুসলিম সন্ত্রাসীরা ছাড়া অন্য কারো দ্বারাই সম্ভব নয়।
হামলার পরপর কোনো প্রকার তথ্য প্রমাণ ছাড়াই উগ্র জাতীয়তাবাদী বিশ্লেষকরা এটিকে মুসলিম ও মুসলিম শরণার্থীদের কাজ বলে চালিয়ে দেয়ার চেষ্টায় লিপ্ত হয়েছেন।
যখন এ হামলার সাথে জঙ্গি জড়িত বলে জানা যায় এবং আইএস হামলার দায় স্বীকার করে তখন বিশ্বনেতারা ১৬০ কোটি মানুষের ধর্ম ইসলামকে দোষারোপ করা শুরু করে এবং মুসলিম দেশগুলো থেকে আগত শরণার্থীদের উপর উগ্রপন্থীরা পরিকল্পিত হামলা চালানো শুরু করে।
ধারণা করা হচ্ছে মুসলিম শরণার্থীরা এখন অব্যাহতভাবেই এরকম হামলার শিকার হবেন।
প্রতিবার মুসলিম উগ্রপন্থীরা হামলা চালায় আর গোটা বিশ্বের ১৬০ কোটি মুসলিমকে এ হামলার দায়ভার নিতে হয়। শুধু দায়ভারই নয়, সন্ত্রাসী তকমাটাও স্বয়ংক্রিয়ভাবে মুসলিমদের শরীরে সেঁটে যায়।
তারপরই গোটা পৃথিবীর আতঙ্ক মুসলিম সন্ত্রাসীদের উপরে চালানো হয় দমন নিপীড়ন।
মুসলিম ও শরণার্থীদের উপরে দমন-পীড়ন চালানো হলে লাভবান হয় কারা?
প্রাথমিকভাবে ২টি পক্ষ লাভবান হয়ে থাকতে পারে। প্রথমপক্ষ ইসলামী জঙ্গিগোষ্ঠীগুলো, কারণ মুসলিমদের উপরে চালানো নির্যাতনের মাধ্যমে তারা প্রমাণ করতে সক্ষম হয় যে ধর্মনিরপেক্ষ ইউরোপে মুসলিমদের কোনো স্থান নেই এবং তারা ইসলামের জন্য যুদ্ধ ঘোষণা করতে পারে।
দ্বিতীয়পক্ষ হচ্ছে মুসলিম বিদ্বেষী উগ্রবাদী গোষ্ঠীগুলো, যারা প্রকৃতপক্ষেই বিশ্বাস করে ধর্মনিরপেক্ষ ইউরোপ থেকে মুসলিমদের বিতাড়িত করা উচিত। কারণ, মুসলিমরা সন্ত্রাসী।
উভয়পক্ষ পরস্পরের শত্রু হলেও তাদের একটি অভিন্ন স্বার্থ আছে। মুসলিম বিদ্বেষী উগ্রবাদীরা মুসলিম ও মুসলিম শরণার্থীদের ইউরোপ থেকে বের করে দিতে চায় ইউরোপকে সন্ত্রাসমুক্ত রাখতে। ইসলামি জঙ্গিরাও চায় মুসলিমদেরকে ইউরোপ থেকে বের করে দেয়া হোক তাহলে সেসব নির্যাতিত মুসলিমকে জঙ্গিবাদে শামিল করে নিজেদের শক্তি আরো বাড়ানো যাবে।
আরো সুনির্দিষ্ট করে বললে, আইএস ও আল-কায়েদা মুসলিম নির্যাতনের সুবিধাভোগী, অপরদিকে ইউরোপের উগ্রপন্থীরা মুসলিম ও শরণার্থী বিদ্বেষী প্রোপাগান্ডা ছড়িয়ে তাদেরও দল ভারী করছে।
প্রত্যেক বছর ইউরোপে হাজার হাজার সন্ত্রাসী হামলা চালানো হয়। অধিকাংশ হামলার ঘটনাই মিডিয়ায় বা কোনো খবরে আসে না। এর কারণ হামলাগুলোর জন্য উগ্রপন্থী ইউরোপীয় জাতীয়তাবাদী গ্রুপগুলো দায়ী।
কিন্তু কোনো হামলার ঘটনায় ন্যূনতম মুসলিম সম্পৃক্ততা পেলেই পশ্চিমা মিডিয়া তো বটেই, সারা বিশ্বের মিডিয়ায় হুলস্থূল পড়ে যায়। এটাই এখন প্রকৃত বাস্তবতা।
কিন্তু মুসলমানরা শুধু এসব হামলার সম্মিলিতভাবে নিন্দাই জানায় না, তারা এর প্রতিক্রিয়ার আগুনেও দগ্ধ হয়।
যেমন গত জানুয়ারিতে প্যারিসে সন্ত্রাসী হামলার পর মাত্র ছয় দিনের মধ্যে ফ্রান্সে ৬০টি ইসলাম বিরোধী হামলা ও হুমকির ঘটনা ঘটেছে বলে জানিয়েছে ন্যাশনাল অবজার্ভেটরি অ্যাগেইনস্ট ইসলামোফোবিয়া। যুক্তরাজ্যে এ সময় ৫০-৬০টি মুসলিম বিরোধী বর্ণবাদী হামলার কথা জানায় টেলমামা নামের যুক্তরাজ্যভিত্তিক একটি সংগঠন।
প্যারিসে সন্ত্রাসী হামলার একদিন আগেই একই ধরনের একটি হামলার হলেও সরকারগুলো নীরবতা পালন করে। গত ১২ নভেম্বর লেবাননের রাজধানী বৈরুতে শিয়া অধ্যুষিত এলাকায় আইএসের দুটি আত্মঘাতী হামলায় অন্তত ৪৩ জন নিহত এবং ২৩০ জন আহত হন।
কিন্তু, কই প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা তো সেই হামলার নিন্দা জানিয়ে বিশ্ববাসীর উদ্দেশ্যে ভাষণ দেননি। কিন্তু সেটিও তো ছিল বৈরুতে অনেক বছরের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ হামলা।
বরং পশ্চিমা গণমাধ্যমে বলা হলো, নিহতরা হিজবুল্লাহর (যাকে পশ্চিমা দেশগুলো সন্ত্রাসী সংগঠন দাবি করে) মানববর্ম হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছিল।
অক্টোবরে তুরস্কের আঙ্কারায় কুর্দিদের শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক সমাবেশে আইএসের হামলায় ১২৮ জন নিহত এবং ৫০০ জনআহত হলেও তেমন নিন্দা দেখা যায়নি।
আরো আশ্চর্যের বিষয় হলো পশ্চিমা সমর্থনপুষ্ট সৌদি আরবের নেতৃত্বাধীন সামরিক জোট গত ২৮ সেপ্টেম্বর ইয়েমেনে বিয়ের অনুষ্ঠানে বিমান হামলা চালিয়ে ৮০ জন নারীসহ ১৩১ জন বেসামরিক লোককে হত্যা করলে তখন বিশ্ব নেতারা কোথায় ছিলেন।
সেই হত্যাযজ্ঞ তো ভাইরাল হয়নি। ওবামা কিংবা ওলাঁদ তার জন্য দুঃখপ্রকাশ তো দূরের কথা তার উল্লেখই করেননি।
তাহলে ফরাসিদের জীবন কী লেবানিজ, তার্কিশ, কুর্দিস অথবা ইয়েমেনিদের চেয়ে বেশি মূল্যবান? এগুলোও কী ‘ঘৃণ্য, শয়তানি কাজ’ ছিল না।
প্যারিস হামলার দায় আইএস স্বীকার করায় মুসলিমদের উপর পশ্চিমা বিশ্বের ক্ষোভ পুঞ্জীভূত। এখন দেখার বিষয়, প্যারিসের ১২৭ জনের মৃত্যুর বদলা নিতে ফ্রান্স সহ পশ্চিমা বিশ্বের আগ্রাসনে কতজন নিরীহ মুসলিম বিভীষিকাময় মৃত্যুর শিকার হন।
স্যালনে প্রকাশিত নিবন্ধের ভাষান্তর (সংক্ষেপিত)
আরটিএনএন থেকে সংগ্রহীত
বিষয়: আন্তর্জাতিক
১৬৩৭ বার পঠিত, ৩ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন