সিরিজ - ৩ "পাকিস্তান ১৯৪৭-১৯৭১"

লিখেছেন লিখেছেন মাজহারুল ইসলাম ২৭ জুন, ২০১৩, ০৯:৪৮:৩৫ রাত

১৯৭১ এর মুক্তি সংগ্রাম পর্যন্ত ঘটনা প্রবাহ।

পাকিস্তানের গঠন প্রকৃতিটিই ছিল কিছুটা অস্বাভাবিক। ভৌগোলিকভাবে এই দেশের দুই অংশের মধ্যে ১০০০ মাইল এর ব্যবধান সৃষ্টি করে রেখেছিল ভারত। ণৃ-তাত্ত্বিক, সাংস্কৃতিক, ভাষা এবং আর্থ-সামাজিক দিক দিয়েও এই দুই অংশের মাঝে ছিল বড় ধরনের ব্যবধান। এই সমস্ত ব্যবধানগুলো ক্রমশঃ বেড়ে যায় ক্ষমতাসীন গোষ্ঠিদের ছলে-বলে, কৌশলে ক্ষমতা কুক্ষিগত করার নীতি গ্রহণের পরিপ্রেক্ষিতে। ক্ষমতাসীন গোষ্ঠি তাদের ভাষা এবং সংস্কৃতি অন্যায়ভাবে গায়ের জোরে অন্যদের উপর চাপিয়ে দিতে চায় যাতে করে রাজনৈতিকভাবে পুরো দেশের উপর তাদের প্রাধান্য বজিয়ে রাখা সম্ভব হয় এবং অর্থনৈতিকভাবে শোষণ কায়েম রাখা যায়।

পাকিস্তান সৃষ্টির জন্মলগ্নেই সংঘাতের সূত্রপাত ঘটে যখন ১৯৪৮ সালে জনাব মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ গর্ভণর জেনারেল হিসেবে ঢাকায় এক জনসভায় ঘোষণা দেন উর্দ্দূই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। তাৎক্ষণিকভাবে এর প্রতিবাদ জানানো হয় বাংলা ভাষাভাষী জনগোষ্ঠির পক্ষ থেকে যা পরবর্তিকালে জাতীয়তাবাদী চেতনার উম্মেষ ঘটাতে সাহায্য করে। এরপর ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের সময় রক্তের বিনিময়ে পূর্ব বাংলার জনগণ তাদের মাতৃভাষার মর্যাদা অক্ষুন্ন রাখার দৃঢ়তা ব্যক্ত করেন। যার ফলে পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠি বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দিতে বাধ্য হয়। ১৯৫৪ সালে পূর্ব পাকিস্তানে জাতীয়তাবাদী চেতনায় উদ্বুদ্ধ ইউনাইটেড ফ্রন্ট নির্বাচনে জয়ী হয়ে প্রাদেশিক সরকার গঠন করে। কিন্তু কেন্দ্রের ক্ষমতাসীনরা এদের হাতে ক্ষমতা দিতে নারাজ হয়ে নানা ধরনের কৌশল অবলম্বন করে তাদেরকে ক্ষমতা থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে চেষ্টা চালায়। ফলে পূর্ব পাকিস্তানে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা দেখা দেয়। একের পর এক সরকারের পতন ঘটানোর তামাশা শুরু করা হয় অতি চতুরতার সাথে; যার অজুহাতে পরে ১৯৫৮ সালে জেনারেল আইয়ূব খান ক্ষমতা দখল করে দেশে সামরিক শাসন জারি করেন।

ষাটের দশকের ঘটনাবলী পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের মনে এই বিশ্বাস জন্মাতে সক্ষম হয় যে, পূর্ণ সায়ত্ত্ব শাসন অর্জন করা ছাড়া আর অন্যকোন উপায়েই তারা নিজেদের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্টা করতে পারবে না। সবক্ষেত্রেই পূর্ব পাকিস্তানবাসীদের উপর চলতে থাকে বৈষম্যমূলক আচরণ এবং পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠিত কায়েমী স্বার্থবাদী গোষ্ঠিদের অবারিত শোষণের ফলে অর্থনৈতিকভাবে পশ্চিম পাকিস্তানের পশ্চাদভূমি হিসেবে দেউলিয়া হয়ে পরে পূর্ব পাকিস্তান।

১৯৬১-৬২ সালে হামিদুর রহমান শিক্ষা কমিশন রিপোর্টের বিরুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্র সমাজের মধ্যে প্রচন্ড বিক্ষোভের সৃষ্টি হয়।

১৯৬৬ সালে সায়ত্ত্বশাসন এবং ন্যায্য অধিকার অর্জন করার জন্য শেখ মুজিবর রহমান ও তার দল আওয়ামী লীগ তাদের ৬ দফা প্রোগাম পেশ করে। এতে জাতীয়তাবাদী চেতনায় এক নতুন মাত্রা যোগ হয়। ৬ দফা ছিল পাকিস্তানের অবকাঠামোর মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানের জন্য পূর্ণ সায়ত্ত্বশাসনের অধিকার আদায়ের দাবি। এতে ক্ষমতাশালী গোষ্ঠি আতংকিত হয়ে উঠে শেখ মুজিবকে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার সাথে জড়িত কর দেশদ্রোহিতার অভিযোগে কারাবন্দী করে। কিন্তু বাংলাদেশের সিংহপুরুষ মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী সারা দেশব্যাপী এক দুর্বার আন্দোলন গড়ে তোলেন যার ফলে ১৯৬৯ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে আইয়ূব সরকার তাকে ও তার সহকর্মীদের বিনাশর্তে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। মার্চ মাসে পাকিস্তানের পূর্ব ও পশ্চিম দুই অংশেই আইয়ূব বিরোধী আন্দোলনের চাপে জেনারেল আইয়ূব ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হন এবং তার স্থলাভিষিক্ত হন সেনাপ্রধান জেনারেল ইয়াহিয়া খান।

জেনারেল ইয়াহিয়া খান ১৯৭০ সালে পাকিস্তানে জাতীয় এবং প্রাদেশিক নির্বাচন করান। সেই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জাতীয় এবং প্রাদেশিক নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে কেন্দ্র এবং প্রাদেশিক সরকার গঠনের দাবিদার হয়ে উঠে। কিন্তু সামরিক জান্তা এবং পশ্চিম পাকিস্তানের ধূর্ত রাজনৈতিক নেতা জুলফিকার আলী ভূট্টোর যোগসাজসে আওয়ামী লীগের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর না করার ফন্দি-ফিকির করতে থাকেন। তাদের এ ধরনের কুটকৌশলের জবাবে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ এক অসহযোগ আন্দোলন শুরু করে ১৯৭১ এর ৩রা মার্চ থেকে। ২রা মার্চ পূর্ব বাংলার ছাত্র ও যুব সমাজের পক্ষ থেকে আসম আব্দুর রব ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় সর্বপ্রথম স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন। তার এই উদ্যোগের জন্য শেখ মুজিব জনাব রবকে তিরষ্কার করেছিলেন। এর চাক্ষুষ সাক্ষী আজো অনেকেই বেচেঁ আছেন। ৩রা মার্চ পল্টন ময়দানের বিশাল জনসভায় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক জনাব শাহজাহান সিরাজ ‘স্বাধীনতার ইশতেহার’ পাঠ করেন শেখ মুজিবের উপস্থিতিতে। অপ্রত্যাশিত এই ঘটনার ফলে শেখ মুজিব ক্ষুদ্ধ হন এবং সভাশেষে শোভাযাত্রার নেতৃত্ব দিতে অসম্মতি জ্ঞাপন করেন। পূর্ব সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ঘোষিত হয়েছিল সভাশেষে গণমিছিলের নেতৃত্ব দেবেন শেখ মুজিব। ৭ই মার্চ রেসকোর্সের বিশাল জনসমুদ্রে তার বহুল প্রচারিত বক্তব্য রাখেন। বক্তৃতা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “এবারের সংগ্রাম- আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম- আমাদের মুক্তির সংগ্রাম।” কিন্তু বক্তৃতা শেষ করার সময় তিনি ঘোষণা দেন, “জয় বাংলা, জয় পাঞ্জাব, জয় সিন্ধু, জয় বেলুচিস্তান, জয় সীমান্ত প্রদেশ এবং জয় পাকিস্তান।” তার ঐ বক্তৃতা পরদিন সবক’টি দৈনিক পত্রিকাতেই ছাপানো হয়। অবশেষে ক্ষমতা হস্তান্তরের সব আলোচনাই যখন ব্যর্থ হয়ে গিয়েছিল তখন সামরিক জান্তা অস্ত্রের মাধ্যমে রাজনৈতিক সংকটের মোকাবেলা করার সিদ্ধান্ত নেয়। তারা হায়েনার মত ঝাঁপিয়ে পড়ে পূর্ব পাকিস্তানের নিরস্ত্র জনগণের উপর ২৫-২৬শে মার্চ ১৯৭১ এর কালোরাতে। চালানো হয় পাশবিক শ্বেত সন্ত্রাস।

বিষয়: রাজনীতি

১০৮৪ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File