সিরিজ - ৬ }--মহা পলায়ন--{
লিখেছেন লিখেছেন মাজহারুল ইসলাম ০২ জুলাই, ২০১৩, ০৩:২৪:০৮ দুপুর
লেঃ মতি, সেকেন্ড লেঃ নূর এবং আমি সর্বপ্রথম পাকিস্তান থেকে পালিয়ে এসে মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করি।
জাতীয় রাজনীতির এই ক্রান্তিলগ্নে আমি তখন কোয়েটায় ১৬ ডিভিশনের ৬২ ফিল্ড আর্টিলারী রেজিমেন্টে পোস্টেড। আমার আবাস কিংস রোডের আর্টিলারী অফিসার্স মেসে। আমি ছাড়াও তখন কোয়েটাতে বেশ কয়েকজন বাঙ্গালী অফিসার বিভিন্ন রেজিমেন্ট ও ব্যাটালিয়নে পোস্টেড ছিলেন। কর্নেল দস্তগীর জিওয়ান ডিভ হেডকোয়ার্টাস, মেজর হাফিজ ৬২ ফিল্ড রেজিমেন্ট, ক্যাপ্টেন শহীদ ৩৩ ক্যেভারলী, ক্যাপ্টেন শরফুল ৩৩ ক্যেভারলী, ক্যাপ্টেন মহ্সীন বেলুচ রেজিমেন্ট, মেজর মালেক বি এম, মেজর কাদের ইঞ্জিনিয়ার্স, ক্যাপ্টেন মাওলা ইএমই ব্যাটালিয়ন, ক্যাপ্টেন আমছা আমিন ইনফ্যানট্রি স্কুল, ক্যাপ্টেন জাকের, ক্যাপ্টেন হুদা, ক্যাপ্টেন শাফায়াত, লেফটেন্যান্ট হারুণ ২৬ ফিল্ড আর্টিলারী রেজিমেন্ট, ক্যাপ্টেন ইফতেখার, ক্যাপ্টেন মাজহার উদ্দিন মোল্লা, লেফটেন্যান্ট কে বি ৬৩ ফিল্ড আর্টিলারী রেজিমেন্ট, ক্যাপ্টেন জামাল এএমসি, ক্যাপ্টেন কাসেম এএসসি প্রমুখ। এছাড়াও ছিলেন বেশ কিছু সংখ্যক জেসিও, এনসিও ও জোয়ান ভাইরা স্কুল অফ ইনফ্যানট্রি এন্ড ট্যাকটিকস, ইএমই ব্যাটালিয়ন, সিগন্যাল ব্যাটালিয়ন, ডিভ হেডকোয়ার্টাস, ষ্টাফ কলেজ এবং ৩৩ ক্যেভারলী রেজিমেন্টে।
কোয়েটায় বাঙ্গালীদের ছোট পরিবার ছিল একটি সুখী পরিবার। আমরা সবাই মিলেমিশে হাসি আনন্দে কাটাতাম দিনগুলো। প্রায়ই আমরা সমবেত হতাম কোথাও না কোথাও। চলতো আলাপ-আলোচনা, হাসি-ঠাট্টা, গান-বাজনা, গল্প-গুজব। জাতীয় সংকট আমাদের মাঝের ব্যবধানকে কমিয়ে আনলো আরো। সবাই দেশ সম্পর্কে সচেতন, সবাই শংকিত। ভাবনায় আকুল, কি হচ্ছে? ঘটনা প্রবাহের পরিণাম কি? প্রেসিডেন্ট আইয়ূবের ক্ষমতা লিপ্সা কোথায় নিয়ে যাবে দেশটাকে? পাকিস্তান টিকে থাকবে কি করে? অন্যায়, অবিচার, শাসন-শোষণ শেষ হবে কবে? আইয়ূব খানের প্রশাসন র্ব্যথ হয়েছে সম্পূর্ণরূপে। জাতীয় বৃহত্তর স্বার্থে তিনি কি গ্রহণযোগ্য রাজনৈতিক সমাধান মেনে নেবেন আলোচনার মাধ্যমে? নাকি ক্ষমতার মোহে দেশকে আরো রসাতলে টেনে নিয়ে যাবেন? গোপনে আমরা মিলিত হই বিভিন্ন জায়গায়। আলোচনার মাধ্যমে খুঁজে পেতে চাই এ সমস্ত প্রশ্নের জবাব। খবরা-খবরের আদান-প্রদান হয় নিজেদের মধ্যে। প্রতিটি নতুন খবর পর্যালোচনা করি অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে। খবর পাই দেশ থেকে আসা চিঠিপত্রের মাধ্যমে। মনযোগ দিয়ে শুনি বিবিসি, ভয়েস অফ আমেরিকা, অল ইন্ডিয়া রেডিও, ভয়েস অফ অস্ট্রেলিয়া প্রভৃতি কেন্দ্রের প্রচারিত অনুষ্ঠানগুলি। জাতীয় রেডিও এবং টিভি মাধ্যমের প্রচারিত খবর একপেশে হওয়ায় বিশ্বাসযোগ্য মনে হয় না। মাঝে মধ্যে সিগন্যালস্ সেন্টারের বাঙ্গালী ভাইরা নিয়ে আসে জিএইচকিউ থেকে প্রেরিত গোপন বার্তাসমূহের সারবস্তু। এ থেকে শাসকচক্রের মন মানসিকতা সম্পর্কে কিছু তথ্য পাওয়া যায়। কিন্তু সেটাই বা কতটুকু। পূর্ব পাকিস্তানের গণআন্দোলনের প্রতি মুহুর্তের ঘটনাবলী জানার জন্য মন উদগ্রীব হয়ে থাকে তীর্থের কাকের মত। দেড় হাজার মাইল দূরত্বে বসে সীমিত মাধ্যমে ঘটনা প্রবাহের যতটুকু খবরা-খবরই পাচ্ছিলাম, তার চুলচেরা বিশ্লেষন করে অবস্থার সাথে নিজেদের যতটুকু সম্ভব সম্পৃক্ত রাখার চেষ্টা করছিলাম আমরা। কিন্তু সবকিছুই করতে হচ্ছিল বিশেষ সতর্কতার সাথে। মনের দাহ ও আক্রোশ অতি কষ্টে চেপে রেখে স্বাভাবিকভাবে দৈনন্দিন দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছিলাম সবাই। নিজেদের সংযত রেখে ধৈর্য্য সহকারে অবস্থার মোকাবেলা করতে হবে সবাইকে; এ সিদ্ধান্তই গৃহিত হয় গোপন বৈঠকগুলোতে। আশা-নিরাশার এক ভয়াবহ অনিশ্চয়তায় কাটছিল আমাদের প্রতিটা মুহুর্ত।
মার্চের ৩০ তারিখে আমরা বিবিসি, ভয়েস অফ আমেরিকা, অল ইন্ডিয়া রেডিও, রেডিও অষ্ট্রেলিয়া প্রভৃতি ষ্টেশনগুলো থেকে প্রচারিত নিবন্ধ থেকে পূর্ব পাকিস্তানে ঘটা ২৫-২৬শে মার্চ রাতের ঘটনা ও পরবর্তী দিনগুলোর ঘটনাবলী সম্পর্কে অনেক কিছুই জানতে পারি। বাংলাদেশে ফেলে আসা আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব, পরিচিতজনদের অবস্থা ভেবে ভারাক্রান্ত হয়ে উঠে মন। পাকিস্তান সরকার ও সেনা বাহিনীর ন্যাক্কারজনক আচরণে বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠি। সেই সেনা বাহিনীতেই চাকুরী করছি বলে নিজের প্রতি আত্মধিক্কার জাগে মনে। ভাবি, এ অবস্থায় প্রবাসে বসে আমাদের কি কিছুই করণীয় নেই? বাঙ্গালীদের ঘোষিত স্বাধীনতা সংগ্রামে আমাদের কি কোন দায়িত্বই নেই? সমগ্র বাঙ্গালী জাতির সাথে একাত্মতা ঘোষণা করে স্বাধীনতা সংগ্রামে অবদান রাখার জন্য আকুল হয়ে উঠে মন। অস্বস্তিকর পরিবেশে শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থায় সময় কাটতে থাকে আমাদের।
ইতিমধ্যে আমাদের কোর্সও প্রায় শেষ হচ্ছে। কোর্সে আগত বাঙ্গালী অফিসারদের মধ্যে ক্যাপ্টেন তাহের, সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট নূর চৌধুরী এবং লেফটেন্যান্ট মতির সাথে আমার ঘনিষ্ঠতা হয়। চিন্ত-ভাবনার মিলই ছিল আমাদের এই ঘনিষ্ঠতার প্রধান কারণ। আমি লোকাল অফিসার। এরা প্রায়ই আমার মেসে আসত। দল বেধে আনন্দ-ফুর্তি করে আমরা অবসর কাটাতাম। একসাথে খাওয়া, বেড়াতে যাওয়া, সিনেমা দেখা, ক্লাবে আড্ডা মারা ছিল আমাদের বিনোদনের উপায়। লেফটেন্যান্ট সুমিও প্রায়ই আমাদের সাথে যোগ দিত। আমরা একত্রিত হয়ে আনন্দ-ফুর্তি করতাম ঠিকই কিন্তু তার ফাঁকে আলোচনা চলত বাংলাদেশ নিয়ে। সবারই একই চিন্তা। আমাদের কিছু একটা করা উচিত। মুখ বুজে সব অত্যাচার সহ্য করে নির্বিকার হয়ে বসে থাকলে চলবে না। জাতীয় সংগ্রামে আমাদের সাধ্যমত অবদান রাখতে হবে। কিন্তু কি করা সম্ভব! ইতিমধ্যে জানতে পারলাম আমাদের ১৬ ডিভিশনকে পূর্ব পাকিস্তানে পাঠানো হবে। অত্যন্ত সুখবর! ডিভিশন গেলে আমিও ইউনিটের সাথে পূর্ব পাকিস্তানে যেতে পারব। খবরটা পেয়ে তাহের, নূর, মতি এবং সুমি সবাই খুশি। কোর্স শেষ হল। কিন্তু স্কুল কর্তৃপক্ষ আদেশ জারি করলেন পূর্ব পাকিস্তান থেকে আগত কোন অফিসারকে তাদের ইউনিটে ফেরত পাঠানো হবে না। তাদের সবাইকে পশ্চিম পাকিস্তানে বিভিন্ন ইউনিটে পোষ্টিং দেয়া হবে। এ কি ব্যাপার! এমনটি তো হবার কথা নয়। আমরা সবাই বিভ্রান্ত হয়ে পরলাম। কোর্স শেষে ইউনিটে ফিরে যাওয়াইতো নিয়ম; তাহলে এ ধরণের আদেশের উদ্দেশ্য কি? তাহের, নূর, মতি সবার ইউনিটই পূর্ব পাকিস্তানে। তারা সবাই আটকা পড়ে গেল। আর আমি ফিরে এলাম ইউনিটে। কিন্তু ইউনিটে যোগদান করেই বুঝতে পারলাম অবস্থার অনেক পরিবর্তন হয়েছে। পরিবেশও অনেক বদলে গেছে। ইতিমধ্যে দেশে ইমারজেন্সী ঘোষিত হল।
একদিন আমার কমান্ডিং অফিসার কর্নেল মিয়া হাফিজ আমাকে তলব করে পাঠালেন। তার অফিসে যাওয়ার পর তিনি কিছুটা বিব্রতভাবেই বললেন, “শরীফ ব্যাটারি কমান্ডারের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দিয়ে আমি তোমাকে এ্যাডজুটেন্ট পদে বহাল করতে চাই। দেশের এই নাজুক পরিস্থিতিতে আমার ষ্টাফ অফিসার হিসাবে তোমাকেই আমি মনোনীত করেছি।” তার কথা শুনে আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম। আমার সাথে কর্নেল হাফিজের সম্পর্ক ছিল খুবই ভাল। ব্যাচেলার হ্যাপিগোলাকি টাইপ কমান্ডো কর্নেল হাফিজ আমাকে খুবই পছন্দ করতেন। আমি তাই সরাসরি তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, “স্যার আমি ইউনিটে সিনিয়র অফিসারদের মধ্যে একজন। সে ক্ষেত্রে আমাকে ব্যাটারি কমান্ডারের দায়িত্ব থেকে সরিয়ে নিয়ে জুনিয়র পদে নিয়োগ করার সিদ্ধান্ত নিলেন কেন? বেচারা কর্নেল হাফিজ মুখ কাচুমাচু করে বললেন, “দেখ, জিএইচকিউ থেকে অর্ডার এসেছে কোন বাঙ্গালী অফিসারকে দায়িত্বপূর্ন কোন পদে রাখা যাবে না। তাছাড়া বর্তমান অবস্থায় সব বাঙ্গালীদের উপর নজর রাখার নির্দেশও জারি করা হয়েছে। তোমার শুভাকাঙ্খী হিসাবে এই গোপনীয় নির্দেশের কথা তোমাকে বিশ্বাস করে বললাম। আমার অনুরোধ সব বুঝে তুমি চোখ-কান খোলা রেখে সতর্কতার সাথে চলবে। তোমার কোন কিছু হলে ব্যক্তিগতভাবে আমি কষ্ট পাব। বোঝার চেষ্টা কর, নেহায়েত অপারগ হয়েই আমি এ ধরণের সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছি।
তার সিদ্ধান্তে কষ্ট পেলেও তার আন্তরিক স্বীকারোক্তি শুনে তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে তার অফিস থেকে বেরিয়ে এলাম। তার সতর্কবাণী সবাইকে জানাবার জন্য ছুটে গেলাম ক্যাপ্টেন তাহেরের মেসে। সেখানে ডেকে পাঠালাম নূর এবং মতিকে। সব শুনে সবাই ঠিক করলাম আমাদের সবকিছুই করতে হবে অতি সাবধানে। পশ্চিমারা আমাদের সব বাঙ্গালীকেই অবিশ্বাসের চোখে দেখছে। তাই এতটুকু অসতর্ক হলে আর রক্ষা নাই। মহাবিপদে পড়তে হতে পারে। সিদ্ধান্ত নিলাম স্বাভাবিকতা বজিয়ে চলতে হবে আমাদেরকে। অত্যন্ত সতর্কতার সাথে গোপনে মিলিত হব আমরা। বাংলাদেশ সম্পর্কে বিশ্বস্ত লোক ছাড়া অন্য কারো সাথে আলোচনা করা ঠিক হবে না। কর্নেল মিয়া হাফিজের সাথে আলাপের পর ঠিক বুঝতে পারলাম ইউনিটের সাথে আমার আর বাংলাদেশে যাওয়া হবে না। ঘটনা প্রবাহ এগিয়ে চলল অতি দ্রুতগতিতে। হঠাৎ করে ডিভিশন হেডকোয়ার্টারসের জিওয়ান বাঙ্গালী অফিসার কর্নেল দস্তগীরকে বদলি করে দেয়া হল জিওয়ান মুজাহিদ কোর হেডকোয়ার্টারস লাহোরে। তার এ বদলিতে আশ্চর্য হয়ে গেল কোয়েটাতে অবস্থিত সব বাঙ্গালী। আমাদের কাছে ব্যাপারটা স্বাভাবিক ছিল কিন্তু অন্যান্য বাঙ্গালীরা অবাক হয়ে গেল তার এ অস্বাভাবিক পোস্টিং এ। ডিভিশনের বাঙ্গালীরা যারা বাংলাদেশে যাবার আশায় উম্মুখ হয়ে ছিলেন তাদের গুড়ে পড়ল বালি। আমি ও নূর একদিন গেলাম কর্নেল দস্তগীরের বাসায়। তার পরিবার তখন বাংলাদেশে। তাকে বললাম,
-স্যার এরপরও কি আমাদের চুপচাপ বসে থাকা যুক্তিসঙ্গত?
-কি করতে চাও? পাল্টা প্রশ্ন করলেন তিনি। আমি বললাম,
-দেশের সংগ্রামে অবদান রাখার চেষ্টা করতে হবে যেভাবেই হোক।
-পাগল হয়েছ? দেড় হাজার মাইল দূরে বসে কি করতে পার তোমরা?
-পালিয়ে গিয়ে যোগদান করতে পারি স্বাধীনতা সংগ্রামে। নয়ত বেলেলির এ্যামুনিশন ডিপো উড়িয়ে দিতে পারি। এতে করে সমস্ত সামরিক বাহিনীর সেকেন্ড লাইন এ্যামুনিশন ধ্বংস হয়ে যাবে। অপূরনীয় ক্ষতি হবে সামরিক জান্তার। যুদ্ধ করার ক্ষমতাও কমে যাবে অনেকাংশে।
-পাগল নাকি? কি সব অদ্ভুত কথা ভাবছ? ইমোশনাল হয়ে এ ধরণের পদক্ষেপ নিলে তোমরা তোমাদের জন্যই শুধু বিপদ ডেকে আনবে না, বিপদ ডেকে আনবে পশ্চিম পাকিস্তানের সব বাঙ্গালীর জন্য। অবাস্তবব চিন্তধারা। তিনি আমাদের স্মরণ করিয়ে দিলেন,
-পাসিং আউট করার দিন শপথ নিয়েছিলে, “ To remain loal to the constitution. So be faithful and Prove your integrity.” পরিশেষে তিনি বললেন, তার উপর কড়া নজর আছে; তাই সাবির্ক মঙ্গলের জন্য এভাবে যখন তখন তার সাথে যেন দেখা না করি। কি আশ্চর্য্য! এই দস্তগীর সাহেবকে জানতাম ভীষণভাবে বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদী চেতনায় উদ্বুদ্ধ একজন সাচ্চা দেশপ্রেমিক হিসাবে। তাকে শ্রদ্ধাও করতাম সে কারণে। কিন্তু একি! আজ তার মুখ থেকে একি শুনছি! মুহুর্তে মনটা বিষিয়ে উঠলো, নূরকে বললাম,
-চলো যাওয়া যাক। বেরিয়ে আসছিলাম। তিনি বললেন,
ÑDon’t be so sentimental. Even if Bangladesh becomes a reality, Preserve yourself, Bangladesh can’t go without you and me. তার সুবিধাবাদী উক্তি শুনে গা’টা ঘিন্ঘিন্ করে উঠল। এ সংসারে সত্যিই মানুষ চেনা দায়! বিক্ষুব্ধ মন নিয়ে আমি ও নূর ফিরে এলাম। এরপর যেদিন তিনি লাহোরের পথে যাত্রা করছিলেন সেদিনও তাকে আকুল মিনতি জানিয়েছিলাম, “স্যার এখনও সময় আছে। আপনার মত বিচক্ষণ সিনিয়র অফিসারের প্রয়োজন স্বাধীনতা সংগ্রামীদের। আপনি রাজি থাকলে আমরা বুকের রক্ত বাজি রেখে আপনাকে সাথে করে পালিয়ে যাবার চেষ্টা করতে পারি।” তিনি রাজি হলেন না। রওনা হয়ে গেলেন লাহোরের পথে। ফিরে এলাম হতাশ হয়ে। এবার একাই সিদ্ধান্ত নিলাম বেলেলি ডিপো উড়িয়ে দেবার। কমান্ডো ট্রেনিং ছিল আমার। Sympathetic Detonation এর মাধ্যমে Explosive দিয়ে Sabotage করে উড়িয়ে দেব ডিপো। তখন আমার বিশেষ এক বন্ধু ছিল ডিপোর চার্জে। তার ওখানে যাওয়া-আসার মাধ্যমে সব প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ করতে লাগলাম অতি গোপনে। পাঠান বন্ধুটি বাঙ্গালীদের প্রতি ছিল বেশ সহানুভূতিশীল। প্রয়োজনীয় তথ্যাদি সংগ্রহ করে একটা Trace তৈরি করে ফেললাম। Trace টা নিয়ে একদিন গেলাম ইঞ্জিনিয়ার্স এর মেজর কাদেরের বাসায়। উদ্দেশ্য তাকে দিয়ে পরখ করিয়ে নেব আমার Trace টা ঠিক হয়েছে কিনা। তাকে গিয়ে সব কথা খুলে বলে তার সাহায্য প্রার্থনা করলাম। আমার প্ল্যান শুনে তিনি ভীষণভাবে আতঁকে উঠলেন। বললেন, “কি সাংঘাতিক! তোমার কি মাথা খারাপ হয়েছে ডালিম? তুমি কি বুঝতে পারছো না কি করতে যাচ্ছ তুমি? তোমার প্ল্যান কার্যকরী করলে প্রায় কোয়েটা শহরটাই ধ্বংস হয়ে যাবে। তাতে আমরাও ধ্বংস হয়ে যেতে পারি। তাছাড়া তোমার এ কাজ অত্যন্ত ঝুকিঁপূর্ণ। আমি এ ব্যাপারে তোমাকে Encourage করতে পারি না। আমার অনুরোধ তুমি আমাকে ভুল বুঝোনা।” এখানেও হতাশা। ফিরে আসার আগে তাকে অনুরোধ জানিয়েছিলাম আমার প্ল্যান সম্পর্কে তিনি যেন অন্য কোন তৃতীয় ব্যক্তির সাথে আলাপ না করেন। তিনি রাজি হয়েছিলেন। কিন্তু প্রতিদানে আমাকেও কথা দিতে হয়েছিল আমি এ ধরণের কাজ থেকে বিরত থাকব। আমি কিন্তু আমার প্ল্যান কার্যকরী করার চেষ্টা করে চলেছিলাম। ইতিমধ্যে হঠাৎ করেই আমার বন্ধু একদিন বদলি হয়ে পিন্ডি চলে গেল। আমার মাথায় বাজ পড়ল। তার অবর্তমানে ডিপোতে আসা-যাওয়ার সুযোগ বন্ধ হয়ে গেল ফলে বাধ্য হয়ে আমাকে আমার পরিকল্পনাও বাদ দিতে হল। দুঃখ পেয়েছিলাম অনেক। কিন্তু অতিকষ্টে নিজেকে সামলে নিতে হল। নতুন করে আবার ভাবতে শুরু করলাম কি করা যায়? ঠিক করলাম পালিয়ে গিয়ে যোগ দিব স্বাধীনতা সংগ্রামে। এমন অবস্থায় একদিন নূর এল আমার মেসে। লনে বসে আলাপ করছিলাম দু’জনে। হঠাৎ করেই নূর বলল,
-স্যার, ক্যাপ্টেন তাহের আপনাকে ডেকেছেন। জরুরী আলাপ আছে।
-ঠিক আছে। আজ রাতে আমরা একসাথে তার মেসে ডিনার করব।
নূর চলে গেল। কি এমন জরুরী আলাপের জন্য ক্যাপ্টেন তাহের ডেকে পাঠিয়েছেন ভেবে কোন কুল কিনারাই পেলাম না। সন্ধ্যার পর গিয়ে হাজির হলাম তার মেসে। নূর ইতিমধ্যেই এসে গেছে। ডিনারের আগে তার রুমে বসে গান শুনছিলাম। গানের আওয়াজের আড়ালে নিচু গলায় আমরা আলাপ শুরু করলাম। কোন ভণিতা ছাড়াই ক্যাপ্টেন তাহের বলল,
-ডালিম, আমি ও নূর পালিয়ে যাবার সিদ্ধান্ত নিয়েছি চমন বর্ডার দিয়ে আফগানিস্তানে। সেখান থেকে বাংলাদেশ। আকবর বখ্তির ছেলেদের সাথে তোমার বন্ধুত্ব আছে। তাছাড়া তুমি স্থানীয় অফিসার। এ ব্যাপারে আমরা তোমার সাহায্য চাই। স্বল্পভাষী ক্যাপ্টেন তাহেরের অনুরোধের জবাবে বললাম,
-স্যার আমিও পালাবার চেষ্টা করছি। ক্যাপ্টেন তাহের আমার জবাব শুনে খুব খুশি হলেন। আমাকে জড়িয়ে ধরে বললেন,
-তাহলে তুমি সময় নষ্ট না করে যেভাবেই হোক বর্ডারটা একবার রেকি (Recce) করে আস। আমি সম্মতি জানিয়ে ফিরে এলাম মেসে। আমরা তিনজনে কোরআন শরীফ হাতে নিয়ে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম আমাদের এ পরিকল্পনা সম্পর্কে কাউকেই কিছু বলা চলবে না। সুযোগমত একদিন Regimental Exercise Area Recce করার উছিলায় ইউনিটের গাড়ি নিয়ে প্রফুল্লচিত্তে (Recce) করে ফিরে এলাম। বন্ধুরা আমাদের পালাতে সাহায্য করবে জানতে পেরে নূর ও তাহের দু’জনেই খুশিতে আত্মহারা হয়ে উঠল। এভাবে সব যখন প্রায় ঠিকঠাক হঠাৎ করে একদিন সিগন্যাল কোরের হাবিলদার নাজির রাতের অন্ধকারে আমার সাথে দেখা করতে এল। লোকাল বাঙ্গালী অফিসার হিসাবে সবার সাথেই আমার যোগাযোগ ছিল। বিশেষ করে জুনিয়রদের মধ্যে আমার একটা বিশেষ প্রভাব ছিল। নাজিরের মত সিনিয়র, জুনিয়র অনেকেই তাদের সমস্যাদি নিয়ে আমার কাছে আসতো সুখ-দুঃখের কথা কইতে এবং আমার পরামর্শ নিতে। ভাবলাম, নাজিরও নিশ্চয়ই তেমন কোন ব্যাপারেই আলাপ করতে এসেছে। কিন্তু তাকে দেখেই আতঁকে উঠলাম। তার মুখ ভীষণভাবে থমথম করছিল। চোখ দু’টোও টলটল করছিল। তাকে দেখে পরিষ্কার বুঝতে পারছিলাম ভীষণ কিছু ঘটেছে। আমি তাকে নিয়ে সোজা আমার ঘরে চলে গেলাম।
- কি হয়েছে নাজির? এত গম্ভীর কেন?
জবাবে নাজির অতি নিচুস্বরে বলল,
- স্যার সর্বনাশ হয়ে গেছে। ডিভ-কমান্ডার GHQ-তে Cypher Message এর মাধ্যমে জানিয়েছেন ২৯ EME Batalion এর ৩জন Junior Commission Officer (JCO) এবং ২জন Non-Commission Officer (NCO) চমন হয়ে আফগানিস্তানে পালাতে গিয়ে ধরা পড়েছে।
খবর শুনে আমার মাথা ঘুরে গেল। নাজিরকে ধন্যবাদ জানিয়ে বিদায় দিয়ে ছুটে গেলাম ক্যাপ্টেন তাহেরের মেসে। ডেকে পাঠানো হল লেফটেন্যান্ট নূরকে। গভীর রাত অব্দি আলোচনার পর সিদ্ধান্ত হল চমন বর্ডার দিয়ে পালানোর প্রচেষ্টা হবে অত্যন্ত বিপদজনক। তাই এই পথ পরিত্যাগ করে অন্য পথে পালাবার চেষ্টা করতে হবে। অন্য পথ হিসাবে আমাদের সামনে খোলা থাকলো কাশ্মীর, লাহোর, শিয়ালকোট কিংবা ভাওয়ালপুর সেক্টর। ভাওয়ালপুর সেক্টর দিয়ে রাজস্থানের মরুভূমি পাড়ি দিতে সময় লাগবে দুই থেকে তিন দিন। অন্যান্য যে কোন সেক্টর দিয়ে বর্ডার পেরোতে লাগবে ৫ থেকে ৬ দিন। এত সময় পাওয়া যাবে কিভাবে অনেক চিন্তা-ভাবনা করে ভাওয়ালপুর-ভাওয়ালনগর সেক্টরকেই বেছে নিলাম আমরা। এ সেক্টর দিয়ে পালাতে শুধু সময়ই কম লাগবে তা নয় আমাদের ডিভিশনের অপারেশনাল এরিয়া ছিল এই সেক্টর। ফলে প্রয়োজনীয় ইনটেলিজেন্স ইনফর্মেশন সংগ্রহ করাও সহজ হবে। পালাবার পরিকল্পনা করার দায়িত্ব যুক্তিগত কারণেই আবার আমাকেই নিতে হল। শুরু হল আবার এক নতুন পরিকল্পনা। এভাবেই সময় বয়ে যাচ্ছিল।
এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহের এক ছুটির দিনে, দুপুরের খাওয়া শেষ করে মেস থেকে ফিরে বিছানায় গড়াগড়ি দিচ্ছিলাম, হঠাৎ করে দরজায় কড়া নড়ে উঠল। কে জিজ্ঞেস করতেই লেফটেন্যান্ট মতির গলা শুনতে পেলাম। ভেতরে এল মতি। শুকনো মুখ, মলিন চেহারা। চিন্তিত লাগছিল ওকে। জিজ্ঞেস করলাম,
-কি ব্যাপার! হঠাৎ কি মনে করে এলে?
-স্যার কিছুদিন যাবত মানসিক যন্ত্রনায় ভুগছি ভীষণভাবে। অবশেষে আজ মনস্থির করে এসেছি আপনার পরামর্শ নিতে।
-খুব সিরিয়াস ব্যাপার কিছু কি?
-হ্যাঁ স্যার। মনস্থির করে ফেলেছি। পালাবো। যে করেই হোক পালিয়ে গিয়ে স্বাধীনতা সংগ্রামে শরীক হবো। চেষ্টা ব্যর্থ হলে যা হবার তা হবে। যে কোন ঝুঁকি নিতে আমি প্রস্তুত। আপনি কি বলেন?
ভালো করে তার মুখের দিকে চেয়ে তার মনের ছবি পড়বার চেষ্টা করলাম। না, তাকে ভীষণ সিরিয়াস মনে হল। কিন্তু আমরা প্রতিজ্ঞা করেছি আমাদের তিনজনের সিদ্ধান্তের কথা কাউকে বলা যাবে না। তাই সে মুহুর্তে আমাদের চিন্তা-ভাবনার কথা না বলে শুধু বললাম,
-মতি তোমার আন্তরিকতা প্রশংসনীয়। কিন্তু আমি এ ব্যাপারে কি করতে পারি?
মতি চুপ করে ভাবছিল কিছু। আমি বেয়ারাকে ডেকে নাস্তার ফরমায়েস দিলাম। নাস্তা এল। মতি তৃপ্তির সাথে খেলো নাস্তা। ওর খাওয়া দেখে বুঝতে পারছিলাম দুপুরের খাওয়া হয়নি তার। হঠাৎ করেই মতি প্রশ্ন করল,
-স্যার সবকিছু সম্পর্কে আপনি আমার চেয়ে অনেক বেশি জানেন। এ অবস্থায় আমরা চোখ-কান বন্ধ করে হাত গুটিয়ে শুধু বসে থাকব? আমাদের কি কোন দায়িত্বই নেই? আপনি কি কিছুই ভাবছেন না? আমি মতির প্রশ্নের তাৎক্ষনিক জবাব না দিয়ে বললাম,
-কাল বিকেলে চায়না ক্যাফেতে ৬টায় এসো; আলাপ হবে বিস্তারিত।
মতি চলে গেল। ও চলে যাবার পর আমি কাপড় পড়ে গাড়ি নিয়ে সোজা বেরিয়ে গেলাম নূরের কাছে। গিয়ে দেখি নূর দিবা নিদ্রা দিচ্ছে। ওকে উঠালাম ঘুম থেকে। প্রথমে নূর কিছুটা থতমত খেয়ে গিয়েছিল।
-কি ব্যাপার স্যার হঠাৎ আপনি! এ সময়ে?
-বিশেষ প্রয়োজনে এসেছি নূর। তাকে মতির ব্যাপারে সব খুলে বললাম। সব শুনে নূর বলল,
-মতির ব্যাপারে আপনি কি ভাবছেন। আমি বললাম,
-ওকে সঙ্গে নিলে কেমন হয়? নূর কিছুক্ষন চিন্তা করে বলল,
-আমার আপত্তি নেই তবে ক্যাপ্টেন তাহেরের মতামতটা জানা দরকার।
-বেশ তবে চল তার ওখানেই যাওয়া যাক।
-তাই চলুন।
আমার গাড়িতে করেই গেলাম ক্যাপ্টেন তাহেরের ওখানে। তাকে সব কথা খুলে বলে জানালাম তাকে সঙ্গে নিতে আমার এবং নূরের কোন আপত্তি নেই। ক্যাপ্টেন তাহের আমাদের সাথে একমত হয়ে বললেন, ঠিক আছে ও যদি বিশ্বাসযোগ্য হয় তবে তাকে সঙ্গে নেয়া হোক। ফিরে এলাম; পথে নূরকে নামিয়ে দিয়ে। পরদিন নির্ধারিত সময়ে আমি ও নূর চায়না ক্যাফেতে গেলাম মতির সাথে আলোচনা করতে। গিয়ে দেখি মতি আমাদের পৌঁছার আগেই আমাদের প্রিয় ডিশগুলোর অর্ডার প্লেস করে অপেক্ষা করছে। চায়না ক্যাফে তখন কোয়েটা শহরের একমাত্র চাইনিজ রেস্তোরা। আমাদের বিশেষ পছন্দের আড্ডা মারার জায়গা। একটি চাইনিজ পরিবার বাবা, মা ও মেয়ে মিলে রেস্তোরাটা চালায়। আমরা তাদের পুরনো রেগুলার কাষ্টমার। তাই গেলে বিশেষ খাতির-যত্ন করে। আমরা যোগ দেবার পরপরই খাওয়া শুরু হল। সাথে আলোচনা। আমি প্রথমেই বললাম,
-মতি তোমার গতকালের প্রশ্নের জবাব আজ দিচ্ছি। কোন কারণবশতঃ সেটা কাল দেয়া সম্ভব হয়নি। আমি, নূর এবং ক্যাপ্টেন তাহের পালাবার চেষ্টা করছি বেশ কিছুদিন যাবত। চমন বর্ডার দিয়ে পালাবার চেষ্টা করেছিলাম কিন্তু EME Batalion এর ঘটনার পর সে পরিকল্পনা বাদ দিতে হয়েছে। এখনও চেষ্টা করছি ভাওয়ালপুর-ভাওয়ালনগর হয়ে রাজস্তান বর্ডার ক্রস্ করব। তুমি আমাদের সঙ্গে ইচ্ছে হলে আসতে পার। মতির চোখে মুখে খুশি উপছে পড়লো।
-স্যার, আমি জানতাম আপনি এ সময়ে চুপ করে বসে থাকতে পারেন না।
- I am so happy that I can’t tell you. I am proud of you Sir.
আমি পকেট থেকে ছোট্ট একটা কোরআন শরীফ বের করে তার উপর হাত রেখে ওকে শপথ নিতে বললাম। ও কোরআন শরীফের উপর হাত রাখলো। আমি বললাম,
-বলো, আমাদের পরিকল্পনা সম্পর্কে অন্য কোন ব্যক্তিকে কিছু বলা চলবে না, কোন পরিস্থিতিতেই। প্রয়োজনমত তোমাকে যে দায়িত্ব দেয়া হবে সেটা বিনা প্রশ্নে তুমি পালন করবে। অযাচিতভাবে পরিকল্পনা সম্পর্কে কৌতুহলবশতঃ কোন প্রশ্ন তুমি করতে পারবে না। একে অপরের উপর সম্পুর্ণ বিশ্বাস রেখে সমস্ত সিদ্ধান্ত মেনে চলবে।
আমার কথাগুলোর পুনরাবৃত্তি করল মতি। কোন জড়তা নেই। কোন দ্বিধা নেই। এভাবেই শেষ হল আমাদের বৈঠক।
আমার উপর দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল সবচেয়ে শর্টকাট এবং গ্রহণযোগ্য পথ খুজে বের করা এবং সে পথের Operational map sheet যোগাড় করে তার উপর Own troops এবং Enemy troops position এবং Deployment Trace যোগাড় করা। তাছাড়া কম্পাস, বাইনোকুলার এবং Personal weapons যোগাড়ের দায়িত্বও আমাকেই নিতে হয়েছিল লোকাল অফিসার হিসাবে। এর সবগুলোই আমার রেজিমেন্টে বিস্তর রয়েছে কিন্তু Classified items হিসাবে Operational purpose ছাড়া এগুলো ষ্টোর থেকে বের করার হুকুম নেই। তাই অন্যপথ খুঁজে বের করতে হল। ম্যাপ যোগাড় করার জন্য ঠিক করলাম ইনফ্যানট্রি স্কুলের ইনন্টেলিজেন্স এর বাঙ্গালী হাবিলদার শফিকের সাহায্য নেব। ছেলেটার সাথে কোর্স করার সময় বেশ ঘনিষ্ঠ হয়ে পড়েছিলাম। কোর্সে বাঙ্গালী হয়েও ভালো রেজাল্ট করায় ও আমাকে বিশেষভাবে শ্রদ্ধা করত। ক্লাশের ফাকে ফাকে প্রায়ই ওর সাথে দেশ নিয়ে আলাপ হত। ও অনেক কথাই বলত আমাকে আপনজন ভেবে, বিশ্বাস করে। কোর্স করার সময় ও সবসময় আমাকে নানাভাবে সাধ্যমত সহযোগিতা করত অত্যন্ত আন্তরিকতার সাথে। এ সম্পর্কের পরিপ্রেক্ষিতেই আমি ঠিক করেছিলাম, দেখা যাক না চেষ্টা করে ও আমাকে ম্যাপের ব্যাপারে কোন সাহায্য করে কিনা। একদিন ওকে খবর পাঠালাম আমার সাথে দেখা করতে। ও ঠিক এল আমার মেসে। নানা ধরণের আলাপ-আলোচনা হল দেশ সম্পর্কে । এক সময় আমি ওকে বললাম,
-শফিক তোমার কাছে আমি একটি ব্যাপারে সাহায্য চাই। যদি ভরসা দাও তবে বলি। ও যেন কিছুটা লজ্জা পেল। বলল,
-স্যার আপনি আমাকে লজ্জা দিচ্ছেন কেন? আমি আপনার কোন কাজে লাগতে পারলে নিজেকে ধন্য মনে করব। আপনি নির্দ্বিধায় বলুন কি প্রয়োজন আপনার?
-আমি যা চাইবো সেটা সাধারণ কোন জিনিস নয় শফিক। বুদ্ধিমান তরুণ শফিক জবাব দিল,
-আপনি আমার কাছে কোন সাধারণ জিনিস চাইবেন না সেটা আমি বুঝতে পেরেছি। তবুও আপনি বলুন আমি আপনার জন্য কি করতে পারি? ম্যাপ শীটের নম্বরগুলো তাকে লিখে দিয়ে বললাম,
-এগুলো আমার চাই। ম্যাপ শীট নম্বরগুলো দেখেই বুদ্ধিমান শফিক হয়তোবা আঁচ করতে পেরেছিল আমার উদ্দেশ্য কি? আমার দিকে স্থির দৃষ্টি মেলে চুপ করে বসে থাকলো শফিক। কি যেন পরখ করে খুজে দেখছিল আমার মাঝে।
ওকে চুপ করে থাকতে দেখে আমি বললাম,
-হ্যা, আমি পালিয়ে যাবার চেষ্টা করছি, তাই এ ম্যাপ শীটগুলো আমার প্রয়োজন। আমার কথা শুনে ও বললো,
-কিন্তু স্যার ...?
-জানি শফিক তাতে যথেষ্ট ঝুঁকি রয়েছে। ব্যাপারটা ফাঁস হয়ে গেলে তোমার শাস্তিও হতে পারে। তাই যা কিছুই করার সিদ্ধান্ত তুমি নেবে সেটা ভেবে চিন্তে স্থিরভাবেই তোমাকে নিতে হবে। এ ঝুঁকি নেবার ব্যাপারে আমার তরফ থেকে কোন বাধ্যবাধকতা নেই। তবে আমার অনুরোধ এ ঝুঁকি তোমার পক্ষে যদি নেয়া সম্ভব না হয় তবে তুমি অন্য কাউকে আজকের আলোচনা সম্পর্কে কিছু বলবে না। আশা করি তুমি এ অনুরোধ রক্ষা করবে। হাবিলদার শফিক আমার মুখের দিকে নির্বাক দৃষ্টিতে চেয়ে ছিল। কথা শেষ হতেই সে আমাকে আবেগে জড়িয়ে ধরে বললো,
-স্যার আপনি আমাকে বিশ্বাস করেছেন। আল্লাহকে সাক্ষী রেখে বলছি এ বিশ্বাসের অবমাননা জান থাকতে হতে দেব না। কাল বিকেল ৫টায় খোকা বাজারে আমার সাথে আপনি দেখা করবেন। দেখি আমি আপনার জন্য কি করতে পারি।
পরদিন বিকেল ৫টায় আমি খোকা বাজারে নির্দিষ্ট স্থানে হাবিলদার শফিকের জন্য অপেক্ষা করছিলাম। প্রতিটি মুহুর্ত কাটছিল চরম উত্তেজনায়। ৫ মিনিট, ১০ মিনিট হয়ে গেল ৫টা বেজে শফিকের দেখা নেই। শফিক কি তবে আসবেনা? কোন অঘটন ঘটলো না তো? নাকি মুখের উপর না বলে আমাকে বিব্রত না করে আজ না এসে বুঝিয়ে দিল এ কাজ তার পক্ষে করা সম্ভব নয়। চুপচাপ দাড়িয়ে লোকজনের আসা-যাওয়া দেখছিলাম আর নানা ধরণের কথা ভাবছিলাম। ৫টা ২০ হয়ে গেল ভাবলাম শফিক আর আসবে না। চলে যাবার জন্য পা বাড়িয়েছি হঠাৎ দেখি ত্রস্ত পায়ে শফিক হাঁপাতে হাঁপাতে ছুটে আসছে আমার দিকে। বাম হাতে একটি ঝোলা। ডান হাত উঁচু করে আমাকে ইশারায় তার আগমন বার্তা জানাচ্ছে। অল্প সময়ের মধ্যেই লোকের ভীড় ঠেলে ও আমার কাছে এল। ওকে দেখে খুশি হয়ে উঠলো মন।
-স্যার স্যরি, একটু দেরী হয়ে গেল। ট্যাক্সি পাচ্ছিলাম না। হাঁপাতে হাঁপাতে বলল শফিক। বললাম,
-চলো কোথাও বসা যাক। মার্কেটের মধ্যেই সাজ্জি কাবাবের দোকানে গিয়ে বসলাম দু’জনে। ইন্টার ইউনিট ম্যাচ ছিল আজ। দারুন খেলা হয়েছে। তারপর ১ ঘন্টা হেভী এক্সারসাইজ করায় বেশ ক্ষিধে পেয়েছিল। আস্ত দু’টো মুরগির সাজ্জি সাথে কড়াই কাবাব এবং নান অর্ডার দিয়ে বসলাম দু’জনে। বেয়ারা কাওয়ার পট এবং কাপ রেখে গেল। কোনার দিকে একটি নিরিবিলি জায়গাতে বসেছিলাম আমরা। রেকর্ড প্লেয়ারে জনপ্রিয় ফিল্মিগান বাজছিল। ফলে আমাদের আলাপ করার সুবিধা হল। পাশের টেবিলের লোকরাও আমাদের কথা কিছু শুনতে পাবে না।
-আমিতো প্রায় নিরাশ হয়ে পড়েছিলাম। কিছুটা চিন্তিত হয়েও পড়েছিলাম।
-কি কষ্ট করে যে আপনার জিনিস হাসিল করেছি, সে একমাত্র আল্লাহপাকই জানেন। এতে ঝুঁকি আছে প্রচুর। কিন্তু আপনি দেশের জন্য প্রাণ দিতেও প্রস্তুত। সে পরিপ্রেক্ষিতে আমার কিছু হলেও শান্তনা পাব এই ভেবে যে দেশের স্বাধীনতায় আমিও কিছু অবদান রাখার সুযোগ পেলাম। বলেই আস্তে টেবিলের নীচ দিয়ে সে ঝোলাটি আমার হাতে তুলে দিল।
-আমি তোমার অবদানের কথা সর্বদা স্মরন রাখব শফিক। ধন্যবাদ জানিয়ে তোমাকে ছোট করব না। তবে একটি কথা জেনে রাখ। ২৫শে মার্চ ন্যাক্কারজনক পাশবিক ঘটনাবলীর পর থেকে দেশ ও স্বাধীনতার সংগ্রামে প্রত্যক্ষভাবে অবদান রাখার জন্য অনেক কিছুই ভেবেছি এবং অনেক বাঙ্গালীর সাথে আলাপ করেছি। কেউই তোমার মত নিঃস্বার্থ আন্তরিকতা দেখায়নি। কেউ আমার চিন্তা-ভাবনায় আতঁকে উঠেছেন। কেউ বা রেগে গিয়ে হুঁশিয়ার বাণী উচ্চারণ করেছেন। কোয়েটার অনেক বাঙ্গালীর কাছেই আমি ইতিমধ্যে বিপদজনক ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত হয়ে উঠেছি। অনেকে আমার সাথে সব যোগাযোগ ছিন্ন করার সিদ্ধান্তও নিয়েছে। সে ক্ষেত্রে তোমার এ সাহায্য আমাকে মুগ্ধ করেছে। তোমার এ অবদান সামান্য নয়। যদি সংগ্রামে যোগ দেবার তৌফিক আল্লাহ আমাকে নছীব করেন; দেশ স্বাধীন হওয়ার পর যদি বেঁচে থাকি তবে তোমার নাম বাংলাদেশের ইতিহাসে থাকবে ভাই, এ ওয়াদা আমি তোমাকে দিলাম।
শফিকের দু’চোখ বেয়ে অশ্রু ঝড়ছিল। রুমালে চোখ মুছে নিয়ে ধরা গলায় বললো,
-স্যার আমার এ অবদান অতি সামান্য । ইচ্ছে হয় আপনার সাথে আামিও পাড়ি জমাই। কিন্তু আমি ফ্যামিলিম্যান। পরিবার ফেলে কি করে পালিয়ে যাই! আমার এ অক্ষমতা আমাকে পীড়া দেবে সারাজিবন। নিজেকে আমি কখনো ক্ষমা করতে পারবো না স্যার।
-কেন মিথ্যে দুঃখ পাচ্ছ ভাই। বাংলাদেশের সবার পক্ষে কি যুদ্ধে সরাসরিভাবে যোগ দেয়া সম্ভব হবে? অনেকেই নানাভাবে সংগ্রামে অবদান রাখবেন। তারাও মুক্তিযোদ্ধা। যেমন আজকে তুমি রাখলে এক অমূল্য অবদান। যারা যুদ্ধক্ষেত্রে যুদ্ধ করবে তাদের অবদানের চেয়ে তোমার এ অবদানের মূল্য কোনক্রমেই কম নয়; সেভাবে তুমিও একজন মুক্তিযোদ্ধা। আমার কথায় শফিক নিজেকে সামলে নিল। বেয়ারা ইতিমধ্যেই খাবার পরিবেশন করে গেছে।
-এসো খাওয়া যাক। দু’জনে তৃপ্তি সহকারে খেলাম। খাওয়া শেষে শফিক বলল,
-আজ আমাদের নাইট ট্রেনিং আছে তাই চলে যেতে হবে। সময় প্রায় হয়ে এল।
-চলো তোমাকে নামিয়ে দেই। গাড়িতে বসে শফিক বলল,
-স্যার একটি কথা যদি আমার কিছু হয় তবে আমার পরিবারকে একটু দেখবেন।
-যদি বেঁচে থাকি তাহলে এ ব্যাপারে তুমি নিশ্চিত থাকতে পার। কথা দিলাম। শফিককে নামিয়ে দিয়ে মেসে ফিরে এসে লনের মাঝখানে ছাতির মত দাড়িয়ে থাকা প্রিয় আখরোট গাছটার নীচে গিয়ে বসলাম। বসন্তের ফুরফুরে বাতাস নানা ধরণের ফুলের সুবাস ছড়াচ্ছিল। গার্ডেন লাইটগুলোর স্বল্প আলোকে ম্লান করে দিয়ে বেশ বড় একটি চাঁদ সামনের মুরদার পাহাড়ের গা ছুঁয়ে উকি দিয়ে হাসছে। মনোরম এক শান্ত পরিবেশ। কফির পেয়ালায় চুমুক দিচ্ছিলাম আর ভাবছিলাম হাবিলদার শফিক সম্পর্কে।
বেঙ্গল রেজিমেন্টের মেজর মালেক তখন পর্যন্ত ব্রিগেড মেজরের দায়িত্ব পালন করছিলেন। তার ব্রিগেডের অপারেশনাল এরিয়ার আওতায় পরেছে ভাওয়ালনগর ফোর্ট আব্বাস সেক্টর। ভাওয়ালপুর হয়ে ভাওয়ালনগর। সেখান থেকে ফোর্ট আব্বাসের পথে ছোট ষ্টেশন হারুনাবাদ। হারুনাবাদ থেকেই শুরু করতে হবে আমাদের পদযাত্রা। পাক বাহিনী এবং ভারতীয় বাহিনীর ডিফেন্স ভেদ করে ২৫ মাইল দুরত্ব অতিক্রম করে আমাদের পৌঁছতে হবে শ্রীকরণপুর। মেজর মালেকের কাছ থেকেই পেতে হবে পাক বাহিনী এবং ভারতীয় বাহিনীর Deployment trace. এতে বিশদভাবে আঁকা থাকে Top secret uptodate intelligence informations. যেমনি ভাবা তেমনি কাজ। ম্যাপ পাবার পরদিনই টেলিফোন করে মেজর মালেককে বললাম জরুরী প্রয়োজনে অবিলম্বে দেখা করতে চাই। অনুমতি নিয়ে তার অফিসে গিয়ে উপস্থিত হলাম মতিকে সঙ্গে নিয়ে। অফিসে একাই ছিলেন মেজর মালেক।
দ্বারে উপস্থিত হতেই ভারী গলায় প্রশ্ন রাখলেন,
-কি ব্যাপার ডালিম?
-আপনার নতুন গাড়ি দেখতে এলাম। কেমন চলছে? অল্প কিছুদিন আগে তিনি একটি Skoda Sedan Car কিনেছেন।
-তোমার Volks Wagon এর মত শানদার না হলেও I have no complain.
-স্যার বাসায় চলেন । লাঞ্চ খাব একসাথে।
-লাঞ্চ খাবে তা বেশতো; তোমার ভাবীকে ফোন করে বলে দাও। But what is your problem? Have you picked up again on some one? তা তোমার সাথের ছেলেটিকে তো চিনলাম না?
আমি ইতিমধ্যেই টেলিফোন তুলে নিয়ে রিং করছিলাম,
-হ্যালো ভাবী, ডালিম Here. আমরা বাসায় আসছি, Three of us over lunch. অসুবিধে হবেনা তো?
-কোন দিকে সূর্য উঠলো আজ! এতদিন পর হঠাৎ ভাবীকে মনে করে যেচে লাঞ্চ খেতে চাচ্ছ?
ভাবীর জবাবে একটু লজ্জা পেলাম।
-বিশ্বাস করেন ভাবী, কোর্সের ঝামেলায় এত ব্যস্ত ছিলাম; তাই আসা হয়ে উঠেনি। আমার সময় কি করে কেটেছে সে শুধু আমিই জানি।
-চলে এসো; ভাবী বললেন। কথোপকথন শেষ করে রিসিভার নামিয়ে রেখে বললাম,
- ÑAll clear Sir at the home front. ও হ্যাঁ, Let me introduce Lieutenant Moti from 3rd East Bengal and Moti this is Maj. Malek from senior Tiger.
মতি মেজর মালেকের সাথে হাত মিলিয়ে বললো,
-স্যার আপনার সাথে আগে দেখা হয়নি কিন্তু আপনার কথা অনেক শুনেছি। প্রাণখোলা উচ্ছল প্রকৃতির মেজর মালেক স্মিত হাসলেন।
ÑMoti is here for OW-JTC. He has done pretty well in the course. বললাম আমি।
ÑThat’s very good. শুনলাম তুমিও নাকি খুবই ভালো করেছো? জানতে চাইলেন মেজর মালেক। নিজের কথায় কিছুটা অস্বস্তি লাগছিল; জবাবে কিছুই বললাম না। তাগিদ দিয়ে বললাম,
-চলেন উঠা যাক।
- ÑYou mean rightaway! কিছুটা আশ্চর্য হলেন মেজর মালেক।
- That’s correct. এতো চাকুরি করে কি আর হবে স্যার! বললাম আমি।
-চলো তবে। মেজর মালেক Buzzer টিপলেন। পিএ এসে সেল্যুট করে দাড়ালো। তাকে কিছু নির্দেশ দিয়ে মেজর মালেক তাকে বললেন তিনি অফিসে আজ আর ফিরছেন না। এরপর আমরা বেরিয়ে এলাম অফিস থেকে। বাসায় ফিরে ড্রইং রুমে বসে আলাপ শুরু হলো।
- Well now tell me what’s up? প্রশ্ন করলেন মেজর মালেক।
- Sir, the matter is very serious and urgent at the same time confidential আমরা পালাবার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। জবাব দিলাম আমি।
অপ্রত্যাশিত জবাবে কিছুটা চম্কে উঠলেন মেজর মালেক। চুপ করে বসে রইলেন কিছুক্ষণ। কিচেনে ভাবী রান্না-বান্না নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন।
- Just a minuite, বলে উঠে গেলেন মেজর মালেক। অল্পক্ষণ পর সিগারেট হাতে ফিরে এসে বললেন,
-কি জানো, my batman is not that reliable. তাই বেটাকে পাঠিয়ে দিয়ে এলাম ক্যান্টিন থেকে সিগারেট আনতে। বুঝলাম আমার কথার গুরুত্ব উপলদ্ধি করে তিনি Precaution নেবার জন্যই তিনি এমনটি করেছেন।
- Now then are you sure? একরাশ প্রশ্ন তার চোখে।
-জি স্যার। এভাবে আর চাকুরি করার কোন মানে হয় না। নিজের প্রতি ঘৃণা বাড়ছে। আজ আমাদের মত লোকের প্রয়োজন স্বাধীনতার সংগ্রামকে এগিয়ে নেবার জন্য। What do you think Sir? প্রশ্ন রাখলাম আমি।
- Well you may be right. কিন্তু সংগ্রাম সম্পর্কে কোন সঠিক তথ্যইতো আমরা জানতে পারছি না। সে অবস্থায় এ ধরণের পদক্ষেপ নেয়াটা কি যুক্তিসঙ্গত হবে? Wouldn’t it be too risky? পাল্টা প্রশ্ন রাখলেন মেজর মালেক।
-আপনার কথায় যুক্তি আছে। কিন্তু যেভাবে এখান থেকে জরুরী ভিত্তিতে Re-inforcement পাঠানো হচ্ছে আর পূর্ব পাকিস্তান থেকে লাশ আসছে তাতে করে এতটুকু নিশ্চয়ই প্রমাণিত হয় যে, সেখানে কিছু একটা ঘটছে। তদপুরি International media কি সবটাই মিথ্যা প্রচারণা চালাচ্ছে বলে মনে করেন আপনি? জোরালো যুক্তি তুলে ধরলাম আমি।
- Well then, what can I do for you in this venture of yours? জানতে চাইলেন মেজর মালেক।
-আমরা হারুনাবাদ থেকে শ্রীকরণপুর পৌঁছার চেষ্টা করবো। সবদিক বিবেচনা করে এ পথই সর্বোত্তম বলে বিবেচনা করছি আমরা।
- Your decision is right. চমন বর্ডার ছাড়া এটাই সবচেয়ে ভালো পথ নিঃসন্দেহে। এপথে দুই থেকে তিন দিন সময় লাগবে।
-স্যার, আপনাকে Operational Trace করে দিতে হবে। অনুরোধ জানালাম আমি।
- Food has been served. এ্যাপ্রন পরা ভাবী ন্যাপ্কিনে হাত মুছতে মুছতে টেবিলে যাবার অনুরোধ জানালেন। ভাবীর আগমনে পরিবেশটাকে হালকা করে দেবার জন্য হঠাৎ করেই মেজর মালেক কথার মোড় ঘুরিয়ে দিয়ে বলে উঠলেন,
-এসো আগে পেট-পুঁজো করা যাক। খালি পেটে ঠিকমত চিন্তাও করা যায় না। সবাই গিয়ে টেবিলে বসলাম। বাচ্চারা সবাই স্কুলে। খাবার দেখে জিভে পানি এসে গেল। টাটকা মাছের বিভিন্ন ব্যঞ্জন। জিজ্ঞেস করলাম,
-ভাবী The Great! এ জিনিসগুলো কোথা থেকে আমদানি করলেন? জবাবে ভাবি বললেন,
-ওরোখ্ থেকে আজ সকালেই আনিয়েছি।
কোয়েটা শহর থেকে ১৫-২০ কিলোমিটার দূরে ছোট্ট একটি সবুজ উপত্যকা ওরোখ্। একটি পাহাড়ী ঝরনা বয়ে যাচ্ছে উপত্যকার ঠিক মাঝ দিয়ে। বিভিন্ন ফলের গাছ-গাছালিতে ছেয়ে আছে উপত্যকাটা। চারিদিকে ঘিরে আছে পাহাড়ের গায়ে চির-সবুজ বন। আকর্ষনীয় পিক্নিক্ স্পট। সেই ঝরনাতেই ট্রাউট এবং অন্যান্য জাতের মাছ পাওয়া যায়। বাঙ্গালীরা সুযোগ পেলেই মাছ আনায় ওরোখ্ থেকে। আমরা Bachelor Boys প্রায়ই গাড়ি ভর্তি করে মাছ নিয়ে এসে ইচ্ছেমত যেকোন ভাবীর শরনাপন্ন হই টাটকা মাছ-ভাতের স্বাদ মেটাতে। হৈ চৈ করে তৃপ্তি মিটিয়ে খাওয়া শেষ করে আমরা আবার ড্রইং রুমে
এসে বসলাম। খাবার সুযোগে সবকিছু ভেবে নিয়ে আমার অনুরোধের জবাবটা ঠিক করে নিয়েছিলেন মেজর মালেক। সোফায় বসে সিগারেটে একটা সুখটান দিয়ে মেজর মালেক বললেন,
- well I admire your courrage. আমি নিশ্চয়ই তোমাদের যথাসাধ্য সাহায্য করবো। শুধু অনুরোধ এ ব্যাপারটা আমার এবং তোমাদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে।
- Definitely Sir, we give you our words. আমি জবাব দিলাম।
- But what about map-sheets? কোথায় পাবে Operational map-sheets? যুক্তিসঙ্গত প্রশ্ন।
-আমরা যোগাড় করেছি। মেজর মালেক জিজ্ঞাসু দৃষ্টি মেলে তাকাতেই তাড়াতাড়ি বললাম,
-Not from my Regiment. From elsewhere. স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে হাঁফ ছেড়ে যেন বাচঁলেন মেজর মালেক।
- Then bring them to me tomorrow. বললেন মেজর মালেক।
- Not tomorrow. এখনি Map-Sheets গুলো দিয়ে যাচ্ছি আপনাকে, কাল এসে নিয়ে যাবো। মতিকে পাঠালাম গাড়ি থেকে Map-Sheets গুলো নিয়ে আসার জন্য। সেগুলো নিয়ে মতি ফিরে এলো। Map-Sheetsগুলো পরখ করে মেজর মালেক স্বগোক্তি করলেন,
- Incredable! জিনিসগুলো উঠিয়ে নিয়ে কোন গোপন জায়গায় রেখে ফিরে এসে যোগ দিলেন আমাদের সাথে।
-আমরা তবে আজ উঠি স্যার, Still a lot to be done.
-বুঝেছি। কি জানো ডালিম, তোমাদের মত দেশপ্রেমিকদের প্রচেষ্টায় বাংলাদেশ স্বাধীন হবে নিশ্চয়ই ইনশাল্লাহ্। ইচ্ছে হচ্ছে আমিও তোমাদের সাথে পালিয়ে যাই, কিন্তু সেটা সম্ভব নয়। পরিবারের দায়িত্ব বাধা হয়ে আছে। How can I leave them and go? ভারী গম্ভীর গলায় কথাগুলো বলছিলেন মেজর মালেক।
-আপনি ঠিকই বলেছেন স্যার। কিন্তু আমাদের সাহায্য করে আপনিতো কম অবদান রাখলেন না স্যার? সেভাবে বিচার করলে আপনিওতো একজন মুক্তিযোদ্ধা। আমরা বেঁচে থাকলে আপনার এই অবদানের কথা দেশবাসী জানবে। বিশ্বাস করেন স্যার, আপনিই একমাত্র সিনিয়র অফিসার যার কাছ থেকে আন্তরিকতা, সহানুভূতি ও সহযোগিতা পেলাম। বাকি সবাইকে চেনা হয়ে গেছে। All are paper tigers. তারা ভিতু, স্বার্থপর। মুখে মুখেই সব বাঙ্গালী এর বেশি কিছু নয়।
আমার কথায় মেজর মালেকের চোখে পানি এসে গিয়েছিল। হৈ হুল্লরবাজ বলে পরিচিত মেজর মালেকের মাঝে সাচ্চা বাঙ্গালী দেশপ্রেমিক মেজর মালেককে খুঁজে পেয়ে তার প্রতি শ্রদ্ধা অনেক বেড়ে গিয়েছিল। সালাম জানিয়ে উঠে পড়লাম। গাড়ি পর্যন্ত এগিয়ে দিতে এলেন তিনি। গাড়িতে বসতে যাচিছ ঠিক তখন আবেগে আমাকে এবং মতিকে জড়িয়ে ধরে বলে উঠলেন,
- I wish you all well boys, take care. ফিরে এলাম মেসে।
-সত্যি অদ্ভুত লোক মেজর মালেক। বললো মতি।
-আমিও কিন্তু ভাবিনি তার কাছ থেকে ঠিক এতটা সহযোগিতা পাবো। সত্যি পৃথিবীতে মানুষ চেনা দায়; জবাব দিলাম। আরো কয়েকটি বিষয়ে আলাপ-আলোচনার পর মতি চলে গেল।
লেফটেন্যান্ট সুমি ফিরে যাচ্ছে লাহোর। ভাবলাম ওর কাছ থেকেই চেয়ে নেব Compass এবং Binocular.
যাবার আগের দিন বিদায় নিতে এসেছে সুমি। টকটকে ফরসা Well Builed সুদর্শন যুবক সুমি। সব সময় মিষ্টি হাসি মুখে লেগেই আছে। সেদিন তাকে খুব মলিন দেখাচ্ছিল।
-সুমি খারাপ লাগছে লাহোর ফিরে যেতে তাই না? জিজ্ঞেস করলাম।
-ঠিক বলেছেন স্যার। আপনাদের সাথে বেশ কেটে যাচ্ছিল সময়গুলো হেসে খেলে। আপনাদের ছেড়ে যেতে মন কিছুতেই চাচ্ছে না। কিন্তু এর বিকল্পওতো কিছু নেই! যেতে তো হবেই। আপনার কথা কখনও ভুলতে পারব না স্যার। আপনি না থাকলে Life out here would have been hell and most boring.
-সুমি আজ তোমাকে একটা অনুরোধ করবো, রক্ষা না করতে পারলে কথা দাও এ ব্যাপারে তুমি কাউকে কিছুই বলবে না।
-কি এমন কথা স্যার, যার জন্য এমনিভাবে আমাকে লজ্জা দিচ্ছেন? সুমির কথায় আন্তরিকতা ফুটে উঠলো। ওকে বিশ্বাস করা চলে।
-আমি পালিয়ে গিয়ে স্বাধীনতা সংগ্রামে যোগ দেব ঠিক করেছি। রাজস্থান বর্ডার দিয়ে ক্রস্ করবো। তোমার Compass এবং Binocular টা পেলে সুবিধে হয়।
- Fantastic, great idea. আমি নিশ্চয়ই দেব Compass এবং Binocular. কিন্তু আমাকে কি সঙ্গে নিতে পারেন না স্যার? আকুতি ঝড়ে পড়ল ওর অনুরোধে। I beg of you Sir, please take me along. আমাকে সঙ্গে নিয়ে চলুন।
- Well Shumi thanks a lot. I shall remain ever greatful for your help. কিন্তু তোমাকে সঙ্গে নেবার ব্যাপারে ঠিক এই মুহুর্তে কোন জবাব দেয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়। I hope you wouldn’t mind. আমাকে একটু ভাববার সময় দিতে হবে।
- That’s fine Sir. Do take your time. But be sure, even if you decide not to take me along for some reason you will get the things which you have asked for. আমিও কিছুই মনে করবো না। উঠি আজ তাহলে?
-না না সে কি করে সম্ভব! লাঞ্চের সময় হয়ে গেছে, লাঞ্চ করে যাবে তুমি। বলেই খাবারের ব্যবস্থা করার নির্দেশ দিলাম বেয়ারাকে ডেকে। খাওয়ার পর সুমি যাবার জন্য বিদায় চাইল। আমি বললাম,
-সন্ধ্যায় মেসে থেকো, আমি আসবো। সম্মতি জানিয়ে চলে গেল সুমি।
সুমি চলে যাবার পর আমিও বেরিয়ে পরলাম। মতি ও নূরকে সঙ্গে করে সোজা ক্যাপ্টেন তাহরের ওখানে। অনেক আলোচনার পর ঠিক হলো সুমিকেও সঙ্গে নেয়া হবে। সন্ধ্যার একটু আগেই সুমির ওখানে গিয়ে হাজির হলাম আমি একাই। প্ল্যানিং এই স্টেজে গোপনীয়তা রক্ষা করার জন্যই Strict compartmentation মেনে চলা হচ্ছিল। Need to know basis -এ যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছিলাম আমরা অতি সতর্কতার সাথে। সুমি আমার অপেক্ষা করছিল। ঘরে ঢুকে দেখি ওর ব্যাটম্যান সবকিছু গোজগাছ করছে। যাত্রার প্রস্তুতি।
- Let’s have Chinese. বলেই গাড়িতে সুমিকে তুলে নিয়ে সোজা চলে গেলাম China Café তে। খাবার ফাঁকে ফাঁকে আলাপ হচ্ছিল।
- Sir, you said Rjasthan is the sector, is that correct? সুমি জানতে চাইলো।
- That’s right. জবাব দিলাম।
-তাহলে আপনার সাথেতো আমার যাওয়া কিছুতেই সম্ভব হবে না। আপনিতো জানেন, I am alegic to sand. বালির স্পর্শে আমার সমস্ত গায়ে চুলকানি শুরু হয়ে যায়। এর জন্য আপনার কোন অসুবিধা হোক সেটা আমি চাইনা, তাই সিদ্ধান্ত নিয়েছি I shall stay back. সত্যিইতো এ কথাটা গতকাল আমাদের খেয়ালেই আসেনি।
- I don’t want to be a liability. এতে আপনার বিপদও হতে পারে। আমার জন্য আপনার পথে কোন বাধার সৃষ্টি হউক সেটা আমি চাই না। ছল ছল চোখে কথাগুলো বলছিলো সুমি। আমি ওর হাত ধরে ওকে সান্তনা দিয়ে বললাম,
- Don’t feel so bad. আমার সাথে মরুপথে যেতে পারছ না তাতে কি হয়েছে? That’s not the end of the world. এখান থেকে যাবার পর লাহোরের কসুর কিংবা ওয়াগা বর্ডার দিয়েতো তুমি পালাবার চেষ্টা করতে পারবে। আমার কথায় সুমির চোখ উজ্জল হয়ে উঠলো।
-তাইতো লাহোর থেকেই ক্রস্ করাটা সহজ হবে আমার জন্য। I promise you Sir, লাহোর পৌঁছেই পালাবার চেষ্টা করবো যে করেই হোক না কেন।
-নিশ্চয়ই করবে। আমি পরম করুনাময়ের কাছে দোয়া করবো যাতে তুমি তোমার প্রচেষ্টায় সফল হও।
দু’জনে ফিরে এলাম সুমির মেসে। সমস্ত মেসটাই ঘুমিয়ে পড়েছে। একে অপরকে জড়িয়ে ধরলাম।
-সুমি Thanks a lot once again for all that you have done for me. আমার জন্য দোয়া করো। বেচেঁ থাকলে স্বাধীন বাংলাদেশে দেখা হবে ইনশাল্লাহ্। Otherwise good luck and good bye my friend. আবেগ এবং বিচ্ছেদের অনুভূতি সব মিলিয়ে চোখে পানি এসে গিয়েছিল নিজের অজান্তেই। সুমি ধরা গলায় বিদায় জানালো,
-খোদা হাফেজ, Take care Sir may Allah be with you.
সুমির দিকে আর চাইতে পারলাম না। দ্রুতপায়ে গাড়ির দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে বসলাম। ইঞ্জিনে ষ্টার্ট দিয়ে ঝড়ের বেগে গেইট দিয়ে বেরিয়ে এলাম। রিয়ার-ভিউ মিরর এ দেখলাম সুমি তখনও পোর্চে দাড়িয়ে হাত নাড়ছে।
এ পর্যন্ত সবকিছুই ঠিকমতই এগুচ্ছিল। হঠাৎ করে ঘটলো প্রথম বিপর্যয়। আকস্মিকভাবে ক্যাপ্টেন তাহেরের বদলির অর্ডার এসে গেল। এবোটাবাদে বেলুচ সেন্টারে তার পোষ্টিং হয়েছে। অবিলম্বে তাকে যোগদান করতে হবে। খবরটা পেয়েই মতি, নূর এবং আমি ছুটে গেলাম তার কাছে। মেসে গিয়ে পৌঁছাতেই তিনি জানালেন কালই তাকে By Air চলে যাবার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। একি বিভ্রাট! কি করবো এখন আমরা? জবাবে ক্যাপ্টেন তাহের বললেন,
It’s OK. এ অবস্থয় তোমাদের সাথে আমার যাবার কোন সম্ভাবনা নেই। But so what? আমি এবোটাবাদ থেকে পালাবার চেষ্টা করবো। তোমরা তোমাদের প্ল্যান অনুযায়ী এগিয়ে যাও।
তবে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব Plan execute করতে হবে। বুঝতে পারলাম পোষ্টিং অর্ডার একবার যখন আসা শুরু হয়েছে তখন যেকোন সময় মতি ও নূরের কিংবা আমার পোষ্টিং অর্ডারও এসে পরতে পারে। একে অপরের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পরার আগেই আমাদের কেটে পড়তে হবে। পরদিন সকালে ক্যাপ্টেন তাহেরকে এয়ারর্পোটে বিদায় জানিয়ে ফিরে এলাম। আশ্চর্য ব্যক্তিত্ব ক্যাপ্টেন তাহের! তরুণ চৌকশ কমান্ডো অফিসার। সবেমাত্র রেঞ্জারস্ কোর্স শেষে আমেরিকা থেকে ফিরেছেন। ফেরার পরপরই Detailed হয়ে কোয়েটাতে এসেছিলেন Senior Tactical Course করতে। স্বল্পভাষী, অসীম সাহসী, তেজদীপ্ত চেহারা, অস্বাভাবিক মনোবল ও আত্মপ্রত্যয়ের অধিকারী যুবক ক্যাপ্টেন তাহের দেশপ্রেমের এক দুর্লভ নিদর্শন। অল্পদিনের মধ্যেই আমাদের মন জয় করে ফেলেছিলেন তিনি। অত্যন্ত আপন হয়ে উঠেছিলাম আমরা। পাকিস্তান থেকে আগত মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে মতি, নূর এবং আমিই সর্বপ্রথম পাকিস্তান থেকে পালিয়ে এসে মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করতে সক্ষম হয়েছিলাম। দ্বিতীয় ব্যাচে এসেছিলেন মেজর মঞ্জুর, ক্যাপ্টেন জিয়াউদ্দিন এবং ক্যাপ্টেন তাহের। তারা এসেছিলেন শিয়ালকোট সেক্টর দিয়ে। আমরা একসাথে যুদ্ধ করেছি কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে। স্বাধীনতার সংগ্রামকালে এবং পরবর্তিকালে বাংলাদেশের গণমানুষের মুক্তি সংগ্রামে বীর মুক্তিযোদ্ধা কর্নেল তাহেরের নিঃস্বার্থ অবদান এবং আত্মত্যাগের ইতিহাস সর্বজন বিধিত। কিংবদন্তির নায়ক কর্নেল তাহেরের আত্মগাঁথা শ্রদ্ধার সাথে স্মরন করবে বাংলাদেশের বর্তমান ও ভবিষ্যত প্রজন্মের দেশপ্রেমিকরা। বাংলাদেশের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে তার নাম। কোন অপচেষ্টাই শহীদ তাহেরের স্মৃতিকে ম্লান করে দিতে পারবে না বাংলার মাটিতে। কর্নেল তাহের মরেও অমর হয়ে আছেন; আর থাকবেনও চিরদিন।
ক্যাপ্টেন তাহেরের হঠাৎ বদলিতে ভেঙ্গে পড়লেও আমরা নিজেদের সামলে নিলাম। তার চলে যাবার পর পুরোদমে আমরা আমাদের পরিকল্পনার কাজ এগিয়ে নিয়ে চললাম। সুমির পিস্তলটা পাওয়ায় আমাদের সুবিধা হলো। আমার ব্যক্তিগত হাতিয়ারের মধ্যে রয়েছে একটা পিস্তল আর একটা রিভলবার। সুমির পিস্তলটা আমাদের হাতিয়ারের সমস্যার সমাধান করে দিল। ক্রমান্বয়ে আমাদের সব প্রস্তুতি প্রায় শেষ হয়ে এলো। এখন শুধু সময় ও সুযোগের অপেক্ষা।
ইতিমধ্যে আমাদের ১৬ ডিভিশনের ইউনিটগুলোকে জরুরী ভিত্তিতে পূর্ব পাকিস্তানে পাঠানো হচ্ছে। যে সমস্ত ইউনিটগুলো পাঠানো হচ্ছে সেগুলো থেকে বাদ দেয়া হচ্ছে বাঙ্গালী সদস্যদের। এ থেকে ধরে নিলাম খুব শীঘ্রই আমার পোষ্টিং অর্ডার এসে যাবে। আমার ইউনিটে আমরা মাত্র দু’জন বাঙ্গালী। হলোও তাই। প্রায় একই সময়ে নূর এবং আমার পোষ্টিং অর্ডার এসে গেল। আমাকে যেতে হবে খারিয়ায় আর নূরকে যেতে হবে কোহাট। একই সময়ে পোষ্টিং অর্ডার পাওয়ায় দু’জনেই খুশী হলাম। এতে আমাদের Movement co-ordinate করতে সুবিধে হবে। আগেই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে পোষ্টিং অর্ডার পেয়ে নতুন জায়গায় যাবার পথেই কেটে পড়বো আমরা। এতে করে খুব সহজেই সপ্তাহখানেকের জয়েনিং টাইম কাজে লাগানো যাবে। কিন্তু সমস্যা দেখা দিল মতিকে নিয়ে। যেকোন কারণেই হোক না কেন ওর পোষ্টিং অর্ডার আসতে দেরী হচ্ছিল। ঠিক হল কিছু একটা করা দরকার। স্কুলে আটকে পরা সব বাঙ্গালীরাই প্রায় চলে গেছে পশ্চিম পাকিস্তানের বিভিন্ন ইউনিটে। হঠাৎ মতির মাথায় একটা বুদ্ধি এলো। ও সরাসরি পিন্ডিতে MS Branch এর সাথে যোগাযোগ করে জানতে চাইলো বেঙ্গল রেজিমেন্টের অফিসারদের পোষ্টিং ইনচার্য কে? ভাগ্যক্রমে জানা গেল ঐ বিভাগের দায়িত্বে যে কর্নেল সাহেব রয়েছেন তিনি মতির পূর্ব পরিচিত। কর্নেল সাহেব মতির এক স্কুল-মেটের বাবা। পরিচয় জানার পর মতি আবদার করে বসলো,
- আংকেল, স্কুলের আটকে পরা সবারই পোষ্টিং হয়ে গেছে শুধু আমিই পড়ে রয়েছি। আমার একটা গতি করুন। একাকিত্বের যন্ত্রনা আমাকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে। Please Uncle, you got to do something for me as soon as possible. জবাবে কর্নেল বললেন,
- তুমি চিন্তা করোনা, আজই আমি তোমার পোষ্টিং অর্ডার পাঠিয়ে দিচ্ছি। 6 East Bengal Regiment পেশাওয়ার এ যাবার জন্য তুমি প্রস্তুত হও।
মতি কর্নেল সাহেবকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেছিল, সম্ভব হলে পেশাওয়ার যাবার পথে মুলতান হয়ে যাবার চেষ্টা করবে ও। উদ্দেশ্য কর্নেল সাহেবের পরিবারের সবার সাথে দেখা করে যাওয়া। পুরো পরিবারের সাথেই মতি পূর্ব পরিচিত। কথা শেষে মতি আনন্দে উচ্ছাসিত হয়ে উঠলো,
- It is all done Sir. Well done indeed, it’s really great.
ঊঠলাম আমরা। কর্নেল আংকেল এর কথা মত পরদিনই মতি তার পোষ্টিং অর্ডার হাতে পেলো। আমরা স্বস্তির নিশ্বাস ফেললাম।
গেইমস্ থেকে ফিরে এক্সারসাইজ করছিলাম মেসে। মতি ও নূর এলো। দু’জনেই খুব রিলাক্সড। এক্সারসাইজ শেষ করে ফ্রেস হয়ে তিনজনেই গিয়ে বসলাম লনে। ঠিক করা হলো, নূর রওনা হবে ট্রেনে করে কোহাটের পথে। কিন্তু পথিমধ্যে ভাওয়ালপুরে নেমে যাবে নূর। সেখানে সার্কিট হাউজে অবস্থান নেবে নূর। মতি ও আমি ওর যাত্রার পরদিন ভাওয়ালপুরে তার সাথে মিলিত হবো। মতি এবং আমি কিভাবে যাবো সে ব্যাপারে কিছুই আলাপ হলো না। আমাদের অঙ্গীকার অনুযায়ী কেউ এ বিষয়ে কোন প্রশ্ন করলো না। আলাপ শেষে ক্লাবে চলে গেলাম ‘তাম্বোলা-নাইট’ অ্যাটেন্ড করার জন্য।
আমাকে কমান্ডিং অফিসার নির্দেশ দিলেন যত তাড়াতাড়ি সম্ভব গোছগাছ করে খারিয়া চলে যেতে। স্বাভাবিকভাবে আমি ব্যস্ত হয়ে পড়লাম গোছগাছ নিয়ে। সমস্ত মালপত্র ব্যাটম্যানকে দিয়ে এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহের শেষের দিকে ট্রেনে করে পাঠিয়ে দিলাম খারিয়ায়। CO -কে বললাম ট্রেনে না গিয়ে By Air লাহোর হয়ে যাবো আমি। Transit Period টা লাহোরে আমোদ-ফুর্তি করে কাটিয়ে দিয়ে খারিয়াতে চলে যাবো আমি। সমস্যা দেখা দিল সদ্য কেনা গাড়িটা নিয়ে। নতুন গাড়ি শখ করে কেনা তাই বেচে দেয়ার প্রশ্নই উঠে না। এতে লোকজনের মনে সন্দেহের সৃষ্টি হতে পারে। তাই ঠিক করলাম আমার এক ঘনিষ্ট বন্ধুকে দিয়ে যাবো গাড়িটা। এজাজ লাহোরের ছেলে। ওর পরিবারের সাথেও আমার ঘনিষ্টতা রয়েছে। আমাকেও তারা পরিবারের একজন হিসাবেই মনে করে। এজাজকে একদিন বললাম,
- এজাজ আমি By Air লাহোর হয়ে যাচ্ছি। তুই আমার গাড়িটা রেখে দে। সুবিধামতো লাহোর পাঠিয়ে দিস। আমি পরে এক ফাঁকে খারিয়া থেকে লাহোর গিয়ে গাড়িটা নিয়ে আসবো।
এজাজ আমার প্রস্তাবে খুশী হয়েই রাজি হলো এবং বললো, Don’t you ever think about it. I shall manage everything. You just go and have fun at Lahore. By the way when are you planing to leave?
- Tentitively arround mid April.
জবাব দিয়েছিলাম আমি। এভাবেই গাড়ির ঝামেলারও সুরাহা হল।
এরই মধ্যে ঘটলো চরম অঘটন। একদিন গেমস এর পর স্কুলের মেসে এ্যান্টিরুমে বসেছিল নূর। কয়েকজন পশ্চিম পাকিস্তানী অফিসারও বসেছিল সেখানে। কথায় কথায় এক সময় বাঙ্গালী জাতি এবং শেখ মুজিব সম্পর্কে কটুক্তি করে নূরকে চটাবার চেষ্টা করছিল। ওদের একজন নূরকে উদ্দেশ্য করে বললো,
- নূর তেরাতো কিসমত খুল গিয়ারে। শেখ মুজিব আভি তুঝে একদমসে জেনারেল বানা দেগা, Bastard Mujib is a traitor don’t you think so? সারে বাঙ্গালী কওম হিন্দু হ্যায়।
উসকানিমূলক এধরণের বক্তব্যে নূর ভীষণভাবে উত্তেজিত হয়ে ওদের কথার জবাবে গর্জে উঠে,
- If Mujib is a Gaddar then Yahia is a rogue. He is killing thousands of Bengalees, he has let loose the forces to rape and dishonour our mothers and sisters. Therefore, he is a bigger Bastard.
এ ধরণের কথা বলেই ক্ষান্ত হয়নি নূর। রাগের চোটে সামনের ষ্ট্যান্ডে রাখা প্রেসিডেন্টে ইয়াহিয়া খানের ছবি তুলে নিয়ে আছড়ে ফেলে দিয়ে তার উপর দিয়ে গটগট করে হেটে বেড়িয়ে যায় নূর। প্রেসিডেন্টের ছবি পা দিয়ে মারিয়ে চূর্ণ-বিচূর্ণ করার গুরু অপরাধে তক্ষুণি তার বিরুদ্ধে Open Arrest এর আদেশ জারি করে স্কুল কর্তৃপক্ষ। শুরু হয়ে যায় কোর্ট মার্শাল প্রসিডিংস্। ঘটনার আকস্মিকতায় আমার ও মতির মাথায় বাজ ভেঙ্গে পড়ে। হতভম্ব হয়ে যাই আমরা। খবর পেয়েই ছুটে গেলাম ওর কাছে।
-একি করলে নূর? ক্ষণিকের উত্তেজনার বসে সবকিছু ভন্ডুল করে দিলে কি করে? তোমার এ ধরণের হঠকারি কার্যকলাপের পরিণামে আমরাও বিপদে পড়তে পারি। তোমার সাথে আমাদের হৃদ্যতার কথা সবাই জানে। How could you be so stupid to do a thing like that. Shame on you. এ ধরণের কাজ তোমার কাছ থেকে আশা করিনি। হঠাৎ করেই ওর উপর ভীষণ রাগ হল।
- I am sorry Sir. I was totally out of my head. যা ঘটেছে তার জন্য আমি লজ্জিত এবং অনুতপ্ত, এখন আমাকে নিয়ে বৃথা চিন্তা না করে প্ল্যানমত আপনারা চলে যাবার ব্যবস্থা করেন যত শীঘ্র সম্ভব। Summery Of Evidence শুরু হলে আপনাদের ডাক পরা অসম্ভব কিছু নয়, কেসে জড়িয়ে পরার আগেই পালিয়ে যেতে হবে আপনাদের। আমার যা হবার তা হবে। কিন্তু আপনারা ফেঁসে পড়লে আর যাওয়ার সুযোগ হবে না। তাই আমার আন্তরিক অনুরোধ Please leave me alone to my fate and just think to escape as quickly as possible. আপনাদের কিছু হলে আমি নিজেকে কখনো ক্ষমা করতে পারবো না। ছেলে-মানুষের মতই ডুকরে কেঁদে উঠলো নূর। ওকে সান্তনা দেবার ভাষা খুজে না পেয়ে ভারাক্রান্ত হৃদয় নিয়ে ফিরে এলাম। হঠাৎ করে কি থেকে কি হয়ে গেল এখন আমাদের কি করা উচিত; ভেবে কোন কূলকিনারাই পাচ্ছিলাম না। নূরের ভবিষ্যত ভেবে শংকিত হয়ে পড়লাম। বেচারা নূর! অনেক তর্ক-বিতর্কের পর ঠিক করলাম মতি এবং আমি ১৬ই এপ্রিল আমাদের যাত্রা শুরু করবো। তখনকার দিনে করাচি থেকে একটি ফ্লাইট কোয়েটা, মুলতান হয়ে লাহোর যেত প্রতিদিন। ১৬ তারিখের ঐ ফ্লাইটেই রওনা হব আমি লাহোরের পথে। মতি স্কুল এ্যডজুটেন্টকে জানিয়ে দিয়েছে ট্রেনে না গিয়ে ও By Air Travel করবে। পথিমধ্যে মুলতানে কয়েকদিন কর্নেল সাহেবের পরিবারের সাথে কাটিয়ে চলে যাবে পেশাওয়ার। MS Branch এর কর্নেল সাহেবের নাম শুনে অতি স্বাভাবিকভাবেই তার প্রস্তাব মেনে নিয়েছিল স্কুলের এ্যডজুটেন্ট. একই ফ্লাইটে আমাদের সিট বুক করলাম। Open Arrest এ থাকার ফলে আমরা নূরের সাথে স্বাভাবিক যোগাযোগ রক্ষা করে চলতে পারছিলাম। Closed Arrest হলে ওর সাথে কোন যোগাযোগ রাখা সম্ভব হতো না। নূর বন্দী হওয়ার পর থেকেই মানসিক অশান্তিতে ভুগছিলাম। ওকে বিপদের মধ্যে ফেলে রেখে চলে যেতে মন কিছুতেই সায় দিচ্ছিল না। ঘুরে ফিরে শুধু একটি কথাই মনে হচ্ছিল, কোন মতেই কি নূরকে উদ্ধার করে আমাদের সাথে নিয়ে যাওয়া যায় না? অনেক চিন্তা ভাবনার পর একটা উপায় আমার মাথায় এলো। ১৫ তারিখ সকালে গিয়ে উপস্থিত হলাম মতির মেসে। গিয়ে দেখি মতির ঘর একদম খালি। বুঝলাম মতি তার মালপত্র ব্যাটম্যানের সাথে পাঠিয়ে দিয়েছে ইতিমধ্যে। বাথরুমে গোসল করছিল মতি। অল্পক্ষণ পরই মতি বেরিয়ে এলো,
-কি ব্যাপার স্যার, এতো সকালে আপনি?
-একটা বিশেষ ব্যাপারে আলাপ করতে এলাম। মতি তুমি ভালো করেই জানো নূরের বন্দী হওয়ার পর থেকেই আমি ভীষণভাবে মানসিক অশান্তিতে ভুগছি। সর্বক্ষণ ওকে নিয়েই ভাবছি। বললাম আমি।
-নূরের বিষয়েই কিছু কি? আমার মানসিক অবস্থা আচঁ করেই বোধহয় প্রশ্নটা করলো মতি।
-হ্যা তাই, নূরকে সঙ্গে নেবার একটা আইডিয়া এসেছে মাথায়....। আমাকে শেষ করতে না দিয়েই মতি বলে উঠলো,
- Are you mad Sir? বন্দী অবস্থা থেকে তাকে নিয়ে যাবার কথা কি করে ভাবলেন? ওকে সঙ্গে নিলে আমরা ধরা পরতে বাধ্য।
-আহা আগে শোনই না আমার আইডিয়াটা। মতিকে শান্ত করার চেষ্টা করলাম।
-বেশ বলেন কি বলতে চান।
-দেখো মতি, নূরই প্রথম আমার কাছে পালিয়ে যাবার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিল। মানছি হঠাৎ করে ও একটা ভুল করে ফেলেছে। মানুষ মাত্রই ভুল করতে পারে। তাছাড়া ওর ভবিষ্যতটা একটু ভেবে দেখ। এ অবস্থয় ওকে অসহায় একা ফেলে রেখে যেতে বিবেকে বাধছে, ওকে ফেলে রেখে যাওয়াটা আমি কিছুতেই মেনে নিতে পারছি না মতি।
- But then how? প্রশ্ন মতির।
-শোন মন দিয়ে। আমি ওর জন্য ৩ দিনের Attend ‘C’ ( Sick in quarters ) যোগাড় করে আজই ওকে রওয়ানা করিয়ে দিতে চাই ভাওয়ালপুরের উদ্দেশ্যে। ওখানে পৌঁছে সে অপেক্ষা করবে আমাদের জন্য। আমাদের পরবর্তী পদক্ষেপ সম্পর্কে ওকে কিছুই বলা হবে না। শুধু এতটুকুই বলা হবে আগামীকাল ভাওয়ালপুর ষ্টেশনে ওর সাথে নির্ধারিত সময়ে আমাদের দেখা হবে। সময় দুপুর ২-৩টার মধ্যে। That’s all. এ ব্যাপারে কোন প্রশ্ন না করে ও যদি যেতে রাজি হয় তবে Let’s take him. If at-all something goes wrong with him on his way even then we would be safe, as he wouldn’t be in a position to reveal anything about our rout or the next step and thus our secret will not be compromised. What do you say?
-ঠিক আছে, বুঝলাম আপনার প্লানে যুক্তি আছে। কিন্তু Attend ‘C’ কি করে যোগাড় করবেন? প্রশ্ন মতির।
ÑFirst of all tell me do you agree or not to take him with us on principle?
ÑWell it is still risky but I shall buy it.
জবাবে বললো মতি। আনন্দে মতিকে জড়িয়ে ধরে বললাম,
-Thanks, you are really great Moti. Now come-along and see what I do. গাড়ি করে ছুটে গেলাম CMH এ ষ্টাফ সার্জেন ক্যাপ্টেন জামালের কাছে। আমি যখন ঢাকা কলেজের ছাত্র তখন ঢাকা মেডিকেল কলেজে পড়তেন জামাল। ছাত্র রাজনীতি করার সুবাদে পরিচয় হয় আমাদের সেই পরিচয় আর্মিতে যোগদানের পর আরো ঘনিষ্ট হয়ে উঠে। বয়সে ক্যাপটেন জামাল আমার চেয়ে কিছুটা বড় হলেও আমরা একে অপরকে তুমি বলে সম্ভোধন করতাম। CMH এর Out Patient এ গিয়ে দেখি জামাল রুগী দেখায় খুবই ব্যস্ত। এক ফাঁকে এগিয়ে এসে বললো,
-কি বন্ধু হাসপাতালে কেন? বস কিছুক্ষণ একটু হালকা হইয়া লই।
জবাবে বললাম,
-না দোস্ত, বসনের সময় নাই খুব একটা জরুরী কামে আইছি।
-কও তইলে। মতিকে সংক্ষেপে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বললাম,
-কাইল যাইতাছি, দেখা না কইরা গেলেতো আমারে কাইট্টা ফেলাইতা তাই খোদা হাফেজ কইতে আইলাম। কিন্তু দোস্ত যাওনের আগে একটা শেষ আবদার লইয়া আইছি। নূরের লাইগা ৩ দিনের Attend ‘C’ লেইখা দাও। বেচারার মন-মেজাজ খুবই খারাপ। নূরের ঘটনা কোয়েটার সব বাঙ্গালীর মনেই সমবেদনার উদ্রেক করেছিল। অনেকেই ওর প্রতি ছিল Sympathetic ক্যাপ্টেন জামাল ছিল তাদেরই একজন। মুহুর্তে র্নিদ্বিধায় এর একটা চিট প্যাডে লিখে সেটা আমার হাতে দিয়ে জামাল বললো,
-এরই মধ্যে একদিন সময় কইরা যামুনে দেখতে কইও তারে। পোলাডা খামাখা নিজেরে কি বিপদেই না ফেলাইছে আল্লাহই জানেন, Young blood খুনকা গরমি বুঝলা বন্ধু। অনেকটা আফসোস করেই কথাগুলো বলেছিল জামাল।
-ঠিক কইছো দোস্ত। এখন তাইলে যাই, ভাবীরে বুঝাইয়া কইও সময়ের অভাবে দেখা করতে পারলাম না। বুঝতেই পারো কি তাড়াহুড়ার মইধ্যে আছি। আল্লাহ্ হাফেজ। বিদায় জানিয়ে বেরিয়ে এলাম। বিকেল ৩:৩০ মিনিটে ‘বোলান এক্সপ্রেস্’ এ তুলে দিতে হবে নূরকে। লাঞ্চ সেরে মতি ও আমি সোজা চলে গেলাম নূরের মেসে। গিয়ে দেখি নূর লুঙ্গি পরে খালি গায়ে শুয়ে আছে।
- Get up you lazzy bum! আওয়াজ পেয়ে চোখ খুলে লুঙ্গি বাধতে বাধতে উঠে বসলো নূর।
-বিনা প্রশ্নে আমার কথা মেনে নিতে রাজি থাকলে তোমাকে সঙ্গে নিয়ে পালাতে পারি। বলো রাজি। আমার কথা বলার ধরণে প্রথমে কিছুটা ভড়কে গিয়েছিল নূর। কিন্তু পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিয়ে বললো,
-কিন্তু............।
-কোন কিন্তু নয়। সময় নষ্ট না করে বলো রাজি। দৃঢ়তার সাথে জিজ্ঞেস করলাম আবার।
-রাজি। জবাব দিল নূর।
-বেশ এবার শোন মনযোগ দিয়ে- You have 3days Attend ‘C’, meanse complete bed rest OK? Send this Chit to the Adjutant through your Batman then give him Chutti for 3days. Call him now and do as I said.
নূর তক্ষুণি তার ব্যাটম্যানকে ডেকে তাকে নির্দেশ দিল চিট টা Adjutant এর কাছে পৌঁছে দিয়ে ছুটিতে বাড়ি চলে যাবার জন্য। অপ্রত্যাশিতভাবে একসাথে ৩ দিনের ছুটি পেয়ে ব্যাটার বত্রিশ দাঁত আর বন্ধই হচ্ছিল না। খুশীর ঠেলায় গদগদ হয়ে লম্বা একটা সেল্যুট মেরে ছুটে চলে গেল হুকুম তামিল করতে।
-এবার কাপড় পরে তৈরি হয়ে নাও। একটা হ্যান্ডব্যাগে দুই প্রস্ত Extra Change ভরে নাও জলদি। তোমাকে বোলান এক্সপ্রেস ধরতে হবে। লাহোর
পর্যন্ত টিকিট থাকবে কিন্তু ভাওয়ালপুরে নেমে যাবে তুমি। সেখানে সার্কিট হাউজে অবস্থান নেবে তুমি। আগামীকাল দুপুর ২ থেকে ৩টার মধ্যে ভাওয়ালপুর ষ্টেশনে আমরা মিলিত হবো ইনশাল্লাহ্। ভাওয়ালপুর পৌঁছে একটা কাজ করতে হবে তোমাকে। সেখান থেকে ভাওয়ালনগর যাবার উপায় কি কি এবং কোন উপায়ে কতটুকু সময় লাগবে সেটা জেনে রাখতে হবে তোমাকে। All the way you will behave like an army officer travelling to your place of posting at Bhawal Nagar. Am I clear?
- Yes Sir. বলেই ছোট একটা হ্যান্ডব্যাগে অতি প্রয়োজনীয় সবকিছু গুছিয়ে নিয়ে নূর তৈরি হয়ে নিল। ওকে গাড়িতে তুলে নিয়ে আমরা ছুটলাম রেলওয়ে ষ্টেশন। বোলান এক্সপ্রেস প্ল্যাটফর্মে দাড়িয়ে ছিল। একটা ফার্ষ্টক্লাশ ক্যুপেতে নূরের জন্য একটা সিট রির্জাভ করা হলো। নির্দিষ্ট কামরায় উঠে বসলাম আমরা। পকেট থেকে ৫হাজার টাকা, একটা পিস্তল এবং ২৫টা গুলি নূরের হাতে তুলে দিলাম। কোন কথা না বলে সেগুলো ব্যাগে ভরে রাখলো নূর। কিছুক্ষণ পর গাড়ি ছাড়ার ঘন্টা এবং হুইসেল দু’টোই বেজে উঠলো। নূরকে জড়িয়ে ধরে বললাম,
-Take care, see you tomorrow. খোদা হাফেজ। গাড়ি নড়ে উঠলো। আমরা প্ল্যাটফর্মে নেমে পড়লাম। তীব্র হুইসেল বাজাতে বাজাতে বোলান এক্সপ্রেস ষ্টেশন ছেড়ে বেরিয়ে গেল। আমরাও ফিরে এলাম।
আজ রাতে Div Arty এর তরফ থেকে আমার Farewell dinner. তাই মতিকে মেসে নামিয়ে দিয়ে ফেরার সময় বললাম, “কাল এয়ারর্পোটে দেখা হবে।”
মেসে সে রাতে Div Arty-র ব্যান্ড এর সাথে অনেক রাতঅব্দি পানাহার চললো। ব্যান্ডের তালে তালে নাচগানও হলো রেওয়াজ অনুযায়ী। বেশ কিছুটা ক্লান্তি অনুভব করছিলাম সারাদিনের ব্যস্ততায়। তার উপর মাথায় রয়েছে নূরের ব্যাপারে টেনশন। কিন্তু কিছুই করার নেই। সব চিন্তা মনে চেপে রেখে স্বাভাবিকভাবেই সব Formalities শেষ করে অনেক রাতে ফিরে এলাম নিজের কামরায়। সেদিন হঠাৎ করে এক পশলা বৃষ্টি হওয়ায় বেশ একটু ঠান্ডা পরেছে। তাই বেয়ারা ঘরের ফায়ার প্লেসে আগুন জ্বালিয়ে দিয়ে গেছে। সঙ্গে নেবার জিনিসপত্র আগেই গোছগাছ করে রাখা হয়েছে। টেবিলের উপর রাখা আমার সবচেয়ে প্রিয় ফটো এলবাম দু’টো। সাথেই আখরোটের সুক্ষকাজ করা লেটার বক্সে রাখা আছে নিম্মীর লেখা চিঠিগুলো। বেড-সাইড টেবিলের উপর ফটো ষ্ট্যান্ডে রাখা নিম্মীর ছবিটাকে ভীষণ জীবন্ত লাগছে। মনে হচ্ছে ও যেন গভীর দৃষ্টিতে আমাকে পরখ করে দেখছে। এগুলো পুড়িয়ে ফেলতে হবে। কোন সূত্র রাখা চলবে না। এতে করে সমূহ বিপদের সম্ভাবনা রয়েছে। ফায়ার-প্লেসের সামনে একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসে পোড়াবার আগে শেষবারের মত এলবামের ছবিগুলো দেখতে লাগলাম। প্রতিটি ছবির সাথে জড়িয়ে আছে একেকটা স্মৃতি। ফটো দেখা শেষ হলে এলবাম দু’টো ছুঁড়ে দিলাম ফায়ার-প্লেসে। দাউ দাউ করে আগুন জ্বলে উঠলো। চিঠিগুলোও ফেলে দিলাম সেই আগুনে। মুহুর্তে আগুনের লেলিহান শিখা গ্রাস করে নিল সব। কষ্টে বুকটা ফেটে যাচ্ছিল। সযত্নে তুলে রাখা এতদিনের অমূল্য সম্পদগুলোকে এভাবে বিসর্জন দিতে হবে সেটা কখনো ভাবিনি। আগুনের দিকে চেয়েছিলাম। দু’চোখ বেয়ে নিজের অজান্তেই পানি গড়িয়ে পড়ছিল। অতীতের স্মৃতিতে তলিয়ে গেলাম আমি। মনে পরে গেল নিম্মীর সাথে আমার প্রথম পরিচয়ের কথা।
রিয়াজুল ইসলাম চৌধুরী (বাপ্পি)-র বোন নিম্মী। বাপ্পি আমার ঘনিষ্টতম বন্ধুর একজন। আমি, স্বপন, টুটু, হায়দার, বাপ্পি একে অপরের হরিহর আত্মা। ছুটিতে ঢাকায় এলে ২৪ ঘন্টা একসাথে থাকা, খাওয়া, হৈ হুল্লর করে সময় কাটে আমাদের। কখনো সিনেমা, কখনো পিকনিক নয়তো শিকার এভাবেই আনন্দে কেটে যায় আমাদের সময় ঝড়ের বেগে। এসব কিছু ভালো না লাগলে চলে যাই সিলেটের চা বাগানে, কাপ্তাই-রাঙ্গামাটি কিংবা কক্সবাজার-টেকনাফ। ১৯৬৮ সালের ফেব্রুয়ারীতে ছুটিতে ঢাকায় এসেছি। হৈচৈ করে কেটে যাচ্ছিল সময়। একদিন হায়দার খবর নিয়ে এলো যমুনার চরে মৌসুমী পাখির আগমন ঘটেছে প্রচুর তাই শিকারে যেতে হবে। শিকারের প্রতি একটা অদ্ভুত নেশা ছিল হায়দারের। সেদিন রাতেই দল বেধে শিকারে বেরিয়ে পরলাম। আরিচা ঘাট পর্যন্ত গাড়িতে তারপর নৌকা যাত্রা। মধ্যরাতের পর খাওয়া-দাওয়ার পর নৌকায় উঠলাম। পরদিন দুপুর পর্যন্ত শিকার করে শেষ বিকেলে ফিরে এলাম। শিকার ভালোই পাওয়া গেছে। ১টা রাজহাস, ৪টা চখা এবং ২০টা বালিহাস। শীতকালে মৌসুমী পাখি সাইবেরিয়া থেকে উড়ে আসে বাংলাদেশে ঝাঁকে ঝাঁকে। গরমের শুরুতেই আবার উড়ে ফিরে যায় তুন্দ্রা অঞ্চলে। পাসপোর্ট কিংবা ইমিগ্রেশনের ঝামেলা নেই তাদের। যখন যেখনে খুশি উড়ে চলে যায় ওরা। শুধুমাত্র মানুষের কাছ থেকেই বৈষয়িক স্বার্থে এই স্বাধীনতা কেড়ে নেয়া হয়েছে। বাসায় ফিরতেই আমার ছোট দুই বোন মহুয়া ও কেয়া বায়না ধরে বসলো, বৃটিশ কাউন্সিলে একটা ফাংশন হচ্ছে সেখানে নিয়ে যেতে হবে। সারা দিন রাত শিকারের ধকলে সবাই ক্লান্ত। কেউই ওদের নিয়ে যেতে রাজি হলো না। ক্লান্ত থাকা সত্ত্বেও আমি ওদের মানা করতে পারলাম না। অনেক কষ্টে বাপ্পিকে সঙ্গে যাওয়ার জন্য রাজি করালাম। যখন বৃটিশ কাউন্সিলে পৌঁছলাম তখন রাত ৯টার উপর। বারান্দায় কয়েকটি মেয়ে দাড়িয়ে আছে দেখতে পেলাম। ফাংশন অথচ লোকজনের ভীড় নেই একদম। গাড়ি পোর্চের নিচে দাড় করাতেই মহুয়া কাচ নামিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
-এই নিম্মী এদিকে এসো।
নিম্মীটি আবার কে! দেখলাম একটি মেয়ে গাড়ির কাছে এগিয়ে এলো।
-কি এত ফাঁকা কেন? প্রশ্ন করলো মহুয়া।
-ফাংশন শেষ। জানালো মেয়েটা। বাপ্পি ওকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলো,
-তুমি এখনও এখানে কি করছো?
-রিক্সা পাচ্ছি না। জবাব দিল মেয়েটা। মহুয়াই পরিচয় করিয়ে দিল,
-ভাইয়া, নিম্মী বাপ্পি ভাইয়ার বোন আমাদের হলিক্রসে পড়ে। বাপ্পিদের বাসায় যাওয়া আসা থাকলেও নিম্মীর সাথে আগে পরিচয়ের সুযোগ হয়নি।
-চলো না ভাইয়া নিম্মীকে নামিয়ে দিয়ে আসি ফাংশন যখন আর দেখাই হলো না। মহুয়া অনুরোধ জানালো।
-বেশ চল। নিম্মীকে গাড়িতে তুলে নিয়ে বাপ্পিদের বাসার দিকে রওনা হলাম। উজ্জ্বল শ্যামবর্নের একহারা গড়নের নিম্মী কেয়া-মহুয়ার সাথে পেছনের সিটে বসেছে। বাপ্পি আমার পাশের সিটে। রিয়ার ভিউ মিরর এ নিম্মীকে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছিল। দেখলাম, সুন্দর ফিগারের অধিকারিণী নিম্মী দেখতে আকর্ষনীয় এবং মিষ্টি। সবচেয়ে আকর্ষনীয় তার চুল। ঘনকালো চুলের একটা অসাধারন মোটা বেনী হাটু ছাড়িয়ে প্রায় গোড়ালির কাছ অব্দি ঝুলছে। হালফ্যাশানে বাঙ্গালী মেয়েদের মাঝে এ ধরনের ঘনকালো লম্বা চুল খুব একটা দেখা যায় না। গাড়ো নীল রং এর বুটিদার কামিজ ও চুড়িদার পায়জামা পরেছিল নিম্মী। কথা বলার ধরণও ভীষণ আন্তরিক। সবকিছু মিলিয়ে প্রাণবন্ত উচ্ছল প্রকৃতির নিম্মীকে প্রথম দেখাতেই ভালো লাগলো। সেই ভালোলাগা থেকেই ভালোবাসা। আশ্চর্য হয়েছিলাম নিজেই। স্কুল-কলেজ-ভার্সিটি জীবনে শুধুমাত্র লেখাপড়ার জন্যই নয় বিভিন্ন কারণে বেশ নাম ডাক ছিল বরাবরই। একনামে পরিচিত ছিলাম বিভিন্ন মহলে। মেয়েদের সাথে মেলামেশার অবাধ সুযোগও হয়েছে ছোটকাল থেকেই। কিন্তু প্রেম-ট্রেমের ধার ধারিনি কখনো। দু’একটা প্রেমপত্র গল্পের বই আদান-প্রদানের মাধ্যমে হাতে এসে পৌঁছায়নি তাও নয়। কিন্তু সেগুলো মনে তেমন একটা দাগ কাটতে সক্ষম হয়নি। ঘটনাগুলো নেহায়েত নেকামী বলেই মনে হয়েছে সবসময়। অবশ্য পছন্দ না হলেও প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষভাবে অনেক বন্ধু-বান্ধবকেই নানাভাবে সাহায্য করতে হয়েছে এ পর্যন্ত ক্ষেত্রবিশেষে। ছাত্র রাজনীতি, খেলা-ধুলা, গান-বাজনা, নাটক, সমাজসেবা ইত্যাদি নিয়ে মেতে থাকাটাই ছিল আমার নেশা। তাই মেয়েদের ব্যাপারে ধ্যান দেবার সময় ছিল না মোটেও। কাউকে দেখে তেমনভাবে আকর্ষণও বোধ করিনি কখনো। সেই আমিই কিনা প্রথম দেখার ভলোলাগা থেকে একেবারে ভালোবেসেই ফেল্লাম নিম্মীকে! এমনটিই বোধহয় হয়। যাকে ভালোলাগে তাকে প্রথম দেখাতেই ভালোলাগে। প্রথমে নিজেকেই বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। হয়তোবা ক্ষণিকের মোহ; কিন্তু না এতো মোহ নয়। এরপর যতই দিন গেছে নিম্মীর প্রতি আকর্ষণ বেড়েছে আমার। গভীর হয়েছে আমার ভালোবাসা। এক অদ্ভুত অনুভূতি! প্রতিদানে নিম্মীও সবটুকু মন উজাড় করে ভালোবেসেছে আমাকে। তার পবিত্র, আন্তরিক ও নিঃস্বার্থ ভালোবাসার গহীন অতলে তলিয়ে গেছি আমি। নিম্মী তার প্রথম যৌবনের কুমারী মনের সবটুকু মাধুর্য্য বিলিয়ে দিয়ে একান্ত বিশ্বাসে আমাকে স্বীকার করে নিয়েছিল তার ভালোবাসার মানুষ হিসাবে। আমি স্থান পেয়েছিলাম তার মনের মণিকোঠায়। আমি ধন্য হয়েছি তার ভালোবাসা পেয়ে। আমাদের ভালোবাসাকে সানন্দেই গ্রহণ করে নিয়েছেন দুই পরিবারের সবাই বিশেষ করে গুরুজনরা। খুশী হয়েছে বন্ধু-বান্ধবরা। এবার ছুটি থেকে ফেরার আগে আমাদের বিয়ের ব্যাপারেও সব ঠিকঠাক হয়ে গেছে। এ বছরের শেষাশেষি কিংবা আগামী বছরের প্রথম দিকে আমাদের বিয়ে হবে ঠিক হয়েছে। কিন্তু হঠাৎ করেই দৈবচক্রে সবকিছুই ওলোট-পালোট হয়ে গেল। ভবিষ্যত হয়ে উঠল অনিশ্চিত। ঢাকা থেকে ফিরে আসার পর কোন চিঠিপত্র পাইনি ওর কাছ থেকে। জানিনা ঠিক এই মুহুর্তে ও কোথায়, কি অবস্থায় আছে! নিম্মীর বাবা জনাব রফিকুল ইসলাম চৌধুরী ১৯৬৯ সাল থেকে কোলকাতায় পাকিস্তান দূতাবাসে কূটনৈতিক হিসেবে পোষ্টেড আছেন। তিনি নিম্মীর ছোটবোন মানুকে নিয়ে কোলকাতাতেই থাকেন। খালাম্মা মানে নিম্মীর আম্মা, বাপ্পি, নিম্মী এবং নিজের পড়াশুনার জন্য ঢাকাতেই থাকেন অনেকটা বাধ্য হয়েই। ছুটিছাটায় কোলকাতায় যান মানুদের দেখে আসতে। আব্বা, মহুয়া, কেয়া, স্বপন, হায়দার, টুটু, বদি ওদেরও কোন খবরা-খবর নেই। কিন্তু আমার বিশ্বাস জাতির এই ক্রান্তিলগ্নে ওরা কিছুতেই হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকবে না। ওরা নিশ্চয়ই জনগণের সাথে প্রতিরোধ সংগ্রামে যোগ দিয়েছে। আমি যে ঝুঁকিপূর্ণ পদক্ষেপ নিয়ে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের পথে পাড়ি জমাচ্ছি তার জন্য একজন পদস্থ সরকারি অফিসার হিসেবে তার এবং পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের উপর অভিসম্পাত নেমে আসতে পারে। পাক-বাহিনীর অত্যাচারের শিকারেও পরিণত হতে পারেন তারা। কথাটা ভেবে মনটা হঠাৎ করে দুর্বল হয়ে পড়লো। ব্যথায় বুকটা ভারী হয়ে উঠলো। কিন্তু না, এ পর্যায়ে এমনভাবে দুর্বল হওয়া চলবে না। সবকিছুর বিনিময়ে এমনকি জীবনের পরোয়া না করে মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের সিদ্ধান্তে অটল থাকতেই হবে। ব্যক্তি, গোষ্ঠি, পারিবারিক সব স্বার্থ থেকে দেশ এবং জাতীয় স্বার্থ অনেক বড়। সে প্রশ্নে কোন আপোষ করা চলবে না কিছুতেই। আমার এই সিদ্ধান্তে-র ফলে কারো কিছু হলে দুঃখ পাবো কিন্তু জাতীয় প্রয়োজনে কোন অবদান রাখতে না পারলে নিজের কাছে নিজেই হেয় হয়ে যাবো। কাপুরুষতার গ্লানি নিয়ে বেঁচে থাকতে হবে সারাজীবন। ইতিমধ্যে অনেক দিনের জমানো স্মৃতির নিদর্শনগুলো সব পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। সারাদিনের ক্লান্তি ছড়িয়ে পড়েছে সমস্ত শরীরে। আগামীকাল ভোর ৭টায় এয়ারর্পোটে যেতে হবে তাই শ্লথগতিতে উঠে পরে বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে বাতি নিভিয়ে দিলাম।
পরদিন ভোর ৬টায় অভ্যাসমত ঘুম ভেঙ্গে গেল। মেস ওয়েটার বেড টি দিয়ে গেল। বেড টি শেষে প্রাতঃক্রিয়া সম্পন্ন করে শেষ বারের মত ডাইনিং হলে গেলাম নাস্তার জন্য। হেড ওয়েটার ফিদা খান নিজেই সমাদর করে নিজের তদারকিতে নাস্তা করালো। নাস্তা শেষে বয়, বার্বুচী, ওয়েটার এবং হেড ওয়েটার সবাইকে বকশিশ দিয়ে তাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে এলাম। মেসের সামনের কারপার্ক গাড়িতে ভরে গেছে। Div Arty -র প্রায় সব অফিসারই জমায়েত হয়েছে আমাকে এয়ারপোর্টে See Off করতে যাবার জন্য। ওদের আন্তরিকতা আমাকে বিহ্ব্ল করে তুলেছিল। সামরিক জান্তার পাশবিকতা আর এদের বন্ধুসুলভ আন্তরিকতায় কত তফাৎ! ভাবছিলাম আজ ইয়াহিয়া খান ও তার দোসররা রাজনৈতিক ফায়দা লুটার জন্য পূর্ব পাকিস্তানে অত্যাচারের যে ষ্টিমরোলার চালিয়ে দিয়েছে তার প্রতি পশ্চিম পাকিস্তানের সাধারণ মানুষের কতটুকু সমর্থন রয়েছে ? সময় হয়ে এল। আমার CO মিয়া হাফিজ এসে বললেন,
- Sharif it’s time, let’s go.
- Yes Sir. বলে যারা এয়ারপোর্টে যাবে না তাদের সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে কর্নেল হাফিজের পাশে গাড়িতে উঠে বসলাম। তিনি গাড়িতে ষ্টার্ট দেবার সাথে সাথে যারা যাবার তারা সবাই যার যার নির্দিষ্ট গাড়িতে উঠে বসলো। কাফেলা চললো এয়ারপোর্টের দিকে। মিনিট বিশেকের মধ্যেই এয়ারপোর্ট পৌঁছে গেলাম। মতি আমার আগেই পৌঁছে Check-In করে অপেক্ষা করছিল।
-আরে মতি তুমি এখানে? ইচ্ছে করেই প্রশ্নটা করলাম।
-মুলতান যাচ্ছি পেশাওয়ারের পথে। জবাবে বললো মতি।
- I see that’s good. প্লেনে তাহলে গল্প করে সময়টা ভালোই কাটবে। বললাম আমি। Check-In পর্ব শেষ করে সবার সাথে কথাবার্তা বলছিলাম, হঠাৎ দেখি Div Arty Commander ব্রিগেডিয়ার বাদশা এয়ারপোর্টে অপ্রত্যাশিতভাবে এসে হাজির। ব্রিগেডিয়ার বাদশা আমাকে A young good gunner officer হিসেবে খুবই স্নেহ করতেন। ব্রিগেডিয়ার বাদশা জাতিতে পাঠান। তিনি এগিয়ে আসতেই আমরা সবাই সেল্যুট করে দাড়ালাম।
-আলাকা শরিফ তু হামকো ছোরকে যা রাহা হ্যায় ইস্লিয়ে হামে দুখ্ হ্যায়, লেকিন এহি জিন্দেগী হ্যায় বেটা। নয়া ইউনিটমে আচ্ছা রেহ্না অওর খোশ রেহ্না এহি মেরা দোয়ায়ে হ্যায়। পিতৃসুলভ ব্রিগেড কমান্ডারের কথাগুলো মনে দাগ কেটেছিল। র্বোডিং এর ঘোষণা হল। সবার সাথে কোলাকুলি করে বিদায় নিলাম। ব্রিগেডিয়ার বাদশার ইশারায় কয়েকজন Young Officers কাঁধে তুলে নিয়ে He was a jolly good fellow বলতে বলতে আমাকে প্লেনের সিড়ি পর্যন্ত বয়ে নিয়ে গেল। পুরনো বন্ধুদের ছেড়ে যেতে খুব খারাপ লাগছিল। কোনমতে নিজেকে সামলে নিয়ে প্লেনে উঠে বসলাম। মতিও উঠে বসেছে। জানালা দিয়ে দেখলাম সবাই লাইন করে দাড়িয়ে হাত নাড়ছে। অল্পক্ষণ পরেই প্লেন ষ্টার্ট নিয়ে Take-Off করলো। সবাই তখনও দাড়িয়ে। কেউ কেউ রুমাল নাড়িয়ে শেষ বিদায় জানাচ্ছিল। প্লেন এয়ারপোর্টের উপর দু’টো চক্কর দিয়ে মেঘের ভিতর দিয়ে উপরে উঠে গেল। সবাইকে পিছনে ফেলে প্লেন উড়ে চললো মুলতানের উদ্দেশ্যে। এভাবেই শুরু হলো আমাদের নিরুদ্দেশ যাত্রা। ঘন্টা দেড়েকের মধ্যেই আমাদের বহনকারী ফোকার-ফ্রেন্ডশিপ বিমানটি মুলতান এয়ারপোর্টে অবতরণ করল। প্লেন থেকে বেরুতেই মুখে লাগলো গরম বাতাসের ঝাপটা। কোয়েটার তুলনায় মুলতানের আবহাওয়া অনেক উষ্ণ। ভাওয়ালপুর ভাওয়ালনগরের দিকে উষ্ণতা ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাবে। ছোট এয়ারপোর্ট ক্যান্টনমেন্টে এরিয়ার মধ্যেই অবস্থিত। প্লেন থেকে অবতরণ করে ট্রানজিট লাউঞ্জে না গিয়ে মতির সাথে সোজা চলে গেলাম Arrival এ। ওখানে PIA কাউন্টারে গিয়ে আমার লাহোর যাওয়া Cancel করে দিয়ে বেরিয়ে এলাম এয়ারপোর্ট থেকে। মুলতান শহর এয়ারপোর্ট থেকে প্রায় ৫মাইল দূরে অবস্থিত। একটা ট্যাক্সি ভাড়া করে সোজা চলে এলাম শহরে। কিছু কেনাকাটা করার ছিল। Survival Kit, FirstAid Box, Anti Snake Bite Kit এগুলো সব সঙ্গে করে আনা হয়েছে। তিনজনের জন্য Desert Shoes, এক বোতল ব্রান্ডি, সুইটস-চুইঙ্গাম, বিস্কিটস, কিছু ড্রাই ফ্রুটস প্রভৃতি কেনা হলো। তারপর গেলাম সোনার দোকানে। ওখানে দু’টো আংটি বানালাম একেকটা দেড় ভরি ওজনের। একটাতে খোদাই করলাম ' S ' এবং অন্যটাতে ' M '। আমি ও মতি আংটি দু’টো পরে নিলাম। কেনাকাটার পাঠ চুকিয়ে গেলাম Railway Station-এ। ওখানে গিয়ে জানতে পারলাম ১২টার ট্রেন ধরলে দু’টো-সোয়া দু’টোর মধ্যেই পৌঁছে যাওয়া যাবে ভাওয়ালপুর। ঠিক করলাম দুই বাঙ্গালীর একসঙ্গে সফর করাটা ঠিক হবে না। সিদ্ধান্ত নেয়া হলো মতি যাবে ট্রেনে আর আমি যাব বাসে। বাসে করে আমি মতির আগেই পৌঁছে যাব ভাওয়ালপুর। ওখানে ষ্টেশনে মিলিত হব আমরা। মতিকে ট্রেনে তুলে দিয়ে ট্যাক্সি করে গিয়ে পৌঁছালাম বাস ষ্ট্যান্ডে। প্রতি ১৫ মিনিট অন্তর বাস ছাড়ছে ভাওয়ালপুরের উদ্দেশ্যে। ট্যাক্সি ছেড়ে দিয়ে অপেক্ষমান বাসে উঠে বসলাম। মালপত্রের বেশিরভাগই মতি নিয়ে গেছে সাথে। আমার কাছে রয়েছে হালকা ছোট্ট একটা ব্যাগ। দু’টো বাজার আগেই পৌঁছে গেলাম ভাওয়ালপুর। বাস ষ্ট্যান্ডে নেমে টাঙ্গা করে পৌঁছলাম ষ্টেশনে। ষ্টেশনে পৌঁছে দেখি পূর্ব সিদ্ধান্ত অনুযায়ী নূর প্ল্যাটফর্মের একপ্রানে- একটা খবরের কাগজ হাতে দাড়িয়ে আছে। সোয়া দু’টোর দিকেই মতির ট্রেন এসে প্ল্যাটফর্মে এসে দাড়ালো। মতি নামলো ট্রেন থেকে। একে অপরের সাথে চোখাচোখি হল কিন্তু কেউ কারো সাথে কথা বললাম না। তিনজনেই আলাদাভাবে সার্কিট হাউজে পৌঁছলাম। নূরের ঘরে ঢুকেই একে অপরকে জড়িয়ে ধরলাম উল্লাসে। নূর আগেই আমাদের লাঞ্চের ব্যবস্থা করে রেখেছিল। ঘরেই লাঞ্চ করলাম। লাঞ্চের সময় নূর জানালো পথে ওর কোন অসুবিধেই হয়নি। আরো জানালো ভাওয়ালপুর থেকে ভাওয়ালনগর দু’ভাবে যাওয়া সম্ভব। ট্রেনে করে গেলে লাগবে ঘন্টা তিনেক। ট্রেনের সময় বিকেল ৪টা। আর ট্যাক্সিতে গেলে সময় লাগবে বড়জোর ঘন্টা দু’য়েক। ঠিক হলো ট্যাক্সিতেই যাব। কারণ ভাওয়ালনগর থেকে সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার ট্রেন ধরতে হবে আমাদের। প্রতিদিন দু’টোই ট্রেন যায় ভাওয়ালনগর থেকে ফোর্ট আব্বাস, একটা সকালে অপরটি সন্ধ্যায়। সাড়ে সাতটার ট্রেন মিস করলে পুরো রাতটা কাটাতে হবে ভাওয়ালনগরে। সেটা হবে আমাদের জন্য খুবই বিপদজনক কারণ সমস্ত ভাওয়ালনগরটাই একটা ক্যান্টনমেন্ট। লোকাল ট্রেনের সময়ের কোন ঠিক-ঠিকানা নেই। কোনরকম রিস্ক নেয়া চলবে না। ট্যাক্সিতে গেলে সাড়ে সাতটার অনেক আগেই পৌঁছে যাবো ভাওয়ালনগর। কিছু সময় বিশ্রাম করে বিকেল ৪টায় একটা ট্যাক্সি ডাকিয়ে এনে রওনা হলাম ভাওয়ালনগরের উদ্দেশ্যে। সিন্ধী ড্রাইভার। ওকে বললাম, সাতটার মধ্যে ভাওয়ালনগর পৌঁছে দিতে পারলে বকশিশ মিলবে। তরুণ ড্রাইভার জবাবে বললো,
- কই বাতই নেহি হ্যায় সাব। আপকো সাতসে পেহলেই পৌঁহ্চা দেঙ্গে। উল্কাবেগে ছুটে চলেছে ট্যাক্সি। শেভ-ইম্পালা গাড়ি। সৌখিন ছোকরা ক্যাসেটে ফিল্মী গান লাগিয়ে দিল। আমরা চুপচাপ বসে গান শুনছিলাম আর ভাবছিলাম ভূত-বর্তমান-ভবিষ্যত। এক সময় ঝিমুনি এসে গিয়েছিল। হঠাৎ বিকট একটা শব্দে চমকে তিনজনেই জেগে উঠলাম। একটা ঝাকুনি দিয়ে ট্যাক্সি ততক্ষণে থেমে গেছে।
-কি হলো? ব্যাপার কি?
প্রায় একেইসাথে বলে উঠলাম তিনজনে।
-দেখতে হেঁ সাব।
বলে গাড়ি থেকে নেমে গেল ড্রাইভার। কিছুক্ষণ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে ফিরে এসে বললো,
-গাড়িকা ক্র্যাঙ্কশাফ্ট টুট গিয়া।
বলে কী ব্যাটা!
-ফির আব হাম কেয়া করেঙ্গে? জিজ্ঞেস করল নূর।
-ঘাবড়াও মাত স্যার, পাঁচছে মিল রেহেতে হ্যায় কোই না কোই সোয়ারী জরুর মিল যায়েগা উসমে বেঠা দেঙ্গে আপলোগকো।
কি সর্বনাশ! তবে কি ঘাটে এসে তরী ডুবল? গাড়িটাকে সবাই মিলে ঠেলে রাস্তার সাইডে রাখা হল। অন্য কোন গাড়ি না আসা পর্যন্ত কিছুই করার নেই। অপেক্ষা করতে করতে বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নেমে এল। দূরে ভাওয়ালনগরের বাতিগুলো এক সময় জ্বলে উঠল। ৭টা বেজে গেল কোন গাড়ির লক্ষণ নেই। অস্থির হয়ে উঠলাম সবাই। হতাশায় মনোবল হারিয়ে ফেলেছিলাম প্রায়। হঠাৎ দূরে গাড়ির হেডলাইট দেখা গেল; কিছু একটা আসছে ভাওয়ালপুরের দিক থেকেই। রাস্তা ব্লক করে দাড়ালাম চার জনেই। যাই হোক না কেন থামাতে হবে। কাছে আসতে দেখলাম একটা ল্যান্ডরোভার। আমরা হাত দিয়ে ইশারা করায় গাড়িটা থামল। Roads & Highways এর এক ইঞ্জিনিয়ার যাচ্ছেন ভাওয়ালনগর। ভদ্রলোককে সবকিছু বুঝিয়ে বললাম।
তিনজন আর্মি অফিসারের দুর্গতি দেখে ভদ্রলোক সহানুভূতি দেখিয়ে বললেন,
-আপনাদের কষ্ট না হলে আমি আপনাদের নিয়ে যেতে পারি।
-কষ্ট! হাতে আকাশের চাঁদ পেলাম। ধন্যবাদ জানিয়ে তাড়াতাড়ি ট্যাক্সির ভাড়া চুকিয়ে মালপত্র নিয়ে জিপে উঠে বসলাম। অধাঘন্টার মধ্যেই ভাওয়ালনগর পৌঁছে গেলাম। তখন রাত পৌনে আটটা। আমাদের ট্রেন নিশ্চয়ই এতক্ষনে ছেড়ে চলে গেছে। ইঞ্জিনিয়ার সাহেব জিজ্ঞেস করলেন,
-কোথায় নামবেন? ষ্টেশন এর কথা না বলে বললাম,
-শহরের যে কোন খানে নামিয়ে দিলেই চলবে। Town Centre এ নামিয়ে দিলেন ভদ্রলোক। সেখান থেকে একটা টাঙ্গা করে কাছেই ষ্টেশনের দিকে রওনা হলাম। ষ্টেশনে পৌঁছে দেখি অসম্ভব ভীড়। এমনটি তো হবার কথা নয়। ট্রেন চলে যাবার পর ষ্টেশন থাকবে জনশূন্য তাহলে এত লোক কেন ষ্টেশনে? ট্রেন কি তাহলে এখনও আসেনি? হঠাৎ করে কিছুটা আশার আলো ঝলকে উঠল। আমি তাড়াতাড়ি ছুটে গিয়ে ষ্টেশন মাষ্টারকে জিজ্ঞাসা করলাম,
-ফোর্ট আব্বাসের ট্রেনের খবর কি? দু’বাক্যে ষ্টেশন মাষ্টার বললেন,
-ট্রেন লেট, এখনও এসে পৌঁছেনি।
জানে পানি ফিরে এল। দৌড়ে গিয়ে মতি ও নূরকে খবরটা দিতেই খুশিতে আত্মহারা হয়ে ওরা লাফ দিয়ে টাঙ্গা থেকে নেমে পড়ল। কুলির মাথায় মাল চাপিয়ে টাঙ্গার ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে প্লাটর্ফমে চলে এলাম। পথে একটি ভিক্ষুক দাড়িয়েছিল। আনন্দের আতিসয্যে একশ টাকার একটি পুরো নোটই তাকে দিয়ে দিলাম। সোয়া আটটায় আমাদের ট্রেন এল। র্ফাষ্টক্লাসের তিনটি টিকেট কাটা হল র্ফোট আব্বাস পর্যন্ত। বর্ডার এলাকার ট্রেন। আমাদের মত ফৌজি ছাড়া ফার্ষ্টক্লাশের যাত্রি বিরল। অতি সহজেই একটা খালি কামরা পেয়ে উঠে বসলাম। ট্রেনে উঠেই বুফে কার থেকে ডিনার আনাবার বন্দোবস্ত করা হল। খাবার সার্ভ করে গেল বেয়ারা। দরজা বন্ধ করে খাওয়ার পাঠ চুকিয়ে নিলাম। ট্রেন ইতিমধ্যে চলতে শুরু করেছে। খাওয়া শেষ করার পর পদযাত্রার প্রস্তুতি শুরু হল। সবাই ডার্ক কালারের কাপড় পরে নিলাম। আমাদের কাছে তখন সর্বমোট প্রায় হাজার বিশেক টাকা। ওগুলো কাপড়ের বিভিন্ন চোরা পকেটে ঢোকানো হল। স্যুটকেস থেকে হ্যাভারস্যাক বের করে ওতে তিন জনের আর এক প্রস্ত করে কাপড় নেয়া হল। প্রয়োজনীয় সাথে নেবার সবকিছু রাখা হল হ্যাভারস্যাক এ। ম্যাপ বের করে নাইট মার্চ চার্ট আঁকা হল। পাকিস্তানের মটরাইজড ইনফ্যানট্রি ডিভিশনের ডিফেন্সিভ এলাকার মধ্য দিয়ে ইন্ডিয়ান আর্মির একটি ট্যাংক রেজিমেন্টের হেডকোয়ার্টারস এর পাশ ঘেষে যেতে হবে আমাদের। রাস্তায় পড়বে এ্যান্টিট্যাংক অবস্ট্যাকল মাইন ফিল্ড। এদের মাঝে গ্যাপ বের করে নিয়ে যাত্রাপথ নির্ধারন করা হয়েছে। পথে দুই তরফের পেট্রোল পার্টির মোকাবেলায় পড়তে হতে পারে। সিদ্ধান্ত নেয়া হল যেকোন উপায়েই হউক own troops and enemy Troops -কে এড়িয়ে চলতে হবে আমাদের। নেহায়েত বিপাকে পড়লেই সংঘর্ষের মাধ্যমে শত্রুকে পরাস্ত করার উদ্যোগ নেয়া হবে। কোন অবস্থাতেই ধরা পড়া চলবে না। ধরা পড়ার আগেই আমরা আত্মহত্যা করব। কোন কারণে অবস্থার প্ররিপ্রেক্ষিতে একে অপরের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়লে ব্যক্তিগত উদ্যোগে করনপুর পৌঁছবার চেষ্টা করতে হবে। কম্পাসে রুট এবং বিয়ারিং সেট করা হল, পরা হল Desert shoes. হাতিয়ার এবং গুলি নিজেদের মাঝে ভাগ করে নিলাম। ম্যাপ, কম্পাস, বাইনোকুলার, নাইট মার্চ চাটর্, একটি টর্চ, একটি কম্বল এবং সাথে নেবার হ্যাভারস্যাকটি ছাড়া সবকিছুই সুবিধামত কোন জায়গায় লুকিয়ে ফেলতে হবে। নিজেদের ID Card ছাড়া অন্যান্য সব কাগজপত্র পুড়িয়ে টয়লেট দিয়ে ফেলে দেয়া হল ট্রেন থেকে। ক্যামেরা দু’টো হ্যাভারস্যাকে ভরে নিলাম। ছোট্ট কোরআন শরীফটাও নেওয়া হল হ্যাভারস্যাকে। অর্ডার অফ মার্চ - মতি আগে তারপর আমি, পেছনে নূর। হ্যাভারস্যাক পালাক্রমে বহন করা হবে। মার্চের সময় প্রতি এক ঘন্টা অন্তর দশ মিনিট বিরতি। বিরতিকালে কম্বলের নিচে ঢুকে টর্চের আলোয় ম্যাপ দেখে নেয়া হবে, ঠিক পথে যাচ্ছি কিনা? প্রয়োজনে কম্পাস বিয়্যারিং এ্যডজাষ্ট করা হবে। আমরা তিনজনই কমান্ডো ট্রেনিংপ্রাপ্ত। নাইট মার্চের সব কৌশলই আমাদের নখদর্পনে।
রাত দশটা বেজে পনেরো মিনিটে আমাদের ট্রেন হারুনাবাদ ষ্টেশনে এসে পৌঁছল। ছোট্ট ষ্টেশন। প্ল্যাটর্ফমের যেখানে আমাদের বগিটা গিয়ে থামল সেখানে বেশ জমাট অন্ধকার। আমরা নেমে পড়লাম। অল্প কয়েকজন যাত্রী উঠা-নামা করল। আমরা আধাঁরে চুপ করে দাড়িয়ে থাকলাম। অল্পক্ষণ পর হুইসেল দিয়ে ট্রেন প্ল্যাটফর্ম ছেড়ে চলে গেল। যে সমস্ত যাত্রি ট্রেন থেকে নেমেছিল তারা সবাই ষ্টেশনের চেকিং গেট দিয়ে বেরিয়ে গেছে। চুপচাপ দাড়িয়ে আমরা জায়গাটা ভাল করে দেখে নিচ্ছিলাম। অপর্যাপ্ত বৈদ্যুতিক আলোয় ষ্টেশন ঘরটার সামনে কিছুটা অংশই আলোকিত হয়েছিল। প্ল্যাটফর্মের বেশিরভাগ অংশই ছিল অন্ধকারাচ্ছন্ন। ষ্টেশনের বাইরে একটা মাঝারি আকারের উঠান, কয়েকটি চায়ের দোকান, তাদের সামনে কয়েকটি টাঙ্গা যাত্রিদের অপেক্ষা করছে। চার পাঁচশ গজ দূরে হাইওয়ে রেল লাইনের প্রায় সমান্তরালভাবেই উত্তর দক্ষিনে চলে গেছে। মাঝে মধ্যে দূরপাল্লার বড় বড় ট্রাকগুলো আওয়াজ তুলে ভীষণ বেগে আসা-যাওয়া করছে। রাস্তার ওপারেই হারুনাবাদ শহর। শহর বলতে একটি বর্ধিষ্ণু বাজার। বাজারের চারদিকে জনবসতি। আমরা হারুনাবাদ শহরের ডানদিক দিয়ে প্রয়োজনীয় দুরত্ব বজিয়ে রেখে যাত্রা শুরু করব। একেতো বর্ডার এলাকার মরু অঞ্চল, রাতও বেশ হয়েছে, লোকজন নেই খুব একটা, সমস্ত শহরটাই ঘুমিয়ে পড়েছে। আমরা প্ল্যাটফর্ম খালি হয়ে যাবার পর ষ্টেশনের সদর দরজার দিকে না গিয়ে প্ল্যাটফর্মের শেষপ্রান্ত দিয়ে বেরিয়ে এলাম। অতি সাবধানে হাইওয়ে ক্রস করে একটা বাবলা ঝোপের মধ্যে অবস্থান নিলাম। হারুনাবাদ শহরের বসতির শেষপ্রান্ত থেকেই শুরু হয়েছে মরুভূমি। উচু-নিচু বালির পাহাড়। মাঝে মধ্যে কাটার ঝোপঝাড়। যে জায়গায় পানির আধার রয়েছে সেখানে গড়ে উঠেছে ছোট ছোট গৃহস্থালি। তাকে কেন্দ্র করেই ছোট ছোট চাষাবাদের খামার। অরহর, কলাই, যব, ভুট্টার ক্ষেত। মোটামুটি এ ধরণের টেরেনই (Terrain) অতিক্রম করে যেতে হবে আমাদের। যাত্রা শুরু করার আগে আমি ও মতি কম্বলের নিচে বসে কম্পাস সেটিং ও নাইট মার্চ চার্ট ঠিক করে ম্যাপের সাথে মিলিয়ে নিচ্ছিলাম। ম্যাপ অনুযায়ী আমাদের অবস্থানের অদূরেই একটি কারেজ থাকার কথা। কারেজ হল মরু অঞ্চলে গভীর কুয়োঁর সারি। এগুলো খুঁড়ে তাতে বৃষ্টির পানি জমিয়ে রাখা হয় প্রয়োজনমত ব্যবহার করার জন্য। আবাদি জমিতে জলসেচের ব্যবস্থাও করা হয়ে থাকে কারেজ থেকে। নূরকে পাঠানো হল কারেজটি খুঁজে বের করার জন্য। উদ্দ্যেশ্য আমাদের সাথের মালপত্র সব কারেজের কুয়োতেই ডাম্প করব। সেটাই হবে সবচেয়ে নিরাপদ। অল্পক্ষণ পরেই নূর কারেজের সন্ধান বের করে ফিরে এল। আমরা সবাই হ্যাভারস্যাকটা রেখে বাকি মালপত্র সব নিয়ে গিয়ে কারেজের একটি কুয়োতে ফেলে দিয়ে এলাম। এবার সর্বিকভাবে যাত্রা শুরু করতে আমরা প্রস্তুত।
বিসমিল্লাহ্ বলে আমরা পদযাত্রা শুরু করলাম শ্রীকরনপুরের উদ্দেশ্যে। ঘন্টায় গড়ে চার থেকে পাঁচ মাইল বেগে চলতে হবে। আকাশে বড় একটা চাঁদ। সপ্তঋষীর মন্ডল, দ্রুবতারা, ক্যাসোপিয়া, ওরিয়েন্ট বেল্ট সবগুলোই দেখা যাচ্ছে পরিষ্কার। কম্পাস ছাড়া তারকারাজির সাহায্যেও আমাদের পদযাত্রা চলতে পারে। বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়লে কিভাবে তারকারাজির সাহায্যে গন্তব্যস্থলে পৌঁছতে হবে সেটা আগেই ভালো করে রপ্ত করে নিয়েছি প্রত্যেকে। প্রথম ঘন্টা কেটে গেল নির্বিঘ্নে। পথে কোন লোকজনের সামনা-সামনি হতে হয়নি। বিরতি কাটিয়ে চলা শুরু হল আবার। মিনিট দশেক পর থমকে দাড়িয়ে পড়ে ইশারা করল মতি। এন্টি-ট্যাংক অবস্ট্যাকল সামনে। একটি খাল, খালে পানি। খালের দুই দিকেই ৬০μ এ্যাঙ্গেলের বেশি উচু Any obstacle is always covered by fire তাই ক্রসিং এর আগে প্রথমে রেকি করতে হবে। মতি ও আমি চললাম। একে অপরকে কভার করে চলেছি। কিছু হলে যাতে অবস্থার মোকাবেলা করা যায়। নূর অপেক্ষায় থাকল একটি বাবলা ঝোপের আড়ালে। রেকি করে দেখলাম। খালে বুক পর্যন্ত পানি। হেটেই ক্রস্ করা যাবে অসুবিধা নই। স্রোতও নেই তেমন। পাড়ে বসে ইনফ্রারেড বাইনোকুলার দিয়ে ক্রসিং এলাকাটা ভাল করে দেখে নিচ্ছিলাম। মতি ফিরে গিয়ে নূরকে সাথে করে নিয়ে এল। অল ক্লিয়ার এর আদেশের সাথে সাথে একে একে ট্যাকটিক্যাল ক্রসিং শুরু হল। সবার শেষে আমিও পার হয়ে গেলাম। ওপারে উঠে রুট অনুযায়ী আবার যাত্রা শুরু করলাম। গতি এবং সময়ের সামঞ্জস্যতা বজায় রেখে অবিরাম ছুটে চলেছি নিঃশব্দে। ইশারা সঙ্কেতে প্রয়োজনমত ভাবের আদান-প্রদান চলছিল। আর দশ মিনিট হাটলেই দ্বিতীয় বিরতি। মতি সঙ্কেত দিল। সবাই মাটিতে শুয়ে পড়লাম। দেখলাম চারটি উটের একটি ছোট কাফেলা। একটি বর্ডার পেট্রোল মরু অঞ্চলে এভাবেই একটি BOP (Border Observation Post) থেকে অন্য BOP -তে পেট্রোলিং করা হয়ে থাকে উটের পিঠে চড়ে। ক্রলিং করে কাছেই কাটা ঝোপের মাঝে আস্তে ঢুকে গিয়ে পজিশন নিয়ে নিথর হয়ে শুয়ে থাকলাম। পেট্রোলটি উত্তর দিকে চলে গেল। ওরা হদিসও পেলনা তাদের উটের প্রায় পায়ের নিচেই শুয়ে রয়েছে জলজ্যান্ত তিনজন লোক। আমরা উঠে আবার হাটা শুরু করলাম। দ্বিতীয় বিশ্রামের পর কিছুদূর যেতেই মাটি খোড়ার শব্দ দুর থেকে ভেসে এল। থমকে দাড়িয়ে পড়লাম আমরা। ম্যাপ অনুযায়ী এখানেতো কোন পক্ষেরই কোন ডিফেনসিভ পজিশন থাকার কথা নয়। তবে মাটি খুঁড়ছে কারা? মতিকে পাঠানো হল রেকি করতে। একটি নতুন ডিফেন্সিভ লাইন তৈরি করতে বাংকার খোঁদা হচ্ছে। তাই নির্ধারিত রুট থেকে একটু বেকিয়ে কিছুদূর যেয়ে পরে আবার নির্ধারিত রুটে ফিরে আসতে হবে আমাদের। সেভাবেই কম্পাস বিয়ারিং এবং নাইট মার্চ চার্ট সেট করে আবার যাত্রা শুরু করলাম। ডিফেন্সিভ পজিশন বাইপাস করে এগিয়ে চললাম আমরা।
এখানে আর একটি নালা কেন? তবে কি আমরা ভুল পথে এগোচ্ছি? যাত্রা থামিয়ে ঝোপের আড়ালে তিনজনেই কম্বলের তলায় ঢুকে ম্যাপ দেখতে লাগলাম গভীর মনোযোগ দিয়ে। না আমরা ঠিক পথেই চলেছি। ওটা নতুন করে খোঁড়া হয়েছে। তবে সেটার অবস্থান ম্যাপের মার্কিং-এ নেই কেন? আমরা বর্ডার ক্রস করে ভারতীয় ডিফেন্সের সীমানায় ঢুকে পড়েছি। ঘড়িতে তখন আড়াইটা বাজে। হিসেবমত আমরা এখন ভারতীয় সীমার ভিতরে। এটা ভারতীয় ডিফেন্স এর অবস্ট্যাকল নতুন করা হয়েছে বিধায় ম্যাপের মার্কিং-এ নেই। একইভাবে সতর্কতার সাথে খালটা ক্রস্ করে পাড়ে উঠে এলাম। এখন থেকে বিপদের ঝুঁকি অনেক বেশি। চলতে হবে খুব সাবধানে। আর এক দেড় ঘন্টার মধ্যেই পৌছে যাবার কথা শ্রীকরনপুর শহরের সীমানায়। খালের পরই দেখলাম বাংকারে ভারতীয় সাজোয়া বাহিনীর ট্যাংকগুলো ডিপ্লয় (Deploy) করা আছে। বাংকারগুলো থেকে মাঝে মাঝে মানুষের কথোপকথোনের আওয়াজ শোনা যাচ্ছিল। গভীর রাত; তাই সমস্ত এলাকা জুড়ে ছিল অস্বাভাবিক নিস্তব্ধতা। আমাদের এগিয়ে চলার জন্য এ ধরণের পরিবেশ অতি অনুকুল। চারিদিকে সর্তক দৃষ্টি রেখে ক্ষিপ্র গতিতে ভারতীয় ডিফেন্স এর বুহ্য ভেদ করে এগিয়ে চললাম আমরা। কেউ কিছু টের পেল না। বেশ কিছুদূর চলে এসেছি। হঠাৎ দেখি অল্প দুরত্বে কয়েকটি ট্যাংক। কতগুলো গাড়ি সেগুলোকে ঘিরে রয়েছে। বুঝলাম এটি হেডকোয়ার্টারস। ঐ অবস্থানকে পাশ কাটিয়ে চুপিসারে এগিয়ে চললাম গন্তব্যস্থলের দিকে। ইতিমধ্যে দূরদিগন্তে শ্রীকরনপুরের আলোকচ্ছটা দেখা যাচ্ছিল। আর মাত্র চার/পাচঁ মাইলের পরই পৌঁছে যাবো শ্রীকরনপুরে। আমাদের জোশ দ্বিগুন হয়ে গেল। পথের ক্লান্তি ভুলে গিয়ে প্রায় দৌড়ে এগুতে থাকলাম সেই আলোকচ্ছটার দিকে। পৌনে চারটায় পৌঁছে গেলাম শ্রীকরনপুর শহরের সীমানায় একটি গ্রামে। গ্রামের প্রায় সবগুলি ঘর মাটি দিয়েই গড়া। প্রতিটি বাড়ির আঙ্গিনা মাটির দেয়াল দিয়ে ঘেরা। গ্রামের ভেতর কুকুর ডাকছে। আমরা একটি পরিত্যাক্ত বাড়ির উঠোনে গিয়ে বসলাম। উঠোনটিও মাটির দেয়াল দিয়ে ঘেরা। বসে বসে ভাবছি এখন আমাদের কি করা উচিত? ঠিক এ মুহুর্তে এমন অসময়ে জনবিরল শহরে আমাদের ঢোকা ঠিক হবে কিনা? অপরিচিত শহরে এমন অসময়ে তিনজন লোক ঘোরাঘুরি করাটা সন্দেহজনক হবে। তাই ঠিক করা হল সকাল হওয়ার পর আমরা শহরে ঢুকে জনগণের মধ্যে মিশে যাবো। তারপর ঠিক করা হবে কি হবে আমাদের পরবর্তী পদক্ষেপ। চুপচাপ বসে বিশ্রাম নিচ্ছিলাম। হঠাৎ করে ট্রেনের আগমনের আওয়াজ পেলাম। দেয়ালের বাইরে উকিঁ মেরে দেখলাম প্রায় ৬-৭শত গজ দূরে একটি ট্রেন ফোঁস ফোঁস করতে করতে এসে থামল। বুঝলাম এটা একটা ষ্টেশন। মুহুর্তে সিদ্ধান্ত নেয়া হল ট্রেনে করে এই মুহুর্তেই পালাতে হবে বর্ডার এলাকা ছেড়ে। দৌড়ে ছুটলাম ষ্টেশনের দিকে। কাছে পৌঁছে দেখলাম লাল রঙ্গের একটি ট্রেন প্ল্যাটফর্মে দাড়িয়ে আছে। কোথাকার ট্রেন কোথায় যাবে কিছুই জানি না; শুধু বুঝলাম এটা যাত্রী বহনের ভারতীয় ট্রেন। ষ্টেশনে লোকজন একদম কম। দৌড়ে গিয়ে একটি খালি কামরায় উঠে গেলাম নির্দ্বিধায়। উঠেই দরজা-জানালা ভাল করে বন্ধ করে দিয়ে বসলাম। কিছুক্ষণ পর ট্রেন সিটি বাজিয়ে ছেড়ে দিল। আমরা হাঁফ ছেড়ে বাচঁলাম প্ল্যাটফর্মে উঠেই লক্ষ্য করেছি ষ্টেশনটির নাম শ্রীকরনপুর। শ্রীকরনপুর রাজস্থান প্রভিন্সের জেলা শ্রীগঙ্গানগরের অধীন একটি সাব ডিভিশন। আমাদের লক্ষ্য দিল্লী পৌঁছানো। ট্রেনতো যাচ্ছে দক্ষিনে কিন্তু আমাদের যেতে হবে উত্তর দিকে। কিছুক্ষণ পর ট্রেনটি একটি ষ্টেশনে এসে দাড়াল। একটি জংশন ষ্টেশন। উল্টো দিক থেকে আর একটি প্যাসেঞ্জার ট্রেনের আগমন ঘটল। আমরা আস্তে করে ট্রেন বদল করে অন্যটির একটি খালি কামরায় উঠে বসলাম। আমাদর ট্রেনটাই আগে ছাড়ল। চলেছি উত্তর দিকে। পথিমধ্যে আবার শ্রীকরনপুর পড়ল। করনপুর পেছনে পড়ে থাকল। আমাদের ট্রেন আমাদের নিয়ে ছুটে চলল। শারিরীক ক্লান্তি এবং মানসিক উৎকন্ঠা সব মিলিয়ে ঝিমুতে ঝিমুতে একসময় ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। কতক্ষণ ঘুমিয়ে ছিলাম জানি না। হঠাৎ ঝাঁকুনিতে জেগে উঠলাম। জানাল খুলে দেখি সকাল হয়ে গেছে। ষ্টেশনের নাম শ্রীগঙ্গানগর। সবাই মহা খুশি। নেমে পড়লাম ষ্টেশনে। বর্ডার থেকে তখন আমরা অনেকে ভিতরে চলে এসেছি। আপার ক্লাস ওয়েটিং রুমে যেয়ে ডুকলাম। হাত মুখ ধুয়ে পোষাক বদলিয়ে ভদ্র হয়ে নিলাম প্রথমে। তারপর বসলাম ঠিক করতে, কি করা যায়? ঠিক হল এখন থেকে আমরা তিনজনই কোলকাতা বিশ্বব্যিালয়ের ছাত্র। স্টাডি ট্যুর-এ বেড়িয়েছি, পুরো রাজস্থান ঘুরে বেড়াচ্ছি। তিনজনেই হিন্দু নাম গ্রহণ করলাম। আমি হলাম শ্রী সৌমেন ব্যানার্জি। মতি শ্রী মনোজ বোস আর নূর শ্রী নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়। টাকা-পয়সার বন্দোবস্ত করতে হবে। কোলকাতা থেকে আগত বাঙ্গালী ছাত্র তাই পাকিস্তানী টাকা ভাঙ্গানো বিপদজনক হবে। ঠিক হল আংটি দু’টো বিক্রি করার চেষ্টা করতে হবে। ষ্টেশন মাষ্টারের সাথে আলাপ করে জানতে পারলাম শহর ষ্টেশন থেকে প্রায় এক মাইল দূরে অবস্থিত। দোকানপাট ৯টার আগে খুলবে না। অগত্যা ৯টা পর্যন্ত ওয়েটিং রুমেই অপেক্ষা করতে হবে। ঠিক ৯টায় তিনজনই বেরিয়ে পড়লাম। আমার ও মতির গলায় ঝুলিয়ে নিলাম ক্যামেরা দু’টো, নূরের পিঠে হ্যাভ্যারস্যাক। চোখে রেবনের সানগ্লাস, টুরিষ্টের মতই লাগছিল তিনজনকে। শহরে পৌঁছে দেখলাম কয়েকটা রাস্তাকে কেন্দ্র করেই ডিষ্ট্রিক হেডকোয়ার্টারস গঙ্গানগর শহর। মফস্বল শহর তাই খুব একটা বড় নয়। শহরের প্রধান রাস্তাগুলির দুই দিকে সব দোকানপাট। একসাথে দুই তিনটি সোনার দোকান। সবচেয়ে বড়টিতে গিয়ে ঢুকলাম। দোকানের মালিক ধুতি নিমা পড়া তিলক কাটা মোটা গোছের একটি লোক ধুপধুনো জ্বেলে গদিতে বসে পূঁজো করছিলেন। পুঁজা সেরে হরিণাম জপতে জপতে আমাদের কাছ এগিয়ে এসে প্রশ্ন করলেন,
-কি চাই? জবাবে বললাম,
-আমরা ছাত্র। কোলকাতা নিবাসী। স্টাডি ট্যুরে এসে টাকা-পয়সার অভাব দেখা দিয়েছে; তাই আংটি দু’টো বিক্রি করতে চাই।
আংটি দু’টো হাতে নিয়ে পরখ করে দেখে মালিক বললো,
-চারশো টাকা পাবে। বলে কি ব্যাটা! আমরা জানি পাকিস্তান থেকে ভারতে সোনার দাম বেশি। তাছাড়া ভারতীয় মুদ্রার তুলনায় পাকিস্তানী মুদ্রার মূল্যও অনেক বেশী। সেক্ষেত্রে মালিক আমাদের যে দাম দিতে চাচ্ছে তার দ্বিগুন দামই আমাদের পাওয়া উচিত। ব্যাটা বেনিয়া আমাদের অসুবিধার সুযোগ নিয়ে ডাহা ঠকাবার চেষ্টা করছে। ভীষণ রাগ হল তার ফন্দি বুঝতে পেরে। আংটি দু’টো ফেরত নিয়ে বেরিয়ে এলাম দোকান থেকে। অন্য দোকানে আর গেলাম না। বুঝতে পারলাম ওতে বিশেষ লাভ হবে না। ভীনদেশে অবস্থার সুযোগ নিয়ে সব বেনিয়াই ঠকাবার চেষ্টা করবে। ঠিক করলাম একটা ক্যামেরা বেচে দেব। একই রাস্তার উপর সবচেয়ে বড় ক্যামেরার দোকানে গিয়ে উপস্থিত হলাম। দোকানের মালিক ২৪-২৫ বয়সের এক তরুণ। জামা কাপড়ে বেশ ফিটফাট। হিন্দী-উর্দ্দু মিশিয়ে তাকে আমাদের সমস্যা বুঝিয়ে বললাম,
-একটা ক্যামেরা বেচে দিতে চাই। তরুণ যুবক আমাদের অবস্থা শুনে সহানুভূতিশীল হয়ে উঠলো। ক্যামেরা দু’টো হাতে নিয়ে বললো,
-এতো অত্যন্ত দামী ক্যামেরা। বিদেশ থেকে ইম্পোর্টেড?
-হ্যাঁ ভাই বিদেশ থেকেই প্রবাসী আত্নীয়ের মাধ্যমে খুব শখ করে আনিয়েছিলাম। নেহায়েত বিপাকে পড়েই বিক্রি করতে হচ্ছে।
-কিন্তু এতো দামী ক্যামেরা এই ছোট শহরে ভালো দামে বিক্রি করতে পারবে না। তাছাড়া শখের জিনিষ কষ্ট করে আনিয়েছ বিক্রি করে দিলে আর কিনতেও পারবে না। তাই বলছি কি, তোমাদের কাছে আর অন্য কিছুই কি নেই?
-আছে ভাই। দু’টো স্বর্নের আংটি। বলে পকেট থেকে আংটি দু’টো বের করে ওর হাতে দিলাম এবং সোনার দোকানের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে ওকে সব খুলে বললাম। সব শুনে ও একটু হাসল। বললো,
-তোমাদের ভীনদেশি দেখে বেনিয়ারা ঠকাতে চেষ্টা করেছে। ঠিক আছে, তোমরা এখানে একটু অপেক্ষা কর, দেখি আমি কিছু করতে পারি কিনা। বলেই যুবক দোকানের কর্মচারীটিকে ডেকে আমাদের চা এনে দিতে বলে বেরিয়ে যাচ্ছিল; চায়ের কথা বলতেই আমরা বলে উঠলাম,
-চায়ের প্রয়োজন নেই ভাই। আমাদের আংটি দু’টো বিক্রি করে দিতে পারলেই আমরা তোমার কাছে কৃতজ্ঞ থাকবো।
-সে আমি দেখছি। চা খাও। এতদূর থেকে তোমরা আমাদের রাজস্থন সফরে এসেছো। তোমাদের একটু আপ্যায়ন করার অধিকার নিশ্চয়ই আমার আছে? যুবকের আন্তরিকতা আমাদের মুগ্ধ করলো। কর্মচারী ইতিমধ্যে চা-নাস্তার যোগাড় করতে বেরিয়ে গেছে। যুবকটিও আমাদের দোকানে বসিয়ে বেরিয়ে গেল। অপরিচিত তিনজন লোকের কাছে পুরো দোকান ফেলে দিয়ে যেতে তার বিন্দুমাত্র দ্বিধা হল না। অপরিচিত ভীনদেশে এমন একজন সাহায্যকারী পেয়ে ধন্য হলাম। কর্মচারী গরম গরম লুচি তরকারী ও চা এনে রাখল সামনে। খাবারের গন্ধ পেয়ে এতক্ষন কষ্ট করে ভুলে থাকা ক্ষুধা পেটে মোচড় দিয়ে উঠলো। দেরি না করে গোগ্রাসে লুচি তরকারী খেলাম। তারপর আস্তে আস্তে সুখ করে খেলাম গরম ধূমায়িত চা। নাস্তা পেটে পড়ায় শরীরটা বেশ চাঙ্গা হয়ে উঠলো। মিনিট বিশেক পর যুবক হাসিমুখে ফিরে এল।
-তোমাদের কাজ হয়ে গেছে এই নাও। বলে আটশত পঞ্চাশ টাকা আমার হাতে দিল। চা নাস্তা খেয়েছতো?
-হ্যাঁ খুব মজা করে খেলাম লুচি তরকারী আর চা। ভাই তোমার নামটা জানতে পারি কি?
-নিশ্চয়ই, রমেশ ত্রিপাঠি। আমরাও আমাদের বাঙ্গালী হিন্দু নামের পরিচয় দিলাম।
-রমেশ ভাই তুমি যদি কখনও কোলকাতায় আস তবে অবশ্যই আমাদের সাথে যোগাযোগ করবে। বিদেশে তোমার কাছ থেকে পাওয়া আন্তরিকতা এবং সাহায্যের কথা চিরকাল মনে থাকবে। তিন নম্বর পার্ক সার্কাস, একটা ভুঁয়া ঠিকানা দিয়ে রমেশকে অসংখ্য ধন্যবাদ জানিয়ে বিদায় নিয়ে ওর দোকান থেকে বেরিয়ে এলাম।
আজকের পৃথিবীতে ভাল লোক যে একদম নেই তা নয়। রমেশের মতো ভাল লোক কিছু রয়েছে বলেই পৃথিবীর চাকা এখনো ঘুরছে। রমেশের দোকান থেকে বেরিয়ে সোজা গিয়ে বসলাম একটা বড় আকারের রেষ্টুরেন্টে। পেটে লুচি তরকারী এবং চা পড়ায় ক্ষুধা বেড়ে গিয়েছিল। পেটপূজা না সারা পর্যন্ত অন্য কিছুতেই মনযোগ দেয়া সম্ভব নয়। পেটভরে খাওয়া হল মুরগির রোস্ট, পরোটা, তরকারী এবং ঘন ডাল। হিন্দুদের অন্য ধাঁচের রান্না। Change of Test ভালোই লাগলো। আমাদের খাওয়ার নমুনা দেখে বাচ্চা বয়টা অবাকই হয়ে গিয়েছিল।
পেট পুরে খাওয়ার পর নূর গেল খবরের কাগজ কিনতে। দু’তিনটা খবরের কাগজ নিয়ে সে ফিরে এল। খবরের কাগজ খুলতেই দেখা গেল বাংলাদেশের উপর বিস্তারিত সচিত্র সংবাদ। জনাব নজরুল ইসলাম, জনাব তাজুদ্দিনের নেতৃত্বে প্রবাসে আওয়ামী লীগ সরকার গঠিত হওয়ার সংবাদ, মুক্তি ফৌজের সংবাদ, সবকিছুই বিস্তারিতভাবে ছাপা হয়েছে। ভারতীয় সরকারের পরোক্ষ সহযোগিতার কথাও লেখা হয়েছে। রনাঙ্গনের ছবিতে মেজর খালেদ মোশাররফের ছবি ছাপা হয়েছে। মুক্তি ফৌজের বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে। কাগজগুলো থেকে বুঝতে পারলাম আমরা মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে যতটুকু জানতাম ঘটনা প্রবাহ তার চেয়ে অনেক বেশি এগিয়ে গেছে। সত্যিই যুদ্ধ চলছে বাংলার মাটিতে। স্বাধীনতার সংগ্রামে যোগদানের জন্য ঝুঁকি নিয়ে আমরা ভুল করিনি। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব রনাঙ্গনে যেয়ে যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করতে হবে আমাদের। তিনজনে পরবর্তী পদক্ষেপ সম্পর্কে আলোচনা শুরু করলাম নিচু স্বরে। ভারতীয় কর্তৃপক্ষের চোখে ফাঁকি দিয়ে মুজিবনগর যাবার চেষ্টা করা হবে রিস্কি। নিয়ম অনুযায়ী বর্ডার ক্রস করার পর ভারতীয় কর্তৃপক্ষের কাছে আত্মসমর্পন করাটাই ছিল যুক্তিসঙ্গত। স্বেচ্ছায় ধরা দিলে আমাদের উদ্দ্যেশ্য সম্পর্কে কোন সন্দেহ দেখা দেবে না ভারতীয় কর্তৃপক্ষের মনে। ধরা না দিলে আমাদের উদ্দ্যেশ্য সম্পর্কে সন্দেহের অবকাশ থাকবে। কিন্তু ধরা দেব কোথায়? গঙ্গানগরে ধরা দিলে অযথা সময় নষ্ট হবে। কারণ আমাদের ব্যাপারে সব সিদ্ধান্তই আসবে কেন্দ্রীয় সরকারের কাছ থেকে। সেক্ষেত্রে এখানকার কর্তৃপক্ষের হাতে বন্দী হয়ে কেন্দ্রীয় নির্দেশের অপেক্ষায় সময় নষ্ট হবে অযথা। তাছাড়া তিনজন কমান্ডো ট্রেনিংপ্রাপ্ত পাকিস্তানী সামরিক অফিসারদের কাছ থেকে প্রকৃত তথ্য জানার জন্য যে উপায় অবলম্বন করা হবে নিম্ন পর্যায়ে। তা সহ্য করার মত মানসিক এবং শারিরীক অবস্থা বর্তমানে আমাদের কারোই নেই। তার চেয়ে বরং দিল্লী পৌঁছে আত্মসমর্পন করাটাই হবে শ্রেয়। যা হবার সেখানেই হোক। ঠিক হল দিল্লী যেয়েই আত্মসমর্পন করা হবে Ministry of External Affairs -এ। কিন্তু বর্ডারে আত্মসমর্পন না করে দিল্লী পর্যন্ত পৌছানোর জন্য ভারতীয় কর্তৃপক্ষের মনে যাতে কোনরূপ সন্দেহের সৃষ্টি না হয়- কেন বর্ডারে আত্মসমর্পন না করে আমরা দিল্লী রওনা হলাম, তার যুক্তি বর্ণনা করে ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর কাছে রাজনৈতিক আশ্রয় চেয়ে একটি আবেদনপত্র লিখে ফেললাম তিনজনে মিলে। ঠিকানা লেখা হল মাননীয়া প্রধানমন্ত্রী, ভারত সরকার, প্রযত্নে Ministry of External Affairs, রাষ্ট্রপ্রতি ভবন, সাউথ ব্লক, নয়া দিল্লী। পোস্ট অফিসে গিয়ে রেজিষ্ট্রারড মেইল-এ চিঠিটা পাঠিয়ে রশিদ নিয়ে ফিরে এলাম রেষ্টুরেন্টে। পোষ্ট মাষ্টার বলেছিলেন দু’এক দিনের মধ্যেই চিঠিটা পৌঁছে যাবে দিল্লীতে। চিঠিটার একটা কপি পাঠাতে হবে মুজিবনগর সরকারের কাছে। এ এলাকা থেকে মুজিবনগর সরকারের কাছে রেজিস্টারড পোষ্ট পাঠান যুক্তিসঙ্গত হবে না। ঠিক করলাম দিল্লী থেকে ওটা পোষ্ট করব। এরপর নূরকে পাঠানো হল ষ্টেশনে দিল্লী যাবার টিকিট করার জন্য। ফিরে এল নূর। সন্ধ্যে সাড়ে সাতটায় কালকা মেইলে করে দিল্লী যাব আমরা। দ্বিতীয় শ্রেণীর তিনটি টিকেট কেটে নিয়ে এসেছে নূর। পয়সা কম থাকায় প্রথম শ্রেণীর টিকেট কাটা সম্ভব হয়নি। হাতে প্রচুর সময়। দুপুরে আর একপ্রস্থ খাওয়া-দাওয়া করে শহরটা একটু ঘুরে ফিরে দেখার জন্য বেরুলাম। ঘুরে ফিরে দেখছি আর ক্যামেরায় ছবি তুলছি স্মৃতিগুলোকে ধরে রাখার জন্য। ছোট্ট শহর ঘোরা শেষ হয়ে গেল অল্প সময়ের মধ্যেই। ঠিক হল সময় কাটানোর জন্য Matinee Show সিনেমা দেখব। একটি হলে গিয়ে দেখলাম ‘অঞ্জনা’ চলছে। ববিতা-রাজেন্দ্রকুমার অভিনীত। টিকিট কেটে ঢুকে পড়লাম। মফস্বল শহরের সিনেমা হল। ব্যবস্থা মোটামুটি। ভরদুপুর রোদে উপরের টিনের চাল তেতে উঠেছে। ভীষণ গরম লাগছিল লোকের ভীড়ে। সদ্য মুক্তি পাওয়া ছবি। House Full কিন্তু বেশ মজাই লাগছিল বাদাম, চানাচুড় চিবুতে চিবুতে ছবি দেখতে। ছবি শেষ হল। হল থেকে বেরিয়ে এলাম বিকেল সাড়ে পাঁচটায়। আবার গিয়ে বসলাম সেই সকালের হোটেলে। আর একপ্রস্থ খাওয়া হল। ধীরে সুস্থে পৌনে সাতটায় ষ্টেশনে গিয়ে পৌঁছলাম। কালকা মেইল ট্রেন আসবে সাড়ে সাতটায় কিন্তু তখনও প্ল্যাটফর্ম একদম খালি। ব্যাপার কি? টিকেট কালেক্টরকে জিজ্ঞেস করতেই তিনি বললেন, ট্রেন সাড়ে ছয়টায় ছেড়ে চলে গেছে। মানে? মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ল! নূর বোর্ড থেকে ট্রেনের সময় সাড়ে ছয়টার জায়গায় সাড়ে সাতটা পড়েছে। ভীষণ রাগ হল। মতি ও আমি নূরকে তার গাফিলতির জন্য বকাবকি করতে লাগলাম। আমাদের বকাবকি শুনে কালেক্টর সাহেব এগিয়ে এসে বললেন,
-যা হবার তা হয়ে গেছে। গোলমাল করে সময় নষ্ট না করে ট্যাক্সি পাকড়ো। ড্রাইভারকে বকশিশ দেবার কথা বললে ও তোমাদের ট্রেন পৌঁছানোর আগেই পরের ষ্টেশনে পৌঁছে দিতে পারবে।
তার মধ্যস্থতায় একটি ট্যাক্সি ঠিক করে উঠে বসলাম। কালেক্টর সাহেব ড্রাইভারকে পাঞ্জাবীতে সব বুঝিয়ে দিয়েছিলেন। শিখ ড্রাইভার তার হিন্দুস্থান ট্যাক্সি চালিয়ে দিল উল্কা বেগে। রাস্তার অবস্থা মোটামুটি। তীব্র বেগে ছুটে চলেছে আমাদের ট্যাক্সি। ভাবলেশহীন অবস্থায় ষ্ট্যায়ারিং হাতে বসে আছেন সরদারজী। আমরাও চুপ করেই বসেছিলাম। মুখে কেউ কিছু না বললেও প্রতিমুহুর্তে মনে হচ্ছিল স্বাধীনতা যুদ্ধে বোধ হয় আর যাওয়া হল না। রাজস্থানের এই মরুভূমিতেই মোটর দুর্ঘটনায় অক্কা পেতে হবে। মনে মনে দোয়া-দুরুদ পড়তে লাগলাম। সরদাজীর চেষ্টা সার্থক হল, ট্রেনের আগেই সে আমাদের পৌঁছে দিল পরর্বতী ষ্টেশনে। ড্রাইভার পাঞ্জাবীতে বলল,
-দেখো সাবজি আছি পৌহছ-ই-গ্যায়ে।
সরদারজীর মুখে একটা গর্বের হাসি। আমরা ট্যাক্সি থেকে নেমে ভাড়ার উপর মোটা বকশিশ দিতেই সরদারজীর হাসি আরো বড় আকার ধারন করল। মিনিট পনেরো পর ট্রেন এসে গেল। আমরা নিজেদের নির্দিষ্ট কামরায় গিয়ে উঠে বসলাম। ঘাম দিয়ে যেন জ্বর নেমে গেল। মেইল ট্রেন ছুটে চললো। কামরায় আমরা মোট চারজন যাত্রী। দূরপাল্লার মেইল ট্রেন। বুফে কার আছে। বিছানা পত্রেরও বন্দোবস্ত রয়েছে। পয়সা দিয়ে বিছানা আনিয়ে নিয়ে যার যার বার্থে শুয়ে পড়লাম। রাতে ছুটে চলেছে কালকা মেইল। পরদিন ভোরে দিল্লী পৌঁছবো আমরা। ট্রেনের শব্দ ও মৃদুমন্দ দোলায় বিছানায় শুয়ে শুয়ে নানান কথা চিন্তা করতে করতে এক সময় গভীর ঘুমে ঘুমিয়ে পড়লাম। অনেকদিন পর আরামের ঘুম হল। হঠাৎ করে ট্রেনের ঝাঁকুনিতে ঘুম ভেঙ্গে গেল। চোখ খুলে দেখি আমাদের সহযাত্রী পাশের ভদ্রলোক আগেই ঘুম থেকে জেগে জানালা খুলে বাইরে তাকিয়ে বসে আছেন। শুয়ে শুয়েই দেখলাম বাইরের অন্ধকার ফিকে হয়ে আসছে। ভোরের পূর্বাভাস দেখতে দেখতে চারিদিক ফর্সা হয়ে এল। পূর্ব দিগন্তে লাল সূর্যের উদয় হল। উদীয়মান সূর্যের লালিমায় রক্তিম হয়ে উঠল পূর্ব আকাশ, সূর্যের আলোয় জেগে উঠল পৃথিবী। জানালা তুলে দিলাম আমি। ভোরের ঠান্ডা হাওয়ার ঝাপটা লাগলো চোখেমুখে। মুখ ঘোরাতেই চোখে পড়লো -পাশের ভদ্রলোক সূর্যের দিকে চেয়ে নমষ্কার করছেন, আর বিড়বিড় করে কি সব বলছেন। বুঝলাম সূর্য দেবের ভক্তি করে মন্ত্র পাঠ করছেন ভদ্রলোক। আমি উঠে টয়েলেটে গিয়ে ঢুকলাম। প্রাতঃক্রিয়া সেরে হাতমুখ ধুয়ে প্রস্তুত হয়ে বেরিয়ে দেখি মতি ও নূর তখনও ঘুমুচ্ছে। ওদের ডেকে তুললাম। একে একে ওরাও প্রাতঃক্রিয়া সেরে আমার পাশে এসে বসল। কালকা মেইল ঘন ঘন হুঁইসেল দিতে দিতে মন্থর গতিতে এগুচ্ছিল। ঘড়িতে তখন ৬:৩০ মিনিটের উপরে বাজে। বুঝলাম দিল্লীর কাছাকাছি এসে গেছি। ৭টায় পৌঁছানোর কথা। ঠিক সাতটার সময় কালকা মেইল এসে থামল দিল্লী ষ্টেশনে। বিরাট বড় দিল্লী ষ্টেশন। অসম্ভব ভীড়। এত সকালেও লোকজনের অভাব নেই। ব্যস্তভাবে সবাই ছুটোছুটি করছে। একটির পর একটি গাড়ি দাড়িয়ে আছে প্ল্যাটফর্মে। নির্দিষ্ট প্ল্যাটফর্মে আমাদের ট্রেন এসে থেমে গেল। ঠিক বিশ্বাস হচ্ছিল না, এত সহজেই দিল্লী পৌঁছে গেলাম। ট্রেন থেকে নেমে ষ্টেশন থেকে বেরিয়ে এলাম। বেরুতেই ট্যাক্সিওয়ালারা ঝেঁকে ধরল। একজন এসে বললো,
-বাঙ্গালীবাবু, ট্যাক্সি চাইয়ে? বললাম,
-হ্যাঁ, নিয়ে চল মাঝারি দামের ভাল কোন হোটেলে। সিটি সেন্টারের কাছাকাছি হলে ভাল হয়।
-লে চল্তে হে, সাব আইয়ে। বলে ও আমাদেরকে ওর ট্যাক্সির কাছে নিয়ে গেল। দরজা খুলে আমরা ভেতরে বসলাম। ২০-২৫ মিনিটের মধ্যেই চালক একটি হোটেলের সামনে গাড়ি থামাল। হোটেল নটরাজ। ট্যাক্সির ভাড়া চুকিয়ে দিয়ে রিসেপশনে এগিয়ে গিয়ে দু’টো কামরা বুক করলাম। একটি সিঙ্গেল রুম আমার জন্য, আর একটি ডাবল রুম মতি ও নূরের জন্য। পাশাপাশি কামরাই পাওয়া গেল। পোর্টার আমাদের হ্যাভারস্যাক কাধে তুলে কামরায় পৌঁছে দিল। থ্রি-ফোর ষ্টার হোটেল। ভালোই পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন। চার্জও রিজেনেবল। প্রতিটি কামরার সাথে ছোট্ট একটা ব্যালকনি। ব্যালকনি থেকে দিল্লী শহরের অনেকদূর দেখা যায়। আমরা রুম পেয়েছিলাম চার তলায়। প্রতিটি রুমের সাথেই রয়েছে এটাচ্যাড বাথরুম। Hot shower নেয়ার পর ট্রেন সফরের ক্লান্তি, গ্লানি সব দূর হয়ে গেল। রুম সার্ভিস ডাকিয়ে নাস্তা করলাম তিনজন একত্রে। নাস্তা খেতে খেতে ঠিক করে নিলাম ২০ তারিখ সকালে নিজেদের সমর্পন করব Ministry of External Affairs -এ গিয়ে। ইতিমধ্যে আমাদের পোষ্ট করা চিঠিও পৌঁছে যাবে কর্তৃপক্ষের হাতে।
বিষয়: রাজনীতি
২০৮২ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন