পথহারাদের কথা
লিখেছেন লিখেছেন বান্দা ০২ জানুয়ারি, ২০১৬, ০১:২২:৪৯ রাত
REHNUMA BINT ANIS·FRIDAY, JANUARY 1, 2016
প্রথম যখন তুষারপাত হয় তখন সেই নিদাগ, নিখাদ, মসৃন, শ্বেতশুভ্র সৌন্দর্য্যের তুলনা কেবল সেই সাগরবিধৌত বেলাভূমি কিংবা বায়ুপ্রবাহিত মরুভূমির সাথেই করা চলে যেখানে কোনদিন মানুষের পা পড়েনি। এই মায়াবী রূপ একই সাথে মনভোলানো, রহস্যময় এবং ভয়ানক। তুষারের চাদরে ঢাকা বাড়ীঘর, পথপ্রান্তর এমনকি নিশ্চল গাড়ীগুলো তখন দেখায় উঁচুনিচু ঢিবির মত, চেনা পথও তখন অপরিচিত মনে হয়। কিন্তু একটু উষ্ণতা পেলেই কিংবা গাড়ীঘোড়া, মানুষের পায়ের চাপে এই তুষার পরিণত হয় ভয়ঙ্কর, পিচ্ছিল বরফে, গাড়ী ঘুরতে থাকে নিয়ন্ত্রনবিহীন, পিছলে পড়ে ভাঙ্গে মানুষের হাত পা।
এই কনকনে শীতেও ক্যানাডার মেয়েদের দেখি শীতলতাকে উপেক্ষা করে শরীর প্রদর্শন চালিয়ে যাবার আপ্রান প্রচেষ্টা। তবু মেয়েগুলোর জন্য মায়া লাগে। ওদের সাথে মিশলেই বোঝা যায় ওরা আসলে কতখানি সহজ সরল, সৎ এবং উদার প্রকৃতির। কিন্তু ওরা একদিকে ফ্যাশনের শিকার, আরেকদিকে সমাজের। ফ্যাশন ওদের স্বাধীনতা দেয়ার কথা বলে এক বিরতিহীন প্রতিযোগিতার পাত্রে পরিণত করেছে, ‘ডিফারেন্ট’ হবার প্রচেষ্টা যেখানে তাদের মনুষ্যপ্রকৃতি থেকে ক্রমাগত দূরে ঠেলে দিচ্ছে। সমাজ ওদের অধিকার দেয়ার কথা বলে অধিকার হরণ করেছে, অর্পন করেছে অধিকার আদায়ের এক বিরামহীন সংগ্রামক্ষেত্রে। তাই বেচারীদের সারাক্ষণ দেখা যায় জামা হয় ওপরদিকে টানতে নয় নিচের দিকে, নয় উভয়দিকে। কারণ বাজারে যা পাওয়া যায় তা কোনদিকেই ঠিকমত ঢাকেনা, অথচ স্বভাবগত লাজুকতাকে ওরা পুরোপুরি উপেক্ষাও করতে পারেনা। অপরদিকে সমাজ ওদের অধিকার দেয়ার কথা বলে দায়িত্বের এমন জোয়াল চাপিয়ে দিয়েছে যা তাদের করেছে পরিবারছাড়া, গৃহহীন। একাকীত্বের কবল থেকে মুক্তির আকাঙ্খা তাদের করে তুলেছে বেহিসেবী। এর সুযোগ নিয়ে পুরুষসমাজের একাংশ হয়ে উঠেছে মৌমাছির মত, তারা ফুলে ফুলে মধু চেখে বেড়ায়, কিন্তু দায়িত্ব নিয়ে ঘর সাজাতে রাজী নয়। এদের ঘরমুখী করে তুলে সংসার সাজাবার প্রচেষ্টায় মরিয়া হয়ে মেয়েরা নিজেদের বিবেকবুদ্ধি বিসর্জন দিয়ে শারীরিক সৌন্দর্য্যের লালনের প্রতি সচেতন হয়ে উঠছে যা আদতেই একটি হেরে যাওয়া যুদ্ধ, কারণ বিবেকবুদ্ধি বয়সের সাথে সাথে বৃদ্ধি পায়, সৌন্দর্য্য কেবল কমে। এভাবে বিভ্রান্ত হচ্ছে মানবপ্রকৃতি, নষ্ট হচ্ছে সমাজের ভারসাম্য।
যুগের পরিবর্তন কিংবা বিজ্ঞানের উৎকর্ষতা নিয়ে যত বক্তৃতাই আমরা দেইনা কেন, মানুষের মন সেই আদিম যুগে যেমন ছিলো তেমনই আছে। মানুষ এখনো চায় ব্যাক্তিজীবনে সুখী হতে, এমন একজন সঙ্গীকে পেতে যাকে সে নিবিড়ভাবে ভালোবাসতে পারে, যার জন্য সে গৃহ সাজাতে পারে, যাকে নিয়ে সে সন্তান লালনপালন করতে পারে। জাপানের বিখ্যাত এক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স করা একজন বিখ্যাত গায়ক কাম নায়ক এক সাক্ষাতকারে জানান তাঁর স্বপ্ন তাঁর একহালি বাচ্চাকাচ্চা হবে, তাদের নিয়ে তিনি সমুদ্রসৈকতে বেড়াতে যাবেন, বালির ওপর চাদর বিছিয়ে বাচ্চাদের নিয়ে পিকনিক করবেন। তাঁর পছন্দ এমন স্ত্রী যে শালীনভাবে পোশাক পরবে, যে হবে বুদ্ধিমতি, পরিবারকেন্দ্রিক। কিন্তু সমাজের উচ্চস্তরের পরিবার থেকে আসা এই ব্যাক্তি তাঁর পারিবারিক কিংবা পনেরো বছরের ক্যারিয়ারে পরিচিতির বলয়ে যে মেয়েদের দেখেছেন তারা তাকে কেবল নারীজাতির প্রতি বীতশ্রদ্ধই করেছে। ফলে তিনি বলেন, ‘আমি বাচ্চাদের ভালোবাসি। আমি অনেক বাচ্চার বাবা হতে চাই। কিন্তু আমি কোন নারীকে বিয়ে করার কথা কল্পনাও করতে পারিনা’।
এই ধরনের মেয়েরা পুরুষদের ঘরমুখী করার জন্য মরিয়া হয়ে এমন সব উৎকট পদ্ধতি অনুসরন করছে যা পুরুষদের বরং বহুগামীতা কিংবা ক্ষেত্রবিশেষে সমকামীতা দিকে ঠেলে দিচ্ছে। স্বাভাবিক কারণেই পৃথিবীতে নারীর সংখ্যা পুরুষদের চেয়ে বেশী। সুতরাং, এই ধরণের ভুল পদক্ষেপের কারণে পুরুষদের চেয়ে নারীরাই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বেশী। অনেক নারী কেবল একটু আবেগের নির্ভরতার ঠাঁই পাওয়ার জন্য জড়িয়ে পড়ে অধিকারবিহীন সম্পর্কে, যেখানে তাদের সন্তানরা পায়না বাবার নিরাপত্তার ছায়া, এমনকি অনেক সময় বাবার নামটিও। পুরুষবিদ্বেষকেই নারীর মুক্তির পথ ধরে নেয়া অনেক পথভ্রষ্ট নারীবাদী মনে করেন কেবল কিছু শুক্রানু দান করা ছাড়া পুরুষদের তাদের প্রয়োজন নেই। এভাবে চালু হয়েছে আরেকটি ভয়ানক পদ্ধতি যেখানে একটি সন্তানের জন্ম হচ্ছে, কিন্তু তার পিতৃপরিচয় জানার অধিকার সন্তানের মায়েরও নেই।
মানুষ প্রানী হিসেবে দূরদর্শী নয়। ফলে আমরা এমন অনেক কথা বলি, এমন অনেক কাজ করি যা পরবর্তীতে আমরা ভুল হিসেবে চিহ্নিত করতে পারি, কিন্তু সংশোধন করতে পারিনা। আপাতদৃষ্টে যাদের মনে হয় বয়ফ্রেন্ড গার্লফ্রেন্ড সংস্কৃতির মাধ্যমে যদি দায়িত্ব না নিয়েই সন্তান ধারণ করা যায়, কিংবা টেস্ট টিউব বা স্পার্ম ডোনেশন পদ্ধতিতে দায়বদ্ধতা ব্যাতিরেকেই সন্তানের মা হওয়া যায় তবে কি দরকার আজীবন একজন পুরুষের অনুগত হয়ে থাকার, কিংবা পুরুষদের ক্ষেত্রে একজন নারীকে আজীবন পোষার? কিন্তু আমরা ভুলে যাই মাত্র বিশ বছরের ব্যাবধানে এই বাচ্চাগুলো পুর্ণাঙ্গ নারী কিংবা পুরুষে পরিণত হবে। এদের প্রয়োজন হবে অন্য নারী কিংবা পুরুষের সাথে সম্পর্ক গড়ার। এরা কিভাবে নিশ্চিত হবে যে ছেলেটি বা যে মেয়েটিকে তারা পছন্দ করছে সেটি আদতে তার ভাই বা বোন নয়? কোন পশুও আপন ভাই বা বোনের সাথে সম্পর্কে লিপ্ত হয়না। কিন্তু এসব ক্ষেত্রে ভুলক্রমে কিংবা জানার অভাবে এমন ঘটনার যে কেবল সম্ভাবনা থাকে তাই নয় বরং এই পদ্ধতিসমূহ অবলম্বনের কয়েক প্রজন্ম পেরিয়ে যাবার পর অনেক ক্ষেত্রে এমন ঘটনা আসলেই ঘটছে।
এজন্যই হয়ত আমাদের সৃষ্টিকর্তা বলেছেন, ‘আপনি কি তাকে দেখেন না, যে তারা প্রবৃত্তিকে উপাস্যরূপে গ্রহণ করে? তবুও কি আপনি তার যিম্মাদার হবেন? আপনি কি মনে করেন যে, তাদের অধিকাংশ শোনে অথবা বোঝে? তারা তো চতুস্পদ জন্তুর মত; বরং আরও পথভ্রান্ত’ (সূরা ফুরকানঃ আয়াত ৪৩-৪৪)। কারণ একটি পশুও কিছু সীমারেখা মেনে চলে। কিন্তু প্রবৃত্তির অনুসরন মানুষকে এমনভাবে বিভ্রান্ত করে ফেলে যে সে মনে করে সে সৃষ্টিকর্তার বিধানকে ফাঁকি দিয়ে নিজের সুবিধামত এমন কিছু আবিষ্কার করে নিতে সক্ষম যা তাকে দেবে লাগামহীন স্বেচ্ছাচারীতার সুযোগ অথচ এর ফল তাকে ভোগ করতে হবেনা! যিনি মানুষকে সৃষ্টি করেছেন মাটির মত একটি তুচ্ছ নোংরা জিনিস থেকে তিনি কি তার নাড়িনক্ষত্রের খবর জানেন না? তিনিই কি তাকে তার উৎপত্তিগত সীমাবদ্ধতার উর্ধ্বে আরোহণ করার পথ বাতলে দিতে সবচেয়ে সক্ষম নন? কিন্তু আমরা ভুলে যাই। প্রবৃত্তির উপাসনা আমাদের ভুলিয়ে দেয়। ফলে আমরা নিজেরা নিজেদের অনাচারের ফসলস্বরূপ অসফলতার এমন অতল গহ্বরে নিক্ষেপ করি যেখানে থেকে বেরিয়ে আসার উপায় আমরা নিজেরাই জানিনা। স্বভাবজাতভাবে একটি অসাধারন সুন্দর সৃষ্টি মানুষ। তাকেই আমরা পৌঁছে দেই এমন এক পর্যায়ে যেখানে পশুও অবতরণ করেনা।
এই কথাটি আমাদের প্রভু আমাদের জানিয়েছেন সূরা ত্বীনে, ‘আমি মানুষকে সুন্দরতম অবয়বে সৃষ্টি করেছি। অতঃপর তাকে ফিরিয়ে দিয়েছি নীচ থেকে নীচে। কিন্তু যারা বিশ্বাসস্থাপন করেছে এবং সৎকর্ম করেছে তাদের জন্য রয়েছে অশেষ পুরস্কার’ (আয়াত ৪-৬)। তুচ্ছ বস্তু থেকে সৃষ্টি করলেও তিনি আমাদের তুচ্ছ করে সৃষ্টি করেননি, কি অসম্ভবকে সম্ভব করেছেন আমাদের প্রভু! তিনি আমাদের দিয়েছেন সুন্দরতম অবয়ব যেন আমরা একে ব্যাবহার করে নিজেদের নিয়ে যেতে পারি উৎকর্ষের এমন এক স্তরে যেখানে আমরা উচ্চতম সৃষ্টি ফেরেস্তাদের অতিক্রম করতে পারি। কিন্তু এই অসীম সম্ভাবনাকে উল্টোদিকে প্রবাহিত করে আমরা পৌঁছে যেতে পারি নিম্নতম সৃষ্টি, সেই পশুদের চেয়েও নিম্নস্তরে। তাই আমাদের স্রষ্টা আমাদের প্রশ্ন করেছেন, ‘যারা জানে এবং যারা জানে না; তারা কি সমান হতে পারে? চিন্তা-ভাবনা কেবল তারাই করে, যারা বুদ্ধিমান’ (সূরা যুমারঃ আয়াত ৯)।
বোকা এবং বুদ্ধিমানের পরিণাম যেমন পৃথিবীতে সমান হতে পারেনা তেমনই বোকামী এবং বুদ্ধির চর্চাকারীদের পরিণতি পরিমাপ করার জন্যও একটি স্থানকাল নির্ধারিত থাকা উচিত, সেটাই আমাদের পরবর্তী জীবনের অস্তিত্বের প্রতি দিকনির্দেশ করে, সেটাই পুরষ্কার কিংবা শাস্তির যথার্থতার প্রমাণ বটে।
ক’দিন আগে এক বান্ধবীকে ফোন করলাম। ক্যানাডা ১০,০০০ সিরিয়ান উদ্বাস্তুকে আশ্রয় দিচ্ছে। কিন্তু বাঁচার তাগিদে এর বাইরেও অনেকে আসছে যারা সরকারী সহযোগিতা পাচ্ছেনা। এদের জন্য কিছু টাকাপয়সা সংগ্রহ করার ব্যাপারে কি করা যায় পরামর্শ করার জন্য ফোন করা। এখানে এখন চাকরীর আকাল, অনেকে পরিবারেই স্বামীস্ত্রী উভয়ে কর্মচ্যূত। অনেকের নয়মাসকালীন সরকারী ভাতাও শেষের পথে, কিন্তু কর্মসংস্থানের কোন লক্ষণ দেখা যাচ্ছেনা। তিনি বললেন, সম্ভবত তেমন কেউ সহযোগিতা করতে রাজী হবেনা। অপরদিকে একই পরিস্থিতিতে আপতিত অনেক ক্যানাডিয়ানরা, এমনকি একাকী মহিলারা এককভাবে একেকটি পরিবারের বাজারখরচ চালাচ্ছে চুপচাপ! তাই আমি বিশ্বাস করি মানবপ্রকৃতি মূলত উত্তম এবং সৌন্দর্যমন্ডিত – প্রথম তুষারপাতের মত কোমল হৃদয় ছুঁয়ে যাওয়া, বালুকাময় বেলাভূমিকে মসৃন করে দিয়ে যাওয়া স্বচ্ছ সাগরজলের মত উষ্ণ, ধূ ধূ মরুভূমিকে অপরূপ উঁচুনিচু ঢিবিতে পরিণত করা বায়ূর মত নিঃস্বার্থ। কিন্তু এরা পথ খুঁজে পাচ্ছেনা। আর আমরা যারা তাদের পথ দেখানোর কথা তারা স্বার্থপরতার আবর্তে নিজেরাই পথ হারিয়ে বসে আছি। সেই স্বার্থের বৃত্তটা ভেঙ্গে আমরা যদি বেরিয়ে আসতে না পারি তাহলে শুধু তারাই ক্ষতিগ্রস্ত হবেনা যারা পথ না চিনে পথ হারিয়েছে, তারা আরো বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে যারা পথের সন্ধান জেনেও পথে আসতে পারেনি।
বিষয়: বিবিধ
১২৭৭ বার পঠিত, ৮ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
আপনি যে আভাস দিলেন তা আমাদের সমাজেও সূত্রপাত হয়ে গেছে৷প্রতিকারের উপায় চাই৷ ধন্যবাদ৷ বান্দাকেও ধন্যবাদ লেখাটি পোষ্ট করার জন্য৷
মাত্র পড়ে এলাম আপুর লিখাটি। শুকরিয়া শেয়ারের জন্য!
শেয়ার করার জন্য ধন্যবাদ, জাযাকাল্লাহ
কিন্তু লিঙ্কটা জুড়ে দিলে উত্তম হতো!!
মন্তব্য করতে লগইন করুন