এ্যাবরশন বিষয়ে ইসলামী চিন্তা
লিখেছেন লিখেছেন বান্দা ০৬ এপ্রিল, ২০১৫, ১২:৫২:২৪ দুপুর
হাদীসটি আল্লাহ্র রাসূলের (সা থেকে বর্ণনা করেছেন ইবন মাস'উদ (রা। এর প্রথম অংশটি এরকম: "তোমাদের প্রত্যেকের সৃষ্টিকে তাদের মাতৃগর্ভে একত্রিত করা হয় নুতফাহ (পুরুষ ও নারী লিঙ্গ হতে নিঃসৃত তরলের মিশ্রণ) হিসেবে ৪০ দিন, অতঃপর অনুরূপ 'আলাকাহ্ (জমাটবদ্ধ রক্ত) হিসেবে, অতঃপর অনুরূপ মুদ্গাহ্ (মাংসপিন্ড) হিসেবে। অতঃপর একজন ফেরেশতাকে পাঠানো হয় এবং তিনি এতে (ভ্রূণে) রূহ্ ফুঁকে দেন...।"
এ হাদীসটিতে আরও কথা রয়েছে কিন্তু এই স্টেটাসে আমি যেটা লিখতে চাইছি সেটার কনটেক্সট এটুকুই। হাদিসটি থেকে যেটা আমরা বুঝতে পারছি সেটা হোলো যে মানব ভ্রূণ প্রথমে তিনটি ধাপ অতিক্রম করে। প্রতিটি ধাপ ৪০ দিন করে। অতএব এ তিনটি ধাপে ১২০ দিন অতিক্রান্ত হয়। এরপর আল্লাহ্ একজন ফেরেশতাকে পাঠান এবং সেই ফেরেশতা (আ ভ্রূণে রুহ্ (যাকে আমরা আত্মা হিসেবে অনুবাদ করতে পারি) ফুঁকে দেন।
এই হাদীসের আলোকে অ্যাবোরশান বা গর্ভপাত করানোর ইসলামিক বিধানটি আলোচনা করা হয়েছে। অ্যাবোরশানের আলোচনা দুটি ভাগে করতে হবে।
১২০ দিন পূর্ণ হবার আগে - ১২০ দিন বা চার মাস অতিক্রান্ত হবার আগে হাদীসের ভাষ্য অনুযায়ী আমরা বুঝতে পারছি এতে রুহ্ ফোঁকা হয়নি। এই অবস্থায় এই ভ্রূণটি রুহ্হীন অবস্থায় আছে বলে এটি মানুষ হিসেবে বিবেচিত হবে না। এই অবস্থায় এটি কেবল মায়ের দেহে লেগে থাকা একটি মাংসপিন্ড মাত্র। এই অবস্থায় কি অ্যাবোরশান করানো যাবে? এই আলোচনা আবার দুভাগে ভাগ করা দরকার। অ্যাবোরশান কি কোনও প্রয়োজনে করা হচ্ছে নাকি প্রয়োজন ছাড়াই।
প্রয়োজন বলতে এখানে মেডিকেল প্রয়োজন বোঝানো হচ্ছে। অন্য কোনোরকম প্রয়োজন নয়। ৪ মাস অতিক্রান্ত হবার আগেই যদি কোনও বিশ্বস্ত মেডিকেল রিপোর্ট দিয়ে প্রমাণিত হয় যে এই ভ্রূণের কারণে মা-র দেহ সংশয়ের সম্মুখীণ হবে তাহলে 'উলামারা মোটামুটি একমত যে এই ভ্রূণকে সেক্ষেত্রে বের করে ফেলা যাবে।
কিন্তু যদি কোনও প্রয়োজন না থাকে? শিশুর মা অথবা বাবা অহেতুক অ্যাবোরশান করাতে চান (এই অহেতুকতার মধ্যে অর্থনৈতিক বা সামাজিক কারণগুলোও পড়বে)। এ ক্ষেত্রে কী হবে। একদল 'উলামার মত হোলো যেহেতু ১২০ দিন বা ৪ মাস অতিক্রান্ত হয়নি সুতরাং অ্যাবোরশান করানো যাবে। তাদের যুক্তি একই যে যেহেতু এতে রুহ্ আসেনি অতএব এর স্টেটাস কেবল দেহের একটি অংশের। দেহের যে অংশ স্বাভাবিক গ্রোথের মধ্যে পড়ে না যেমন 'আঁচিল বা আব - সেগুলো যেমন ফেলে দেয়া যায় তেমনি এই বাড়তি মাংসপিন্ডকেও ফেলে দেয়া যাবে।
অপর একদল 'আলেম বলছেন যদি কোনও বৈধ মেডিকাল সমস্যা দেখা না দেয় তাহলে এই ভ্রূণকে ফেলা যাবে না। কারণ হিসেবে তারা কুরআনের একটি আয়াতকে নিয়ে এসেছেন। আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়াতা'আলা বলছেন: "অতঃপর আমরা একে তৈরি করেছি নুত্ফাহ্ হিসেবে একটি সুরক্ষিত প্রকোষ্ঠে।" [আল-মু'মিনূন: ১৩]। এখানে আল্লাহ্ মাতৃগর্ভকে একটি সুরক্ষিত প্রকোষ্ঠ (কারার মাকীন) হিসেবে বর্ণনা করেছেন। এ থেকে প্রমাণিত হচ্ছে যে ভ্রূণটি সুরক্ষা পাবার অধিকার রাখে এবং সেই অধিকার আল্লাহ্ তাকে দিয়েছেন। অতএব রুহ্ থাকুক বা না থাকুক - ভ্রূণটিকে সুরক্ষিত রাখতে হবে এবং মানুষের জন্য সেই সুরক্ষা নষ্ট করা বৈধ নয় - যদি না মাতৃদেহের ক্ষতি হবার কোনও সুস্পষ্ট প্রমাণ থাকে।
এবার আমরা দেখব ১২০ দিন অতিক্রান্ত হয়ে যাবার পরের অবস্থাটি।
১২০ দিন অতিক্রান্ত হবার পর - অর্থাৎ গর্ভধারণের ৪ মাস চলে যাবার পর আমরা ধরে নিতে পারি যে এতে রুহ্ চলে এসেছে। এ অবস্থায় এই ভ্রূণটি - যেই ফিজিকাল অবস্থায়ই থাকুক না কেন - মানুষের মর্যাদা পাবে। এই অবস্থায় কোনও ভাবেই অ্যাবোরশান বৈধ হবে না যেহেতু এসময় অ্যাবোরশানের অর্থই হোলো একজন মানুষকে হত্যা করা। মায়ের পেটে আছে বলে বা শারীরিক ভাবে এখনও ম্যাচিউর হয়নি বলে এর ওপর কোনোরকম দ্বিতীয় শ্রেণির মনুষ্যত্ব চাপিয়ে দেয়া যাবে না।
ইন ফ্যাক্ট অবস্থা যদি এতটা সঙ্গীন হয়ে দাঁড়ায় হাইপোথেটিকালি যে মা এবং পেটের শিশুর মাঝে কেবল একজনই বেঁচে থাকতে পারবে - এরকম ক্ষেত্রেও এক দল 'আলেম বলছেন যে এই অবস্থায়ও মা-কে বাঁচাতে পেটের শিশুকে হত্যা করার সিদ্ধান্ত নেয়া যাবে না। তাদের যুক্তি হচ্ছে যে এ ব্যাপারে ইসলামিক প্রিন্সিপ্ল হোলো কখনই একজন মানুষকে বাঁচানোর জন্য আরেকজন মানুষকে মৃত্যুমুখে ঠেলে দেয়ার ব্যবস্থা করা যাবে না।
এই মতের সাথে অবশ্য অনেক 'আলেম একমত নন - অন্তত এই হাইপোথেটিকাল প্রশ্নে। তবে আমার আলোচনার মূল উদ্দেশ্য এই হাইপোথেটিকাল সিচুয়েশানের উত্তর দেয়া নয়। এটা সেনসিটিভ একটি অবস্থা যেটা যখন হবে এবং যার হবে তিনি তার বিশ্বস্ত 'আলেমের সাথে কনসাল্ট করে সিদ্ধান্তে আসবেন।
আমার আলোচনার মূল উদ্দেশ্য হোলো এই যে অ্যাবোরশানের ব্যাপারে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গী তুলে ধরা। এই আলোচনা থেকে দেখা যাচ্ছে কেবল গর্ভধারণের ৪ মাস অতিক্রান্ত হবার আগে এবং কেবল মায়ের কোনও স্পষ্ট শারীরিক সমস্যা দেখা দিলেই অ্যাবোরশানের বৈধতা আছে। নতুবা অন্য সব অবস্থায় অ্যাবোরশান হয় স্পষ্ট হারাম অথবা আলোচনা সাপেক্ষে হারাম। অথচ আমাদের দেশে যে কোনও অবস্থায়ই যত্র তত্র অ্যাবোরশান করিয়ে দেবার প্রথা এখন মোটামুটি প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। মুসলিম পরিবারগুলোতেও এ ব্যাপারে জ্ঞান নেই বললেই চলে। আমরা আশা করব এ ব্যাপারে আমাদের মাঝে সচেতনতা বৃদ্ধি পাবে এবং আমাদের তরুণ সমাজ এই ব্যাপারে আরও সাবধান হবে। নারী পুরুষের সম্পর্ক কেবল বিনোদনের বস্তু নয় - এর রয়েছে সামাজিক দায়িত্বশীলতা ও ইসলামিক বিধিবিধান।
আল্লাহ্ মাতৃগর্ভকে কারার মাকীন বা সুরক্ষিত প্রকোষ্ঠ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। কেমন সেই মা, বাবা ও সমাজ যে আল্লাহ্র তৈরি এই সুরক্ষিত প্রকোষ্ঠকে নষ্ট করতে চায়? আর যে শিশুর মাঝে আল্লাহ্র রুহ্ চলে এসেছে - তার শারীরিক ভুগোল যেমনই হোক না কেন - সে মানুষ। আর মানুষ হত্যা পাপ। আল্লাহ্ রুহকে কুরআনে নিজের রুহ বলেছেন। এই আত্তীকরণ সম্মানসূচক। এমন নয় যে রুহ্ আল্লাহ্র সত্তার কোনও অংশ। বরং রুহের সম্মান বোঝাতেই আল্লাহ্ একে নিজের বলে উল্লেখ করেছেন। এই সম্মানিত রুহকে যেন আমরা অসম্মানিত না করি।
[অধিকাংশ আলোচনা শায়খ সালেহ্ আল-'উসায়মীনের ব্যাখ্যা থেকে নেয়া]
সংগৃহীত
বিষয়: বিবিধ
১৫৫৭ বার পঠিত, ১০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
খুব ভালো যুক্তি বা বিশ্লেষণ। ভালো লেগেছে।
এই কথাটুকু পরিষ্কার না করলে আলোচনাটা ধোঁয়াশাই থেকে যেতো।
আসলে তারাই এবরশন করে, যারা অনৈতিক জড়িয়ে ঝামেলায় পড়ে যায়। আর হা, কিছু মায়ের সমস্যাতো থাকবেই, তাই বলে আমভাবে বিষয়টাকে জায়েজ করে নেবার কোন সুযোগ নেই।
আপনাকে অনেক ধন্যবাদ, সময়োপযোগী বিষয় নিয়ে দারুণ আলোচনা করেছেন। জাযকাল্লাহু খাইর।
যাজাকাল্লাহ ৷ লিখে যান ৷
গতি আরো বেগবান হতো। আমাদের মত মূর্খ
রিডারদের বুঝতে সুবিধা হতো।
মন্তব্য করতে লগইন করুন