সোশ্যাল মিডিয়া নিয়ন্ত্রণে প্রযুক্তিঃ “বিদ্বেষ প্রতিরোধ” কে ঢাল হিসেবে ব্যাবহার করে বিরুদ্ধ মত প্রকাশ ঠেকানো কাম্য নয়

লিখেছেন লিখেছেন চক্রবাক ২৪ মে, ২০১৩, ১১:৩০:২১ সকাল

ইন্টারনেট গেটওয়েতে নজরদারির প্রযুক্তি দিয়ে বিটিআরসি সোশ্যাল মিডিয়াকেও নিয়ন্ত্রণে আনার পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে! এক্ষেত্রে “বিদ্বেষ প্রতিরোধ” তত্ত্ব হাজির করেছে তারা! বিটিআরসির বিজ্ঞাপনে বলা হয়, আগ্রহী প্রতিষ্ঠানকে এমন ইন্টারনেট নিরাপত্তা ব্যবস্থা তৈরি করে দিতে হবে যাতে মূল সাইট চালু রেখেই সহজে আপত্তিকর বিষয়গুলো ইন্টারনেট থেকে সরিয়ে ফেলা যায়"।

দরপত্র আহবান ও আগ্রহপত্র জমার কাজ শেষ, এখন চলছে যাছাই বাছাইঃ

সামাজিক যোগাযোগের ওয়েবসাইটগুলোসহ ইন্টারনেট ব্যবস্থায় নজরদারিতে (ফিল্টারিং) ইন্টারন্যাশনাল ইন্টারনেট গেটওয়েগুলোতে(আইআইজি) বিশেষ প্রযুক্তি বসানোর জন্য বেশ কয়েকটি প্রস্তাব পেয়েছে সরকার।প্রতিটি আইআইজিতে এ প্রযুক্তি বসানোর পর ইন্টারনেটের নজরদারি বা নিয়ন্ত্রণের মূল ক্ষমতা থাকবে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসির হাতে। এ প্রক্রিয়ার অংশ হিসাবে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) গত ৮ এপ্রিল আন্তজার্তিক প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে ‘ইন্টারনেট সেফটি সলিউশন’ চেয়ে ওয়েবসাইটে বিজ্ঞাপন দেয়। এই আগ্রহপত্র জমা দেয়ার শেষ দিন ছিল গত ২০ মে।বিটিআরসির একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, কয়েকটি আন্তজার্তিক ইন্টারনেট সলিউশনস প্রোভাইডার কোম্পানি গত রবিবার বিটিআরসিতে আগ্রহপত্র(এক্সপ্রেশন অব ইন্টারেস্ট/)জমা দিয়েছে। এগুলো যাচাই বাছাই করে পুরো প্রক্রিয়া শুরু করা হবে। [হদিসঃ http://bangla.bdnews24.com/bangladesh/article628230.bdnews]

“বিদ্বেষ প্রতিরোধ” তত্ত্বকে ঢাল হিসেবে ব্যাবহার করে বিরুদ্ধ মত দলনের চেষ্টা হতে পারেঃ

সরকারের তরফ থেকে বলা হচ্ছে এই প্রযুক্তিগত নিয়ন্ত্রনের উদ্দেশ্য হচ্ছে বিদ্বেষ প্রতিরোধ!

“রাষ্ট্রীয়, সমাজ, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় বিদ্বেষ ছড়ায়- ওয়েবসাইটগুলো থেকে এমন বিষয় সনাক্ত করে তা বন্ধ করে দেয়া হবে এই প্রযুক্তির মাধ্যমে।”

বিদ্বেষ ছড়ানো একটা সাইবার ক্রাইম, তার প্রতিরোধ দরকার, কিন্তু “বিদ্বেষ প্রতিরোধ” তত্ত্বকে ঢাল হিসেবে ব্যাবহার করে নানান ইস্যুতে নাগরিকদের প্রতিবাদী ভার্চুয়াল ভূমিকা প্রতিরোধ করার আশঙ্কা আছে, ব্যাপকভাবেই আছে! এখানে রাষ্ট্রযন্ত্রের নিপীড়নের বিরুদ্ধে দেয়া স্ট্যাটাস বা নোটকে “রাষ্ট্রীয় বিদ্বেষ”, সামাজিক নিপীড়নের বিরুদ্ধে দেয়া স্ট্যাটাসকে “সমাজ বিদ্বেষ”, জাতীয় স্বার্থ বিরোধী রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে দেয়া পোস্টকে “রাজনৈতিক বিদ্বেষ”, ধর্মতাত্ত্বিক পর্যালোচনাকে “ধর্ম বিদ্বেষ” বলে চালিয়ে দিয়ে সেসব পোস্ট মুছে ফেলার চেষ্টা হতে পারে! যদি তাই হয় তাহলে এই সমাজে আমরা যে প্লুরালিজমের কথা বলি, আমরা যে গণতান্ত্রিক মত প্রকাশের অধিকারের কথা বলি তা মারাত্মকভাবে বাধাগ্রস্ত হবে! দেখা যাবে কেউ একজন রামপাল চুক্তির সমালোচনা করে পোস্ট দিল তাকে “রাষ্ট্রীয় বিদ্বেষ” বলে মুছে ফেলা হবে, কেউ একজন TICFA চুক্তির মত জাতীয় স্বার্থ বিরোধী বিষয়ে পোস্ট দিলে তাকে “রাজনৈতিক বিদ্বেষ” বলে মুছে ফেলা হবে...............এসব আমাদের আশংকার কথা, আমরা চাই এই আশংকা যেন ভুল প্রমাণিত হয়! তবে বাংলাদেশের সমাজ আর রাষ্ট্রে বিরুদ্ধ মত অবদমনের যে সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয় সংস্কৃতি তৈরি হয়েছে তাতে এ ধরনের আশংকাই বাস্তবে সত্য হয়ে থাকে!

ফেসবুকে কোরআন শরিফ অবমাননাকর ছবি প্রদর্শন করে ট্যাগ করাকে কেন্দ্র করে রামুর ১২টি প্রাচীন বৌদ্ধবিহার ও ৩০টি বসতবাড়িতে হামলা হয়। আর তদন্ত কমিটি এই ঘটনার প্রেক্ষিতেই ফেইসবুক সহ সোশ্যাল মিডিয়ায় নিয়ন্ত্রনের সুপারিশ করেন, এই সুপারিশের প্রেক্ষিতেই নাকি প্রযুক্তিগত নিয়ন্ত্রনের ধারণা এসেছে, তো আমরা নিজেরাও স্বীকার করছি সোশ্যাল মিডিয়াতে বিদ্বেষ মূলক পোস্ট বা ছবি শেয়ার করা চরম অন্যায় এবং তার বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেয়া উচিত। কিন্তু এর জন্য প্রচলিত তথ্য আইনেই তার বিচার সম্ভব। প্রয়োজনে তথ্য ও প্রযুক্তিগত আইনকে আরও কঠোর করা যেতে পারে। কিন্তু তার উপর নির্ভর না করে প্রযুক্তিগত নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা গণতান্ত্রিক অধিকারকে ভূলুণ্ঠিত করতে পারে।

“রাষ্ট্রীয়, সমাজ, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় বিদ্বেষ" প্রতিরোধের অজুহাতে রাষ্ট্র, সমাজ, রাজনীতি ও ধর্ম নিয়ে নাগরিক সমাজের নানান শ্রেণীর নানান মত প্রকাশকে বাধাগ্রস্ত করার চেষ্টা বাংলাদেশকে সরাসরি একটা নিয়ন্ত্রনবাদি রাষ্ট্রে পরিনত করবে যা আমাদের কারও জন্যই কল্যাণকর হবে না!

তাই সোশ্যাল মিডিয়ায় ফিল্টার বসানোর সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করা দরকার! বিদ্বেষমূলক পোস্ট দাতাদের তথ্য আইনে শাস্তি দিলেই এসব পোস্ট দেয়া অনেকটাই নিয়ন্ত্রনে চলে আসবে। কিন্তু তার জন্য পুরা সোশ্যাল মিডিয়ায় একটা অস্থির পরিবেশ সৃষ্টি কাম্য নয়!

(জোবায়ের আল মাহমুদ)

বিষয়: রাজনীতি

১২৫২ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File