ফরিদ খানের মৃত্যু : মুসলিমবিদ্বেষী মানসিকতার বহিঃপ্রকাশ।

লিখেছেন লিখেছেন মাজহারুল ইসলাম ২৯ এপ্রিল, ২০১৫, ০৭:২৭:৩৩ সন্ধ্যা

ভারত সরকারকে এ বিষয়টি ভীষণ পীড়া দিচ্ছে, ১৬ ডিসেম্বরের দিল্লি গণধর্ষণের ওপর বিবিসি প্রামাণ্য তথ্যচিত্র বানিয়ে ভারতকে সারা বিশ্বের কাছে কেন দুর্নামের পাত্র বানাল? ওই ঘটনার মূল আসামি মুকেশ সিংয়ের সাাৎকার প্রচার করে ভারতের নেতিবাচক রূপ কেন তুলে ধরা হলো? অথচ সরকারের এই বিষয় নিয়ে কোনো চিন্তাই নেই যে, গত ৫ মার্চ নাগাল্যান্ডের শহর ডিমাপুরে ফরিদ খান নামের এক যুবকের ওপর ধর্ষণের মিথ্যা অভিযোগ আরোপ করে যে নির্মম নির্যাতন ও অত্যাচার চালানো হয়েছে এবং তাকে যেভাবে উলঙ্গ করে রাস্তায় ছেঁচড়িয়ে হত্যা করা হয়েছে, তাতে পুরো দুনিয়ায় ভারতের চিত্র কী পরিমাণ কলঙ্কিত হলো এবং ওই নির্মম ঘটনার দ্বারা ভারতের কতটুকু বদনাম হলো। ১৬ ডিসেম্বরের লজ্জাজনক ঘটনা রাতের অন্ধকারে সংঘটিত হয়েছে। অথচ ডিমাপুরের এই ঘটনা দিনের উজ্জ্বল আলোয় আইনের লোকদের সামনে বাস্তবায়ন করা হয়েছে। এ সময় আইনের লোকেরা কাপুরুষের মতো হাতের ওপর হাত রেখে বসেছিল। ফরিদ খানের ওপর ুধার্ত বাঘের মতো আক্রমণকারী হিংস্র বন্যদের পুলিশ গ্রেফতার করেনি। ফরিদ খানের পরিবার ন্যায়বিচারের আশায় দেয়ালে দেয়ালে মাথা ঠুকে যাচ্ছে। ডিমাপুর থেকে দিল্লি পর্যন্ত এ ব্যাপারে শুধু লোক দেখানো কিছু ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে মাত্র।

ফরিদ খানের অপরাধ তিনি ডিমাপুরে ব্যবসায় করে নিজের সংসার চালাতেন। অবৈধভাবে আয় রোজগারকারী একটি দল তাকে টার্গেট করে। ফরিদ খান তাদের ফাঁদে পা দিতে অস্বীকার করেন। ব্যস, তার বিরুদ্ধে ধর্ষণের মিথ্যা অভিযোগ আরোপ করে এ কথা ছড়িয়ে দেয়া হয়, তিনি একজন বাংলাদেশী অনুপ্রবেশকারী। যিনি ডিমাপুরে অবৈধভাবে ব্যবসায় করছেন। যে নাগা মহিলা ফরিদ খানের বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ দায়ের করেছিল, তা মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে। স্বয়ং সরকারি সূত্র এর সত্যতা স্বীকার করেছে। এ ধারাবাহিকতায় নাগাল্যান্ড সরকার কেন্দ্রীয় সরকারকে যে রিপোর্ট পেশ করেছে, তাতে সব কিছু স্পষ্ট পরিষ্কার হয়ে গেছে। কিন্তু এ রিপোর্ট এত দেরিতে দৃশ্যপটে এসেছে, তখন ওই নির্যাতন ও বর্বরতার কোনো ধরনই আর অবশিষ্ট নেই, যার দ্বারা ফরিদ খানের জীবনাবসান ঘটেছে।

ডিমাপুর সেন্ট্রাল জেলের লৌহ কপাট ভেঙে উত্তেজিত একদল জনতা যে সময় ফরিদ খানকে বাইরে বের করে নিয়ে আসে, তখন সেখানে পুলিশ ফোর্স বিদ্যমান ছিল। জেলের সব কর্মকর্তাও ডিউটিতে ছিলেন। সেখানে কর্তব্যসচেতন পুলিশ এবং জেলের চৌকস ও সতর্ক কর্মকর্তারা হিংস্র বর্বরদের সামনে কোনো বাধা সৃষ্টি করেননি। উত্তেজিত জনতাকে এ কথা বোঝানোর চেষ্টা করা হয়নি, ফরিদ খান আইনের আশ্রয়ে রয়েছেন। আইনসংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর মৌলিক দায়িত্ব হচ্ছে, যতণ কোনো ব্যক্তির অপরাধ প্রমাণিত না হবে, ততণ পর্যন্ত তারা তাকে শাস্তির দোরগোড়ায় নিয়ে যেতে পারবেন না। আইনের মূলকথা হচ্ছে, শত অপরাধী ছুটে যাবে; কিন্তু কোনো নিরপরাধ ব্যক্তি যেন শাস্তি না পায়। দুঃখের বিষয়, ডিমাপুর সেন্ট্রাল জেলের কর্মকর্তারা তাদের দায়িত্ব পালন না করে বরং আক্রমণোদ্যত বর্বরদের চিনিয়ে দিয়েছে, ফরিদ খান কে? ফরিদ খানকে ধর্ষণের মিথ্যা অভিযোগ এনে যেভাবে পাশবিকতা ও বর্বরতার সাথে হত্যা করা হয়েছে, তার পূর্ণ বর্ণনা অত্যন্ত রোমহর্ষক। ফরিদ খানকে ২৩ ফেব্র“য়ারি গ্রেফতার করা হয়েছিল। যখন এ খবরটি স্থানীয় চ্যানেলগুলো ও সোস্যাল মিডিয়াতে ব্যাপকভাবে প্রচার হলো, তখন পরিস্থিতির অবনতি ঘটতে থাকে। সন্দেহাতীতভাবে মিথ্যা প্রচার করা হয়েছে, ফরিদ খান একজন বাংলাদেশী অনুপ্রবেশকারী। তিনি এক নাগা মহিলাকে ধর্ষণ করেছেন। উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলোতে বাংলাদেশীদের বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীগুলো এত বিষোদগার করে রেখেছে, যদি আপনি কারো ওপর বাংলাদেশী হওয়ার মিথ্যা অভিযোগ আরোপ করেন, তাহলে তার বেঁচে থাকাকে হারাম করে দেয়া হয়। নাগাল্যান্ডের পাশের রাজ্য আসামে ৮০ লাখের বেশি বাংলাভাষী মুসলমান রয়েছেন। বাংলা ভাষায় কথা বলার কারণে যাদের বাংলাদেশী আখ্যায়িত করা হয়। ওই মুসলমানদের বিরুদ্ধে আসামে সাম্প্রদায়িক ও উগ্রবাদী সংগঠনগুলোর কার্যক্রম নতুন নয়। ওই সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষেরই ফল ছিল ৫ মার্চের নাগা ঘটনা, যে দিন সকালবেলায় নাগাদের একটি ুব্ধ দল ফরিদ খানের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নিতে রাস্তায় নেমে আসে। প্রতিশোধের আগুনে জ্বলে ওঠে ডিমাপুর সেন্ট্রাল জেলের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। স্থানীয় পুলিশ হাতে হাত রেখে বসেছিল। পুলিশের কাপুরুষতার সুযোগ নিয়ে উত্তেজিত জনতা ডিমাপুর সেন্ট্রাল জেলে হামলা চালিয়ে ফরিদ খানকে নিজেদের কব্জায় নিয়ে নেয়। তাকে উলঙ্গ করে নির্মমভাবে পেটানো হয়। এরপর ফরিদ খানকে রশি দিয়ে বেঁধে ডিমাপুরের রাস্তায় ছেঁচড়াতে থাকে। ওই সময় ফরিদ খান আঘাত সহ্য করতে না পেরে ইন্তেকাল করেন। হিংস্র বর্বরদের উন্মত্ততা এর পরও থামে নেই। ওই বর্বররা ফরিদ খানের লাশ সাত কিলোমিটার ছেঁচড়িয়ে শহরের মধ্যে অবস্থিত কক টাওয়ারে নিয়ে যায়। শিণীয় নিদর্শন বানানোর জন্য তাকে সেখানে টাঙিয়ে রাখে। পুরো ঘটনা অত্যন্ত লজ্জাজনক ও রোমহর্ষক। অথচ কারো কোনো মানবতা জেগে ওঠেনি। বিস্ময়ের কথা হচ্ছে, ডিমাপুরের রাস্তায় হিংস্র ও বর্বরতার এ তাণ্ডব কয়েক ঘণ্টা ধরে চলে। অথচ সরকারি লোকেরা শান্তির বাঁশি বাজাতে থাকে। ধর্ষণ মামলায় ফরিদ খানের নির্দোষ হওয়ার ব্যাপারে তার ভাই স্পষ্ট বক্তব্য প্রদান করেছেন। তিনি অভিযোগ দায়েরকারী মহিলাকে একজন ব্ল্যাকমেইলার আখ্যায়িত করে বলেন, ওই মহিলা ফরিদ খানের কাছে দুই লাখ রুপি চেয়েছিল। ওই অর্থ প্রদান না করায় সে ফরিদ খানকে ধর্ষণের মিথ্যা অভিযোগে ফাঁসিয়ে দেয়। আসামের মুখ্যমন্ত্রী তরুণ গগৈ টিভি চ্যানেলে ওই ঘটনার সত্যতা স্বীকার করেছেন। নাগাল্যান্ড সরকারও এখন এ কথা বলছে।

ফরিদ খান মূলত আসামের বরাক উপত্যকার করিমগঞ্জের অধিবাসী। তিনি ডিমাপুরে ছোটখাটো ব্যবসায় করতেন। যে ফরিদ খানকে উগ্রপন্থীরা বাংলাদেশী আখ্যায়িত করে মৃত্যুর দুয়ারে পৌঁছিয়ে দিয়েছে, মূলত তিনি আসামের এক দেশপ্রেমিক পরিবারের সদস্য। তার বাবা মিলিটারি ইঞ্জিনিয়ারিং সার্ভিসে চাকরি করেছেন। তার দু’ভাই এখনো বাহিনীতে থেকে ভারত সীমান্ত রার কাজে নিয়োজিত আছেন। ফরিদ খানের তৃতীয় ভাই কারগিল যুদ্ধে শহীদ হয়েছেন। যে ব্যক্তির পুরো পরিবার দেশের সীমান্ত রার কাজে নিয়োজিত, তাকে বাংলাদেশী আখ্যায়িত করে ধর্ষণের মিথ্যা অভিযোগে হত্যা করার অর্থটা পরিশেষে কী দাঁড়াচ্ছে? ভারতে মুসলমান হওয়া কি এত বড় অপরাধ যে, তাকে শূলে চড়ানোর জন্য শুধু অভিযোগ আরোপই যথেষ্ট? আইনি কার্যক্রম বা আদালতের শরণাপন্ন হওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। এটা সেই ভারত, যেখানে ১৬ ডিসেম্বরের অত্যন্ত বিভীষিকাময় ঘটনায় জড়িত অপরাধীদের মৃত্যুদণ্ড শোনানো সত্ত্বেও জেলে নিরাপদে রাখা হয়েছে। শুধু তাই নয়, বরং গণধর্ষণের মূল আসামি সুকেশ সিংয়ের সাাৎকার রেকর্ড করে সারা বিশ্বকে দেখানো হচ্ছে। সরকারকে শুধু এই চিন্তাটা পীড়া দিচ্ছে, মুকেশ সিংয়ের সাাৎকার সারা বিশ্বকে দেখিয়ে ভারতের বদনাম করা হচ্ছে; কিন্তু এটা নিয়ে কারো চিন্তা নেই, ধর্ষণের মিথ্যা অভিযোগ দিয়ে এক নিরপরাধ নাগরিককে মর্মান্তিক হত্যার মাধ্যমে ভারতকে লজ্জায় ফেলে দিয়েছে।

দুঃখের বিষয়, ফরিদ খানকে নির্দোষ প্রমাণ করার সুযোগ না দিয়ে ুধার্ত বাঘের হাতে তুলে দেয়া হয়। আর ১৬ ডিসেম্বরের মর্মান্তিক ঘটনার অপরাধীদের তিহাড় জেলে নিরাপদে রাখা হয়। আফসোসের কথা হচ্ছে, ফরিদ খানের নির্দোষ হওয়ার পে আজো কোনো প্রতিক্রিয়ামূলক বক্তব্য শোনা গেল না। আমাদের সম্মিলিত অন্তর কি মরে গেছে? আমরা একজন নিরপরাধ ব্যক্তির বেদনাদায়ক মৃত্যুর ওপর দু’ফোঁটা অশ্র“ও কি ঝরাতে পারি না। আমরা নিজেদের সভ্য জাতি বলতে বেশ গর্ববোধ করি। যখন কোনো ঘটনা আমাদের সভ্যতাকে আছড়ে পিষে ফেলে, তখন আমরা কানে তুলো দিয়ে বসে থাকি। যদি এটা মেনেও নেয়া যায়, ফরিদ খান ধর্ষণের দায়ে অভিযুক্ত ছিলেন, তাহলে তাকে শাস্তি প্রদানের জন্য আইন-আদালতের উপায় খোলা ছিল। কিন্তু ওইসব উপায়কে পায়ের তলায় পিষ্ট করে যে বর্বররা ফরিদ খানকে হত্যা করল, পরিশেষে তাদের শাস্তি দেবে কে? ডিমাপুর পুলিশ ওই বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারে বহু লোককে গ্রেফতার করেছে; কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে কোনো মোকাদ্দমা করা হয়নি। এখন পর্যন্ত নাগাল্যান্ড সরকারের প থেকে এমন কোনো পদপে গ্রহণ করা হয়নি, যার দিয়ে প্রমাণিত হয়, তারা এ ব্যাপারে ইনসাফের প।ে নাগাল্যান্ডের পুলিশের কর্মকর্তাদের যখন জিজ্ঞাসা করা হলো, তারা জেল ভাঙা ও আইন নিজের হাতে তুলে নেয়া জনতাকে ছত্রভঙ্গ করার জন্য ফায়ারিং কেন করলেন না? তাদের জবাব ছিল, ওই জনতার মধ্যে প্রচুর অল্পবয়সের ছাত্রছাত্রী ছিল। অথচ সোস্যাল মিডিয়ায় বিদ্যমান বর্বরদের ছবিগুলো নাগাল্যান্ড সরকারের ওই দাবির মুখোশ খুলে দেয়। কেননা ওই হামলাকারীদের বেশির ভাগই সমাজের শত্র“। যাদের চেহারায় তাদের অন্যায় কৃতকর্মের ছাপ লেখা ছিল। প্রকাশ থাকে, ফরিদ খানের বর্বরোচিত হত্যার অভিযোগ নিয়ন্ত্রণহীন উত্তেজিত জনতার ওপর আরোপিত হয়। আর ভারতের ইতিহাস বলে, আজ পর্যন্ত বিােভরত কোনো জনতার কোনোরূপ শাস্তি হয়নি।

মুম্বাই থেকে প্রকাশিত দৈনিক উর্দু টাইমস ১৫ মার্চ,

২০১৫ হতে উর্দু থেকে ভাষান্তর ইমতিয়াজ বিন মাহতাব



লেখক : ভারতের প্রখ্যাত সাংবাদিক ও কলামিস্ট

নয়াদিগন্ত অনলাইন থেকে সংগ্রহীত

বিষয়: আন্তর্জাতিক

৮৩০ বার পঠিত, ৬ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

317495
২৯ এপ্রিল ২০১৫ সন্ধ্যা ০৭:৫৭
ঘুম ভাঙাতে চাই লিখেছেন : ফরিদ খানের খবরটা পড়েছিলাম তাও একজন নীতিবান হিন্দুর মুখ থেকে ঘটনার সবটুকু জেনেছি। সবটুকু দেখার সাহস হয়নি চোখের পানি ঝরিয়েছি শুধু আল্লাহকে বলেছি আল্লাহ এদের ছাড় দিওনা পৃথিবী ও কিয়ামতের দিন।
০২ মে ২০১৫ বিকাল ০৪:৪৭
258872
মাজহারুল ইসলাম লিখেছেন : আমীন
317511
২৯ এপ্রিল ২০১৫ রাত ০৯:০১
রিদওয়ান কবির সবুজ লিখেছেন : ভারত তে একমাত্র হিন্দুত্ব ছারা কিছুই এক রাখেনি।
০২ মে ২০১৫ বিকাল ০৪:৪৭
258873
মাজহারুল ইসলাম লিখেছেন : জি ভাইজান।
317552
৩০ এপ্রিল ২০১৫ রাত ১২:৫২
শেখের পোলা লিখেছেন : নিজের দেশে চোখের সামনে মিথ্যা অভিযোগে এমন বর্বর হত্যাকাণ্ড একটার পর একটা ঘটে চলেছে৷ সমবেদনা জানাবার সাহস নেই, সেখানে অন্য দেশে কেমন করে সমবেদনা জানাব বলেন?
০২ মে ২০১৫ বিকাল ০৪:৪৮
258874
মাজহারুল ইসলাম লিখেছেন : তা ঠিক ভাই কিন্তু মুসলিম ভাই বলে একটা কথা আছে তাই লেখাটা শেয়ার করলাম।

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File