আইসক্রিম!
লিখেছেন লিখেছেন নিশান শাহীন ০৮ অক্টোবর, ২০১৩, ১১:১৪:৪৮ রাত
বাচ্চাটি কাঁদছে। কারণ, কিছুণ আগেই বাড়ির মেঠোপথ ধরে চলে গেছে আইসক্রিমওয়ালা। বাড়িতে মা-বাবা কেউ না থাকায় মেয়েটির আইসক্রিম খাওয়া আর হয়নি। এ জন্যই ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কান্না। আইসক্রিম ছোট-বড় সবার কাছে সমান প্রিয়। বিশেষ করে তরুণ-তরুণীরা তো সুযোগ পেলেই এর স্বাদ গ্রহণ করে। তবে মজার এই খাবারটির ইতিহাস মোটেও নতুন নয়। বহুকাল আগে থেকেই এটি খাবার হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। আজ থেকে প্রায় ৪ হাজার বছর আগে মেসোপটেমিয়া সভ্যতা গড়ে উঠলে মানুষ জঙ্গল থেকে সংগ্রহ করা ফলমূল টাটকা রাখতে বরফ ব্যবহার করত। তারা ইউফ্রেটিস নদীর জমাট বাঁধা পানি সংগ্রহ করে রাখত এবং পরে ব্যবহার করত। খ্রিস্টীয় প্রথম শতাব্দীতে রোমান সম্রাট নিরো ফলাহারের সময় আইসক্রিম ব্যবহার করতেন। নানা ধরনের ফলমূল টাটকা রাখতে নিরো দাসদের দিয়ে দূরের তুষার পাহাড় থেকে বরফ সংগ্রহ করে আনতেন। খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতকে কেবল মধু ও ফলমূলকে ঠাণ্ডা রাখার জন্যই গ্রিসের এথেন্স শহরে গড়ে উঠেছিল বিশাল বরফের মার্কেট। সে সময় পারস্যবাসী বরফ সংগ্রহ করে রাখত গরমকালে পান করার জন্য। খ্রিস্টীয় পনেরো শতকেও বরফের ব্যবহার ছিল। মোগল সম্রাটগণ হিন্দুকুশ থেকে দিল্লিতে যাতায়াতের সময় ঘোড়ার পিঠে বরফের বাক্স নিতেন, পথে ক্ষুধা পেলে যাতে ফলের শরবতের সঙ্গে তা মিশিয়ে খাওয়া যায়। শরবতের সঙ্গে বরফ মিশিয়ে খাওয়ার প্রক্রিয়াটি মূলত শুরু হয় তখন থেকেই।
তবে ঐতিহাসিকদের মতে, আইসক্রিমের জন্ম চীনে। আজ থেকে এক হাজার বছর আগে ইতালীয় পর্যটক মার্কো পোলো এটি তৈরির কৌশল শিখে নেন চীনাদের কাছ থেকে। সে সময় কুবলাই খানের লোকরা ঠেলাগাড়ি করে জমাট দুধের খাবার বিক্রি করত। মার্কো পোলোর খাবারটি খুব পছন্দ ছিল। পরে এই খাবারটিরই নাম হয় আইসক্রিম। ১৫৩৩ সালে এটি ইতালি থেকে ফ্রান্সে আসে। সেখান থেকে চলে যায় ইংল্যান্ডে। ঐতিহাসিকদের মতে, সফলভাবে আইসক্রিম তৈরি শুরু হয় খ্রিস্টীয় ষোড়শ শতাব্দীতে। ইংল্যান্ডে তখন এটি বেশ জনপ্রিয় ছিল। অষ্টাদশ শতকের দিকে ইংল্যান্ডের সম্রাট প্রথম চার্লসের রাজকীয় খাবার টেবিলেও ফরাসি ও ইতালীয় বাবুর্চিরা পরিবেশ করত আইসক্রিম। খাবারটি ক্রমে আরও জনপ্রিয় হয়ে উঠলে এর উন্নতি সাধনেও লেগে পড়েন কেউ কেউ। তারা আইসক্রিম বানাতে ব্যবহার করেন নানা উপাদান। ফ্রান্সে এটি তৈরি করা হতো বড় পাত্রের মধ্যে বরফ রেখে তাতে লবণ ছিটিয়ে। কেউ কেউ আবার জমাট বাঁধা বরফ গলানোর জন্য আগুনের সাহায্য নিত। ঠাণ্ডা হয়ে এলে লবণপানি ঢেলে দিত। খেতে নাকি মজাই লাগত। ইউরোপ ও আমেরিকায় ক্রমে এটি জনপ্রিয় হয়ে উঠলে গড়ে ওঠে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কলকারখানা। উৎপাদনের পর তা নানা দেশে বাজারজাত করা হতো।
১৮৫১ সালে বাল্টিমোরের জ্যাকব ফিউসেল আইসক্রিম তৈরির জন্য বরফ কল স্থাপন করেন। ব্যবসা বেশ জমে ওঠে। সে সময় দামি পণ্যগুলোর মধ্যে আইসক্রিম ছিল খুব জনপ্রিয়। কিন্তু প্রকৃতি থেকে বরফের চাঙ সংগ্রহ করে আইসক্রিম তৈরি করা মোটেও পছন্দ ছিল না জার্মান প্রকৌশলী কার্ল ভন লিন্ডের। ১৮৭০ সালে তিনিই প্রথম এটিকে আধুনিক রূপ দেন। ১৯২৬ সালে যে অত্যাধুনিক মেশিনটির জন্ম হয়, সেটি ছিল লিন্ডেরই চিন্তার ফসল। পরে বরফ কলে দেওয়া হয় বৈদ্যুতিক সংযোগ। এখন আইসক্রিম তৈরি করা কারও যেন কোনো বিষয়ই না। বিশুদ্ধ পানি, চিনি এবং রঙ একসঙ্গে করে ডিপ ফ্রিজে কিছুণ রাখলেই হলো। একটু পরই দেখা যাবে চমৎকার আইসক্রিম। বিভিন্ন উৎসবে এর ব্যবহার অনেক সময় পার্টির মর্যাদাই বাড়িয়ে দেয়।
এখন আইসক্রিম তৈরি করা অনেক সহজ। কিন্তু কয়েকশ' বছর আগে এত সহজ ছিল না। তখন আইসক্রিম তৈরি করতে লাগত বরফের চাঙ। শীতকালে হ্রদ কিংবা পুকুরের পানি জমাট বেঁধে গেলে সম্ভ্রান্ত লোকরা শ্রমিকের মাধ্যমে হ্রদ, পুকুর বা নদী থেকে সেই বরফ সংগ্রহ করে রাখত বিশেষভাবে তৈরি কাঠের বাক্সের ভেতর। প্রেসিডেন্ট জর্জ ওয়াশিংটন এবং থমাস জেফারসনও বহু শ্রমিক নিয়োগ করে বরফ সংগ্রহ করে রাখতেন গরমকালে ব্যবহারের জন্য। আইসক্রিমের ভক্ত সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলছে। বাংলাদেশেও এর চাহিদা ব্যাপক। পথে বের হলেই দেখা যায়, ফাস্টফুড ও কনফেকশনারির দোকানগুলোতে প্রচণ্ড ভিড়! অনেকের হাতে শুধু আইসক্রিম আর আইসক্রিম!
বিষয়: বিবিধ
১৪৩৮ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন