ধ্বংসের শেষ সিঁড়িতে দাড়িয়ে বাংলাদেশের সংস্কৃতি।
লিখেছেন লিখেছেন মাজহারুল ইসলাম ১৬ মে, ২০১৫, ০৭:৩৬:০৯ সন্ধ্যা
ভারতের হিন্দি এবং বাংলা সিরিয়াল দেখে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে এই দেশের হাজার হাজার পরিবারের মা,বউ,মেয়ে, বোন, চাচী, ভাবী সহ অন্যরা। ভারতীয় টিভি চ্যানেলের মধ্যে স্টার প্লাস, স্টার জলসা, জি বাংলা, মহুয়া বাংলা, জিটিভি, লাইফ ওকে, স্টার ওয়ান, সনি, জি স্মাইল, ইটিভি বাংলায় প্রচারিত সিরিয়ালের অধিপত্যে বাংলা স্যাটেলাইট চ্যানেলগুলা কোণঠাসা হয়ে পড়েছে। পরিবারের মা, বোন, বৌ, চাচিরা এখন টেলিভিশন বলতে শুধু সিরিয়ালই বোঝেন। সারা দিন রিমোট হাতে এ ধরনের ভারতীয় হিন্দি, বাংলা সিরিয়ালে মগ্ন হয়ে থাকেন। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত এসব চ্যানেলে চলতে থাকে বিভিন্ন নামের ধারাবাহিক নাটক। গাঞ্জাখুরি কাহিনীর মত আবার এক একটা সিরিয়াল চলতেছে চার পাঁচ বছর দরে। আমাদের দেশে হিন্দি সিরিয়ালের যাত্রা শুরু হয় মূলত স্টার প্লাসে সম্প্রচারিত ‘সাসভি কাভি বাহু থি’ সিরিয়ালের মাধ্যমে। সিরিয়ালটি অল্পদিনেই জনপ্রিয়তা লাভ করে। এরপর ‘কাহানী ঘার ঘার কি’, ‘কাসেটি জিন্দেগী কি’, ইত্যাদি সিরিয়াল গুলো দেশের বিশেষ করে মহিলাদের নিকট অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। মহিলাদের নিকট এসব হিন্দি সিরিয়াল জনপ্রিয় হয়ে ওঠার কারণ হলো, গৃহবধূদের সময় কাটানোর একটি চমৎকার উপায়। সন্ধ্যা সাতটা থেকে শুরু হয়ে একটানা রাত বারটা পর্যন্ত সম্প্রচার করা হয়। এইসব বস্তা পচা সিরিয়ালে উদ্ভট সব কাহিনী দেখানো হয়। সিরিয়ালে যে সব দৃশ্য সচরাচর দেখতে পাওয়া তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো-অসম প্রেম, স্বামী-স্ত্রীর পরকীয়া,পারিবারিক ভাঙ্গন, বহু বিবাহ, বউ- শ্বাশুড়ীর ঝগড়া, সম্পত্তির কারণে ভাই-ভাই ঝগড়া, স্ত্রীর কূটনৈতিক চাল, ভুল বোঝাবুঝি, হিংসা, সন্দেহ, অশ্লীলতা, আত্মীয়দের ছোট করা, অন্যকে বিপদে ফেলা। প্রতিটি সিরিয়ালেই পরকীয়া হলো ঘটনার একটি মূল উপাদান। প্রতিটি সিরিয়ালে দেখান হয় কিভাবে ননদ-বৌ, কিংবা বৌ- শ্বাশুড়ীর বিরোধ। বৌ-শ্বাশুড়ীর বিরোধ আজকাল মহামারী আকার ধারণ করেছে এদেশের নারীদের মন-মগজে ভারতীয় সিরিয়ালের কুপ্রভাবের কারণে।
ভারতীয় সিরিয়ালে ভারতের সংস্কৃতি প্রচার হবে এটাই স্বাভাবিক তবে যা প্রদর্শিত হয় তার কিছুই বাংলাদেশের সংস্কৃতির সাথে মেলে না। যেমন সিরিয়াল গুলোতে অতিমাত্রায় পূজা অর্চনা (ভণ্ডামি) দেখানো হয়, আমার জানা নেই বাস্তবে ভারতের হিন্দুরা এত ধর্মপ্রাণ কীনা? গত রমজানের (২০১৪ সালের) ঈদে সবচেয়ে বেশি প্রচার হয় ভারতীয় বাংলা সিরিয়ালের কথা যার প্রধান কারন হচ্ছে পাখি ড্রেস যা বোঝেনা সে বোঝেনা নাটকের নায়িকার ড্রেস ছিল। বাংলাদেশের মিডিয়ার মাধ্যমে জানা গেছে এই ড্রেসের জন্য নাকি কয়েক জন আত্মহত্যা করেছে এমন কি স্ত্রী স্বামীকে তালাক পর্যন্ত দিয়েছে।
আগেই বলা হয়েছে এই সব নাটকে দেখা মানে এক কথায় পরিবার ধ্বংসা করা। নাটকে যদি দেখানো হয় স্বামী অন্য মেয়ের সাথে পরকীয়া করে তাহলে এখন আমাদের দেশের মেয়েরা মনে করে তাদের স্বামীরাও অন্য মেয়ের সাথে পরকীয়া করে। এইসব ঘটনা বাস্তব কিনা বা আদৌ এই ঘটনা সত্য কিনা তা ঐ সব যারা দেখে তারা জানেনে কিনা আমি জানিনা। এই সব কারনে এখন আমাদের দেশের হাজার হাজার পারিবারে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক তালাকে রুপ নিতেছে এই ভারতীয় সিরিয়ালের কারনে।
এই সব নাটকের কারনে আমাদের দেশের নাটক নির্মাতারা এখন আর আগের মত ধারাবাহিক নাটক নির্মাণ করতে আগ্রহ প্রকাশ করতে চান না। এসব ভারতীয় সিরিয়াল দেখার ফলে মানুষের মাঝে এখন ব্যাপকভাবে দেখা যাচ্ছে কুসংস্কার বিশ্বাস, তাছাড়া বাংলাদেশের ভাষা, সংস্কৃতি ইত্যাদির উপরও সিরিয়ালের ব্যাপক প্রভাব পরেছে। এমনকি স্কুল কলেজে কিশোর-তরুণীদের আলোচনার বিষয় হিসেবে প্রাধান্য পায় এই ভারতীয় সিরিয়াল। ভারতীয় সিরিয়ালগুলো ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মূল্যেবোধ পাল্টে দিচ্ছে অথবা তাদের উস্কে দিচ্ছে বাংলাদেশী মূল্যেবোধের বিপরীতে অবস্থান নিতে।
নিচে কয়েকটা বাস্তব ঘটনা দেওয়া হয়েছেঃ
প্রথম ঘটনাঃ- সন্ধ্যা ৬টা বাজে। মিরপুরের বাসিন্দা রফিক আহমদ কেবলই অফিস থেকে ফিরেছেন। স্ত্রীর চিৎকারে ঠিকমতো ফ্রেশ হতে পারেননি। বাইরে এসে দেখলেন তাদের একমাত্র এক বছর বয়সী বাচ্চা মিমি কাঁদছে। স্ত্রী রফিক সাহেবকে বললেন বাচ্চাকে নিয়ে অন্য রুমে বসে খেলতে, কারণ স্টার জলসায় শুরু হয়ে গেছে ‘টাপুর-টুপুর’ নামের সিরিয়ালটি। আজকের পর্বটি নাকি অনেক আকর্ষণীয়, নতুন কিছু ঘটবে বলে জানান তার স্ত্রী। অগত্যা রফিক সাহেব কথা না বাড়িয়ে মেয়ের কান্না থামাতে ব্যস্ত হয়ে গেলেন।
দ্বিতীয় ঘটনাঃ- সীমান্ত স্কয়ারে মেয়েকে নিয়ে কেনাকাটা করতে এসেছেন ধানমণ্ডির সাতমসজিদ এলাকার গোলাম হাসান। সবার পোশাক পছন্দ হলেও তার সপ্তম শ্রেণী পড়ুয়া মেয়েটি কোন পোশাকই পছন্দ করছে না। কারণ তার পছন্দ ‘ঝিলিক’ নামের একটি পোশাক, এটা ছাড়া আর কোন কিছুই সে কিনতে নারাজ। তার এক কথা, ঝিলিক জামা লাগবেই। হাসান সাহেব অনেকটা অসহায়ের দৃষ্টি নিয়ে মেয়েকে বোঝানোর চেষ্টা করছেন যে ওই নামের পোশাকটি এখানে নেই। পোশাকটি পরে কিনে দেয়া হবে।
তৃতীয় ঘটনাঃ- ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের শহীদ আনোয়ার স্কুলে নবম শ্রেণীতে পড়ে ইতি। প্রতিদিনই একটি বিষয় নিয়ে বাবা-মায়ের সঙ্গে তার কথাকাটাকাটি হয়। যে যত কথা বলুক না কেন ‘রাশি’ নামের একটি বাংলা এবং স্টার প্লাসের ‘শ্বশুরাল গেন্দা ফুল’ হিন্দি সিরিয়ালটি তাকে দেখতে দিতেই হবে। পরীক্ষা কিংবা বাসা টিউটর পড়াতে এলেও সেটাতে তার মনোযোগ থাকে না। দীর্ঘদিন ধরে হিন্দি সিরিয়াল দেখার কারণে এখন তাকে অধিকাংশ সময়ই হিন্দিতে কথা বলতে দেখা যাচ্ছে, এমনকি সিরিয়ালের বিভিন্ন ডায়ালগ মুখস্থ করে রেখেছে। অন্যদিকে পরীক্ষার রেজাল্টে যথেষ্ট খারাপ হচ্ছে দিন দিন।
এই হচ্ছে আমাদের সমাজের অবস্থা। কিভাবে এর থেকে মুক্তি পাওয়া যায়?
শুধু ভারতীয় সিরিয়াল নয় ভারতীয় হিন্দি কার্টুন ও আমাদের দেশের জন্য ভাইরাস। বাচ্চারা কিছুদিন আগেও ডোরেমন দেখত! খুবই মনোযোগ দিয়ে। এক সময় দেখতে দেখতে অবস্থা এমন যে বাচ্চারা সব হিন্দি এক্সপার্ট হয়ে গেল!
এখানে উল্লেখ্য যে, ১৯৬৯ সালে জাপানে তৈরি হয় ‘ডরিমন'। বিদেশে জাপানি সংস্কৃতি প্রচারের লক্ষ্যে এটাকে ‘কার্টুনদূত’ ঘোষণা করেছে জাপানের পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয়। কিন্তু প্রশ্ন হলো, আমাদের সংস্কৃতি প্রচারের জন্য তেমন কোনো উদ্যোগ আছে কী?
চার থেকে ১০ বছরের শিশুরা হিন্দিতে কথা বলতে পারে। এটি হয়েছে তাদের প্রিয় কার্টুন ডোরেমন দেখে। এখন আবার আমাদের দেশের এশিয়ান টিভি ডরিমন বাংলায় সম্প্রচার করে আসছে।
আর এইসব বাচ্চাদের ডোরেমনীয় অনুভূতিকে কাজে লাগিয়ে শুরু হয়ে গেল বিভিন্ন ব্যবসায়ীদের ব্যবসা। ডোরেমন নামের চকলেট, স্কুল ব্যাগ, খেলনা এখন বাজারে পাওয়া যায়। আর এই সব কিনে দেওয়ার জন্য মা বাবার কাছে হন্য হয়ে পড়ে থাকে ছোট ছোট ছেলে মেয়েরা অথবা না কিনে দিলে স্কুলে যাবে না এমন ঘোষণা পর্যন্ত দিয়ে দেয় ছোট ছোট বাচ্চারা।
ন্যাশনাল মিডিয়া সার্ভে সূত্রে পাওয়া তথ্য মতে, বাংলাদেশে টেলিভিশনের দর্শক ৯ কোটি ১২ লাখের মতো। এসব দর্শকের বয়স ১৫ বছরের ওপরে। যাদের বয়স ১৪ বছরের নিচে তাদের গোনা হয়নি। সে হিসাব নিলে দর্শক সংখ্যা ১১ কোটির মতো হতে পারে। এ দর্শকেরা তাদের প্রতি শত মিনিটের মাত্র ২০ মিনিট বাংলাদেশের টিভি চ্যানেল দেখেন। এটি তারা দেখেন মূলত বিকেল ৩টা থেকে সন্ধ্যা ৬টার মধ্যে। রাত ৯টা থেকে সাড়ে ১১টা পর্যন্ত হিন্দি চ্যানেল গুলোর দর্শক বেশি থাকে। বাকিটা তারা ব্যয় করেন হিন্দি চ্যানেলের পেছনে। এই দেশে ২৮০ টির মতো চ্যানেল দেখা যায়। এর মধ্যে ৪৫ টির মতো চ্যানেল বাংলাদেশ কিনে দেখায় এ সব চ্যানেলের প্রায় সবগুলোই ভারতীয়। বাংলাদেশে ভারতীয় চ্যানেল আমদানি করে থাকে দুইটি প্রধান প্রতিষ্ঠান। একটি মোহাম্মদী গ্রুপ এর মালিক এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি আনিসুল হক। অন্য পরিবেশক বেঙ্গল গ্রুপ অথচ বেঙ্গল গ্রুপ দেশীয় সংস্কৃতি চর্চার কথা বলে ধানমন্ডিতে গড়ে তুলেছে বেঙ্গল ফাউন্ডেশন। এ দুইটি প্রতিষ্ঠান থেকেই মূলত ক্যাবল টিভি ব্যবসায়ীরা পে চ্যানেলগুলো কিনে গ্রাহকদের মধ্যে সংযোগ দিয়ে থাকে। এ জন্য পরিবেশকদের গ্রাহক প্রতি চ্যানেলের জন্য আলাদা পেমেন্ট করতে হয়। বাংলাদেশে সব মিলিয়ে বছরে অন্তত এক হাজার কোটি টাকা এখাত থেকে ভারত চলে যাচ্ছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা। ইদানীং প্রাণ সহ অনেক কোম্পানিই ভারতের চ্যানেল গুলোতে বিজ্ঞাপন প্রচার করছে। কারন বাংলাদেশী চ্যানেল ঢাকা সহ অন্যান্য শহর অঞ্চলের মানুষেরা দেখে না তাই তারা এখন হিন্দে চ্যানেলে তাদের বিজ্ঞাপন দিয়ে আসছে যদিও প্রানের সহ্য কিছু কোম্পানির পণ্য ভারতে পাওয়া যায়।
ভারতীয় সিরিয়াল নিয়ে খবরের কাগজ গুলোতে অনেক লেখালেখি হয়েছে। যেমনঃ-
[ভারতীয় সিরিয়ালে আসক্ত দর্শক বাংলাদেশী নির্মাতারা শঙ্কিত। ২ জানুয়ারি ২০১২]
[ভারতীয় সিরিয়ালে আসক্ত দর্শক বাংলাদেশী নির্মাতারা শঙ্কিত। ২ জানুয়ারি ২০১২]
[ভারতীয় সিরিয়ালগুলো ভাঁড়ামি পুর্নঃ প্রথম আলো,২৪ অক্টোবর,২০১৩]
[ভারতীয় সিরিয়াল দেখতে না দেওয়ায় কিশোরীর আত্মহত্যা। প্রিয়. কম, ৫ সেপ্টেম্বর ২০১৩।]
[ভারতীয় সিরিয়াল ধ্বংস করে দিচ্ছে আপনার জীবন। এইমাত্র.কম ১৫ জানুয়ারী ২০১৪।]
[ভারতীয় নাটকের সিরিয়াল দেখে শিশুদের নৈতিকতা শিক্ষা দেয়া যাবে না। কক্সবাজার সময়, ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৪]
[ভারতীয় সিরিয়ালের যে সূক্ষ চালে ধ্বংস হচ্ছে আপনার জীবন! নতুন খবর, ২৮ জানুয়ারি ২০১৪।]
[ভারতীয় সিরিয়াল দেখা নিয়ে স্কুলছাত্রীর আত্মহত্যা। দ্যা রিপোর্ট২৪ডটকম, ১২ আগস্ট ২০১৪]
[ভারতীয় হিন্দী সিরিয়াল, ধ্বংসের পথে বাংলার সংস্কৃতি। সিটিজি নিউজডটকম, মার্চ ২৪, ২০১৪]
এতো লেখালেখির পরেও সরকারের এইসব সিরিয়ালের চ্যানেল বন্ধের কোনো ভুমিকা নেই এবং আমাদের দেশীয় চ্যানেল ভারতে এখনো চলে না বা আদৌ ভারতে বাংলাদেশী চ্যানেল সম্প্রচার করার কোন উদ্যোগ নিবে কিনা সরকার তাও জানা যায় নাই।
সবশেষে যারা ব্লগে আছেন আপনাদের উদ্দেশ্যে একটা কথা, আপনার পরিবার আপনাকেই রক্ষা করতে হবে এখন চিন্তা করেন আপনার পরিবারকে কি এইসব চ্যানেল দেখতে দিবেন? আর যদি পারেন আপনার আশে-পাশের মানুষকে এই সম্পর্কে বুঝিয়ে বলেতে পারেন। সরাসরি কাউকে নিষেধ করবেন না এতে সে মনে করতে পারে এইটা মনে হয় ভালো কিছু কিন্তু আমাকে দেখতে দিবে না। তাই কৌশলে তাদেরকে এই সব দেখা থেকে দূরে রাখুন।
আল্লাহ আমাদের সবাইকে সঠিক পথে চলার এবং সব কিছু বুঝার তৌফিক দান করুক, আমীন।
বিষয়: বিবিধ
১৯৮৫ বার পঠিত, ১০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
জি সচেতনতা মানুষকে অনেক পরিবর্তন করতে পারে।
আসলে বাংলাদেশি পত্রিকাগুলিও এই সিরিয়াল গুলিকে প্রমোট করছে নানা ভাবে।
মন্তব্য করতে লগইন করুন