জাতীয় স্বার্থবিরোধী টিকফা চুক্তি প্রত্যাখ্যান করুন।

লিখেছেন লিখেছেন চক্রবাক ২০ নভেম্বর, ২০১৩, ০৫:৩১:০০ বিকাল



টিকফা কি ?

একেকবার একেক মোড়কে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে টিফা (Trade and Investment Framework Agreement) স্বাক্ষরের পায়তারা চলছে। টিফার হরেক রঙ দেখা যায় কখনও টিইসিএফ (Trade and economic Co-operation forum) ,কখনও টিকফা (Trade and Investment Co-operation Framework Agreement)। নাম যাই হোক, বাণিজ্য সুবিধা, পণ্যের শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার, কৌশলগত স্বার্থ ইত্যাদি বিভিন্ন রঙের চোখ ধাঁদানো সাজে বাংলাদেশের সামনে উপস্থাপন করছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। বাংলাদেশের শাসকরা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নভাবে নাম পরিবর্তন করে জনগণকে বিভ্রান্ত করে চুক্তির ধারা-উপধারা সম্পূর্ণ গোপন রেখে মার্কিন স্বার্থের টিফা চুক্তি স্বাক্ষরের চেষ্টা চলালেও দেশের ভেতরে প্রবল বিরোধীতার কারণে এখন পর্যন্ত জাতীয় স্বার্থ বিরোধী এই চুক্তি স্বাক্ষর করতে সক্ষম হয় নি। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে গার্মেন্টস সেক্টরে মালিক শ্রেণীর সীমাহীন মুনাফাবাজির কারণে সৃষ্ট বিপর্যয়ের সংকটকে কাজে লাগিয়ে কথিত জিএসপি সুবিধা অক্ষুন্ন রাখার প্রয়োজনীয়তার কথা তুলে আবারও টিকফা নামে টিফা চুক্তি স্বাক্ষরের পায়তারা করছে। টিকফা চুক্তি স্বাক্ষর হলে দেশের অর্থনীতি, রাজনীতি ও সামরিক ক্ষেত্রে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের শোষণ-নিপীড়ন ও আধিপত্য বহু গুণ বৃদ্ধি পাবে। এ চুক্তির জন্য জাতিকে বহুযুগ ধরে ভয়াবহ মাশুল গুণতে হবে।

টিফা থেকে টিকফা

যুক্তরাষ্ট্র ২০০১ সাল থেকে প্রায় দশ বছর ধরে বাংলাদেশে টিফা (Trade and Investment Framework Agreement) বাস্তবায়নের চেষ্টা করে। অসংখ্য বার দুই দেশের মধ্য এর খসড়া আদান প্রদান হলেও কোন সরকারই তা বাস্তবায়নে সফল হয়নি। ব্যাপক সমালোচিত এবং জনগনের কাছে প্রত্যাখ্যাত এই টিফা পরিবর্তিত আকারে টিকফা (Trade and Investment Cooperation Framework Agreement) নামে বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়া হয় হিলারী ক্লিনটনের সাম্প্রতিক সফরে। সরাসরি না বললেও চুক্তিটি যে প্রায় ১০ বছর ধরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক বাংলাদেশের উপর চাপিয়ে দিতে চাওয়া টিফা চুক্তিরই ছদ্ম নাম সেটা অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত এর কথা থেকে স্পষ্ট হয়: “তাড়াহুড়ো করে এ চুক্তি করা হচ্ছে না। দীর্ঘ প্রায় দশ বছর ধরে এর প্রক্রিয়া ও এ সংক্রান্ত পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে এর একটি খসড়া তৈরি করা হয়েছে” গত ২৬-০৭-২০১১ তারিখে প্রথম আলো লিখেছে : “প্রায় ১০ বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ রূপরেখা চুক্তিটি (টিফা), শেষ পর্যন্ত তা করা হয়নি। এর বদলে টিইসিএফ করা হচ্ছে টিফার আদলেই। টিফা নামটি যুক্তরাষ্ট্র দিয়ে থাকলেও নতুন নামের প্রস্তাবটি দিয়েছে বাংলাদেশই। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।”

বৈশ্বিক টিফা



চুক্তিটি যুক্তরাষ্ট্র শুধুমাত্র বাংলাদেশের জন্যই তৈরি করে নি বরং তাদের সম্রাজ্যবাদি হাত যেন বিশ্ব ব্যপি ছড়িয়ে পড়ে তার সুদূরপ্রসারী চিন্তা নিয়েই তৈরি, বাংলাদেশকে গুরুত্বপূর্ণ একটি খাত হিসেবে ধরা যেতে পারে। চুক্তিটির ধারাগুলো সম্রাজবাদিদের কয়েকটি বিষাক্ত ক্যাপ্সুল বলা যেতে পার

থাইল্যান্ড এবং শ্রীলঙ্কায় টিফা

থাইল্যান্ড টিফা চুক্তি করে ২০০২ সালের অক্টোবরে। চুক্তি স্বাক্ষরের পর থেকেই থাইল্যান্ডকে বাধ্য করা হতে থাকে আমেরিকার কর্পোরেট মনোপলির স্বার্থে এর বিভিন্ন সেবা খাত বেসরকারী করে দিতে। Electricity Generating Authority of Thailand (EGAT) বেসরকারী করণের উদ্যোগ নেয়া হয়। শুধু তাই নয়, EGAT বিক্রির পরমর্শক দের মধ্যে অন্যতম কর্পোরেশনMorgan Stanley, Citigroup and JP Morgan Chase and Co. অন্যান্য রাষ্ট্রায়াত্ব প্রতিষ্ঠান যেমন: Metropolitan Waterworks Authority, Provincial Waterworks Authority, the Government Pharmaceutical Organization, the Port Authority of Thailand, the Expressway and Rapid Transit Authority of Thailand ইত্যাদি বিক্রি করে দেয়ার উদ্যোগ নেয়। জনগণের তীব্য আন্দোলন সংগ্রাম এর কারণে এগুলো এখন বাস্তবায়ন করতে পারেনি। শুধু তাই নয়, ১৯৯৯ সাল থেকে থাইল্যান্ড জেনিটিক্যালী ইঞ্জিনিয়ারড বীজ আমদানীর উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে, মুক্ত বাণিজ্যের নামে মনসান্টোর বিটি কটন আর রাউন্ড আপ রেডি কর্ন থাইল্যান্ডের বাজারে ঢুকানোর জন্য আমেরিকা ব্যাপক চাপ প্রয়োগ করছে। আবার ইন্টেলেকচুয়াল প্রপার্টি রাইটস এর আওতায় থাইল্যান্ডের সুগন্ধি চাল জেসমিন এর ও পেটেন্ট করার চেষ্টা চলে। আবার শ্রীলঙ্কার সাথে ২০০২ সালে টিফা চুক্তির সময় আমেরিকা গার্মেন্টস পণ্যের কোটা মুক্ত সুবিধার কথা বললেও বাস্তবে তা না দেয়ার জন্য নানান শর্ত চাপিয়ে দেয় - যেমন রুলস অব অরিজিনের এমন শর্ত যে শ্রীলঙ্কার উৎপাদিত গার্মেন্টস পণ্য তেরী হতে হবে আমেরিকান ফ্যাব্রিক্স ব্যবহার করে, ইন্টেলেকচুয়াল প্রপার্টি রাইটস বাস্তবায়ন ইত্যাদি। ২০০৩ সালে পার্লামেন্ট এ ইন্টেলেকচুয়াল প্রপার্টি রাইটস সম্পর্কিত আইন পাশ করতে গেলে তীব্র বাধার সম্মুখীন হয় এবং এক পর্যায়ে আদালতে মামলা পর্যন্ত হয় এবং আদালত মামলাকারীর পক্ষেই রায় দেন। সর্বশেষ ২০০৯ সালে ৭ম টিফা বৈঠকে আমেরিকা আবার ট্রিপস বাস্তবায়নের ব্যাপারে শ্রীলংকাকে চাপ দেয় এবং সেই সাথে যুক্তরাষ্ট্র থেকে জেনিটিক্যালী মডিফাইড ফুড আমদানীর উপর শ্রীলংকার যে নিষেধাজ্ঞা আছে সেটাও তুলে নেয়ার ব্যাপারে চাপ প্রয়োগ করে।

এরকম উদাহরণের শেষ নেই, যেখানেই টিফা স্বাক্ষরিত হয়েছে সেখানেই এই ধরণের ঘটনা ঘটছে, অবিলম্বে প্রতিরোধ করা না গেলে বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম হওয়ার কোন কারণ দেখছিনা।।

বাংলাদেশে টিফা চুক্তি

আমেরিকা চুক্তিটি স্বাক্ষরের বিষয়ে নাছোড়বান্দা এবং তারা হাল ছেড়ে না দিয়ে বছরের পর বছর ধরে এজন্য সে বাংলাদেশের ওপর ক্রমাগত চাপ দিয়ে চলেছে। এর মাঝে এদেশে ও আমেরিকায় কয়েক দফা সরকার বদল হয়েছে। কিন্তু ‘টিফা’ চুক্তির বিষয়টি সব আমলেই যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে একটি গুরুত্বপূর্ণ এজেন্ডা হয়ে থেকেছে। তারা এমনও বলেছে যে, ‘টিফা’ চুক্তি স্বাক্ষর না করলে বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র সহযোগিতার ওপর তার নেতিবাচক প্রভাব পরবে। যেহেতু বাণিজ্য ও বিনিয়োগ উভয় ক্ষেত্রেই বাংলাদেশের তুলনায় যুক্তরাষ্ট্রের প্রাধান্য ও আধিপত্য প্রশ্নাতীত এবং এই অসামঞ্জস্য পরিবর্তন হওয়ার সম্ভাবনা নেই, তাই ‘বাণিজ্য ও বিনিয়োগের’ স্বার্থ রক্ষার উদ্দেশ্যে করা চুক্তিটির দ্বারা প্রধানত যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক স্বার্থ সংরক্ষণের একতরফা সুবিধা প্রাপ্তির ব্যবস্থা করা হবে এই সমালোচনা নিরসনের জন্য ‘বাণিজ্য ও বিনিয়োগ’-এর সাথে ‘সহযোগিতা’ শব্দ যুক্ত করা হয়েছে। কিন্তু চুক্তিতে যে সব প্রস্তাবনা ও ধারা রয়েছে সেগুলোর জন্য চুক্তিটি অসম ও মার্কিন স্বার্থবাহী।

টিকফা চুক্তির খসড়া

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশের মধ্যকার সম্ভাব্য Trade and Investment Framework Agreement বা TIFA চুক্তির খসড়া

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার-

১) দুই দেশের মধ্যকার বন্ধুত্বের বন্ধন ও সহযোগিতার চেতনা উন্নত করার আকাঙ্খা পোষণ করে;

২) ক্রমবর্ধমান বাণিজ্য ও বিনিয়োগ এর মাধ্যমে উভয় দেশের জনগণের বৃহত্তর কল্যানের জন্য কাজ করতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ;

৩) উভয় দেশের আন্তর্জাতিক বাণিজ্য এবং অর্থনৈতিক আন্তঃসম্পর্ক আরো এগিয়ে নেয়ার আকাঙ্খা পোষণ করে;

৪) আন্তর্জতিক বাণিজ্য ও বিনিয়োগে স্বচ্ছতা বৃদ্ধির আকাঙ্খা পোষণ করে;

৫) আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ও বিনিয়োগের অবাধ পরিবেশ তৈরীর গুরুত্বকে স্বীকৃতি প্রদান করে;

৬) উভয় পক্ষের জন্যই আন্তর্জাতিক বাণিজ্য কার্যক্রম বৃদ্ধি লাভজনক এবং সংরক্ষণবাদী বাণিজ্য প্রতিবন্ধকতা উভয় পক্ষকেই এইসব সুফল থেকে বঞ্চিত করে- এই বিষয়টিকে স্বীকৃতি প্রদান করে;

৭) বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থায় (WTO) উভয় দেশের সদস্য পদের বিষয়টিকে বিবেচনায় রেখে এবং WTO এর প্রতিষ্ঠাতা চুক্তি Marrakesh Agreementএবং অন্যান্য চুক্তি ও সমোঝাতা এবং এর সাথে সম্পর্কিত ও এর পৃষ্ঠপোষকতার আওতায় থাকা অন্যান্য ইন্সট্রুমেন্ট ইত্যাদির আওতার মাঝে প্রত্যেক পক্ষের নিজস্ব অধিকার ও বাধ্যবাধকতার বিষয়গুলোকে লক্ষ্য রেখে;

৮) প্রবৃদ্ধি, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, বাণিজ্য বিকাশ, প্রযুক্তি উন্নয়ন এবং অর্থনৈতিক উন্নয়ন তরান্বিত করা ইত্যাদির জন্য দেশী এবং বিদেশী উভয় ধরণের বেসরকারী বিনিয়োগের আবশ্যিক ভূমিকার বিষয়টিকে স্বীকৃতি প্রদান করে;

৯) দুই দেশের মধ্যকার বেসরকারী খাতের কন্ট্রাক্টকে উৎসাহিত করা এবং সুবিধাদি দেয়ার ইচ্ছা পোষণ করে;

১০) বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বিষয়ক সমস্যাগুলোর যত দ্রুত সম্ভব সমাধানের আকাঙ্খাকে স্বীকৃতি প্রদান করে;

১১) বিনিয়োগ বিষয়ে পারস্পরিক অনুপ্রেরণা এবং সংরক্ষণের বিষয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের মাঝে মার্চ ১২, ১৯৮৬ সালে স্বাক্ষরকৃত চুক্তির (Bilateral Investment Treaty) স্বীকৃতি প্রদান করে;

১২) এই চুক্তি প্যারাগ্রাফ ১১ তে উল্লেখিত চুক্তির আওতায় উভয় পক্ষের অধিকার ও বাধ্যবাধকতাগুলোকে অস্বীকার করে না;

১৩) দ্বি-পাক্ষিক সম্পর্ক ও উভয়ের অর্থনীতিতে সেবা খাতের বাণিজ্য বৃদ্ধির গুরুত্ব বেড়ে যাওয়ার বিষয়টিকে স্বীকৃতি প্রদান করে;

১৪) উভয় দেশের বাজারে প্রবেশের সুবিধাদি বৃদ্ধি করার জন্য অ-শুল্ক বাধা দূর করার প্রয়োজনীয়তা এবং এর ফলে পারস্পরিক সুফল পাওয়ার বিষয়টিকে বিবেচনায় রাখে;

১৫) বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পত্তির অধিকার বা intellectual property rights (Trade-Related Aspects of Intellectual Property Rights (TRIPS)বিষয়ক চুক্তি বা অন্যান্য বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পত্তি রক্ষার প্রচলিত নীতি ) এর পর্যাপ্ত এবং কার্যকর প্রয়োগ এবং সুরক্ষার গুরুত্ব স্বীকার করে।

১৬) প্রত্যেক দেশের নিজ নিজ শ্রম আইনের পর্যাপ্ত ও কার্যকর প্রয়োগ এবং সুরক্ষা এবং আন্তর্জাতিক ভাবে স্বীকৃত শ্রমিক ব্যবস্থাপনা (labor standards)আরও ভাল ভাবে মেনে চলা গুরুত্ব স্বীকার করে;

১৭) টেকসই উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয় বাণিজ্যিক এবং পরিবেশ বিষয়ক নীতিমালা নিশ্চিত করতে ইচ্ছা পোষণ করে;

১৮) আকাঙ্ক্ষা পোষণ করে যে, এই কাঠামোগত চুক্তি (Framework Agreement) দোহা উন্নয়ন এজেন্ডা সফলভাবে পরিপূর্ণ করার লক্ষে যৌথ প্রচেষ্টা জোরদার করার মাধ্যমে বহুপাক্ষিক বাণিজ্যকে আরও শক্তিশালী করবে;এবং

১৯) উভয় দেশের বাণিজ্য উদারীকরণ ও নিজেদের মধ্যকার বিনিয়োগ বৃদ্ধির জন্য দ্বি-পাক্ষিক প্রক্রিয়া প্রতিষ্ঠা উভয় দেশের জন্য লাভজনক- এই বিষয়টিকে বিবেচনায় রাখে।

এ লক্ষ্যে উভয় পক্ষ নিম্নোক্ত বিষয়ে একমত পোষণ করছেঃ

আর্টিকেল এক: চুক্তিকারী পক্ষদ্বয় এই চুক্তির আওতায় নিজ নিজ দেশের বিনিয়োগ পরিস্থিতি উন্নয়নের মাধ্যমে পণ্য ও সেবা খাত সম্প্রসারিত করবে। তারা নিজেদের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ও চাহিদা মোতাবেক সুদূরপ্রসারী উন্নয়নের লক্ষ্যে পণ্য ও সেবা খাত অধিকতর নিরাপদ ও দ্বি-পাক্ষীয় বাণিজ্য সহজতর করার উদ্দেশ্যে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।

আর্টিকেল দুই: চুক্তিকারী পক্ষদ্বয় বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সংক্রান্ত একটি ‘কাউন্সিল’ গঠন করবে। কাউন্সিলে দুই দেশেরই প্রতিনিধিত্ব থাকবে। বাংলাদেশ পক্ষের সভাপতি থাকবেন বাংলাদেশ সরকারের বাণিজ্যমন্ত্রী এবং যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধিত্বকারী হবে United States Trade Representative (USTR)। দুই পক্ষই তাদের যথাযথ পরিস্থিতি ও প্রয়োজনানুযায়ী সরকারের অন্যান্য অঙ্গ-সংগঠনগুলো থেকে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা গ্রহণ করতে পারবে। কাউন্সিল নিজ কাজের সুবিধার্থে ঐকমত্য সহকারে অথবা আলাদাভাবে Joint Working Group প্রতিষ্ঠা করতে পারবে।

আর্টিকেল তিন: কাউন্সিলের উদ্দেশ্যাবলী হবে নিম্নরূপঃ

১) বাণিজ্য ও বিনিয়োগ পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ, বাণিজ্য সম্প্রসারণের ক্ষেত্র সনাক্তকরণ এবং যথাযথ ফোরামে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত গ্রহণ।

২) চুক্তির আওতার বাইরে বিশেষ বাণিজ্য কিংবা বিনিয়োগ ক্ষেত্রে পক্ষদ্বয়কে চুক্তির নিয়মাবলী অনুযায়ী সিদ্ধান্ত গ্রহণে সাহায্য করা।

৩) দ্বি-পাক্ষীয় বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সম্প্রসারণে বাধাসমূহ চিহ্নিতকরণ ও অপসারণ

৪) কাউন্সিলের সাথে যুক্ত বিষয়ে চুক্তিকারী পক্ষদ্বয়কে যথাযথ ক্ষেত্রে প্রাইভেট সেক্টর থেকে প্রয়োজনীয় উপদেশ গ্রহণে সাহায্য করা।

আর্টিকেল চার: দ্বি-পাক্ষীয় এই চুক্তির আওতার বাইরে কোন পরিস্থিতির উদ্ভব হলে কাউন্সিল পক্ষদ্বয়ের যে কোন একটির অনুরোধে সুবিধাজনক সময়ে ও স্থানে আলোচনায় বসতে পারে। কোন অবস্থাতেই কোন পক্ষ এককভাবে এমন কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারবে না যা দ্বি-পাক্ষীয় বাণিজ্য ও বিনিয়োগে বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে।

আর্টিকেল পাঁচ: এই চুক্তিটি কোন পক্ষের প্রচলিত অভ্যন্তরীণ আইন এবং কোন পক্ষের স্বাক্ষরিত অন্যকোন চুক্তির ফলে প্রাপ্য অধিকার ও দায়বদ্ধতাকে ব্যাহত করবে না।

আর্টিকেল ছয়: চুক্তি স্বাক্ষরের দিন থেকেই এটা দুই দেশে কার্যকর বলে গণ্য করা হবে।

আর্টিকেল সাত: এই চুক্তি দ্বি-পাক্ষীয় সম্মতিতে বাতিল না হওয়া পর্যন্ত কিংবা এক পক্ষ দ্বারা অপর পক্ষকে ছয় মাসের পূর্ব নির্ধারিত নোটিশ ব্যতিরেকে,যথাশক্তিতে বলবৎ থাকবে।

টিকফা কি স্রেফ একটা বাণিজ্য চুক্তি?

টিফা চুক্তির প্রস্তাবনা কিংবা ধারায় ব্যাবসা-বাণিজ্য, বিনিয়োগ ইত্যাদি কথা থাকলেও চুক্তির ব্যাবহার কিন্তু স্রেফ বাণিজ্যিক নয়। উল্ল্যেখিত উইকিলিকস প্রকাশিত বার্তা থেকে দেখা যায় মার্কিন রাষ্ট্রদূত যুক্তরাষ্ট্রের জন্য বাংলাদেশের সাথে টিফা স্বাক্ষরের গুরুত্ব বোঝাতে গিয়ে বলেছেন:

“I would like to stress our compelling political, economic, and potentially commercial reasons for securing a TIFA with Bangladesh….We have important strategic reasons for helping Bangladesh succeed, politically and economically, and approving the Bangladesh TIFA would be a significant step in that direction.” (সূত্র: ৫)

কাজেই দেখা যাচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র শুধু বাণিজ্যিক বা অর্থনৈতিক স্বার্থই নয়,সেই সাথে রাজনৈতিক ও কৌশলগত কারণেও বাংলাদেশের সাথে টিফা স্বাক্ষরকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করে। বাস্তবে বহুপাক্ষিক ফোরামগুলোতে স্বল্পোন্নত দেশগুলো জোট বাধতে থাকায় মার্কিনযুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে বহুপাক্ষিক ফোরামগুলোতে তার স্বার্থ হাসিল করা ক্রমশ কঠিন হয়েপড়েছে। ফলে যুক্তরাষ্ট্রের এখনকার লক্ষ হলো বহুপাক্ষিক ফোরামে তার স্বার্থ বিরোধী তৎপরতা বন্ধ ওদুর্বল দেশগুলোর সাথে আলাদা আলাদা দ্বিপাক্ষিক চুক্তির মাধ্যমে একদিকে অধিকতর বাণিজ্য সুবিধা আদায় অন্যদিকে ভূ-রাজনৈতিক,সামরিক ও কৌশলগত ক্ষেত্রে প্রাধান্যবিস্তার। এই প্রেক্ষিতে একটা বিষয় লক্ষণীয়। এ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র যতগুলো দেশের সাথে টিফা চুক্তি স্বাক্ষর করেছে তার কোনটির সাথেই কিন্তু তার সম্পর্ক স্রেফ বাণিজ্য কেন্দ্রিক নয়। সবচেয়ে বাণিজ্যিক লেনদেন যেসব দেশের সাথে যেমন: কানাডা, চীন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ভারত ইত্যাদির সাথে কিন্তু আমেরিকার কোন টিফা নেই। টিফা আছে দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে শ্রীলংকা ও পাকিস্তানের সাথে,দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও প্রশান্তমহাসাগরীয় দেশগুলোর মধ্যে ব্রুনেই, কম্বোডিয়া, ইন্দোনেশিয়া,মালয়েশিয়া, নিউজিল্যান্ড, ফিলিপিনস, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনামের সাথে, ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর মধ্যে আলজেরিয়া, বাহরাইন, মিশর, জর্জিয়া,আইসল্যান্ড, ইরাক, কুয়েত, লেবানন, ওমান, কাতার, সৌদিআরব, টিউনিশিয়া,সংযুক্ত আরব আমিরাত, ইয়েমেনের সাথে, আমেরিকা মহাদেশের মধ্যে ক্যারীবিয়ান দেশগুলো ও উরুগুয়ের সাথে এবং আফ্রিকা অঞ্চলের মধ্যে অ্যাঙ্গোলা, ঘানা, লাইবেরিয়া, মোজাম্বিক, নাইজেরিয়া, রুয়ান্ডা, দক্ষিণ আফ্রিকা ইত্যাদি দেশের সাথে। দেশগুলোর তালিকা একটু খেয়াল করলেই বোঝা কঠিন নয় টিফা নামের এই বাণিজ্য চুক্তিটি আসলে যতটা না বাণিজ্য বিষয়ক তার চেয়ে অনেক বেশি বিশ্বের দেশে দেশে আমেরিকার রাজনৈতিক-সামরিক স্ট্রাটেজি বা কৌশলগত অস্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।

যুক্তরাষ্ট্র এই চুক্তিগুলোকে ব্যবহার করে তার দুর্বল পার্টনাদের কাছ থেকে বিবিধ রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামরিক সুবিধা হাসিল করে নেয়। ইরাক আগ্রাসন কিংবা ”সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ” ইত্যাদি ক্ষেত্রে অস্ট্রেলিয়া, থাইল্যান্ড,পাকিস্তান কিংবা মধ্য প্রাচ্যের দেশগুলোকে ব্যাবহার করার কাজে দ্বি-পাক্ষিক বাণিজ্য চুক্তিগুলোকে কাজে লাগানো হয়েছে। এ প্রসঙ্গে ২০০৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে পাকিস্তান-যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যকার বাণিজ্য আলোচনায় যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য প্রতিনিধি রবার্ট জোয়েলিক এর বক্তব্যটি স্মরণীয়:

“পাকিস্তান ও যুক্তরাষ্ট্র বিশ্ব সন্ত্রাস দমনের বিরুদ্ধে পরস্পের সহযোগী। এটা পাকিস্তানের অর্থনীতিকে শক্তিশালী করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে যেন উভয় অর্থনীতির রপ্তানিকারক ও বিনিয়োগকারীরা নতুন নতুন সম্ভাবনা সৃষ্টি করতে পারে এবং সন্ত্রাস দমনের জন্য উপযুক্ত অর্থনৈতিক বাস্তবতা তৈরী করতে সহায়তা করতে পারে।” একই ভাবে জোয়েলিক ২০০৪ এর মার্চ মাসে সংযুক্ত আরব আমিরাতের সাথে টিফা চুক্তি স্বাক্ষরের সময়ও বলেন, “এ চুক্তি অর্থনৈতিক স্তরে উভয় দেশের সম্পর্ককে শক্তিশালী করবে যা সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে আমাদের যুদ্ধকে আরও শক্তিশালী করতে সম্পূরক ভূমিকা পালন করবে” কাজেই টিফা চুক্তিকে স্রেফ আর দশটা সাধারণ বাণিজ্যচুক্তি হিসেবে দেখলে চলবে না। (কল্লোল মোস্তফার বিশ্লেষণ)

সেবা খাতে টিকফা

চুক্তির প্রস্তাবনা ৮ এ প্রবৃদ্ধি, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, বাণিজ্য বিকাশ, প্রযুক্তি উন্নয়ন এবং অর্থনৈতিক উন্নয়ন তরানি¡ত করা ইত্যাদির জন্য সরাসরি বিদেশী বিনিয়োগের ধনাত্মক ভূমিকার কথা বলা হয়েছে। তো কোন খাতে ঘটবে এ বিনিয়োগ সে বিষয়টি পরিস্কার হয়ে যায় প্রস্তাবনা ১৩ তে এসে যেখানে সেবা খাতের বাণিজ্য বৃদ্ধির উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। অর্থাৎ, টিফার মাধ্যমে বাংলাদেশের সেবা খাত মার্কিন বেসরকারী পুজির বিনিয়োগ ও বাণিজ্যের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র যে বাংলাদেশের জ্বালানীসহ বিভিন্ন সেবা খাতে বিনিয়োগ করতেই আগ্রহী সে বিষয়টি পরিস্কার হয়ে যায় যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য প্রতিনিধির কথা থেকেই:

“গত কয়েক বছরে যুক্তরাষ্ট্রের অনেক জ্বালানি কোম্পানি শত শত মিলিয়ন ডলার বাংলাদেশে বিনিয়োগ করেছে। বাংলাদেশে এখনও বিপুল পরিমাণ বিদ্যুৎ ও জ্বালানী দরকার। যুক্তরাষ্ট্র এসব খাতে বিনিয়োগ করতে আগ্রহী।”

আর যুক্তরাষ্ট্রের বহুজাতিক কোম্পানিগুলোকে এসব খাতে বিনিয়োগ করার সুযোগ করে দেয়ার জন্যই জ্বালানী খাতে বাপেক্স বা পেট্রোবাংলাকে যেমন দুর্বল করে রাখা হয়েছে ক্রমশ শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পরিবহন, বন্দর, ডাক ও যোগাযোগ খাতেরও একই অবস্থা করা হবে। এবং একসময় জ্বালানী খাতের মত অন্যান্য খাতের ক্ষেত্রেও বলা হবে বাংলাদেশের দক্ষতা নাই, প্রযুক্তি নাই, অর্থ নাই,সুতরাং মার্কিন বহুজাতিকের বিনিয়োগ ছাড়া আর উপায় কি! অথচ এই সব সেবা খাতে আমাদের মোট শ্রম শক্তির ২১.৪০ ভাগ নিয়োজিত এবং মোট দেশজ উৎপাদনের ৪১.৩৭ ভাগ আসে এ খাত থেকে। টিফা চুক্তি হলে এসবই চলে যাবে মার্কিন পুজি-বিনিয়োগ কারীদের হাতে, বাণিজ্যিকীকরণের ফলে আরো বেড়ে যাবে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পরিবহন ইত্যাদি সেবার দাম এবং বহুজাতিকের মুনাফার স্বার্থে কাজ হারাবে বিপুল সংখ্যক শ্রমিক।

বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পত্তি অধিকার

পশ্চিমা সমাজ ব্যবস্থায় বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পত্তি অধিকার (Intellectual property right) একটি বহুল আলোচিত বিষয়। WIPO (World Intellectual Property Organization) এর রিপোর্ট অনুযায়ী ২০০৫ সাল থেকে ২০০৯ সালের মধ্যে সারা বিশ্বে গড়ে ৩০ লক্ষের উপর আই পি আবেদন জমা পড়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে মার্কিন কংগ্রেসে উত্থাপিত (Stop online piracy act - SOPA) এবং (Protect intellectual property act - PIPA) বিলের প্রেক্ষিতে বিষয়টি আবারো আলোচনায় উঠে আসে। অনলাইনে কপিরাইটকৃত সম্পত্তির (বই, গান, চলচ্চিত্র ইত্যাদি) আদান প্রদান রোধের উদ্দেশ্যে বিল দুটি উত্থাপিত হয়। এই আইনের আওতায় সরকার যুক্তরাষ্ট্রের বাইরের যেকোন অভিযুক্ত ওয়েব সাইটের বিরুদ্ধে যেসকল শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে পারবে সেগুলো হচ্ছে: অনলাইনে অর্থ লেনদেনের সেবাদানকারী অথবা বিজ্ঞাপন দানকারী সকল প্রতিষ্ঠানের সাথে সাইটির সম্পর্ক চ্ছিন্ন করা, সকল ব্লগসাইট, অনলাইন ফোরাম এবং সার্চ ইঞ্জিন গুলো থেকে সাইটটির সকল লিংক মুছে ফেলতে বাধ্য করা এবং ইন্টারনেট সেবা দানকারী প্রতিষ্ঠান (ISP) গুলোর মাধ্যমে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের সাইটটিতে প্রবেশ বন্ধ করা। বিল দুটি উত্থাপনের সাথে সাথে ব্যাপকভাবে আলোচিত হয়। বিরোধিরা একে বাকস্বাধীনতা এবং সৃষ্টিশীলতার উপর আঘাত বলে প্রত্যাখ্যান করেন। Wikipedia এর মতো প্রায় ৭০০০ সাইট এই আইনের প্রতিবাদে ১৮ জানুয়ারী, ২০১২ তারিখে তাদের সাইটগুলো বন্ধ রাখে অথবা এর প্রতিবাদে বিভিন্ন ছবি অথবা লিঙ্ক প্রকাশ করে।

বাজার উন্মুক্তকরণ ও কথিত জিএসপি সুবিধা

একথা এখন সুবিদিত যে টিফা হলে মুক্তবাণিজ্য চুক্তি বা ফ্রি ট্রেড এগ্রিমেন্টের পূর্ব ধাপ। আমেরিকা যত দেশের সাথে টিফা স্বাক্ষর করেছে পরবর্তিতে তাদের তিন ভাগের এক ভাগের সাথে ইতোমধ্যে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষরও করেছে। বাংলাদেশের বেলায়ও যে তা হবে তার ইঙ্গিত দিয়েছেন এর আগে ২০০৯ সালে বাংলাদেশ সফরে আসা আমেরিকার বাণিজ্য প্রতিনিধি ডিলানি। তিনি বলেছেন: “আমাদের দুই জাতির মধ্যে ভবিষ্যত বাণিজ্য চুক্তির প্রাথমিক ধাপ হতে পারে টিফা কিন্তু মূলত টিফা হলো এমন একটি চুক্তি যেখানে উভয় পক্ষ নিয়মিত আলোচনা করা এবং অর্থনৈতিক সম্পর্ক বাড়ানোর ব্যাপারে উদ্যোগ নেয়ার ব্যাপারে একমত হয়।”

আর এই অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিস্তার যে কোন দিকে যাবে তার ইঙ্গিত পরিস্কারভাবে টিফা চুক্তির ১৪ নং প্রস্তাবনায় উল্লিখিত অশুল্ক বাধা দূর করণ ও প্রস্তাবণা ১৯ এ উল্লিখিত বাণিজ্য উদারীকরণের প্রয়োজনীয়তার গুরুত্ব আরোপ করা থেকেই স্পষ্ট হয়ে যায়। এর আগের বিশ্ব বানিজ্য সংস্থার চুক্তি অনুসারে আমেরিকার মত উন্নত দেশগুলোতে বাংলাদেশের মতো সল্পোন্নুত দেশ গুলোর মোট ৯৭% পণ্য শুল্কমুক্ত প্রবেশের সুযোগ দেয়ার কথা। অর্থাৎ কোন স্বল্পোন্নত দেশ ১০০টি পণ্য রপ্তানি করলে ৯৭ টি বিনা শুল্কে রপ্তানি করতে পারবে এবং বাকি ৩ টি পণ্যের ক্ষেত্রে তাকে শুল্ক দিয়ে আমেরিকার বাজারে ঢুকতে হবে। আমেরিকা বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি পণ্য যেমন: গার্মেন্টস পণ্য, চামড়াজাত পণ্য ও ফার্মাসিউটিক্যালস পণ্যকে এই ৩% এর মধ্যে ফেলে দেয়ায় বাংলাদেশ কার্যত এলডিসি বা স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে প্রাপ্য শুল্কমুক্ত বাজার সুবিধার কিছুই পাচ্ছে না। উল্টো বিশ্বের বিভিন্ন দেশে গার্মেন্টস পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে গড় শুল্কহার ১২% হলেও বাংলাদেশকে আমেরিকার বাজারে ঢুকতে হলে ১৬% শুল্ক দিয়ে ঢুকতে হয়।

প্রশ্ন হলো টিফা হলে কি বাংলাদেশের গার্মেন্টস বা অন্যান্য পণ্য এই ৩% এর বেড়াজাল থেকে বেরিয়ে শুল্কমুক্ত সুবিধা পাবে? টিফা চুক্তিতে এ বিষয়ে কোন কথাই নেই। চুক্তিতে অ-শুল্ক বাধা বা নন ট্যারিফ ব্যারিয়ার উভয় দেশেরই তুলে নেয়ার কথা থাকলেও ট্যারিফ বা শুল্ক মুক্ত বাজার সুবিধার কিছুই নেই। টিফার আওতায় বাংলাদেশ যে এ ধরণের কোন কিছুই পাবেনা তা ডিলানির নসিহত থেকেও স্পষ্ট, তিনি মনে করেন:

“শুল্কমুক্ত রপ্তানি সুবিধার চেয়ে বরং শুল্ক হ্রাস এবং অগ্রাধিকার সুবিধার জন্য বাংলাদেশকে নিরবচ্ছিন্ন সংলাপ চালিয়ে যাওয়া উচিত - আর তৃতীয় বিকল্প হতে পারে দ্বিপক্ষীয় মুক্তবাণিজ্য চুক্তি(এফটিএ)।”

অর্থাৎ, ভয়ংকর ফ্রি ট্রেড এগ্রিমেন্ট বা মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি ছাড়া বাংলাদেশের পক্ষে আমেরিকার বাজারে শুল্কমুক্ত প্রবেশের কোন সুযোগ যে নেই সেটা স্পষ্ট। আর জিএসপি সুবিধা রক্ষার বিনিময়ে টিফা/টিকফা চুক্তি জায়েজ করার জন্য যেসব কথা বলা হচ্ছেতা ভাওতাবাজি ছাড়া আর কিছুই নয় কারণ বাংলাদেশ বর্তমানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে জিএসপি সুবিধা পায়ই না! গার্মেন্টস মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ’র সাবেক সভাপতি সফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন এর বক্তব্য থেকেই দেখা যায়:

“যুক্তরাষ্ট্রে রফতানির ক্ষেত্রে সেই অর্থে বাংলাদেশ জিএসপি বা শুল্কমুক্ত সুবিধা পায় না। বরং প্রায় ৭৫ কোটি ডলার শুল্ক আমাদের কাছ থেকে পায় যুক্তরাষ্ট্র। দেশটিতে বাংলাদেশের মোট রফতানি প্রায় ৪৮০ কোটি ডলারের। এর মধ্যে মাত্র দশমিক ৫ শতাংশ পণ্য জিএসপি সুবিধা পায়। কাজেই দেশটি জিএসপি সুবিধা তুলে নিলেও কোনো অসুবিধা হবে না।কারণ আমাদের পোশাক খাত অনেক শক্তিশালী ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে আছে। চাইলেই কেউ ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিতে পারবে না।”

স্রেফ শুল্কমুক্ত পণ্য রফতানির সুবিধার বিনিময়ে টিফার মতো জাতীয় স্বার্থ বিরোধী চুক্তি স্বাক্ষর যৌক্তিক হতো কি না, সেই প্রশ্নে না গিয়েও বলা দরকার,যে জিএসপি সুবিধা বাংলাদেশ পায়ই না, সে জিএসপি সুবিধা কিংবা সেই জিএসপি সুবিধাজাত কথিত ভাবমূর্তির রক্ষার নামে টিফা চুক্তি স্বাক্ষর কোন ভাবেই জায়েজ হতে পারে না।

টিফাতে অ-শুল্ক বাধা তুলে দেয়ার যে কথা আছে তাতে বাংলাদেশের কি কোন উপকার হবে? অশুল্ক বাধা হচ্ছে বাংলাদেশের মতো স্বল্পোন্নত দেশগুলোর জন্য দেশীয় শিল্প কিংবা কৃষিজ পণ্যকে বিদেশী বহুজাতিকের পণ্যের হাত থেকে রক্ষা করার সর্বশেষ হাতিয়ার। বাংলাদেশ যদি মনে করে আমেরিকার রপ্তানিকরা কোন পণ্য বাংলাদেশের জনস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর কিংবা দেশের কোন উদীয়মান শিল্পের বা কৃষিজাত পণ্যের জন্য হুমকীস্বরূপ সেক্ষেত্রে এখন চাইলে সেই পণ্য দেশে আমদানী নিষিদ্ধ করতে পারে কিংবা আরো বিভিন্ন ধরণের শর্তের বেড়াজালে ফেলে সে পণ্য আমদানী নিরুৎসাহিত করতে পারে। কিন্তু টিফার মাধ্যমে যদি নাকে খত দিয়ে ফেলে যে আর অ-শুল্ক বাধা আরোপ করবে না তাহলে বাংলাদেশের অবস্থা টিফা চুক্তি করা শ্রীলংকা কিংবা থাইল্যান্ডের মতোই হবে- থাইল্যান্ডকে চাপ দেয়া হচ্ছে আমেরিকা থেকে জেনিটিক্যালি মডিফাইড বা জিএম বীজ আমদানীর উপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নিতে আর শ্রীলংকাকে চাপ দেয়া হচ্ছে জিএম খাদ্য আমদানীর উপর থাকা নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নেয়ার জন্য।

টিকফা বিরোধী আন্দোলন

টিকফা চুক্তির বিরোধিতা করে ভিবিন্ন সামাজিক এবং রাজনৈতিক দলের আন্দোলনের কিছু ছবি দেখুন।









পরিশেষে...বলছি টিকফা যে আমাদের জন্য বিষাক্ত ট্যাবলেট ছাড়া আর কিছু না তা আর বলার অবকাশ রাখে না।

তথ্যসূত্রঃ উইকিপিডিয়া, ব্লগ, পত্রিকা,সচেতন লেখকশ্রেণী,ফেইসবুক।

বিষয়: রাজনীতি

২৬৮২ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File