সিরিজ - ৪ "ছয় দফা"
লিখেছেন লিখেছেন মাজহারুল ইসলাম ২৯ জুন, ২০১৩, ০২:০৯:২৩ দুপুর
আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক ম্যানিফেষ্টো।
৬ দফা :
(১) ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে পাকিস্তানকে একটি সত্যিকারের ফেডারেশন রূপে গড়িতে হইবে। তাহাতে পার্লামেন্ট পদ্ধতির সরকার থাকিবে। সকল নির্বাচন সার্বজনীন প্রাপ্ত বয়স্কদের সরাসরি ভোটে অনুষ্ঠিত হইবে। আইন সভাসমূহের সার্বভৌমত্ব থাকিবে।
সংশোধিত: সরকারের চরিত্র হবে ফেডারেল এবং সংসদীয় গণতান্ত্রিক। জাতীয় এবং ফেডারেটিং ইউনিটসমূহতে প্রত্যক্ষ গণভোটের মাধ্যমে সরকার নির্বাচিত হবে। জনসংখ্যার অনুপাতে ফেডারেল সংসদে প্রতিনিধিত্ব করা হবে।
(২) কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে মাত্র দুইটি বিষয় থাকিবে। প্রতিরক্ষা এবং বৈদেশিক নীতি। অবশিষ্ট বিষয়সমূহ স্টেট বা প্রদেশসমূহের হাতে থাকিবে।
(৩) পূর্ব এবং পশ্চিম পাকিস্তানের দুইটি পৃথক অথচ বিনিময় যোগ্য মুদ্রার প্রচলন করিতে হইবে। অথবা দুই অঞ্চলের জন্য একই কারেন্সি থাকিবে। শাসনতন্ত্রে এমন সুনির্দিষ্ট নির্দেশ থাকিবে যাহাতে পূর্ব পাকিস্তানের মুদ্রা পশ্চিম পাকিস্তানে পাচার না হইতে পারে। এই বিধানে পাকিস্তানে একটি ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক থাকিবে। দুই অঞ্চলে দুইটি আঞ্চলিক রিজার্ভ ব্যাংক থাকিবে।
সংশোধিত: ফেডারেল সরকার শুধুমাত্র পররাষ্ট্র, প্রতিরক্ষা এবং নিম্মে বর্ণিত শর্তসাপেক্ষে মুদ্রা সম্পর্কিত বিষয়াদির জন্য দায়ী থাকিবেন। বিষয়গুলো হল:-
ক. দুই উইং এর জন্য দুইটি ভিন্ন কিন্তু পরিবর্তনশীল মুদ্রা ব্যবস্থা চালু করতে হইবে অথবা
১। সারা দেশের জন্য একটি মুদ্রা ব্যবস্থাও রাখা যাইতে পারে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে সাংবিধানিক আইন প্রবর্তন করিতে হবে যাতে করে পূর্ব পাকিস্তান থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে সম্পদ ও অর্থ পাচাঁর হইতে না পারে।
খ. আলাদা ব্যাংকিং রিজার্ভ সৃষ্টি করিতে হইবে পূর্ব পাকিস্তানের জন্য; আলাদাভাবে আর্থিক এবং আয়-ব্যয় এবং হিসাব-নিকাশের ক্ষমতা থাকিবে পূর্ব পাকিস্তানের।
১। দুইটি ভিন্ন কিন্তু পরিবর্তশীল মুদ্রা ব্যবস্থার প্রচলন করা প্রতিটি অংশে কিংবা অঞ্চলের জন্য অথবা একটি মুদ্রা ব্যবস্থাই চালু থাকিবে তবে কেন্দ্রিয় রিজার্ভ ব্যাংকিং সিষ্টেমের ভিতর আঞ্চলিক রিজার্ভ ব্যাংক সৃষ্টি করিতে হইবে এবং এমন ব্যবস্থা প্রবর্তন করিতে হইবে যাতে এক অঞ্চলের সম্পদ কিংবা অর্থ অন্য অঞ্চলে পাচাঁর করা সম্ভব না হয়।
(৪) সকল প্রকার ট্যাক্স, খাজনা ধার্য্য ও আদায়ের ক্ষমতা থাকিবে আঞ্চলিক সরকারের হাতে। আঞ্চলিক সরকারের আদায়কৃত রেভিনিউর একটি অংশ ফেডারেল তহবিলে জমা হইবে। এইভাবে জমাকৃত টাকাই ফেডারেল সরকারের মূলধন হইবে।
সংশোধিত: আর্থিক লেনদেন, আয়-ব্যয় এবং পরিকল্পনা হইবে ফেডারেটিং ইউনিটগুলোর। ফেডারেটিং ইউনিটগুলো কেন্দ্রিয় সরকারকে বরাদ্দকৃত অর্থের যোগান দিবে প্রতিরক্ষা এবং পররাষ্ট্র বিষয়ক কর্মকান্ডের জন্য। দেশের সংবিধানে নির্ধারিত বরাদ্দ আয় কেন্দ্র পাইবে যথাযথভাবে নির্ধারিত অনুপাতে। সংবিধানে এমন বিধান নির্ধারন করা হইবে যাতে কেন্দ্রিয় সরকার ফেডারেটিং ইউনিটগুলোর কাছ থেকে নিয়মিত অর্থ পায় যাতে করে ফেডারেল ইউনিটগুলোর আয়-ব্যয় সংক্রান্ত নীতিগুলোর উপর ক্ষেত্রবিশেষে নিয়ন্ত্রন রক্ষা করা সম্ভব হয়।
(৫) দুই অঞ্চলের বৈদেশিক মুদ্রা আদায়ের পৃথক পৃথক হিসাব রাখিতে হইবে। এইসব অর্থ আঞ্চলিক সরকারের এখতিয়ারে থাকিবে। কেন্দ্রীয় সরকারের প্রয়োজনীয় বৈদেশিক মুদ্রা দুই অঞ্চল সমানভাবে দিবে অথবা সংবিধানের নির্ধারিত হারে আদায় হইবে। বিদেশের সঙ্গে বাণিজ্য চুক্তি, বিদেশে ট্রেড মিশন স্থাপন ও আমদানি-রপ্তানীর অধিকার আঞ্চলিক সরকারের থাকিবে।
সংশোধিত: বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের সব হিসাব প্রতিটি ফেডারেটিং ইউনিটের নিয়ন্ত্রনে পৃথক পৃথক ভাবে রাখার বিধান সংবিধানে রাখা হইবে। কেন্দ্রের জন্য প্রয়োজনীয় বৈদেশিক মুদ্রা প্রতিটি ফেডারেটিং ইউনিট কি অনুপাতে প্রদান করে সেটা সংবিধানে পরিষ্কারভাবে বর্ণিত থাকিবে। দেশের পররাষ্ট্র নীতি নির্ধারনের দায়িত্ব হবে কেন্দ্রিয় সরকারের। কিন্তু সেই নীতির আওতায় আঞ্চলিক সরকারগুলো বর্হিবাণিজ্য ও বৈদেশিক সাহায্য সর্ম্পকে সরাসরি আলোচনা এবং চুক্তি সম্পাদন করতে পারবে সেই বিধানও সংবিধানে থাকতে হইবে।
(৬) পূর্ব পাকিস্তানের জন্য মিলিশিয়া বা প্যারামিলিটারী রক্ষীবাহিনী গঠন করা হইবে এবং প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার ক্ষেত্রে পূর্ব পাকিস্তানকে আত্মনির্ভরশীল করিতে হইবে।
সংশোধিত: জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থে ফেডারেটিং ইউনিটগুলো নিজস্ব মিলিশিয়া অথবা প্যারামিলিটারী ফোর্স গঠন করিতে পারিবে।
পূর্ব পাকিস্তানের আপামর জনসাধারনের আশা-আকাংখার প্রতিফলন ঘটেছিল ৬ দফায়। ৬ দফার মাধ্যমে পরিষ্কার হয়ে উঠেছিল কিভাবে কেন্দ্রের ক্ষমতাসীন গোষ্ঠি পূর্ব পাকিস্তানকে শোষণ করেছিল। যাই হউক তবুও বলতে হয় ৬ দফার ঘোষণার সময়টা ছিল তাৎপর্যপূর্ণ। ১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধের পরই ৬ দফা ঘোষিত হয়। সামরিক চুক্তি থাকা সত্ত্বেও ১৯৬৫ সালের যুদ্ধে আমেরিকার ভূমিকা পাকিস্তান সরকারের মনঃপুত ছিল না। এ বিষয়ে প্রেসিডেন্ট আইয়ূব খান আমেরিকান সরকারকে তার অসন্তুষ্টি জানিয়েছিল তাই নয়; বিকল্প উপায় হিসেবে আইয়ূব খান আমেরিকার শত্রু গণচীনের সাথে বন্ধুত্ব গড়ে তোলার উদ্যোগ গ্রহণ করে।
তার এই উদ্যোগকে আমেরিকান সরকার তাদের স্বার্থবিরোধী বলে মনে করে। তাই আইয়ূবের ঔদ্ধত্বের উপযুক্ত জবাব দেবার জন্য আমেরিকা আইয়ূব বিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় সহযোগিতা দিতে থাকে। এই চক্রান্তে মদদ যোগাবার জন্য যারা হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন তাদের মধ্যে বিদগ্ধ হারুণ পরিবারের আলফা ইনস্যুরেন্স কোম্পানীর ভাতাপ্রাপ্ত সদস্য শেখ মুজিব ছিলেন অন্যতম। ঐ চক্রান্তের ফসল হিসেবেই বেরিয়ে আসে ৬ দফা। যদিও বলা হয়ে থাকে বাঙ্গালী বুদ্ধিজীবি এবং অর্থনীতিবিদ যথা: ডঃ কামাল হোসেন, ডঃ রেহমান সোবহান, ডঃ নুরুল ইসলাম, প্রফেসর আব্দুর রাজ্জাক প্রমুখরাই ছিলেন ৬ দফার জন্মদাতা। কিন্তু যে সত্যটি কখনোই প্রকাশ করা হয়নি সেটা হলো ৬ দফা প্রণয়নে আমেরিকার কয়েকজন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ফোর্ড ফাউন্ডেশনের মদদপুষ্ট হয়ে এই ৬ দফা দাবি প্রণয়নে কাজ করেছিলেন। ৬ দফা পাকিস্তানকে দ্বি-খন্ডিত করার জন্য নয় শুধুমাত্র আইয়ূব খানকে তার বেয়াদবীর উপযুক্ত শিক্ষা দেবার জন্যই প্রণিত হয়েছিল। পাকিস্তানকে দ্বি-খন্ডিত করতে কখনো কাউকে কোনরূপ সাহায্য আমেরিকা করেনি কারণ তারা কখনোই পাকিস্তান দ্বি-খন্ডিত হোক সেটা চায়নি। এ ব্যাপারে তৎকালীন আমেরিকার রাষ্ট্রদূত জে ফারল্যান্ড পরিষ্কারভাবে মুজিবকে হুশিয়ার করে দিয়েছিলেন।
রাজনৈতিক অবমৃশ্যতা থেকে একচ্ছত্র নেতায় পরিণতঃ
৬ দফা দাবির বর্হিপ্রকাশ ঘটার আগ পর্যন্ত শেখ মুজিবের ভূমিকা পূর্ব পাকিস্তানের রাজনীতিতে তেমন গুরুত্বপূর্ণ ছিল না।
১৯৫৪ সালে রাজনীতিতে এক চমকপ্রদ ঘটনা ঘটিয়ে মুজিব আকষ্মিকভাবে রাজনীতিতে আলোচ্য ব্যক্তিতে পরিণত হন। হক-ভাসানীর যুক্তফ্রন্টের সংসদ অধিবেশন চলাকালে হঠাৎ করে শেখ মুজিব তার গুন্ডাপান্ডা নিয়ে অতর্কিতে অধিবেশন কক্ষে প্রবেশ করে হৈ চৈ শুরু করে লাঠিবাজী এবং চেয়ার-টেবিল ছোড়াছুড়ি করে অধিবেশন পন্ড করে দেয়। ঐ তান্ডবলীলায় সংসদের স্পীকার মারা যান গুরুতররূপে আহত হয়ে। এই অপকর্মের নেপথ্যে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর হাত ছিল। এই ঘটনা পরবর্তিকালে আইয়ূব খানকে পূর্ব পাকিস্তানের প্রাদেশিক সরকার বিলুপ্ত করে সামরিক শাসন জারি করতে সুযোগ করে দেয়। ৬ দফায় কেন্দ্রিয় সরকার দেশদ্রোহিতার গন্ধ পায়। তাদের ধারনা হয় ৬ দফা দেশকে দ্বি-খন্ডিত করারই একটা কুটকৌশল। যদিও ৬ দফা ছিল পূর্ব বাংলার জনগণের মুক্তির সনদপত্র। ৬ দফায় পরবর্তিকালে বর্ণিত হয়েছিল পূর্ব পাকিস্তানে কেন্দ্রিয় শাসকদের দ্বারা কী ধরনের শোষণ চালানো হচ্ছিল দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকেই। যা হোক, শেখ মুজিবসহ আওয়ামী লীগের বেশকিছু শীর্ষস্থানীয় নেতাদের জড়িত করা হয় বিখ্যাত ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায়’; যদিও আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় শেখ মুজিব কিংবা তার দলীয় নেতারা কেউই জড়িত ছিলেন না। নেতাদের গ্রেফতারের ফলে ৬ দফা আন্দোলনে ভাটা পড়ে। সেই ক্রান্তিলগ্নে আবারও অগ্রণীর ভূমিকায় এগিয়ে আসে জাগ্রত ছাত্রসমাজ। বাংলার সিংহপুরুষ মাওলানা ভাসানীর পৃষ্ঠপোষকতায় তারা গঠন করেছিল ‘ইউনাইটেড এ্যাকশান কমিটি’ এবং এর নেতৃত্বে ১১ দফার আন্দোলনকে জনপ্রিয় করে তুলে দেশব্যাপী এক দুর্বার গণআন্দোলনের জোয়ার সৃষ্টি করেছিল। ১১ দফা জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল কারণ এর মূল বিষয় ছিল পূর্ব পাকিস্তানের জন্য স্বাধিকার ও স্বায়ত্ত্বশাসনের দাবি। সারা পূর্ব পাকিস্তানে ১১ দফাকে কেন্দ্র করে সরকার বিরোধী আন্দোলনের যে গণজোয়ার সৃষ্টি হয়েছিল তার প্রচন্ডতায় ম্লান হয়ে গিয়েছিল আওয়ামী লীগের ৬ দফা। মাওলানা ভাসানী এই আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়ে আন্দোলনকে গণঅভ্যুত্থানের রূপ দিতে সক্ষম হয়েছিলেন। যার জন্য সামরিক শাসকরা শেখ মুজিব এবং তার দলীয় নেতাদের বিনাশর্তে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। মুক্তি পেয়ে রেসকোর্সে এক বিশাল জনসভায় মুজিব তার ভাষণে বলেছিলেন, “জেল থেকে মুক্তি পাবার পর আমি দেখলাম আওয়ামী লীগের ৬ দফা ছাত্রদের ১১ দফায় বিলীন হয়ে গেছে।”
জনগণের চাপে মুক্ত হয়ে মুজিব নিজেকে নতুন করে আবিষ্কার করলেন। তিনি নিজেকে পেলেন সমগ্র বাংলাদেশী জনগণের একচ্ছত্র নেতা হিসেবে। কিন্তু এমনটি হওয়ার পেছনে তার নিজস্ব কোন অবদান ছিল না। আমাদের জাতীয় ইতিহাসে নেতারা সবাই সবকালে চলেছেন পেছনে কিন্তু জনগণ কখনোই কোন ক্রান্তিলগ্নে ভুল সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেনি। এটা এক ঐতিহাসিক বাস্তবতা যার আবর্তে জাতি আজও ঘুরপাক খাচ্ছে। সেই সময় জাতি উম্মুখ হয়ে উঠেছিল স্বাধিকার ও সায়ত্ত্বশাসন পাওয়ার জন্য। তারা হয়ে উঠেছিল অস্থির, ধৈর্যহারা এবং বিষ্ফোরম্মুখ। কিন্তু তাদের প্রত্যাশাকে বাস্তবায়িত করার মত আস্থাভাজন কোন জাতীয় নেতা ছিল না সামনে। বিষ্ফোরম্মুখ জাতিকে এগিয়ে নেয়ার জন্য নিঃস্বার্থ চরিত্রের পরিক্ষিত একজন বিচক্ষণ নেতার প্রয়োজন হয়ে উঠেছিল বিকল্পহীন। মাওলানা ভাসানী ছিলেন তেমন মাপের একমাত্র নেতা। কিস্তু বয়সের ভারে তিনি তখন অনেকটাই দুর্বল। নেতা হিসেবে তাকে জনগণ অবশ্যই জেনে এসেছে আপোষহীন বৃহত্তর গরীব জনগোষ্ঠির বন্ধু হিসেবে। তার রাজনৈতিক দূরদর্শিতা ও প্রজ্ঞতারও অভাব ছিল না। কিন্তু তার ছিল না সংগঠনভিত্তিক শক্তি। এ কারণেই এই বর্ষিয়ান নেতার পক্ষে কিছুতেই সম্ভব ছিল না গণআন্দোলনের চড়াই উৎরাই পেরিয়ে আন্দোলনকে ক্রমান্বয়ে বিপ্লবে রূপান্তরিত করে ধাপে ধাপে এগিয়ে নিয়ে চরম বিজয় অর্জন করা তার পক্ষে শ্রদ্ধার ও জনপ্রিয়তার শীর্ষে অবস্থান করেও এটা কার্যকরী করা তখন তার পক্ষে কিছুতেই সম্ভব ছিল না। অন্যদিকে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দৈবক্রমে শেখ মুজিবকে রাতারাতি এক কিংবদন্তির নায়কে পরিণত করেছিল। ভাসানীর সক্ষমতার মাওলানা নিজেই সবচেয়ে বেশি বুঝতেন তাই তারই আহ্বানে দেশের জনগণ মুজিবকেই একচ্ছত্র নেতা হিসেবে তখন গ্রহণ করে নিয়েছিল একান্ত বাধ্য হয়ে কোন বিকল্প না থাকায়।
স্বাধীন বাংলাদেশের চিন্তা করেছিলেন মজলুম জননেতা মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীও। কিন্তু শেখ মুজিব কখনও পূর্ব পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করার কথা চিন্তা করেননি। তিনি স্বায়ত্বশাসনের দাবি জানিয়েছিলেন মাত্র।
আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার ধারা বিবরণী খবরের কাগজে প্রকাশিত করতে থাকে আইয়ূব-মোনেম চক্র। তারা পূর্ব পাকিস্তানের বাঙ্গালী মুসলমানদের ভারত বিরোধী মনোভাবকে তাদের স্বার্থে কাজে লাগাবার উদ্দেশ্যেই এ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিলেন। তারা ভেবেছিলেন, মানুষ যখন জানতে পারবে শেখ মুজিব ভারতের দালাল হয়ে পাকিস্তানের অখন্ডতার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত তখন তার বিরুদ্ধে বিক্ষোভে ফেটে পড়বে। কিন্তু পরিণাম হল সম্পূর্ণ উল্টোটাই। প্রকাশিত ধারা বিবরণীর মধ্যেই পরিস্ফুটিত হয়ে উঠল আইয়ূব-মোনেম চক্রের ঘৃণ্য চক্রান্ত। এই ষড়যন্ত্রমূলক মামলাকে তখন বাঙ্গালীরা সমগ্র বাঙ্গালী জাতির বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র বলেই ধরে নেয়। ফলে সারা বাংলার মানুষ আইয়ূব শাহীর বিরুদ্ধে রুদ্র আক্রোশে ফেটে পড়ল। এখানে আবারও উল্লেখ করতে হয় যে, আইয়ূব বিরোধী আন্দোলনে পূর্ব পাকিস্তানেও মুখ্য এবং অগ্রণী ভূমিকা ছিল ছাত্র সমাজের। তারা ইতিমধ্যেই সংগ্রামকে একটি ঐক্যবদ্ধ জাতীয় সংগ্রামে রূপ দেবার লক্ষ্যে ১১ দফার ভিত্তিতে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠন করেন। ১১ দফার ভেতরেই বাংলাদেশের জনগণের আশা-আকাঙ্খার প্রকৃত রূপ ফুটে উঠে। ১১ দফার ভিত্তিতেই বাংলার মাটিতে ১৯৬৯ সালে গণআন্দোলনের জোয়ার এক প্রচন্ড রূপ ধারণ করে।
ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ১১ দফা দাবিঃ
স্বৈরাচারী সরকারের দীর্ঘ দিনের অনুসৃত জনস্বার্থ বিরোধী নীতির ফলেই ছাত্র সমাজ ও দেশবাসীর জীবনে সংকট ক্রমশঃ বৃদ্ধি পাইতেছে। শাসন শোষনের নিপীড়নে অতিষ্ট ছাত্র-জনতা আন্দোলনের পথে আগাইয়া আসিয়াছেন। আমরা ছাত্র সমাজ ও দেশবাসীর স্বার্থে নিম্নোক্ত ১১ দফা দাবিতে ব্যাপক ছাত্র গণআন্দোলনের আহ্বান জানাইতেছি -
১। (ক) স্বচ্ছল কলেজসমূহকে প্রাদেশিকরণের নীতি পরিত্যাগ করিতে হইবে এবং জগন্নাথ কলেজসহ প্রাদেশিকরণকৃত কলেজসমূহকে পূর্বাবস্থায় ফিরাইয়া দিতে হইবে।
(খ) শিক্ষার ব্যাপক প্রসারের জন্য প্রদেশের সর্বত্র বিশেষ করিয়া গ্রামাঞ্চলে স্কুল-কলেজ স্থাপন করিতে হইবে এবং বেসরকারি উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত স্কুল কলেজসমূহকে সত্ত্বর অনুমোদন দিতে হইবে। কারিগরী শিক্ষার প্রসারের জন্য পর্যাপ্ত সংখ্যক ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, পলিটেকনিক্যাল ও কমার্শিয়াল ইনস্টিটিউট স্থাপন করিতে হইবে।
(গ) প্রদেশের কলেজসমূহে দ্বিতীয় শিফটে নৈশ আইএ, আইএসসি, আইকম ও বিএ, বিএসসি, বিকম এবং প্রতিষ্ঠিত কলেজসমূহে নৈশ এমএ ও এমকম ক্লাশ চালু করিতে হইবে।
(ঘ) ছাত্র বেতন শতকরা ৫০ ভাগ হ্রাস করিতে হইবে। স্কলারশীপ ও স্টাইপেন্ডের সংখ্যা বৃদ্ধি করিতে হইবে এবং ছাত্র আন্দোলনে অংশ গ্রহণ করার অপরাধে স্কলারশীপ ও স্টাইপেন্ড কাড়িয়া লওয়া চলিবে না।
(ঙ) হল, হোস্টেলের ডাইনিং হল ও কেন্টিন খরচার ৫০ ভাগ সরকারি সাবসিডি হিসাবে প্রদান করিতে হইবে।
(চ) হল ও হোস্টেলের সমস্যা সমাধান করিতে হইবে।
(ছ) মাতৃভাষার মাধ্যমে সর্বস্তরে শিক্ষার ব্যবস্থা করিতে হইবে। সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পর্যাপ্ত সংখ্যক অভিজ্ঞ শিক্ষকের ব্যবস্থা করিতে হইবে। শিক্ষকের বেতন বৃদ্ধি করিতে হইবে এবং স্বাধীন মতামত প্রকাশের অধিকার দিতে হইবে।
(জ) অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত শিক্ষাকে অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক করিতে হইবে।
(ঝ) মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করিতে হইবে এবং অটোমেশন প্রথা বিলোপ, নমিনেশনে ভর্তি প্রথা বন্ধ, মেডিকেল কাউন্সিল র্অর্ডিন্যান্স বাতিল, ডেন্টাল কলেজকে পূর্ণাঙ্গ কলেজে পরিণত করা প্রভৃতি মেডিকেল ছাত্রদের সকল দাবি মানিয়া লইতে হইবে। নার্স ছাত্রীদের সকল দাবি মানিয়া লইতে হইবে।
(ঞ) প্রকৌশল শিক্ষার অটোমেশন প্রথা বিলোপ ১০% ও ৭৫% রুল বাতিল, সেন্ট্রাল লাইব্রেরীর সুব্যবস্থা, প্রকৌশল ছাত্রদের শেষ বর্ষেও ক্লাশ লইতে হইবে।
(ট) পলিটেকনিক ছাত্রদের কন্ডেন্স কোর্সের সুযোগ দিতে হইবে এবং বোর্ড ফাইনাল পরীক্ষা বাতিল করিয়া একমাত্র সেমিষ্টার পরীক্ষার ভিত্তিতেই ডিপ্লোমা দিতে হইবে।
(ঠ) টেক্সটাইল, সিরামিক, লেদার টেকনোলজি এবং আর্ট কলেজ ছাত্রদের সকল দাবি অবিলম্বে মানিয়া লইতে হইবে। আইইআর ছাত্রদের ১০ দফা, সমাজকল্যাণ কলেজ ছাত্রদের, এমবিএ ছাত্রদের, ও আইন ছাত্রদের সমস্ত দাবি মানিয়া লইতে হইবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ে বাণিজ্য বিভাগকে আলাদা ফ্যাকাল্টি করিতে হইবে।
(ড) কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ ছাত্রদের ন্যায্য দাবি মানিয়া লইতে হইবে। কৃষি ডিপ্লোমা ছাত্রদের কন্ডেন্স কোর্সের দাবিসহ কৃষি ছাত্রদের সকল দাবি মানিয়া লইতে হইবে।
(ঢ) ট্রেনে, স্টীমারে ও লঞ্চে ছাত্রদের আইডেন্টিটি কার্ড দেখাইয়া শতকরা ৫০ ভাগ কন্সেসনে টিকিট দেওয়ার ব্যবস্থা করিতে হইবে। মাসিক টিকেটেও এইরূপ সুবিধা দিতে হইবে। পশ্চিম পাকিস্তানের মত বাসে ১০ পয়সা ভাড়ায় শহরের যে কোন স্থানে যাতায়াতের ব্যবস্থা করিতে হইবে। দূরবর্তী অঞ্চলেও বাস যাতায়াতে ৫০% কন্সেসন দিতে হইবে। ছাত্রীদের স্কুলে ও কলেজে যাতায়াতের জন্য পর্যাপ্ত বাসের ব্যবস্থা করিতে হইবে। সরকারি ও আধা সরকারি উদ্যোগে আয়োজিত খেলাধূলা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে ছাত্রদের ৫০% কন্সেসন দিতে হইবে।
(ণ) চাকুরীর নিশ্চয়তা বিধান করিতে হইবে।
(ত) কুখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয় অর্ডিন্যান্স সম্পূর্ন বাতিল করিতে হইবে এবং বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য সকল প্রতিষ্ঠানের স্বায়ত্বশাসন দিতে হইবে।
(থ) শাসক গোষ্ঠির শিক্ষা সংকোচন নীতির প্রামান্য দলিল জাতীয় শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট ও হামিদুর রহমান কমিশন রিপোর্ট সম্পূর্ন বাতিল এবং ছাত্র সমাজ ও দেশবাসীর স্বার্থে গণমুখী বৈজ্ঞানিক শিক্ষা ব্যবস্থা কায়েম করিতে হবে।
(২) প্রাপ্তবয়স্কদের ভোটে প্রত্যক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে পার্লামেন্টারী গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করিতে হইবে। বাক স্বাধীনতা ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা দিতে হইবে। দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকার উপর হইতে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করিতে হইবে।
(৩) নিম্নলিখিত দাবিসমূহ মানিয়া লইবার ভিত্তিতে পূর্ব পাকিস্তানের পুর্ন স্বায়ত্বশাসন দিতে হইবে।
(ক) দেশের শাসনতান্ত্রিক কাঠামো হইবে ফেডারেশন শাসনতান্ত্রিক রাষ্ট্রসংঘ। এবং আইন পরিষদের ক্ষমতা হইবে সার্বভৌম।
(খ) ফেডারেল সরকারের ক্ষমতা দেশরক্ষা, বৈদেশিক নীতি ও মুদ্রা এই কয়েকটি বিষয়ে সীমাবদ্ধ থাকিবে। অপরাপর সকল বিষয়ে অঙ্গ রাষ্ট্রগুলির ক্ষমতা হইবে নিরঙ্কুশ।
(গ) দুই অঞ্চলের জন্য একই মুদ্রা থাকিবে। এই ব্যবস্থায় মুদ্রা কেন্দ্রের হাতে থাকিবে। কিন্তু এই অবস্থায় শাসনতন্ত্রে এমন সুনির্দিষ্ট বিধান থাকিতে হইবে যে যাহাতে পূর্ব পাকিস্তানের মুদ্রা পশ্চিম পাকিস্তানে পাচার হইতে না পারে। এই বিধানে পাকিস্তানে একটি ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক থাকিবে এবং পূর্ব পাকিস্তানের জন্য পৃথক অর্থনীতির প্রবর্তন করিতে হইবে।
(ঘ) সকল প্রকার ট্যাক্স, খাজনা, কর ধার্য ও আদায়ের সকল ক্ষমতা থাকিবে আঞ্চলিক সরকারের হাতে। ফেডারেল সরকারের কোন কর ধার্য করিবার ক্ষমতা থাকিবে না। আঞ্চলিক সরকারের আদায়ী রেভিনিউর নির্ধারিত অংশ আদায়ের সংগে সংগে ফেডারেল তহবিলে জমা হইবে। এই মর্মে রিজার্ভ ব্যাংকসমূহের উপর বাধ্যতামূলক বিধান শাসনতন্ত্রে থাকিবে।
(ঙ) ফেডারেশনের প্রতিটি রাষ্ট্র বর্হিবাণিজ্যের পৃথক হিসাব রক্ষা করিবে এবং বর্হিবাণিজ্যের মাধ্যমে অর্জিত মুদ্রা অঙ্গরাষ্ট্রগুলির এখতিয়ারাধীন থাকিবে।
(চ) পূর্ব পাকিস্তানকে মিলিশিয়া বা প্যারামিলিটারি রক্ষীবাহিনী গঠনের ক্ষমতা দিতে হইবে। পূর্ব পাকিস্তানে অস্ত্র কারখানা নির্মান ও নৌ বাহিনীর সদর দফতর স্থাপন করিতে হইবে।
৪। পশ্চিম পাকিস্তানের বেলুচিস্তান, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ এবং সিন্ধুসহ সকল প্রদেশের স্বায়ত্বশাসন প্রদানকরতঃ সাব ফেডারেশন গঠন।
৫। ব্যাংক, বীমা, পাট ব্যবসা ও বৃহৎ ভারী শিল্প জাতীয়করন করিতে হইবে।
৬। কৃষকদের উপর হইতে খাজনা ও ট্যাক্সের হার হ্রাস করিতে হইবে এবং বকেয়া খাজনা ও ঋন মওকুফ করিতে হইবে। পাটের সর্বনিম্ন মূল্য মনপ্রতি ৪০ টাকা নির্ধারন ও আখের ন্যায্যমূল্য দিতে হইবে।
৭। শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরী ও বোনাস দিতে হইবে এবং শিক্ষা, বাসস্থান ও চিকিৎসার ব্যবস্থা করিতে হইবে। শ্রমিক স্বার্থ বিরোধী কায়দা-কানুন প্রত্যাহার করিতে হইবে এবং ধর্মঘটের অধিকার ও ট্রেড ইউনিয়ন করিবার ক্ষমতা প্রদান করিতে হইবে।
৮। পূর্ব পাকিস্তানের বন্যা নিয়ন্ত্রন ও জন সম্পদের সার্বিক ব্যবহারের ব্যবস্থা করিতে হইবে।
৯। জরুরী আইন প্রত্যাহার, নিরাপত্তা ও আন্যান্য নির্যাতনমুলক আইন প্রত্যাহার করিতে হইবে।
(১০) সিয়াটো, সেন্টো, পাক-মার্কিন সামরিক চুক্তি বাতিল করিয়া জোট বর্হিভূত স্বাধীন নিরপেক্ষ পররাষ্ট্র নীতি কায়েম করিতে হইবে ।
(১১) দেশের বিভিন্ন কারাগারে আটক সকল ছাত্র, শ্রমিক, কৃষক, রাজনৈতিক কর্মী ও নেতৃবৃন্দের অবিলম্বে মুক্তি, গ্রেফতারী পরোয়ানা ও হুলিয়া প্রত্যাহার এবং আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলাসহ সকল রাজনৈতিক কারণে দায়েরকৃত মামলা প্রত্যাহার করিতে হইবে ।
বিষয়: বিবিধ
১৪৮৮ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন