সিরিজ - ২ "জাতীয়তাবাদী সংগ্রামের চুড়ান্ত পর্যায়েই শুরু হয়েছিল ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধ, পাকিস্তানের ভাঙ্গন অবধারিত ছিল না।"
লিখেছেন লিখেছেন মাজহারুল ইসলাম ২৭ জুন, ২০১৩, ১০:৩০:৫১ সকাল
এ অঘটন এড়ানো সম্ভব ছিল।
পাকিস্তানের মত একটি বহুজাতিক দেশের জন্য শুরু থেকেই প্রয়োজন ছিল বিভিন্ন জাতিসত্ত্বার এলিট শ্রেণীর মধ্যে ঐক্যমত্যের ভিত্তিতে একটি কার্যকরী শাসন ব্যবস্থা গড়ে তোলা। ঐক্যমত্যের ভিত্তিতে রাষ্ট্র পরিচালনার কৌশল এবং পরিকল্পনা নির্ধারনের জন্য যে সহযোগিতা অতি আবশ্যক ছিল তা নিশ্চিত করার জন্য নিম্মে বর্নিত বিষয়গুলোর উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা উচিত ছিল জাতীয় পরিসরে :-
১. সব জাতীয় এলিট শ্রেণীর সমন্বয়ে একটি প্রতিনিধিত্বকারী সরকার কায়েম করা।
২. বিভিন্ন জাতিসত্ত্বার মধ্যে ঐক্যমত্য এবং একটি কার্যকরী ব্যবস্থা গড়ে তোলা।
৩. সর্বক্ষেত্রে একতা ভিত্তিক সহজলভ্য জাতীয় প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা।
৪. জাতির লক্ষ্য এবং আশা-আকাঙ্খা বাস্তবায়নের জন্য বিভিন্ন জাতিসত্ত্বার এলিট শ্রেণীর জনগণকে অনুপ্রানিত করার দায়িত্ব গ্রহণ করা।
৫. যে কোন বিচ্ছিন্নবাদী প্রচেষ্টাকে অঙ্কুরেই বিনষ্ট করে দেয়া; বল প্রয়োগের মাধ্যমে নয় এবং তা ইতিবাচক পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমেই।
৬. অর্থনৈতিক সুবিধাদি যাতে জনগণ পর্যন্ত পৌঁছে তা নিশ্চিত করা। আধুনিকীকরণ এবং উন্নয়নের সুফল সমভাবে যাতে সব জাতিগোষ্ঠিই উপভোগ করতে পারে তার ব্যবস্থা নিশ্চিত করা। জাতীয় এলিট শ্রেণীগুলো কর্তৃক বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠির জনগণের মাঝে জাতীয় সম্পদ ও সুবিধাদির সুষম বন্টন নিশ্চিত করা।
এ ধরণের কৌশল এবং পরিকল্পনা সব সমস্যার সমাধান অবশ্যই ছিল না, কিন্তু এর ফলে আশা করা যেত জাতীয় রাজনৈতিক অবকাঠামোতে বর্জনের পরিবর্তে ঐক্যের মাধ্যমে বহুজাতিক দেশের অখন্ডতা বজিয়ে রাখা।
ধারণা করা চলে, ন্যায্য অধিকার পাবার জন্য বিভিন্ন জাতিসত্ত্বার জনগোষ্ঠি কিছুকাল হয়তো বা প্রলম্বিত শিল্পায়নের পরিকল্পনা এবং স্তিমিত আধুনিকীকরণ প্রক্রিয়াকেও মেনে নিত। যে কোন ব্যক্তির পক্ষে একটি ন্যায়ভিত্তিক সমাজে দরিদ্র হয়ে থাকাটা সহনীয় হয় তখনই যখন তার পড়শীরা সমাজে অর্জিত ধন-সম্পদের বড়াই করার সুযোগ না পায়। একটি দেশ উন্নত হতে পারে শুধুমাত্র ঐক্যের ভিত্তিতে। বৈষম্য এবং বিভক্তি এক অথবা একাধিক জাতিগত রাষ্ট্রের জন্ম দেয়। ফলে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠিরই হয় সমূহ ক্ষতি।
এ জন্যই বহুজাতিক একটি দেশের এলিট শ্রেণীদের ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করা অপরিহার্য হয়ে দাড়ায় শ্রেণী স্বার্থ এবং জাতীয় স্বার্থ দু’টোই বজিয়ে রাখার জন্য। কোন এক বিশেষ পর্যায়ে তারা অবশ্যই নিজ নিজ জাতি স্বার্থে একে অপরের সাথে দ্বন্দ্বে লিপ্ত হতে পারেন। কিন্তু কোনক্রমেই তাদের একে অপরের সহ্যশক্তি ও বোঝাপড়ার ক্ষমতার প্রতি সন্দেহ পোষণ করা উচিত নয়। তেমনটি হলে বিচ্ছিন্নবাদের বিপদসংকুল একতরফা রাস্তা অবশ্যই খুলে যাবে।
তথাকথিত ইসলাম ও ইসলামিক রাষ্ট্রের ধ্বজ্জাধারী পাঞ্জাবী-মোহাজের নিয়ন্ত্রিত কেন্দ্রীয় সরকার শুরু থেকেই বাঙ্গালীদের নিঃস্ব, হীনমনা এবং পশ্চাদমূখী জনগোষ্ঠি হিসাবে গন্য করে আসছিলেন। তারা মনে করতেন বাঙ্গালী জনগোষ্ঠি পশ্চিম পাকিস্তানের উপর একটি বোঝাস্বরূপ। তারা বিশ্বাস করতেন পাকিস্তানী জাতীয়তাবাদ এবং অর্থনৈতিক উন্নতির সাথে বাঙ্গালীর জাতিগত চেতনা এবং তাদের হিন্দুয়ানী মনোভাব সঙ্গতিপূর্ণ নয়।
যাই হোক না কেন, এ কথা অস্বীকার করার কোন উপায় নেই যে আইয়ূব খানের প্রণীত অর্থনীতির ফলে পূর্ব পাকিস্তানে শিল্প উদ্যোগীর সংখ্যা তুলনামূলকভাবে বৃদ্ধি পায়। কিন্তু ঐ সমস্ত উদীয়মান শিল্প উদ্যোগীরা সরকারি মদদ এবং পৃষ্ঠপোষকতায় বেড়ে উঠা পশ্চিম পাকিস্তানী শিল্পপতিদের সাথে প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদী রাজনীতিবিদ যারা আঞ্চলিক স্বায়ত্বশাসনের জন্য সংগ্রাম করেছিলেন তাদের সাথে হাত মেলান। সমস্তস বাঙ্গালী শিল্পপতিরা ইম্পোর্র্ট লাইসেন্স এবং বৈদেশিক মুদ্রার কোটা বাড়াবার জন্য ঐ আন্দোলনকে কেন্দ্রের উপর চাপ প্রয়োগকারী হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করতে থাকেন। শেষ পর্যায়ে আঞ্চলিক স্বায়ত্বশাসনের দাবি বাঙ্গালী জাতির বিভিন্ন শ্রেণীকে একক একটি রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্মে ঐক্যবদ্ধ করতে সক্ষম হয়। পশ্চিম পাকিস্তানী এলিট শাসক শ্রেণী অসঙ্গতভাবে তাদের বাঙ্গালী দোসরদের হীনমন্য, পশ্চাদমূখী এবং হিন্দু মনোভাবাপন্ন বলে চিহ্নিত করেন। এই ধরণের মনোভাব বিচ্ছিন্নতাবাদী চেতনার উম্মেষ ঘটাতে বিশেষভাবে সাহায্য করে। তদপুরি শেখ মুজিবের বিচার দেশের নাজুক ঐক্যের উপর হানে চরম আঘাত। এখানে আবারও উল্লেখ করতে হয় মুজিবের ৬ দফায় কোন নতুন কিছু ছিল না। অতীতে বহুবার এ ধরণের দাবিসমূহ বাঙ্গালী সাংসদগন কেন্দ্রীয় সংসদে উত্থাপন করেছিলেন। আগরতলা ষড়যন্ত্রের ঘোষণার সময়টি ছিল অতীব গুরুত্বপূর্ন। এ ঘোষণাটি করা হয় এমন এক সময় যখন সারা দেশ জুড়ে এক জটিল রাজনৈতিক সমস্যা বিরাজমান। দেশ জুড়ে জনগণ তখন আইয়ূব শাহীর নিষ্পেষন এবং স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হয়ে উঠেছে।
আইয়ূব শাহী আঞ্চলিক বৈষম্য দূরীকরণের কোন প্রচেষ্টাতো করেইনি বরং পাঞ্জাবী-মোহাজের এলিট শ্রেণীর কায়েমী স্বার্থকে লালন করে তাদের আধিপত্যকে আরো সুসংহত করে তোলে। সামরিক শাসনকালে কেন্দ্রীয় প্রশাসনে বাঙ্গালীদের প্রতিনিধিত্ব একরকম ছিলনা বললেই চলে। ষাটের দশকে যখন বাঙ্গালীদের ধৈর্য্যের বাধঁ প্রায় ভেঙ্গে পড়ছিল ঠিক তখনই পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় শাসকগোষ্ঠি কর্তৃক বাঙ্গালী রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে বিশ্বাসঘাতক এবং শত্রুশক্তি ভারতের দালাল হিসাবে আখ্যায়িত করার ফলে অবস্থার আরো অবনতি ঘটে। বাংলাভাষী জনগণ যারা দ্ব্যার্থহীনভাবে ১৯৪৭ সালে পাকিস্তানের পক্ষে ছিলেন তারা পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠির কাছ থেকে এ ধরণের ব্যবহার কখনোই প্রত্যাশা করেনি। পাকিস্তানের সৃষ্টিতে বাঙ্গালী জনগোষ্ঠি সবিশেষ গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা পালন করে। এ সত্যটিই অতি সহজে ভুলে গিয়েছিলেন পশ্চিমা শাসকগন। যদিও বাহ্যিকভাবে মুজিবের দাবিগুলো ছিল চরম প্রকৃতির। পাকিস্তান তখনও ছিল অতিপ্রিয় প্রতিটি বাঙ্গালীর কাছে। বাঙ্গালী জনগণ শুধু চেয়েছিল রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে মত প্রকাশের ন্যায্য অধিকার। তারা চেয়েছিল সাম্য ও সংহতির উপর একটি রাজনৈতিক কাঠামো।
তারা চাইছিল স্বৈরাচারী একনায়কত্বের পরিবর্তে একটি গণতান্ত্রিক সরকার। স্বৈরাচারী একনায়কত্ব তাদের অতীতের হিন্দু আধিপত্য ও অত্যাচার এবং ঔপনিবেশিক শোষণকেই জোরালোভাবে মনে করিয়ে দিয়েছিল। এ থেকে এটাই পরিষ্কারভাবে বলা চলে, বাঙ্গালীরা সুচিন্তিত কতগুলো লক্ষ্যের বাস্তবায়নের জন্যই মূলতঃ সংগ্রাম করছিল। কোন স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্টা করার জন্য নয়। এটা জোর দিয়েই বলা চলে যে, আইয়ূব শাহীর পতনকালে পূর্ব পাকিস্তনের বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়াটা মোটেই অবধারিত পরিণতি ছিল না। জাতীয় রাজনীতি এবং অর্থনীতিতে বাঙ্গালীদের অংশদারিত্বের অধিকার থেকে বঞ্চিত রেখে ক্ষমতাধর শাসকচক্র বাঙ্গালী এলিট শ্রেণীকে জনগণের আন্দোলনের প্রতিই ঠেলে দিয়েছিল এবং তাদের নৃতাত্ত্বিক, সাংস্কৃতিক এবং ভাষাগত বৈষম্যকে পুর্নঃজীবিত করার আন্দোলনে নেতৃত্ব দিতে বাধ্য করেছিল জাতীয় ঐক্যের বিরুদ্ধে। এ থেকে পরিশেষে এটাই বলা চলে যে অসম উন্নয়নই বাধ্য করেছিল বাঙ্গালী এলিট শ্রেণীকে কেন্দ্রের বিরুদ্ধে জনগণের সাথে ঐক্যবদ্ধ হতে এবং জাতীয়তাবাদী চেতনার পরিবর্তে বাঙ্গালীত্বকে উস্কে দিতে।
বাঙ্গালীত্বের চেতনাই তখন আঠারমত বাঙ্গালী এলিট শ্রেণীকে জনগণের সাথে এক অটুট বন্ধনে বেধেঁছিল। অসম উন্নয়ন, শোষণ, বঞ্চনা, এবং নৃতাত্ত্বিক চেতনা ঐ ধরণের লোভী জোঁক যা একে অপরকে শুষে বেচে থাকে সেই সময় অব্দি যখন সশস্ত্র সংঘাত অথবা গণঅভ্যুত্থানের বিকল্প কোন পথই খোলা থাকে না। দুঃখজনক হলেও সত্য পাকিস্তানও ঠিক সেই সন্ধিক্ষণে পৌঁছে অপরিহার্য এক মহা বিপর্যয়ের অপেক্ষা করছিল ষাটের দশকের শেষে। অন্তিম অবস্থায় সামরিক জান্তা রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান বন্দুকের জোরে করার সিদ্ধান্ত নেয়। শুরু হয় ২৫-২৬শে মার্চ ১৯৭১ এর আর্মি ক্র্যাকডাউন। পাকিস্তান সেনা বাহিনী বাঙ্গালীদের আন্দোলন নস্যাৎ করার জন্য বর্বরোচিত সশস্ত্র অভিযান শুরু করে সমগ্র বাঙ্গালী জাতির বিরুদ্ধে। এভাবেই অনিবার্য হয়ে উঠে দেশ বিভক্তি।
**মেজর ঢালিমের ওয়েব সাইট থেকে।**
ফেইসবুকে আমি https://www.facebook.com/Bodorerjuddho
বিষয়: রাজনীতি
১১৫৪ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন