দাজ্জালের মহা ফিতনা ও বর্তমান বিশ্বঃ পর্ব-৯ (ডলারের প্রতারনা)

লিখেছেন লিখেছেন কায়সার আহমেদ (কায়েস) ২৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৫, ১১:৩৮:৫৩ রাত



কাগুজে মুদ্রার ইতিবৃত্ত (দাজ্জালের এক শক্তিশালী অস্ত্র)

কাগুজে মুদ্রা বা Paper money কখন ও কোথায় প্রথম ব্যবহার হয় এটা স্পষ্ট নয়, তবে ১৮০০ শতাব্দীতে ব্যাংক নোট প্রথমে দেখা যায়, ১৮৭০-১৯১৭ পর্যন্ত Classical gold standard কাগুজে মূদ্রা ব্যবস্থা ছিল। অর্থাৎ সেন্ট্রাল ব্যাংক প্রথমে গোল্ড জমা করে রাখবে আর যত টুকু গোল্ড তাদের কাছে আছে ততটুকু কাগুজে মুদ্রা ছাপাবে (১০০% রিজার্ভ অনুপাত)। মানে কাগুজে টাকা হল একটা ‘চেক’ যা দিয়ে সব কিছু ক্রয় করা যাবে আর প্রয়োজনে ব্যাংকে জমা দিয়ে তার বিনিময়ে চেকে উল্লেখিত মূল্যের গোল্ড দাবী করা যাবে।

আমরা বলতে পারি

২০ ডলারের বিল (চেক/টাকা)=২০ ডলার গোল্ড। (১০০% রিজার্ভ)

তো এখানে এমন কোন সুযোগ নেই যে সরকার চাইলেই যতইচ্ছা চেক বা কগুজে মুদ্রা প্রিন্ট করতে পারে, কারন যদি বেশি ছাপিয়ে দেয় তবে চেক/টাকা বিনিময়ে গোল্ড ফিরত দিতে পারবে না।

এভাবেই চলছিল কিন্ত ১ম বিশ্ব যুদ্ধ শুরু হলে মানুষ আর ব্যংকে যেতে পারতো না ফলে কাগুজে মুদ্রার বিনিময়ে গোল্ড পরিবর্তন করা কমে গেল আর চেক/কাগুজে মুদ্রার টাকা দিয়ে সবাই লেনদেন করা শুরু করলো, আর এই সুযোগে সরকার পাগলের মত মুদ্রা ছাপাতে লাগলো। এতে ইউরোপীয় দেশসমূহ মুদ্রাস্ফীতির সম্মুখীন হয়, আর জার্মানি তে Hyperinflation দেখা দেয়, জার্মান মার্কের মান এত কমে যায় যে একটা পত্রিকার দাম ১ মার্ক থেকে ১ বছর পর ৭ কোটি মার্ক হয়ে যায়, আর অনেকে কয়লার দাম বেশি হওয়ায় মার্ক/টাকা পুরিয়ে খাবার রান্না করে। তাই ১৯১৬-১৯৪৪ পর্যন্ত আগের ১০০% রিজার্ভ সিস্টেম বাতিল হয়ে গিয়ে নতুন ব্যবস্থা চালু হল Gold Exchange Standard অর্থাৎ কত টুকু কাগুজে মুদ্রার বিনিময়ে ব্যাংক থেকে কতটুকু গোল্ড দাবী করা যাবে, সেটা কেন্দ্রীয় ব্যংক নির্ধারণ করবে।

Classical gold standard --

২০ ডলারের বিল (চেক/টাকা)= ২০ ডলার গোল্ড। (১০০% রিজার্ভ)

বদলে গিয়ে

Gold Exchange Standard ---

৫০ ডলারের বিল (চেক/টাকা)= ২০ ডলার গোল্ড। (৪০% রিজার্ভ)

যুদ্ধের সময়ে যুদ্ধের অংশগ্রহণকারী ও যুদ্ধবিধ্বস্ত সকলদেশের প্রচুর নিত্যপন্য ও অস্ত্রের প্রয়োজন ছিল আর যেহেতু অ্যামেরিকা উভয় বিশ্বযুদ্ধেই প্রায় শেষের সময়ে অংশগ্রহণ করে তাই প্রয়োজনীয় মেটেরিয়ালস এর সামগ্রিক যোগান দাতা হয়ে গেল আমেরিকা। সে সময়ে স্বর্ণের মাধ্যমে বৈদেশিক বাণিজ্য হত তাই আমেরিকা খুব অল্প সময়ে অর্থনীতিক ভাবে অনেক লাভবান হল, আর পন্যের বিনিময়ে বিশ্বের ২/৩ (Central Bank gold) স্বর্ণের রিজার্ভ কারী দেশ হয়ে গেল। আমেরিকার জাতীয় আয় (National Income) অকল্পনীয় ভাবে বেড়ে ১৯৩৩ সালে -৪৬ বিলিয়ন, থেকে ১৯৩৯ সালে- ৭১ বিলিয়ন পরে তা ১৯৪৩ সালে- ১৪২ বিলিয়নে পৌঁছল অর্থাৎ মাত্র ১০ বছরে ৩ গুন আয় বৃদ্ধি পেল।

“যুদ্ধ অর্থনীতির জন্য খুব ভালো, যদি তুমি যুদ্ধের বাহিরে থেকে পন্য ও অস্ত্রের যোগান দাও” এই নীতিতে বিশ্বাসী আমেরিকা তাই করলো যুদ্ধে লাগাতে উস্কানি ঠিকি দিত তবে যুদ্ধে জড়াত না যখন ফায়দা লুটা হয়ে যেত তখন আরও বেশী করে লুটার জন্য যুদ্ধ শামিল হয়ে জয় ছিনিয়ে নিত। প্রথম ও দ্বিতীয় উভয় বিশ্বযুদ্ধে আমেরিকা তাই করলো।

যাইহোক, বাকি পুরো দুনিয়ার কাছে মাত্র ১ ভাগ স্বর্ণ রিজার্ভ থাকার কারনে ইউরোপের কোন দেশ আর আগের মত গোল্ড রিজার্ভ রেখে কাগুজে মুদ্রা ছাপাতে পারলো না ফলে পুরো বিশ্ব মনেটারি সিস্টেম আবার পতন ঘটলো। আর এর মধ্যেই আমেরিকা প্রচুর ডলার (কাগুজে মুদ্রা) ইউরোপের বাজারে ছেঁড়ে দিল।

এইভাবেই ১৯৪৪ সালে একটি কনফেরেন্স ডেকে সকলের সম্মতি তে ডলার এর উপর ভিত্তি করে ব্রিটন উড (Bretton Woods) নামে একটি নতুন বিশ্ব মনেটারি/মুদ্রা সিস্টেম চালু হল।

Gold Standard সিস্টেমে

সকল দেশের সেন্ট্রাল ব্যাংক তাদের নিজস্ব কারেন্সি ছাপায় গোল্ড রিজার্ভ রেখে। যেমন-বাংলাদেশের টাকা/জাপানী ইয়েন/ডলার = গোল্ড (১ টাকার বিনিময়ের জন্য ব্যাংক তত পরিমাণ গোল্ড সংরক্ষণ করতো)

আর নতুন প্রণীত Bretton Woods Agreement সিস্টেমে

(বাংলাদেশের টাকা/জাপানী ইয়েন/ডলার) = গোল্ড।

বদলে গিয়ে হয়ে গেল

(বাংলাদেশের টাকা/জাপানী ইয়েন)= ডলার = গোল্ড

সহজ ভাষায় গোল্ড আগে যে কাজ করত এখন ডলার তা করছে, গোল্ডের জায়গা ডলার দখল করেছে। হুম যদিও সিস্টেম অনুযায়ী আমেরিকার সেন্ট্রাল ব্যাংক ডলার ছাপানোর আগে অবশ্যই তার পিছনে গোল্ড সংরক্ষণ (রিজার্ভ) করবে।

তবে সেই রিজার্ভের কোন নির্দিষ্ট অনুপাত নির্ধারণ করা ছিল না যেমনটা আগে ছিল ১০০% রিজার্ভ অথবা ৪০%। তাই আমেরিকা ইচ্ছা মত ডলার ছাপালো আর এক্সপোর্ট করা শুরু করলো। ১৯৬০ এর দশকে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট চার্লস ডিগল প্রথমে উত্থাপন করেন যে ডলার এর পিছনে গোল্ডের রিজার্ভ নেই মানে ০% রিজার্ভ। ফলে ফ্রান্স তাদের কাছে যত ডলার ছিলো তার বিনিময়ে গোল্ড দাবী করে আমেরিকার কাছে আমেরিকাও বাধ্য হয়ে গোল্ড দেই, তবে এইভাবে একে একে আরো সকল দেশ ও চেয়ে বসল তখন আমেরিকা বিপাকে পড়ল। ডলারের প্রতি সকলের বিশ্বাস ও ভ্যালু মান কমা শুরু হল।

আমেরিকা তাদের কাছে গোল্ডের মজুদের চেয়ে ১২ গুন বেশি ডলার ছাপিয়ে ছিল। ফলে ১৯৫৯-১৯৭১ সালের মধ্যে আমেরিকা ৫০% তাদের সংরক্ষিত গোল্ডের মজুদ হারালো। পরিশেষে ১৯৭১ সালে প্রেসিডেন্ট রিচারড নিকসন, ডলারের সাথে গোল্ড রূপান্তরকে বাতিল করল এবং প্রস্তাব করল যে International Monetary fund (IMF) এর সহযোগিতাই আমেরিকা প্রয়োজনীয় মাফিক ডলার ছাপাবে আর একটি নতুন মনেটারি সেস্টেম তৈরি করবে। তখন আবার Bretton Woods Agreement বাতিল হয়ে আবারো নতুন মনেটারি সেস্টেম আসলো যার নাম Dollar Standard

Bretton Woods Agreement সিস্টেমে

(বাংলাদেশের টাকা/জাপানী ইয়েন/ডলার) = গোল্ড।

আর নতুন প্রণীত Dollar Standard

(বাংলাদেশের টাকা/জাপানী ইয়েন)= ডলার

(বেচারা হাজার হাজার বছর ধরে এক্সেচেঞ্জ হিসেবে চলে আসা গোল্ডকে বাতিল করে একটা সাধারণ পন্য বানিয়ে দেয়া হল)



আবার সে সময়ে অ্যামেরিকা বিশ্বের সবচেয়ে বড় তেল উৎপাদনকারী ও ব্যবহারকারী ছিল ফলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে তেলের দাম US Dollar এই নির্ধারণ করা হত। তাই তখন ডলার এর ভ্যালু কমা থেকে নিস্তারের জন্য রিচার্ড নিক্সন সৌদি আরবের সাথে ঐকমতে এসে একটা চুক্তি সম্পাদন করে। চুক্তি অনুয়ায়ি-এর পর থেকে তেল শুধু ডলারের মাধ্যমেই কিনা যাবে অন্য কোন কারেন্সি বা সম্পদ দিয়ে নয়, তো এর পরে পর্যায়ক্রমে OPEX এর সকল দেশ এই চুক্তির সাথে একমত হয়ে যায় আর তারপর থেকে ডলার পেট্র-ডলারে রূপান্তর হয় ফলে US Dollar এর চাহিদা বাড়তে থাকে আর আমেরিকা তাদের অতিরিক্ত ছাপানো (মুদ্রাস্ফীতি) কাগুজে ডলার অন্য দেশে রপ্তানি শুরু করে।

অর্থনীতিবিদ মাইক মালনি বলেন আমেরিকা তাদের ইনফ্লেশন কেই বিক্রি করে। তারা যত ইচ্ছা ডলার ছাপাই আর অন্য দেশের কাছে তা বিক্রি করে, এই ক্ষেত্রে তাদের তেমন কোন জবাবদিহিতা নেই। তেমনি আমাদের সম্পদ তারা শুধু কিছু টুকরো কাগজের বিনিমরে কিনে নিচ্ছে, সৌদি আরব ও অন্যান্য সকল দেশের তেল কিনে বিনিময়ে কাগজ ছাপিয়ে দিয়ে দেই, তাদের কোন চিন্তা নেই, এই ভাবেই মুসলমানদের সম্পদ তারা হাতিয়ে নিচ্ছে। আবার যখন ইচ্ছা বেশি ছাপিয়ে মুদ্রাস্ফীতি করে দেই ফলে গরিব দের সম্পদ কে টেনে নিয়ে নেই, তাই মুদ্রাস্ফীতি/Inflation কে আমরা ম্যাক্রো লেভেলের সুদ বলতে পারি, যা সময়ের সাথে সাথে মানুষের টাকা গ্রাস করে নিচ্ছে। আমেরিকান ডলারের এত মুদ্রাস্ফীতি হয়েছে যে ১৯১৩ সালে যে কাগুজের মুদ্রার মুল্যমাণ ছিল ১ ডলার এখন তা হয়ে গেল ০ (শূন্য), (১৯১৩ সালে ১ ডলার=১ ডলার আর ২০১৩ সালে সেই ১ ডলার=০ ডলার)

আল্লাহ তায়ালা বলেছেন,“তোমরা একে অন্যের সম্পদ অন্যায় ভাবে গ্রাস কর না” (সূরা বাকারা-১৮৮)

অন্যভাবে বললে বর্তমানে ক্রুড তেল ই আগের গোল্ড এর জায়গা নিয়ে নিল। তখন সেই হাদিস টি খুব স্পষ্ট হয়ে গেল যেখানে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ

.

‘‘তত দিন পর্যন্ত কিয়ামত প্রতিষ্ঠিত হবেনা যতদিন না ফুরাত নদী থেকে একটি স্বর্ণের পাহাড় বের হবে। মানুষেরা এটি দখল করার জন্যে যুদ্ধে লিপ্ত হবে। এ যুদ্ধে শতকরা নিরানববই জনই নিহত হবে। তাদের প্রত্যেকেই বলবেঃ আমিই এযুদ্ধে রেহাই পাবো এবং স্বর্ণের পাহাড়টি দখল করে নিবো’’ [বুখারী, অধ্যায়ঃ কিতাবুল ফিতান]

অর্থাৎ এখানে বর্তমান তেলের কথাই বলা হয়েছে যা ফুরাত নদীর আশেপাশে থেকেই বের হয়েছিল। আর একে নিয়েই মধ্যপ্রাচ্যে মারামারি শুরু হল যা এখনো চলছে। আমরা জানি দাজ্জালের কাছে সম্পদের অসংখ্য পাহাড় থাকবে। তারই প্রস্তুতি হিসাবে ইহুদীরা পৃথিবীর সমস্ত সম্পদকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নিচ্ছে এই মুদ্রা ব্যবস্থার মাধ্যমে। (আল্লাহু আলাম)

চলবে.......

------“আল্লাহুম্মা আরেনি আল আশ’ইয়া'আ কামা হিয়া” (হে

আল্লাহ আমাদের প্রত্যেক জিনিসের আসল রূপ দেখাও যাতে বাহিরটা দেখে প্রতারিত না হই)



বিষয়: বিবিধ

১৫৪৮ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File