সিরিজন - ৫ "ইতিহাস বিকৃতির প্রথম পদক্ষেপ আওয়ামী লীগই গ্রহণ করে।"

লিখেছেন লিখেছেন মাজহারুল ইসলাম ৩০ জুন, ২০১৩, ০৯:০৯:০৯ রাত

শেখ মুজিবের নির্দেশেই মেজর জিয়া তার ঐতিহাসিক ঘোষণা দেয় এ দাবী প্রতিষ্ঠার জন্য আওয়ামী লীগ আষাঢ়ে গল্পের উপস্থাপন করে।

সেই লোমহর্ষক ক্রান্তিলগ্নে নেমে আসে ২৫-২৬শে মার্চের সেই কালোরাত্রি। পাকিস্তান সেনা বাহিনী নির্মমভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ে বাঙ্গালী জাতিকে শায়েস্তা করার জন্য। ২৫শে মার্চের বর্বরতা আধুনিককালের সব নজীরকেই ছাড়িয়ে যায়। হাজার হাজার নারী, পুরুষ, শিশুকে হত্যা করা হয় নির্বিচারে। সামরিক বাহিনী এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর বাঙ্গালী সদস্যগণও রেহাই পাননি শ্বেত সস্ত্রাসের হত্যাযজ্ঞ থেকে। ঢাকা, চিটাগাং এবং খুলনাসহ পূর্ব পাকিস্তানের সর্বত্রই অভিযান চালানো হয়। নিষ্ঠুর অভিযান। প্রতিরোধ সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়তে বাধ্য হয় বাঙ্গালী জাতি। জাতির এ ক্রান্তিলগ্নে অনেক অনুরোধ ও আকুতি জানানো হয় শেখ মুজিবকে সশস্ত্র জাতীয় মুক্তি সংগ্রামে নেতৃত্ব দেবার জন্য। কিন্তু সব অনুরোধ উপেক্ষা করে জাতিকে মৃত্যু ও অনিশ্চয়তার মুখে ঠেলে দিয়ে কাপুরুষের মতই তিনি কারাবরণ করে চলে যান পশ্চিম পাকিস্তানে। আত্মরক্ষার জন্যই অনন্যোপায় হয়েই শান্তিপ্রিয় বাঙ্গালী অস্ত্র হাতে তুলে নিতে বাধ্য হয়। প্রতিরোধ সংগ্রামে নেতৃত্ব দানে অসম্মত শেখ মুজিব বলেছিলেন, “আমি গণতন্ত্রের রাজনীতি সারাজীবন করেছি, অস্ত্রের রাজনীতিতে আমি বিশ্বাস করি না।”

এ কি পরিহাস! সমগ্র বাঙ্গালী জাতি যার কথায় বিশ্বাস করে অকাতরে প্রাণ দিয়েছে, তাকে মেনে নিয়েছে একমাত্র নেতা হিসাবে; দীর্ঘ সংগ্রামে চরম ত্যাগ স্বীকার করেছে নির্দ্বিধায়; সে নেতাই ক্রান্তিলগ্নে জাতিকে পিছে ফেলে রেখে খোঁড়া যুক্তি তুলে বহাল তবিয়তে পশ্চিম পাকিস্তানে পাড়ি জমালেন। ক্ষনিকের জন্য স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিল বাঙ্গালী জাতি। মুজিবের সুবিধাবাদী আচরনে হতাশায় ভেঙ্গে পড়েছিল মুক্তিকামী জনতা। কিন্তু সে ক্ষণিকের জন্য মাত্র। আওয়ামী লীগের নেতারাও সব যার যার মত গা ঢাকা দিলেন প্রাণ বাচাঁবার প্রচেষ্টায়। মুজিব গ্রেফতার হওয়ার সাথে তারাও পালিয়ে হাফ্‌ ছেড়ে বাচঁলেন। এ অবস্থায় জনগণকে স্বতঃস্ফুর্তভাবে প্রতিরোধ সংগ্রামের দায়িত্ব নিজেদের হাতেই তুলে নিতে হয়েছিল। বিচ্ছিন্নভাবে বাংলাদেশের সর্বত্র প্রতিরোধ সংগ্রাম গড়ে উঠে। গৃহযুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ে পুরো বাংলাদেশে। এ অবস্থায় ২৬শে মার্চ রাতে চিটাগাং এ অবস্থিত অষ্টম ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের এক অখ্যাত তরুণ মেজর জিয়াউর রহমান তার তরুণ বাঙ্গালী সহকর্মীদের পরামর্শ ও সহচার্যে তীব্র জাতীয়তাবাদী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে বেতার মাধ্যমে জাতির প্রতি আহ্‌বান জানান স্বাধীনতা সংগ্রামের। তার আহ্‌বানে আশার আলো দেখতে পেয়েছিল জাতি। তারই পরিপ্রেক্ষিতে পরবর্তিকালে স্বাধীনতার লক্ষ্যে শুরু হয় রক্তক্ষয়ী মহান মুক্তি সংগ্রাম।

কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে ভেসে আসে মেজর জিয়াউর রহমানের ক্ষীন কন্ঠ, “Under circumstances however, I hereby declare myself as the Provisional Head of the Swadhin Bangla Liberation Government.” অবশ্য পরবর্তী ঘোষণায় এর সাথে যোগ করা হয়, “Under guidance of Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman.” স্বাধীনতার ঘোষণা নিয়ে সেই সময় চুলচেরা বিশ্লেষন করার ফুরসৎ কারও ছিল না। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭১ সালে ২৬শে মার্চ কালুরঘাট থেকে প্রচারিত স্বাধীনতার ঘোষণা সর্ম্পকে সরকার ও আওয়ামী লীগের তরফ থেকে পর্যায়ক্রমে কয়েকটি কাহিনী প্রচার করা হয়।

প্রথম গল্পটি ছিল: ২৫শে মার্চ দিবাগত রাতে গ্রেফতারের পূর্বক্ষণে চট্টগ্রামের জহুর আহ্‌মদ চৌধুরীকে টেলিফোনে শেখ মুজিব স্বাধীনতার ঘোষণা বাণীটি পাঠিয়ে ছিলেন। কিন্তু সামরিক অভিযানের প্রাক্কালে সকল প্রকার টেলিফোন যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। অতএব ঐ গল্প ধোপে টিকেনি।

দ্বিতীয় গল্পে বলা হয়: ওয়্যারলেসের মাধ্যমে (?) চট্টগ্রাম বন্দরে অবস্থানরত একটি অষ্ট্রেলিয় জাহাজের ক্যাপ্টেনকে স্বাধীনতার ঘোষণা জানানো হয়। ঐ ক্যাপ্টেন নাকি জনাব জহুর আহ্‌মদকে শেখ মুজিবের সেই ঘোষণা বাণী পৌঁছে দিয়েছিলেন! চট্টগ্রামের কোন লঙ্গর করা জাহাজের সাথে ঢাকায় বসে ওয়্যারলেস সংযোগ প্রতিষ্ঠা করা কোনভাবেই তখন সম্ভব ছিল না। কারণ ঐ সময় চট্টগ্রাম বন্দরে ইপিআর ও বেঙ্গল রেজিমেন্টের বাঙ্গালী সৈনিকদের সাথে পাক বাহিনীর লড়াই চলছিল। তাছাড়া ঢাকার ওয়্যারলেস সেন্টারসহ সবগুলো যোগাযোগ কেন্দ্র তখন পুরো মাত্রায় খানসেনাদের অধিনে। সুতরাং এ গল্পও সারহীন প্রমানিত হয়।

শেষ গল্পে বলা হয়: চট্টগ্রাম ইপিআর-কে জানানো হয়েছিল সারা দেশে স্বাধীনতার ঘোষণা বা বাণী প্রচারের জন্য। ‘স্বাধীনতার যুদ্ধের ইতিহাস’ নামক প্রকাশনায় এই কাহিনীটিই নথিবদ্ধ করা হয়েছে।

কিন্তু একটুখানি যুক্তি দিয়ে বিশ্লেষন করলেই বুঝা যায় এ কাহিনীটিও আষাঢ়ে গল্প মাত্র।

প্রথমত: ঢাকার সাথে দেশের অন্যান্য অঞ্চলের যোগাযোগ মাধ্যমগুলো যথা:- টেলিফোন, টেলিগ্রাফ, ঢাকা বেতার, ওয়্যারলেস সমস্তই তখন সম্পূর্ণরূপে পাক বাহিনীর নিয়ন্ত্রনে। এবার দেখা যাক ঢাকা ইপিআর এর মাধ্যমে চট্টগ্রাম ইপিআর-কে নির্দেশ পাঠানোর প্রশ্নটি। ঢাকা ইপিআর যদি শেখ মুজিবের নির্দেশে স্বাধীনতার ঘোষণা চট্টগ্রাম পৌঁছাতে পারে তাহলে ঢাকা ইপিআর-কেইতো ঢাকা থেকেই সারা বাংলাদেশে ঐ ঘোষণা প্রচার করার জন্য বলা যেত! তাছাড়া সবারই জানা ছিল ঢাকা ইপিআর-এর হেডকোয়ার্টার এবং পিলখানা সিগন্যাল সেন্টার ২৩শে মার্চেই আর্মি দখল করে নিয়েছিল। তারপরও কথা থাকে। চট্টগ্রামের ইপিআর-এর দায়িত্বে ছিলেন তখন বাঙ্গালী তরুণ অফিসার ক্যাপ্টেন রফিকুল ইসলাম। যে সমস্ত বাঙ্গালী অফিসারদের সাথে একত্র হয়ে মেজর জিয়াউর রহমান ২৬শে মার্চ রাতে কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন তাদের মধ্যে ক্যাপ্টেন রফিক ছিলেন অন্যতম। পরবর্তী পর্যায়ে ১নং সেক্টরে তিনি যুদ্ধ করেন। স্বাধীনতার পর তাকে হঠাৎ করে সেনা বাহিনী থেকে অবসর দেয়া হয়। মুক্তিযুদ্ধের উপর ক্যাপ্টেন রফিক একাধিক গ্রন্থ লিখেছেন। কিন্তু কোথাও তিনি স্বাধীনতার ঘোষণা বাণী ঢাকা থেকে পাবার ব্যাপারে কিছু লেখেননি। কেন? সর্বোপরি স্বাধীনতার ঘোষণা সত্যি সত্যি ঢাকা থেকে পাঠানো হয়ে থাকতো সেই ক্ষেত্রে মেজর জিয়া তার প্রথম ভাষণে নিজেকে অস্থায়ী সরকার প্রধান হিসাবে ঘোষণা দিয়েছিলেন কোন যুক্তিতে? তারপরও প্রশ্ন থাকে। চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের তৎকালীন আরেক নেতা আবদুল হান্নান যিনি ৩০ মার্চ চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্র থেকে একাধিকবার বক্তব্য প্রচার করেছেন, তিনিই বা কেন তার প্রচারণায় একবারও উল্লেখ করলেন না স্বাধীনতার ঘোষণা বাণী ঢাকা থেকে পাবার কথা? অতএব, ২৬শে মার্চ মেজর জিয়াই যে কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে সর্বপ্রথম স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন এই ধ্রুব সত্যকে শত চেষ্টা করেও কোন যুক্তি দিয়েই খন্ডানো সম্ভব নয়।

বিষয়: বিবিধ

১০৭৭ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File