সিরিজ-১৪_"৮নং এবং ৯নং সেক্টরে যোগদান"

লিখেছেন লিখেছেন মাজহারুল ইসলাম ০৯ জুলাই, ২০১৩, ০৯:৫০:২৯ সকাল

স্বয়ং কর্নেল ওসমানীই আমাকে নিয়ে গিয়েছিলেন ৮নং এবং ৯নং সেক্টরের অধিনায়কদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে।

থিয়েটার রোড থেকে কর্নেল ওসমানী একদিন আমাকে নিয়ে চললেন ৮নং সেক্টর হেডকোয়ার্টারস বনগাঁয়, সাথে নূর। শহর থেকে প্রায় ৯০-৯৫ মাইল দূরে যশোর বর্ডারের গা ঘেসে বনগাঁ। ওখানে পৌঁছে কর্নেল ওসমানী আমাকে পরিচয় করিয়ে দিলেন ৮নং সেক্টর কমান্ডার মেজর ওসমান এবং ৯নং সেক্টর কমান্ডার ক্যাপ্টেন জলিলের সাথে। তাদের বিস্তারিত ব্রিফিং দিলেন তিনি। সেখানে পরিচয় হল বেঙ্গল রেজিমেন্টের ক্যাপ্টেন হাফিজ, লেফটেন্যান্ট হালিম, ক্যাপ্টেন হুদা, ক্যাপ্টেন সালাহ্‌উদ্দিন, পুলিশের এসডিপিও মাহবুব, সিএসপি কামাল সিদ্দিকী এবং তৌফিক এলাহী চৌধুরী ও লেফটেন্যান্ট মাহবুবের সাথে। ওরা সবাই আমাকে সাদর অভিনন্দন জানালেন। দুপুরের খাওয়ার পর কর্নেল ওসমানী নূরকে নিয়ে ফিরে গেলেন। যাবার আগে জানিয়ে গেলেন শীঘ্রই তিনি সেক্টর কমান্ডারদের একটি গুরত্বপূর্ন কনফারেন্স ডাকবেন কোলকাতায়। সে কনফারেন্সে মুক্তিযুদ্ধের বর্তমান স্তর এবং ভবিষ্যত রনকৌশল ও প্রাসঙ্গিক বিষয়াদি নিয়ে আলোচনা করে কর্মপদ্ধতি ঠিক করা হবে। থিয়েটার রোড ছেড়ে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের মাঝে পৌঁছে ভীষণ ভালো লাগছিল। মতিও আমি চলে আসার পরপরই উত্তর-পশ্চিম সীমান্তের সেক্টরগুলোর দায়িত্ব নিয়ে চলে যায়।

শুরু হল নতুন কর্মজীবন। খুলনা, যশোরের ছিন্নমূল ও বিক্ষিপ্ত অনেক ইপিআর, কিছুসংখ্যক নিয়মিত বাহিনীর সৈন্য, পুলিশ, আনসার, মুজাহিদদের নিয়ে মেজর ওসমানের অধিনে শুরু হয় প্রতিরোধ সংগ্রাম। তার সাথে যোগ দেয় স্থানীয় ছাত্র-জনতা। নড়াইলের তরুণ এসডিও জনাব কামাল সিদ্দিকী, মেহেরপুরের এসডিও তৌফিক এলাহী চৌধুরী এবং মাগুরার এসডিও ওয়ালীউর রহমানও প্রতিরোধে সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েন। মেজর ওসমান তার অধিনস্থ সমস্ত নিয়মিত ও অনিয়মিত বাহিনীর সদস্যদের ৭টি কোম্পানীতে বিভক্ত করে সীমান্তবর্তী এলাকায় তাদের নিয়োগ করেন।

১) প্রথম কোম্পানী উত্তরে মহেশকুন্ড বিওপি এলাকায় লেফটেন্যান্ট জাহাঙ্গীরের অধিনে।

২) দ্বিতীয় কোম্পানী তার দক্ষিনে ইছাখালী বিওপি এলাকায়। কোম্পানী কমান্ডার ছিলেন ক্যাপ্টেন আজম চৌধুরী।

৩) তৃতীয় কোম্পানী আরো দক্ষিনে জীবননগর বিওপি এলাকায়। নেতৃত্বে ছিলেন ক্যাপ্টেন মোস্তাফিজুর রহমান।

৪) চতুর্থ কোম্পানী কাশিমপুর-মুকুন্দপুর-বয়ড়া এলাকায় ক্যাপ্টেন খন্দোকার নাজমুল হুদার অধিনে।

৫) পঞ্চম কোম্পানী বেনাপোল কাস্টমস্‌ চেকপোষ্ট এলাকায় লেফটেন্যান্ট আবদুল হালিমের অধিনে। এ কোম্পানী পরবর্তী পর্যায়ে ক্যাপ্টেন তৌফিক এলাহী চৌধুরী সিএসপির অধিনে দেওয়া হয়।

৬) ষষ্ঠ কোম্পানী আরও দক্ষিনে বকশা-কাকডাঙ্গা-বেনাপোল থানার এলাকায় ক্যাপ্টেন শফিকউল্লার অধিনে।

৭) সপ্তম কোম্পানী ভোমরা এলাকার গোজভাঙ্গায় ক্যাপ্টেন সালাহ্‌উদ্দিনের অধিনে।

মে মাসের শেষে ক্যাপ্টেন সালাহ্‌উদ্দিনকে হেডকোয়ার্টারসে গোয়েন্দা বিভাগের দায়িত্ব নেয়ার জন্য চলে যেতে হয় মুজিবনগর তথা ৮নং থিয়েটার রোডে। তখন ঐ সেক্টরের দায়িত্ব দেয়া হয় পুলিশের এসডিপিও মাহবুবউদ্দিনকে। মে মাসের প্রথম সপ্তাহে প্রাক্তন ফ্ল্যাইট লেফটেন্যান্ট জামালউদ্দিন এমপি, ক্যাপ্টেন ওয়াহাব এবং লেফটেন্যান্ট এনামুল হক ৮নং সেক্টরে যোগদান করেন। ফ্ল্যাইট লেফটেন্যান্ট জামালউদ্দিনকে সেক্টর হেডকোয়ার্টারস এ ষ্টাফ অফিসার হিসাবে নিয়োজিত করা হয়।

যশোর ক্যান্টনমেন্ট থেকে পাক বাহিনীর ব্যুহ ভেদ করে ক্যাপ্টেন হাফিজের নেতৃত্বে বিদ্রোহ ঘোষণা করে যুদ্ধ করতে করতে বর্ডার পেরিয়ে ৮নং সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে যোগ দেন ফার্ষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অকুতোভয় সেনারা। বেনাপোল বর্ডার পর্যন্ত মাত্র ১৮৮ জন সৈনিককে জীবিত অবস্থায় নিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছিল হাফিজ। পুরো রেজিমেন্টের বাকি সবাই যুদ্ধে শাহাদাত বরণ করেছিলেন। বেনাপোল পৌঁছে সেক্টর হেডকোয়ার্টারস এর কাছেই সে তার ক্যাম্প প্রতিষ্ঠা করে। বনগাঁ বিওপির বিপরীতে মুক্ত এলাকায় বাংলাদেশের পতাকা সমুন্নত রাখার পবিত্র দায়িত্ব যথাযথ বীরত্ব ও সাহসিকতার সাথে ক্যাপ্টেন হাফিজের নেতৃত্বে ফার্ষ্ট ইস্ট বেঙ্গলের বীর জোয়ানরা শেষদিন পর্যন্ত পালন করেছিলেন। ক্যাপ্টেন হাফিজ আমার বিশেষ বন্ধু বিধায় ওর সাথেই আমার থাকার বন্দোবস্ত করি।

বরিশাল ও খুলনায় একইভাবে ২৫শে মার্চ রাতের পর থেকে প্রতিরোধ সংগ্রাম গড়ে তোলার দায়িত্ব নেন ক্যাপ্টেন জলিল। তিনি ছিলেন আর্মড কোরের একজন সৈনিক এবং পরে মেধাবলে অফিসার হয়েছিলেন তিনি। পুলিশ বাহিনীর অস্ত্রাগার লুন্ঠন করেই তিনি শুরু করেন প্রতিরোধ সংগ্রাম। তার সাথে যোগ দেন লেঃ মেহেদী, লেঃ জিয়া এবং লেঃ নাসের। এছাড়াও তার সাথে যোগ দিয়েছিলেন ক্যাপ্টেন হুদা, ক্যাপ্টেন শাহজাহান ওমর, লেঃ খুরশীদ প্রমুখ। লেফটেন্যান্ট খুরশীদ তথাকথিত আগরতলা মামলার একজন আসামীও ছিলেন। এরপর এমএ বেগ নামে একজন যুবক এসে নবম সেক্টরে যোগ দেয়। তিনি পাকিস্তান সেনা বাহিনীর একজন দক্ষ প্যারাস্যুট জাম্পার ও ফ্রগম্যান হিসেবে ট্রেনিংপ্রাপ্ত সৈনিক বিধায় পরে তাকে নৌবাহিনীতে শীপম্যান হিসাবে নিয়োগ করা হয়েছিল। ৯নং সেক্টরকে গঠন করা হয় খুলনার কিছু অংশ, ফরিদপুরের কিছু অংশ এবং পুরো বরিশাল ও পটুয়াখালী জেলা নিয়ে। সেক্টর কমান্ডার নিযুক্ত হন ক্যাপ্টেন জলিল। স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রথমার্ধে বরিশাল, পটুয়াখালীতে ক্যাপ্টেন মেহেদী, খুলনার সুন্দরবন এলাকায় লেঃ জিয়া এবং সীমান্তবর্তী এলাকায় ক্যাপ্টেন হুদা যুদ্ধ পরিচালনা করেছিলেন। জুলাই মাসে ৯নং সেক্টরকে পুনর্গঠিত করা হয়। বরিশাল জেলার দায়িত্ব দেয়া হয় পাকিস্তান থেকে পালিয়ে আসা ক্যাপ্টেন শাহজাহান ওমরকে। পটুয়াখালীর দায়িত্ব দেয়া হয় ক্যাপ্টেন মেহেদীকে। সুন্দরবন ও খুলনার দায়িত্ব দেয়া হয় লেঃ জিয়াকে। পিরোজপুর, বাগেরহাট এলাকা দেয়া হয় সুবেদার তাজুল ইসলামকে। ক্যাপ্টেন হুদাকে দেয়া হয় সীমান্তবর্তী এলাকা। সেক্টর হেডকোয়ার্টারস প্রথম স্থাপন করা হয় হাসনাবাদে। পরে সরিয়ে নেয়া হয় টাকীতে। সেক্টর হেডকোয়ার্টারসে থাকতেন ক্যাপ্টেন জলিল, এডজ্যুটেন্ট এর দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন ফ্ল্যাইট সার্জেন্ট ফজলুল হক ও মফিজ। এদের সাথে ষ্টাফ অফিসার হিসেবে ছিল ক্যাপ্টেন আরিফিন। সেক্টরের প্রধান প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ছিল তকিপুর। ইনচার্জ ছিলেন সুবেদার গোলাম আজম। ৯নং সেক্টরের নৌবাহিনীর দায়িত্বে ছিলেন চীফ পেটি অফিসার এম ইউ আলম। সুন্দরবনে লেঃ জিয়ার অধিনে ছিলেন ফুল মিয়া ও মধু। প্রথম পর্যায়ে টাকী, হাসনাবাদ, হিঙ্গলগঞ্জ এবং শমসের নগরে মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্প স্থাপন করা হল। এরপর হিঙ্গলগঞ্জের ক্যাম্প উক্‌শা পর্যন্ত বিস্তৃত করা হয়। এরপর বরিশাল, খুলনা অঞ্চলে ক্রমে যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়েছিল।

বিষয়: বিবিধ

১২৭৬ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File