এক হাজার ও আরও একটি ধর্ষণ !!
লিখেছেন লিখেছেন চক্রবাক ০৫ এপ্রিল, ২০১৪, ০৪:২৫:০২ বিকাল
একটি ধর্ষণ নয় অনেকগুলো নিয়েই বলছি। হুমায়ুন আজাদের “এক হাজার ও আরও একটি ধর্ষণ” লেখাটিতে তৎকালীন সমাজে নারী নির্যাতনের স্বরূপ ফুটিয়ে তুলতে গিয়ে ইসলাম ধর্মের মৌলবীদের অন্য এক এঙ্গেলে ফুটিয়ে তুলেছিল। আজ আমরা দেখব একই বিষয়বস্তুকে কিভাবে অন্য এঙ্গেলে প্রমান করা যায়।
বর্তমান সমাজের দিকে তাকালে আমরা নারী নির্যাতনের যে হার দেখতে পাই তা সমাজের উন্নতির জন্য কতটুকু বাঁধা আমরা সেটাই আগে ভাবি, কিন্তু কজন ভাবে সমাজের এই অসঙ্গতির কারণ কি ? আমরা যখন মিডিয়াতে নারী নির্যাতনের চিত্র দেখতে পাই তখন খুব ব্যথা অনুভব করি। কিন্তু যখন নিজের ছেলে কিংবা কোন আত্মীয় এর সাথে সম্পৃক্ত থাকে তখন কি করি ? তাকে বাঁচানোর জন্য বিভিন্ন জায়গায় ধরনা দেই। এটাই নীতি, মজ্জায় মজ্জায় ঢুকে গেছে স্বজনপ্রীতি, আত্মপূজা ! বাংলাদেশে ইদানিং যে পরিমানে নারী নির্যাতন হচ্ছে তার একমাত্র কারন যে বিজাতীয় সাংস্কৃতিক আগ্রাসন তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। যে হারে দেশের আনাচে-কানাচে ধর্ষণের ঘটনা চোখে পড়ছে, তাতে ইউরোপ-আমেরিকা, ভারতের মতো বাংলাদেশও এখন ধর্ষণপ্রবণ এলাকা হিসাবে গণ্য হচ্ছে। জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির জরিপে দেখা গেছে, দেশে শুধু ২০১২ সালে ৮১৪ এবং ২০১৩ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৫৫৫টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। সংগঠনটির জরিপ মতে, ধর্ষণের ঘটনায় ৭০ শতাংশেরই মামলা হয় না আর ৬০ শতাংশ মামলায় কোনো শাস্তি হয় না।
সমিতির সভাপতি ফাওজিয়া করিম বলেন, ধর্ষণের শাস্তি হয় খুবই কম। মানবাধিকার নেত্রী মাহবুবা হক কুমকুম বলেন, ধর্ষণের অধিকাংশ ঘটনা নিয়ে রাজনীতি করা হয়, যার জন্য বিচার ঠিকমতো করা যায় না।
যেখানে রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বরা সমাজের অসঙ্গতিগুলো দূর করবে, সেখানে তাদের ছায়াতলেই কাজগুলো হচ্ছে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের এক নেতা ছাত্রীধর্ষণের সেঞ্চুরি পূর্তি উৎসবে বন্ধুদের মিষ্টিমুখ করিয়েছে এটা কার না জানা ? ঢাকায় ইডেন মহিলা কলেজের ছাত্রীনিবাস থেকে ‘উপঢৌকনস্বরূপ’ কোনো কোনো নেতার বাসায় জোর করে ছাত্রীদের পাঠানো হয়েছে বলে আমরা পত্রিকায় এ খবরও পড়েছি। ভিকারুন নিসা নূন স্কুলশিক্ষক, যৌনসন্ত্রাসী পরিমল জয়ধরকে (ছাত্রলীগ নেতা) এখনো কেউ হয়তো ভুলে যাননি। এছাড়াও অতীতের আরও অনেক ঘটনার কথা শুনলে গা এখনো শিউরে উঠে, হয়। ১৯৯৫ সালের ৭ জুন ভোলার বোরহান উদ্দীনের কুতুব গ্রামের ১৬ বছরের জমিলা তার বোনের বাড়ি থেকে ফেরার সময় ধর্ষণের শিকার হয়। ২০০২ সালের ১৯ এপ্রিল ধর্ষণ করা হয় রংপুরের পীরগঞ্জে ৮ বছরের শিশু আসমা খাতুনকে। ২০০৪ সালে ১১ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর মিরপুর ১৪ নম্বরে কালাপানি এলাকায় পাঁচ যুবক মিলে আলমিদা খাতুনকে গণধর্ষণ করে। একই বছর ২০ এপ্রিল সাত বছরের শিশু পিংকিকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়।
ধর্ষণে পিছিয়ে নেই আমাদের আইন শৃঙ্খলা বাহিনীও ১৯৯৫ সালে ঢাকা থেকে ফেরার পথে দিনাজপুরগামী কিশোরী ইয়াসমিন বাড়ি পৌঁছার জন্য পুলিশের আশ্রয় নিয়েছিল; সেই আশ্রয়দাতা পুলিশ সদস্যরাই উপর্যুপরি গণধর্ষণের পর তাকে হত্যা করে। কয়েক দিন আগে গাইবান্ধায় কয়েকজন পুলিশ সদস্য পাশবিকভাবে একটি শিশুকে গণধর্ষণ করেছে। এ ছাড়া প্রকাশিত-অপ্রকাশিত শত শত ধর্ষণের ঘটনা আমাদের দেশে ঘটে চলেছে। শিক্ষক ছাত্রীকে ধর্ষণ করেছে, রিকশাওয়ালা পথের শিশুকে ধর্ষণ করেছে, মাতবরের ছেলে পাশের বাড়ির গরিব প্রতিবন্ধী মেয়েকে এবং গৃহকর্তা কাজের মেয়েকে ধর্ষণ করেছে ইত্যাদি। শহরে এবং গ্রামে সর্বত্র রাজনৈতিক দলীয় (বিশেষত ক্ষমতাসীন) ব্যানারের দুর্বৃত্তরা ইচ্ছেমতো ধর্ষণ করছে। আবার অনেকে ধর্ষিতাকে হত্যাও করেছে। কিন্তু এত কিছু ঘটার পরও আমরা কয়টা ধর্ষণের বিচার হতে দেখাছি ? লোকলজ্জা কিংবা রুই কাতলাদের ভয়ে অনেকে তো মামলা করতেই আসেনি, করবে কিভাবে রক্ষকই যেখানে ভক্ষক। ধর্ষণের পর তা ধামাচাপা দেয়ার ঘটনা কি আমারা কম দেখাছি ? কিন্তু প্রশাসন বোধয় দেখেনি !! আর এগুলো কিন্তু মৌলবি/তার ছেলেরা করে নি, করেছে করেছে আধুনিক শিক্ষিতরাই (সবাই নয়)। বার থেকে মাতলামি করে এসে জৈবিক চাহিদা মেটানো তাদেরই সংস্কৃতি। এতক্ষন তো সুধুমাত্র ঘটনা দেখালাম এবার কারণ ও সম্ভাব্য প্রতিকার...
সাংস্কৃতিক আগ্রাসনঃ
বর্তমানে বহুজাতিক কোম্পানি গুলো তাদের ব্যবসার ক্ষেত্রে পেশিশক্তির চেয়ে প্রতারণা বা কৌশলের ব্যবহারও করছে অধিক হারে। কৌশল ফলপ্রসূ এবং ঝামেলামুক্ত বলেই হয়তো এর প্রয়োগ বেড়ে গেছে আশাতীতভাবে। কেননা কৌশল প্রয়োগের মাধ্যমে নারীকে খুব সহজে বশে এনে ইচ্ছে মতো ব্যবহার করা যায়। আর সে কৌশলগুলোর মধ্যে রয়েছে ফ্যাশন শোর আয়োজন, বিজ্ঞাপনী সংস্থা তৈরি, সুন্দরী প্রতিযোগিতা, নাটক-সিনেমায় অভিনয়ের প্রশিক্ষণ ইত্যাদি। এভাবেই নারীকে বাজারযাত করনের মাধ্যমে কোম্পানিগুলো মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নেয়। আর আড়ালে সংঘটিত যৌন হয়রানির চিত্র না’হয় অস্পষ্টতই থাক ! টিভি বিজ্ঞাপনগুলোর বেশির ভাগ বিজ্ঞাপনে যৌনতার অশ্লীল ছায়া রয়েছে, যেটা আমাদের চক্ষুর অন্তরালে নয়। নারীকে যৌন আবেদনময়ী করে উপস্থাপন করা এবং সেই সুবাদে মানুষের রুচিকে বিকৃত রুচির সিদ্ধি অর্জন সমাজে বিরল নয়। এভাবে নারীর অধিকার ও স্বাধীনতার নামে যা করা হচ্ছে তা গোষ্ঠীবিশেষের উদ্দেশ্য চরিতার্থ করা ছাড়া আর কিছুই নয়। আমাদের টেক্সট বুকে শিশুদের যে যৌনাচারন শিক্ষা দেয়া হচ্ছে, সেটা আমাদের অবক্ষয় নয় কি ?
কুসংস্কৃতির বেড়াজাল ইউরোপ-আমেরিকার অপসংস্কৃতির হাওয়া লেগেছে আমাদের পরিবারগুলোতে। পর্নোগ্রাফিতে ছেয়ে গেছে সমাজ। স্যাটেলাইটের দৌরাত্ম্যে ঘরে ঘরে হলিউড, বলিউড আর ঢালিউডের বেহায়াপনা। রাস্তায় বের হলেই চোখে পড়ে দেয়ালে, বিলবোর্ডে নানা ধরনের যৌনউত্তেজনাকর পোস্টার ! আপনারা কি যুবশ্রেণীকে যৌনরোগী ভাবেন নাকি ? ভারতের বিনোদন জগৎ যখন সীমানা পেরিয়ে বাংলায় পদার্পণ করে তখন আমার কাছে ওটাকে সম্রাজ্যবাদিদের থাবা ছাড়া সংস্কৃতি মনে হয় না। যেটা আমাদের যুবসমাজকে খুবলে খুবলে খাচ্ছে। সানী লিওন যখন কোন দেশের আইডল তখন সে দেশের সংস্কৃতি আমাদের কি শিক্ষা দিতে পারে ধর্ষণ ছাড়া ? যাদের জন্মই মজার জন্য তাদের কাছে সনন্দের গভীরে যাওয়ার অভিপ্রায় অমঙ্গলের হবে কেন ? আর যৌনতা তো তার অন্তে। গ্রীক সভ্যতা যখন আধুনিকতাবাদের অন্যতম হাতিয়ার, তখন যৌনতার কনসেপ্টটা আধু হবে না কেন সে অভিপ্রায়ই বোধয়... আর আমাদের যুবসমাজও আধুনিকতাকামী কিনা তাই ! বিজ্ঞাপনে নারীর শরীর প্রদর্শনের স্বতঃস্ফূর্ততা দেখে যে কারো মনে হতে পারে যে, লাখো মানুষের যৌনানুভূতিতে সুড়সুড়ি সৃষ্টি করতেই বোধয় তাদের জন্ম। বহুজাতিক কোম্পানিগুলো উচ্চাকাক্সী ও মূল্যবোধহীন তরুণ-তরুণীদের টাকা ও প্রতিষ্ঠার লোভ দেখিয়ে পণ্য হিসেবে ব্যবহার করে আসছে এবং তাদের প্রলোভনে পড়ে বিচার-বিবেকহীন তরুণীরাও বেআব্রু হতে সঙ্কোচবোধ করছে না। এতে সমাজে যে যৌনউপনিবেশ সৃষ্টি হচ্ছে; তার প্রভাবে যে নিরপরাধ নারী ও শিশু যৌন হয়রানি বা ধর্ষণের শিকার হচ্ছে তা কে না স্বীকার করবে ? পরিতৃপ্তি নারী পরিতৃপ্তি সমাজ শ্লোগানটাই বোধয় কোম্পানিগুলোকে রসদ যোগাচ্ছে । কিন্তু আমরা পরিতৃপ্ত নই, সে সব বোনরা পরিতৃপ্ত নয় যাদের ন্যূনতম আত্মসম্মানবোধ রয়েছে। তারা চায় যেখানে একটি সমাজ যেখানে থাকবে না কোন অবক্ষয়, কেউ নিরাপত্তাহীনতায় ভুগবে না, সকলে তার অধিকার নিয়ে বাঁচবে। ভারতের/ইউরোপ-আমেরিকার চাকচিক্যময় নগ্ন সংস্কৃতি বাংলাদেশ থেকে দূরে না সরালে সেটা কখনই সম্ভব নয়। ধর্মীয় মূল্যবোধবিবর্জিত মুম্বাই, হলিউড সিনেমা ও তাদের টিভি চ্যানেলের কল্পকাহিনী আমাদের সমাজে বিষবাষ্প ছড়াচ্ছে। এগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে আমাদের পারিবারিক শান্তি অটুট রাখা দুরূহ হয়ে উঠবে। আর তাই আমাদের সমাজে যৌনতার মেশিনগুলোকে (সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের প্রডাক্ট) অকেজো করতে সমাজের সবাইকে একমত হয়ে সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের বিরোধিতা করতে হবে। ইসলাম ধর্মের মৌলিক দিকগুলোকে মাথায় রেখে পর্দা প্রথাকে চালু করতে হবে। পুরুষের নারীদের প্রতি কূমনোভাব দূর করতে হবে। মৌলবিরা নয় সমাজে অবক্ষয়ের স্রস্টা প্রগতিবাদীরাই। এই প্রগতি যে কি সেটাই বুঝি না। প্রগতিবাদীদের বলছি আপনারা আপনাদের মন মাইন্ড থেকে নারী নামক অবলা বস্তুটিকে দূরে রাখুন, সেখানে স্থান দিন নারী নামক মানুষটিকে যে সমাজে তার আত্মসম্মান নিয়ে বেঁচে থাকবে।
বিষয়: বিবিধ
১৬১৪ বার পঠিত, ১৬ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
অনেক সুন্দর বিশ্লেষণ। ভালো লাগলো ধন্যবাদ
অনেক অনেক ধন্যবাদ আপনাকে সুন্দর একটা বিষয় উপস্থাপন করার জন্য।
বর্তমানে সৌদি আরবেই ধর্ষণের হার সবচেয়ে কম, সে ক্ষেত্রে আমি ঐ প্রশ্নটুকু করতে পারি এক্সেপ্সন এক্সজাম্পল হওয়ার কতটুকু যোগ্য ??
মন্তব্য করতে লগইন করুন